এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধর্ম, মৌলবাদ ও আমাদের ভবিষ্যৎ : কিছু যুক্তিবাদী চর্চা

    Debasis Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬০৪৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইসলাম সম্পর্কে আলাদা করে দু-চার কথা

    মৌলবাদ নিয়ে এই ধরনের একটা লেখায় যদি কেউ ঘোষণা করেন যে, এইবার ইসলাম নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা হবে, তখন পাঠকের সে নিয়ে একটা প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। কাজেই, এখানে গোড়াতেই সে ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার, না হলে পাঠক হয়ত বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হবেন। সম্ভাব্য প্রত্যাশাটি এই রকম যে, মৌলবাদের স্বরূপ নিয়ে যখন চর্চা হচ্ছে, এবং তার মধ্যেই আলাদা করে ইসলাম নিয়ে চর্চার ঘোষণা হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই দেশে দেশে ইসলামীয় মৌলবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যাবে এখানে, বিভিন্ন স্থান-কালে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ বিশেষ বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে, এবং অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে তার মিল ও অমিল এবং তার কার্যকারণ ইত্যাদি বিষয়ক অনুসন্ধান ও তার ফলাফলও পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এখানে তা করতে পারলে ভালই হত, কিন্তু তার উপায় নেই। সেটা করতে গেলে আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদের কার্যকলাপ নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা সেরে রাখতে হত, তবেই তার প্রেক্ষিতে ইসলামীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারত। দুঃখের বিষয়, সে পরিসর এখানে ছিল না, এখানে তো এতক্ষণ মৌলবাদ নিয়ে শুধু কতকগুলো অতি সাধারণ কথাই বলেছি। বলে রাখা দরকার, এখানে আমি সরাসরি সেইসব নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব না, যদিও যা আসলে বলব তার মধ্যে এ বিষয়ে আমার মতামত ও চিন্তাভাবনারও কিছু ইঙ্গিত হয়ত মিলবে। এখানে আমি মূলত কথা বলব ইসলাম ধর্ম ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের মূলস্রোত ধ্যানধারণা নিয়ে, এবং তার ঠিক-বেঠিক নিয়েও। এ নিয়ে কথা বলব কারণ, আমার ধারণা, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই।
     
    ওপরে বলেছি, যাঁরা ধার্মিক নন বরঞ্চ ‘ধর্ম’ জিনিসটার সমালোচক, তাঁদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে দু রকমের ভাবনা বেশ পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় --- ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ। ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও তাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা। প্রথম ভাবনাটি ভুল, কেন তার কিছু ব্যাখ্যা নিচে আছে।
     
    আর ওই দ্বিতীয় প্রকারের যে দুশ্চিন্তা, আমি এবং আমার মত অনেকেই যার শরিক, তার এক প্রতিনিধি-স্থানীয় দৃষ্টান্ত আমার হাতে এসেছে কয়েকদিন আগে, আমার এক তরুণ বন্ধুর সাথে ফেসবুকীয় কথোপকথনে। তিনি কে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না, কিন্তু তিনি আমাকে যে সব প্রশ্ন করেছেন তা বোধহয় অতিশয় প্রাসঙ্গিক। এখানে সেগুলো হুবহু উদ্ধৃত করলে হয়ত আমাদের আলোচ্য প্রশ্নগুলোকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে সুবিধে হবে। অবশ্য, এখানে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তিমূলক উত্তর দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য ততটা নয়, যতটা হল মূল প্রশ্নগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমস্যাটাকে আরেকটু স্পষ্ট করে তোলা। নিচে রইল সেই তরুণ বন্ধুর দুশ্চিন্তা-জারিত প্রশ্নগুলো।
     
    দাদা,

    একটা বিষয় একটু বিস্তারিত জানতে চাই আপনার কাছে। আপনি যদি সময় করে একটু ডিটেইলসে উত্তর দেন, খুব উপকৃত হই। অনেকদিনই এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব ভেবেছি, কিন্তু করা হয়নি, কারণ বিষয়টা একটু সেন্সেটিভ, আর প্রশ্নটা একটু বিস্তারে করতে হবে।

