

এই লেখাটা পড়ে অনেকেই হয়তো সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন এবং একপাক্ষিক ভিত্তিহীন কাঁদুনি গাওয়া বলে যথেচ্ছ গালাগালও দিতে পারেন – কারণ এ লেখায় প্রকাশিত বক্তব্যের সমর্থনে দেওয়ার মত তথ্য বা ডেটা লেখকের কাছে নেই। এর অন্যতম কারণ এই যে, এ লেখার সমস্তটাই লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা – যা লেখকের সাথে ঘটেছে অথবা সে হতে দেখেছে এবং সে সময় লেখকের মানসিক অবস্থা বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাকে ‘জনসমক্ষে তুলে ধরবার মত প্রমাণ স্বরূপ তথ্য’ রাখার অবস্থায় রাখেনি। এই মুখবন্ধটুকু দেওয়াটা জরুরি, কারণ আমরা যারা সামান্য হলেও গবেষণা বা রিসার্চ করি, তারা ‘প্রত্যক্ষই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ’-এ বিশ্বাস করি এবং হাত নেড়ে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ বলে চালানোর চেষ্টা করি না। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই অপারগতা লেখকের সদিচ্ছায় নয়। আশা করি সেটুকু মার্জনা করা হবে।
২০১২ সালে আমি দেশের একটি অন্যতম রিসার্চ ইন্সটিট্যুটে গবেষণা করবার সুযোগ পাই পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে। সত্যি বলতে কি, তার আগে রিসার্চ কী, সেখানে ঠিক কী করতে হয় বা সেটা প্রথাগত পড়া-মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার থেকে কতটা আলাদা – সে বিষয়ে আমার সম্যক কোনো ধারণা ছিল না। নিজের সিনিয়র, আত্মীয়, বন্ধুদের থেকে শুনে এবং ফিজিক্সের প্রতি একটা আকর্ষণ থেকে মনে হয়েছিল – এই পথে চললে হয়তো কিছু একটা করতে পারব। সেই আশা নিয়ে আমি উক্ত ইন্সটিটিউটে ঢুকি। তা, প্রথম ছ’মাস কোর্সওয়ার্ক ইত্যাদি করে কেটে যায় এবং সেখানে অসাধারণ কিছু শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ পেয়ে অনেক কিছু শিখি। আমি কোনোকালেই মারাত্মক প্রতিভাবান ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু ভাল শিক্ষক পাওয়ার সুবাদে বিষয়ের প্রতি বেশ একটা আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তখনও আমার ছাত্রদশা কাটেনি এবং বুঝিনি ‘রিসার্চ’ বিষয়টা কী এবং তা ক্লাস করে পরীক্ষা দিয়ে নম্বর পাওয়ার থেকে কী ভয়ানকভাবে আলাদা। আমার সুপারভাইজারের সঙ্গে এর মধ্যে আমার দেখা হয়েছে, তিনি আমাকে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে অবগত করেছেন এবং আমি বুঝতে পেরেছি তাঁর বিষয়টি সিমুলেশন-নির্ভর – অর্থাৎ, সেখানে কাগজ-কলমের থেকে কম্পিউটারের ব্যবহার বেশি। এবার, এই বিষয়টিতে আমার চিরকালই একটা ভয় ছিল, কারণ আমি ‘কোড’ ব্যাপারটা একদমই