    ছোটবেলা থেকেই (ক্লাস ওয়ান থেকে) আমি দেখে এসছি, আমার পরিমণ্ডলে শুধুমাত্র ধর্মে মুসলিম হওয়ার জন্য মানুষকে সন্দেহের চোখে, বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে "কীরে, খুব আনন্দ বল!" বলে টন্ট কাটা হয়, কেবল নাম দেখে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকার করা হয়, এমনকি মুসলিম ছাত্র ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলেও "আশ্রম থেকে শেষে মুসলিম ফার্স্ট হবে" এরকম কথা খোদ টিচারের মুখেই শুনেছিআমি ঘটনাক্রমে মুসলিম পরিবারে জন্মাইনি, কিন্তু একদম ছোটবেলা থেকেই আমার মুসলিম বন্ধু বা প্রতিবেশীদের এভাবে সামাজিক হেট ক্যাম্পেনিং এর মুখে পড়াটা ভীষণ দুঃখজনক লাগে। এই খারাপ লাগাটা ক্লাস ওয়ান থেকেই শুরু হয়েছিল, তো তখন তো আমি ধর্ম ভাল না খারাপ, যুক্তিবাদ ভাল না খারাপ, এতকিছু তো বুঝতাম না।

    এখন মুসলিমবিদ্বেষকে যারা জাস্টিফাই করে, তাদের থেকে যে যুক্তিগুলো উঠে আসে, সেগুলো -

    ১) আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?

    ২) "ওরা" (মুসলিমরা) সংখ্যায় বাড়লেই ইসলামিক রাষ্ট্র চায়, সংখ্যায় কমলেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়।

    ৩) সব ধর্মে সংস্কার হয়েছে, কিন্তু "ওরা" এখনও মধ্যযুগেই পড়ে আছে।

    ৪) সব ধর্মেই বহুবিবাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু "ওদের ধর্মে" বহুবিবাহ আজও জায়েজ, ওদের ধর্মে নারীর অবস্থা সবচাইতে খারাপ।

    ৫) "ওরা" নিজেদের বাঙালি মনে করে না, মননে চিন্তনে আরব, ওদের কাছে ধর্মই সব।

    ৬) ধর্মের নামে মানুষ হত্যা "ওদের ধর্মের মত কোন ধর্মই করেনি।"

    ৭) "ওদের" বাড়াবাড়ির জন্যই বিজেপির মত দলের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, হিন্দু মৌলবাদ ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল।

    ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত এই কটাই মনে পড়ছে।

    এখন আমার প্রশ্ন

    ১) মুসলিমবিদ্বেষীদের এই দাবিগুলো কি তথ্যগতভাবে সত্যি?

    ২) সত্যিই কি ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের থেকে ব্যতিক্রমী ভায়োলেন্ট? এখন তো যুক্তি, তথ্য, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মেথডলজি দিয়ে অনেক বিষয় কম্পারেটিভ স্টাডি করা যায়। "ইসলাম অন্য পাঁচটা ধর্মের থেকে ভায়োলেন্ট" - এই বিষয়টা কি যুক্তি, তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায়? মানে আমার প্রশ্ন, দাবিটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

    ৩) ধরে নিলাম, ইসলাম সবচাইতে ভায়োলেন্ট ধর্ম। কিন্তু তাতে করেই কি মুসলিমবিদ্বেষ জায়েজ হয়ে যায়?

    ৪) একজন নাস্তিক হিসাবে মুসলিম সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার হরণ করা হলে তার প্রতিবাদ করা কি অন্যায়?

    ৫) হিন্দু মৌলবাদ কি সত্যিই ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল? ইসলামিক মৌলবাদ না থাকলে সত্যিই কি হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছু থাকত না?

    ৬) আইসিস বা তালিবানের মত মুসলিম লিগ বা বর্তমানে মিমকে কি মৌলবাদী বলা যায়? নাকি "সাম্প্রদায়িক, কিন্তু মৌলবাদী নয়"-এমনটা বলা উচিত?