বুঝতাম না। এই বুঝতে না পারার সিংহভাগ কারণ অবশ্যই আমার নির্বুদ্ধিতা এবং তারই সাথে ভাল একজন পথপ্রদর্শকের অভাব। যাইহোক, আমি ভয় পেলেও মনে মনে ভাবি – লড়ে যাব, যখন পিএইচডি করতেই ঢুকেছি আর গাইড যখন আছেনই, নিশ্চয়ই তিনিও সাহায্য করবেন। মুশকিল হচ্ছে, ‘লড়ে যাব’ ভাবলেই হয় না, কোথা থেকে লড়াইটা শুরু করব – সেটাও ভাবতে হয়। সেই ধরতাইটা একবার কেউ ধরিয়ে দিলে তারপর বাকিটা বুঝে নেওয়া গেলেও যেতে পারে। আমার গাইড আমার ‘কোড’ না লিখতে পারার এই অপরাগতা কয়েকদিনেই বুঝে যান এবং তার পর থেকে শুরু হয় তাঁর ‘বুলি’ করা। তিনি বিভিন্ন সময় তাঁর অফিসে আমাকে ডাকতেন, নানারকম ‘কোড’ লিখতে দিতেন এবং বলতেন পরদিন এসে সেটা দেখাতে। অত্যন্ত সাধু ফ্রয়েডিয়ান উদ্যোগ – যে জিনিসে ভয়, সেটাই বারংবার করে ভয় কাটানো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ‘কোড’ লিখতে গেলে আগে জানতে হবে তার অন্তর্নিহিত ফিজিক্সটা কী। তবেই তো বুঝব – কেন লিখছি, কী লিখছি আর কীভাবে লিখতে হবে। আমার উদ্দেশ্য তো স্রেফ ‘কোড’ লেখা নয়, বরং সেটিকে একটা ‘টুল’ হিসেবে ব্যবহার করা। সেইটা আমাকে কখনই বলা হত না। ফলস্বরূপ সেইসব ‘কোড’-এর কোনোটাই আমি লিখতে পারতাম না এবং গাইডের অফিসে রুদ্ধদ্বার কক্ষে যৎপরোনাস্তি অপমানিত হতাম। সেইসব ‘অপমান’-এর মধ্যে আমার বুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ, পিএইচডি ছেড়ে অন্য চাকরির ব্যবস্থা দেখা এবং ‘আমি সত্যি চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি’ – এই বাক্যের পুরোটাই যে মিথ্যে এবং আমি সারাদিন খেলে বেড়িয়ে কাটাই – এই দাবিতে আমাকে প্রকাণ্ড মিথ্যেবাদী প্রমাণ করা ইত্যাদি – সবই থাকত।
তারপর থেকে আমার যেটা শুরু হল, সেটা ভয় পাওয়া। আমি আমার গাইডের ‘কাল সকালে দেখা করবে’ ইমেল পাওয়া মাত্র কীর’ম একটা ‘নাম্ব’ হয়ে যেতাম। রাতে ঘুমোতে পারতাম না এই ভেবে, যে, কাল আমাকে যেটা করে দেখাতে বলেছে – সেটা আমি পারিনি এবং তার জন্যে আমাকে অপমানিত হতে হবে। এবং বলাই বাহুল্য, হতও তাই। গাইডের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে – সেই ভয়ে ইন্সটিটিউটে আমি লুকিয়ে ঢুকতাম আর বেরোতাম। ভদ্রলোক বোধহয় রোজ বসে বসে নতুন নতুন অপমান করবার পন্থা ভেবে বের করতেন। একদিন আমাকে সকালে ডাকলেন অফিসে। আমি ঢুকতেই একগাল হেসে ‘গুড মর্নিং’ বলে জিজ্ঞেস করলেন চা খাব কি না। আমি মাথা নেড়ে না বললাম। তো, উনি নিজের জন্যে এককাপ চা বানিয়ে আমার সামনের চেয়ারে বসলেন। আমাদের মাঝে দুটো কম্পিউটার স্ক্রিন। তার একটাকে আমার দিকে ঘুরিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাকে একটা জিনিস শেখাব।’ আমি ভাবলাম আজ বোধহয় ওঁর ‘মুড’ ভাল আছে, কিছু একটা নতুন কাজ-টাজ দেবেন। উনি কম্পিউটার স্ক্রিন-এ গুগল-এর হোমপেজ খুলে আমাকে বললেন, ‘বল তো এইটা কী?’ আমি মিনমিন করে বললাম ‘সার্চ ইঞ্জিন’। উনি বললেন, ‘বাহ্! তুমি তো জানো দেখছি। এবার আমি তোমাকে দেখাব কীভাবে সার্চ করতে হয়। তুমি সেইটা জানো না, নইলে ‘ওই কাজ’টা করে ফেলতে পারতে।’ আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। উনি চায়ের সাথে বিস্কুটের অভাব আমাকে দিয়ে পূরণ করলেন। এসবের ফলস্বরূপ – যে বিষয়ের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল, তার প্রতিই প্রবল বিতৃষ্ণা তৈরি হল এবং সাথে সাথেই প্রবল হীনমন্যতা। ক্রমাগত মনে হত, সত্যিই আমি আমার নিজের এবিলিটিকে ওভারএস্টিমেট করে ফেলেছি, রিসার্চ চূড়ান্ত প্রতিভাবান মানুষদের জায়গা এবং আমি তাদের ধারকাছ দিয়েও যাই না। এখন এই সমস্যা আমি কাকে জানাব? অনেকেই বলেন, ডিপ্রেশান হলেই কথা বলতে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি কী বলব? যে আমি কীভাবে কোড লিখব বুঝছি না বলে আমার গাইড আমাকে হেনস্থা করছে? কাকে বলব এ কথা? সে শুনেই বা কী সাহায্য করবে? কোডটা লিখে দেবে? স্বভাবতই আমি ইন্সটিটিউট ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু সেখানেও বয়েলিং ফ্রগ সিনড্রোম কাজ করে। একটা জায়গায় সুযোগ পেয়েছি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, সেটা ছেড়ে দিলে যদি আর কোথাও না পাই? দোষ নির্ঘাৎ আমারই, আমাকেই আরও পরিশ্রম করতে হবে, গাইড কীভাবে ভুল হতে পারেন? এত ছেলেমেয়ে তো কাজ করছে – কই কারুর তো আমার মত অবস্থা না? দেখাই যাক না, যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয়? এইসব দোলাচলতার মধ্যে আমার প্রায় আড়াই বছর কেটে যায় ইন্সটিটিউট ছাড়বার স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। আমার গাইডের সঙ্গে আমার শেষ এনকাউন্টারটি আরও চমকপ্রদ। এক সন্ধেবেলা, আমার নির্বুদ্ধিতায় হতাশ-উনি আমাকে অফিসে ডেকে পাঠান। আমাকে একটি স্টেপলারের মত জিনিস দেখিয়ে জিগেস করেন, ‘বল তো এইটা কী?’ আমি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বুঝতে না পেরে ওঁকে বলি, যে, আমি জানি না এর কী কাজ। উনি বলেন, ‘তোমাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা দিলাম, তার মধ্যে তুমি জেনে এসে বল – এইটা কী কাজে ব্যবহার করা হয়। তুমি এটা সঙ্গে নিয়ে যাও, অন্যদেরকে দেখাও, কিন্তু কাল যেন আমি তোমার থেকে সঠিক উত্তর পাই।’ এমনই দুর্ভাগ্য, যে সেটারও উত্তর আমি দিতে পারিনি পরদিন। উনি তখন বেশ একটা হাইক্লাস হাসি হেসে আমাকে বলেন, ‘একেই বলে রিসার্চ, বুঝেছ?’