    আমার প্রশ্ন করার মূল কারণটা কিন্তু কোনভাবেই ইসলামকে ডিফেন্ড করা বা তার ভয়াবহতাকে লঘু করা নয়। আমিও ধর্মহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, সব ধর্মের মত ইসলামের অবসানও আশা করি।

    কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত স্তরে ইসলামের সমালোচনাটা যেভাবে হয়, তার টোনটা ঠিক যুক্তিবাদের নয়, টোনটা বিদ্বেষের। এখন রিলিজিয়াস ক্রিটিসিজমকে ঢাল করে বুঝে বা না বুঝে অনেক প্রগতিশীল মানুষও বিদ্বেষের টোন ব্যবহার করছেন। এটা খুব আশঙ্কার।

    এখন, এই প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটাকে আলাদা করে উত্তর দেবার চেষ্টা না করে বরং এ প্রসঙ্গে কতকগুলো সাধারণ কথা ভেবেচিন্তে দেখি। তাতে করে সমাধান না আসুক, অন্তত সমস্যাটার চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারে কিনা, দেখা যাক। হতে পারে, ভাবতে গিয়ে হয়ত ওপরের দু-একটা প্রশ্ন শেষতক বাদই পড়ে গেল, বা উল্টোভাবে, যে প্রশ্ন এখানে নেই তেমন কিছু এসে কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

    প্রথমেই বলা দরকার, অনেকে আধুনিক মৌলবাদী উত্থানকে মুসলমান জঙ্গি উত্থানের সঙ্গে এক করে দেখেন, যা মোটেই সঠিক নয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ধর্মীয় ধারাগুলোর সবকটির মধ্যেই মৌলবাদী উত্থান ঘটেছে, বিভিন্ন মাত্রা, ভঙ্গী ও ধরনে। আমেরিকায় খ্রিস্টান মৌলবাদীদের কথা আমরা জানি, জানি ইসরায়েলের ইহুদী মৌলবাদীদের কথা, জানি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের কথা, এবং জানি এই ভারতেই আশির দশকে তেড়েফুঁড়ে ওঠা শিখ মৌলবাদীদের কথাও --- যাদের হাতে ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন। ‘অহিংসার ধর্ম’ বলে কথিত বৌদ্ধধর্মও এ প্রবণতার বাইরে নয় মোটেই। থাইল্যান্ড, বর্মা ও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের তরফেও জঙ্গি প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। আজ অনেকেরই হয়ত আর মনে নেই, দুহাজার এক সালের কুখ্যাত ‘নাইন ইলেভেন’-এর ঘটনার আগে পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নাশকতার ঘটনা বলে ধরা হত উনিশশো পঁচানব্বই সালের দুটি ঘটনাকে। তার একটি ঘটেছিল আমেরিকার ওকলাহোমা সিটি-র ‘ট্রেড সেন্টার’-এ, যাতে বিস্ফোরক-ভর্তি ট্রাক দিয়ে ওই ভবনটিতে ধাক্কা মেরে প্রায় দেড়শো লোকের প্রাণনাশ করা হয়েছিল, এবং সেটা ঘটিয়েছিল কতিপয় খ্রিস্টান মৌলবাদী। অন্যটি ঘটেছিল জাপানে, যেখানে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে বিষাক্ত সারিন গ্যাসের কৌটো ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিষাক্ত গ্যাসে সরাসরি যত না মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় এবং গুরুতরভাবে জখম হয় সুড়ঙ্গের ভেতরে আতঙ্কগ্রস্তদের দৌড়োদৌড়িতে পদপিষ্ট হয়ে --- এবং সেটা ঘটিয়েছিল কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের একটি ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠী। আমরা বৌদ্ধধর্মটা অন্তত অহিংস বলে জানতাম, তাই না? তার দু বছর আগে উনিশশো তিরানব্বই সালে ভারতে সংঘটিত কুখ্যাত ‘বম্বে বিস্ফোরণ’ অবশ্যই একটি বৃহৎ নাশকতা, এবং সেটা ঘটিয়েছিল মুসলমান জঙ্গিরাই। কিন্তু, মুসলমান মৌলবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেটা ছিল তার এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া। বলা বাহুল্য, এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিকেও আবার মুসলমানদের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া বলেই দেখানো হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেটা কোনও সাম্প্রতিক ‘অত্যাচার’-এর প্রতিক্রিয়া ছিল না। হিন্দু মৌলবাদীদের নিজেদের দাবি অনুযায়ীই, এটা নাকি মোগল সম্রাট বাবরের তরফে ঘটে যাওয়া পাঁচশ বছরের পুরোনো এক অন্যায়ের প্রতিকার মাত্র! এবং, এই বাবরি মসজিদের ধ্বংসও আবার এ দেশে ধর্মীয় নাশকতার প্রথম ঘটনা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও নয়। এ দেশে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় নাশকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে যদি কোনও বিশেষ ঘটনাকে ধরতেই হয়, তো সেটা সম্ভবত উনিশশো চুরাশি সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করার ঘটনা। সেটা মুসলমানেরা ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল শিখ মৌলবাদীরা।