আমি এই ঘটনার একমাস পর ইন্সটিটিউট ছাড়ি। পরে জানতে পারি, যে জিনিসটির আত্মার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে উনি আমাকে দিয়েছিলেন – সেটি একটি বিদগুটে দেখতে স্টেপলারের পিন তোলবার যন্ত্র। এর মধ্যে অবশ্য আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে। একটি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের কোর্স করাবার জন্যে আমাকে আমার গাইড বলেন। সেখানে প্রথম বা দ্বিতীয় দিন ক্লাস শুরু হতেই প্রফেসর বলেন, উনি কয়েকটি বিষয় দেবেন এবং গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের (BS -MS) ছাত্রছাত্রীদের তার মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিয়ে প্রজেক্ট করতে হবে। কিন্তু পিএইচডি করছে যারা – তাদের ক্ষেত্রে সেটা বাধ্যতামূলক না, কেউ ইচ্ছে করলে করতে পারে যদিও। তো তিনি ক্লাসে জিগেস করছেন, কে কে কোন বিষয়টি নিতে চায়, ক্রমে আমারও পালা এল। আমি তখন এমনিতেই নিজের কাজ নিয়েই জর্জরিত, বোঝার ওপর শাকের আঁটি নেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আমি বললাম, যে, না আমি করতে চাইনা। উনি তৎক্ষণাৎ আমাকে জিগেস করলেন, ‘তাহলে ক্লাসে এসেছো কেন? আমার মুখ দেখার জন্যে?’ আমি কী আর বলব, কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে, ‘আমি তো স্যার পিএইচডিতে’ বলে বসে পড়লাম। বেশ এক ঘর ছাত্রছাত্রীর মাঝে সুন্দর একটা হেনস্থা-দৃশ্য তৈরি হল। এর কিছুদিন পর একটি সেমিনারে উক্ত প্রফেসর তাঁর নিজেরই সিনিয়র রিসার্চ স্কলারকে পাঁচ মিনিট দেরি করে ঢোকার জন্যে আমাদের সামনেই বললেন (ইংরিজিতে), ‘তোমার হাতে ঘড়ি আছে দেখছি, তুমি ওটা দেখতে জানো? গাধা কোথাকার! আর জীবনে যেন দেরি না হয়।’ তারপর শুনলাম উনি নাকি ওর’ম বলেই থাকেন, ওটাই ওঁর বিশেষত্ব। রিসার্চ স্কলারদের সর্বসমক্ষে যা খুশি বলে দেওয়া। থিওরেটিক্যাল কনডেন্সড ম্যাটারের এক ‘প্রতিভাধর’ অধ্যাপক, আমারই সমসাময়িক এক বন্ধুকে শুধু ঘাড় ধরে নিজের গ্রুপ থেকে বের করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সাথে উনি এটাও এনশিওর করেন, যে, সে যেন ইনস্টিটিউটে আরে কারোর কাছেই কাজ না করতে পারে।
আমার সমসাময়িক যারা আমার সাথেই পিএইচডি করতে ঢুকেছিল, ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে আসার পর শুনলাম, তাদের অনেকের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের গাইডদের কল্যাণে। তাদের মধ্যে অনেকের সাথেই এখনও কথা হয় এবং তারা যে থিসিস জমা করে শেষ অবধি ওই ইনস্টিটিউট থেকে বেরোতে পেরেছে – এতেই যথেষ্ট খুশি হয়। তাদের মধ্যেই একজনকে – সে-ও ঢুকেছিল থিওরিটিক্যাল কনডেন্সড ম্যাটারে পিএইচডি করতে – তার গাইড বলেছিলেন, ‘তোমার জ্ঞান এতটাই কম – তুমি নিজেই জানো না যে তুমি কতটা কম জানো।’ তার মনের যথেষ্ট জোর ছিল বলে সেখানেই দাঁত কামড়ে পিএইচডি শেষ করে এবং বিদেশে পোস্টডক করতে চলে যায়। এর’ম উদাহরণ যে আরও কত আছে – লিখতে গেলে বছরখানেক লাগবে মনে হয়। এ হেন একটি বিষাক্ত পরিবেশ যে ইনস্টিটিউটে সযত্নে লালন করা হয়, সেখানে একজন রিসার্চ ফেলো আজ যখন আত্মহত্যা করেন – সেই সংবাদ আমাকে খুব একটা আশ্চর্য করে না। বরং এইটা ভেবে দুঃখ হয়, যে এই পরিবেশটিকে সেখানে নর্ম্যালাইজ করে ফেলা হয়েছে। সেখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে, একজন অধ্যাপক তাঁরই সিনিয়র রিসার্চ স্কলারকে সর্বসমক্ষে ‘গাধা’ বলতেই পারেন, কারণ ওটাই ওঁর ‘স্টাইল’। সেখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে, পিএইচডি করতে যারা এসেছে – তারা সকলেই নির্বোধ, অপোগণ্ড, অলস এবং তাদের উচিৎ ছিল আগেভাগেই সবকিছু জেনে আসা আর এখানে এসে স্রেফ ডিগ্রিটি নিয়ে কেটে পড়া। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেখানকার প্রবীণ অধ্যাপকরা এসব জেনেও দু’চোখে ঠুলি আর কানে তুলো দিয়ে বসে থাকেন। প্রসঙ্গত, সেই সর্বসমক্ষে ‘গাধা’ বলে দেওয়া অধ্যাপক, রিসার্চ স্কলারের আত্মহত্যার এক-দু’দিন পরই নিজের গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে (তাঁর একটি আবার আলাদা গালভরা নামের গ্রুপ আছে) একটি পার্টি করেন গেস্টহাউসের ঘরে। সেই গেস্টহাউসেরই ওপর-তলাতেই মৃত ছেলেটির মা ছিলেন তখন। কতটা নির্লজ্জ হলে অধ্যাপক হওয়া যায়?
আমি এখনও বিশ্বাস করি, সেইসব দিনগুলোতে আমার গাইড আমাকে দুচ্ছাই করে হ্যাটা না করে যদি দুটো ভাল কথা বলতেন, একটু দেখিয়ে দিতেন – কোন পথে হাঁটলে সুবিধে হয়, আমার হয়তো আড়াইটে বছর নষ্ট হত না। শুধু সময়ের দিক দিয়েই নয়, আমাকে এই অহেতুক মানসিক পীড়াও সহ্য করতে হত না। এর মানে কি উনি কাউকেই গাইড করতে পারেননি? উনি নিজে একজন খারাপ গবেষক? মোটেই না। অনেক ছাত্রছাত্রী ওঁর সাথে কাজ করেছে, ভাল ভাল জায়গায় পৌঁছে গেছে – এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু যারা সেইসব অসামান্য প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীদের দলে পড়ে না, যারা আমার মত – তাদের ‘তুমি অপদার্থ, তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না’ বলে কি এত সহজেই দাগিয়ে দেওয়া যায়? নাকি তাকে দিনের পর দিন নিজের অফিসে ডেকে ‘বুলি’ করলেই তার আজ্ঞাচক্র উন্মুক্ত হয়ে হু-হু করে অতিমানবীয় ব্রেনওয়েভ জেনারেট করতে শুরু করে? আমাকে আমার তত্কালীন গাইড বলেছিলেন, ‘তোমার পিএইচডি – তোমার দায়িত্ব। আমাকে বলে কী হবে, তুমি কেন প্রব্লেম সল্ভ করতে পারছ না?’ এখন মনে হয় এ তো মারাত্মক অক্সিমোরন! উনিই ‘গাইড’ আর উনিই বলছেন, ওই যে সামনে হিমালয় – কোনদিক দিয়ে উঠবে নিজে বুঝে নাও, আমাকে বাপু জ্বালাতে এসো না! আরও বেশি ভয় লাগে, যে, এঁদের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে যেসব ছাত্রছাত্রী হাটে-বাজারে ছড়িয়ে পড়ে, তারাও একইরকম স্যাডিস্ট হয় না তো? এভাবেই বংশপরম্পরায় এই ‘কালচার’ চলতেই থাকে।
ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে, অ্যাকাডেমিয়া-তে কীভাবে এর’ম সংকীর্ণ মনের মানুষ তৈরি হয়? শিক্ষা তো মনের প্রসার ঘটায়, মানুষকে বিনয়ী করে, এম্প্যাথেটিক হতে শেখায়। তাহলে এঁরা এর’ম কেন? আমাদের মধ্যে একটা প্রচলিত ধারণা কাজ করে, যে, যিনি বেশ নামী জায়গা থেকে বড় বড় ডিগ্রি, উপাধি ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন এবং কথায় কথায় ‘আমি অমুককে চিনি’ বা ‘তমুক আর আমি একই টেবিলে বসে খেতাম’ – ইত্যাদি বলেন, তাঁর সাতখুন মাফ। তিনি ইচ্ছে করলেই হাতে মাথা কেটে নিতে পারেন, ইচ্ছে হলেই ডেকে নিয়ে দু’গালে চড় কষিয়ে দিতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে চুপচাপ মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়, কারণ তাঁর অনেক ক্ষমতা। IISER Kolkata-র অফিসিয়াল স্টেটমেন্টটি দেখে ঠিক সেটাই মনে হল। ভাবটা অনেকটা “এর’ম ঘটনা ঘটতেই পারে, কিন্তু মাথায় রাখবেন, যে উনি অমুক জায়গা থেকে গামছা কিনতেন এককালে” ইত্যাদি, অতএব উনি সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এই ক্ষমতার সুযোগ নিয়েই বহু উচ্চপদে আসীন অ্যাকাডেমিশিয়ানরা বিভিন্ন রিসার্চ ইনস্টিট্যুটে বছরের পর বছর কাজ না করে নানাবিধ ইতরামি করে চলেন, যার খেসারত দিতে হয় রিসার্চ স্কলারদের। ‘কাজে প্রগ্রেস হচ্ছে না?’ রিসার্চ স্কলারের দোষ, ‘সময়মত থিসিস জমা করতে পারনি?’ রিসার্চ স্কলারের দোষ, ‘সে কী! মারা গ্যালে নাকি?’ রিসার্চ স্কলারের দোষ; কারণ সুপারভাইসার তো সাধক, তিনি জ্ঞানসাগরে সেই যে ডুব মেরেছেন, তারপর থেকে ওঠার নামটি নেই, স্কলারের পেটি ইমোশান ধুয়ে কি তিনি জল খাবেন? এখানে শুধু একজন বা দশজন গাইডকে দুষে অবশ্য লাভ নেই, আঙুল তোলা উচিত সেই সিস্টেমের দিকে – যা চোখের সামনে এগুলি ঘটছে দেখেও এইসব মানুষদের(?) পোষে, যথেচ্ছ লাই দেয় আর আত্মহত্যায় পরোক্ষে প্ররোচনা দেয়।
রিসার্চার হিসেবে আমি নিজে খুব সাধারণ মানের, কোনোভাবে টিকে গেছি বহু প্রতিভার এই জঙ্গলে। কিন্তু প্রায় বছর আষ্টেক কাজ করবার সুবাদে এ’টুকু বুঝেছি, পিএইচডি বিষয়টা নিরানব্বই শতাংশ পরিশ্রম (বুদ্ধি তো কমবেশি সকলেরই থাকে, তাই না?)। আর এক শতাংশ অনুপ্রেরণা, যেটা একমাত্র একজন গাইডই দিতে পারে। আর ওই এক শতাংশ অনুপ্রেরণাই বহু প্রতিভাকে ম্লান করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
Amit | 120.2.***.*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ০৯:৩৪506273
dc | 122.183.***.*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:০২506276
Somnath Roy | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:০৭506277
য | 2601:5c0:c280:4020:2c1a:114e:e3c3:***:*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:১৩506278
পার্থ প্রতিম রায় | 2409:4060:2d81:6cde::fbc9:***:*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:১৮506279
য | 2601:5c0:c280:4020:2c1a:114e:e3c3:***:*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:২২506281
Somnath Roy | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:২৯506282
Somnath Roy | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১০:৩২506284
SH | 2601:18c:c900:4810:bba6:2941:5be1:***:*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১১:০৫506289
r2h | 134.238.***.*** | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১১:৪৯506295
একক | ১৩ এপ্রিল ২০২২ ১৫:০১506299