    ধর্মের সমালোচনা যে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। সমালোচনা মানে সব ধর্মেরই সমালোচনা, ইসলামেরও।  কিন্তু, ইসলাম ধর্মের সমালোচনায় একটি ভুল আমরা প্রায়শই করে থাকি। আমরা বলি, ইসলাম ধর্ম (এবং সেইহেতু ওই ধর্মাবলম্বীরাও) তো হিংস্র হবারই কথা, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার উপাদান খুব বেশি আছে। হয়ত সত্যিই আছে, কিন্তু যুক্তিটা তা সত্ত্বেও ভুল, এবং দুটো দিক থেকেই ভুল। কারণ, প্রথমত, সব ধর্মশাস্ত্রেই হিংসার উপাদান কমবেশি আছে। এবং দ্বিতীয়ত, যে ধর্মের শাস্ত্রে হিংসার উপাদান কিছু কম আছে সে ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের আচরণে হিংসা কম থাকবেই --- এ প্রত্যাশার ভিত্তিটাও বোধহয় খুব পোক্ত নয়।
     
    হিংস্রতার বর্ণনা ও তার নৈতিক সমর্থন হিন্দু শাস্ত্রগুলোতে কোরানের চেয়ে কিছু কম নেই। কম নেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও, যদিও, হয়ত বা সত্যিই কিছু কম আছে নিউ টেস্টামেন্টে।  আবার, শাস্ত্রগ্রন্থে হিংস্রতার বর্ণনা কম থাকলেই যে ধার্মিকেরা কিছু কম হিংস্র হবেন, এমন নিশ্চয়তাও পাওয়া কঠিন। যুদ্ধলিপ্সা, হত্যা এবং হিংস্রতায় যিনি প্রবাদপ্রতিম, সেই চেঙ্গিস খান কিন্তু মোটেই মুসলমান ছিলেন না, 'খান' পদবী দেখে যা-ই মনে হোক।  খ্রিস্টানরা ষোড়শ-সপ্তদশ শতক জুড়ে আমেরিকাতে স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে হত্যালীলা চালিয়েছে নিউ টেস্টামেন্টের যাবতীয় ক্ষমার বাণী সত্ত্বেও, তা ইতিহাসে বিরল। মধ্যযুগের শেষে এবং আধুনিক যুগের গোড়ায় 'ক্ষমাশীল' খ্রিস্টানদের ডাইনি পোড়ানোর হিড়িক দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন না, এমন কেউই কি আছেন এ যুগে? 'ইসলামিক স্টেট' তার ঘোষিত 'বিধর্মীদের' হত্যা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই, বা প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা সারা জগতের লোককে ডেকে দেখানোর জন্যেও বটে। দেখ হে, আমরা কত ভয়ঙ্কর, কত বড় বীর, এই রকম একটা ভাব। কিন্তু মধ্যযুগের খ্রিস্টানরা ডাইনি মারত ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে, এবং যন্ত্রণা দেওয়াটাই সেখানে মূল উদ্দেশ্য, যাতে অকথ্য অত্যাচার করে তার মুখ থেকে অন্য আরেক ‘ডাইনি’-র নাম বার করে আনা যায়। এই কাজটির জন্য তারা বিচিত্র ও বীভৎস সব কলা-কৌশল ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিল। কাজেই, বিশেষ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় হিংস্রতার সঙ্গে তার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের একটা সহজ সরল সম্পর্ক ধরে নেওয়াটা বোধহয় সব সময় খুব নিরাপদ নয়।

    মুসলমানদের হিংস্রতার মতই আরেকটি বাজে গল্প আছে মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে। মুসলমানদের হুহু করে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, এবং দ্রুত তারা হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে গিয়ে গোটা দেশটাকে দখল করে ফেলবে, এই মিথ্যে আতঙ্কটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু, বহু মানুষই যা সরলমনে বিশ্বাস করেন। এখানে বলে নেওয়া দরকার, মুসলিম জনসংখ্যা যে বাড়ছে এবং তার হার যে হিন্দুদের চেয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বেশিই বটে, এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। মিথ্যে হল এই প্রচারটা যে, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হিন্দুদের চেয়ে তাদের সংখ্যা নাকি বেশি হয়ে যাবে, এবং তারাই দেশটাকে গ্রাস করে ফেলবে। আসলে ঘটনা হল, সব ধর্মের জনসংখ্যাই বাড়ছে, এবং সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সব দেশেই সংখ্যাগুরুদের চেয়ে সামান্য একটু বেশি হয়, যদি সেখানে সংখ্যালঘু নিধন না চলে, এবং বিশেষত যদি সে সংখ্যালঘুরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া হয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির আসল যোগটা ধর্মের সঙ্গে নয়, অর্থনীতির সঙ্গে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও গরিবদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি যদি আলাদা করে হিসেব করা হয় তো দেখা যাবে যে তা সচ্ছল হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি। সম্পন্নরা ভাল রোজগার করতে চায়, ভালভাবে থাকতে চায়, এবং সন্তানের জীবনযাপনও যাতে সে রকমই হয়, সে ব্যবস্থা করতে চায়। তারা জানে যে সেটা করতে গেলে সন্তানকে উচ্চমানের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া দরকার, তার পেছনে ভাল করে যত্ন ও খরচাপাতি করা দরকার, এবং সেটা করার ক্ষমতাও তাদের আছে। ছেলেপুলে বেশি হলে তা সম্ভব নয়, এবং তাতে করে বাচ্চার মায়ের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে, মা ঘরের বাইরে গিয়ে পেশাগত কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে না। ফলে, তারা বেশি সন্তান একদমই চায় না। উল্টোদিকে, গরিবরা এত কথা জানেও না আর তাদের সে ক্ষমতাও নেই। ফলে তারা যত বেশি সম্ভব সন্তান চায়, সেটা মায়ের স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও। গরিবরা জানে তাদের সন্তান দুধেভাতে থাকবে না, এবং শেষপর্যন্ত কোনও শ্রমসাধ্য কাজেই যোগ দেবে যাতে শিক্ষা বা 'স্কিল' সেভাবে লাগে না। ফলে, সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে দুরবস্থা আর অযত্নের মধ্যেও হয়ত রোগভোগ মৃত্যু এড়িয়ে কেউ কেউ টিঁকে যাবে, আর পরিশ্রম করে পরিবারের আয় বাড়াতে পারবে, যৎসামান্য হলেও। অথচ এদেরই যখন অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তখন এরা মেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাতে চাইবে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে কেরানি-আমলা-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল এইসব বানাতে চাইবে, ফলে স্বল্পসংখ্যক সন্তান চাইবে, এবং মায়ের জীবন ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবে। একটু ভাল করে খোঁজখবর করলেই জানা যাবে, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে কিন্তু আসলে ঠিক তাইই, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই। এবং, মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বলেই তাদের অগ্রগতিও দ্রুততর। তাদের জন্মহারের বৃদ্ধি কমছে কিছু বেশি দ্রুতলয়ে। এভাবে চললে আর দেড় দুই দশক পরেই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে, এবং মুসলমানদের ভারত দখলের কুৎসিত অশিক্ষিত গল্পতেও তখন আর কেউই পাত্তা দেবে না। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি এই দিকেই।
     
    এখানে 'অগ্রগতি' বলতে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার কথা বুঝিয়েছি। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই কমিয়ে আনাটা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হারে ঘটছে (বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া মানে জনসংখ্যা কমে যাওয়া নয় কিন্তু, এ হার কমতে কমতে শূন্যের নিচে নামলে তবেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে)। এই কমে আসাটা উন্নয়নের পরোক্ষ সূচক। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন বাদে যে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।  পিছিয়ে আছে বলেই অগ্রগতি বেশি তাড়াতাড়ি হচ্ছে --- এ কথাটা হয়ত অনেককে বিস্মিত করতে পারে, কিন্তু কথাটা বলার কারণ আছে। নিশ্চয়ই জানেন, ভারত চিন ব্রাজিলের মত একটু এগিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর থেকে বেশি। এর কারণ হচ্ছে, একবার উন্নত হয়ে গেলে একই গতিতে আরও আরও উন্নত হতে থাকাটা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে কঠিন হয়ে ওঠে, তাই উন্নয়নের প্রথম দিকে বৃদ্ধির যে গতি থাকে পরের দিকে আর তত গতি থাকে না। মুসলমানদের জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও তাইই ঘটছে, এবং আরও ঘটবে (ও দুটোকে খুব নিখুঁতভাবে মেলানোর দরকার নেই, যদিও)।

    আমরা যারা এই বিষয়গুলোকে এইভাবে ভাবার চেষ্টা করি, তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আসে প্রায়শই, ফেসবুকে সে গর্জন রোজই শোনা যায়। এখন, এটা তো সত্যি কথাই যে, পশ্চিমবাংলার যুক্তিবাদীদের লেখালিখিতে, এবং যথারীতি আমার নিজের লেখাতেও, হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনাই বেশি আসে, মুসলমান মৌলবাদের কথা বাস্তবিকই আসে অনেক কম। ঠিক এই অভিযোগটি সেক্যুলারদের প্রতি হিন্দু মৌলবাদীরা করে থাকেন নিয়মিতই (বস্তুত, প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীরাই তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী বা সমাজের সেক্যুলারদের প্রতি এই একই অভিযোগ করে থাকে)। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝবেন, এটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। এবং, অন্যরকম কিছু হলেই বরং অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত হত, এমন কি অন্যায়ও হত। কেন, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ যে মৌলবাদী হুমকিটির মুখোমুখি, সেটা তো হিন্দু মৌলবাদই, অন্য কোনও মৌলবাদ নয়। শিক্ষা-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, সংবিধানকে পাল্টে দেবার পরিকল্পনা, ভিন-ধর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, ধর্মের জিগির তুলে তার আড়ালে সরকারি সম্পত্তি পাচার --- এ সব তো মুসলমানরা করছে না, হিন্দুত্ববাদীরাই করছে। অতএব, তাদের মুখোশ খোলাটাই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। মুসলমান জঙ্গিরা নাশকতা ঘটালে তার মোকাবিলার জন্য পুলিশ-মিলিটারি আছে, কিন্তু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা মৌলবাদীদের রোখবার দায়িত্ব তো আর পুলিশ-মিলিটারি নেবে না, সেটা সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের কাজ। আমি যে দেশে এবং যে ধর্মীয় সমাজের মধ্যে বাস করি, সেখানে যারা অন্ধত্ব ও হিংস্রতা ছড়াচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে বিনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই তো আমার পক্ষে স্বাভাবিক, তাই না? বাংলাদেশি মুক্তমনারা যদি মুসলমান ধর্ম ছেড়ে হিন্দুদেরকে গালি দিতে থাকতেন, বা বার্ট্র্যান্ড রাসেল যদি 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চান' না লিখে 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু' লিখে বসতেন, তাহলে যেমন উদ্ভট অসঙ্গত কাজ হত, এখানে আমরা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলমান নিয়ে পড়লেও ঠিকই একই ব্যাপার হবে (যদিও বাংলাদেশি মুক্তমনারা ঠিক যা বলেন এবং যেভাবে বলেন, তার অনেক কিছুর সঙ্গেই আমার দ্বিমত আছে, তবে সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না)। দ্বিতীয়ত, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মুক্তমনা যুক্তিবাদী নাস্তিকেরা হিন্দু সমাজে জন্মেছি বলেই সে সমাজ ও তার ধর্ম শাস্ত্র রীতিনীতি আচার বিচার এইসব অনেক বেশি জানি, ফলে সে ব্যাপারে আমাদের সমালোচনা অনেক বেশি নিরেট, নির্ভুল এবং অর্থবহ হয়, যা ভিনধর্মী সমাজে যারা জন্মেছে তারা পারবেনা। ঠিক একই কারণে, মুসলমান সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে মুসলমান সমাজে জন্মানো যুক্তিবাদীদের সমালোচনা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয়। যদিও, এর মানে মোটেই এই নয় যে এক ধর্মে জন্মানো লোক অন্য ধর্মের সমালোচনা করতেই পারবেনা --- যে কোনও মানুষের যে কোনও ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার আছে, এবং করা উচিত। তবে কিনা, নিজের সমাজের অন্ধত্ব অযুক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে সোচ্চার হওয়াটা যে কোনও মানুষেরই ‘স্বাভাবিক’ অধিকার, কর্তব্যও বটে।
     
    আচ্ছা, তা সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা তাহলে কী দাঁড়াল --- মুসলমানেরা ধর্মান্ধতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, না পিছিয়ে? এসব ঠিকঠাক বলতে গেলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার নির্ভরযোগ্য ফলাফল চাই, না হলে সবটাই চায়ের দোকানের আড্ডা হয়ে যাবে। আপাতত আছে কি সে সব, আমাদের হাতে? সুখের বিষয়, সে সব আছে। এই কিছুদিন মাত্র আগেও সেভাবে ছিল না, কিন্তু এই একুশ শতকে বেশ ভালভাবেই আছে। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সংস্থা এখন মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে প্রামাণ্য সমীক্ষা করে থাকে, তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসও পড়ে। এইসব সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বড় বড় বিশেষজ্ঞরা নানা গভীর গবেষণাও করে থাকেন, এবং তাতে তেমন চমকপ্রদ কোনও ফলাফল পাওয়া গেলে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে সে নিয়ে আলোড়ন উঠে যায়। এই রকমই একটি সংস্থা হল ‘উইন গ্যালাপ’। তারা সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এক বিখ্যাত সমীক্ষা চালিয়েছিল ২০১২ সালে, তাতে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য, ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা, এইসবের হিসেব ছিল। তাতে কি দেখা গেল? নিচে দেখে নিন ২০১২ সালের পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার ফলাফল, সুন্দর করে সারণিতে সাজানো। এখানে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, নিজেকে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন অথচ ধার্মিক বলে দাবি করেন না --- এমন মানুষের অনুপাত মুসলমানদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। কারা কবে সমীক্ষাটি করেছে, এবং তা কোন নথিতে প্রকাশিত, সব তথ্যই পাবেন এখানে।
     
     
    এবার একটি ইসলামীয় দেশকে নিয়ে ভাবা যাক, যেখানে প্রায় সর্বাত্মক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ইসলামীয় রাষ্ট্র আছে। ধরুন, ইরান। এই  দেশটা সম্পর্কে আপনি কী জানেন? জানি, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই একই কথা বলবেন। ছিয়ানব্বই দশমিক পাঁচ শতাংশ (সরকারি সেন্সাসের তথ্য অনুযায়ী) মুসলমান অধ্যুষিত একটি ধর্মান্ধ দেশ, যার মধ্যে আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা শিয়া মুসলমানদের। কট্টর মৌলবাদীরা সেখানে দেশ চালায়, প্রশ্ন করলেই কোতল হতে হয়, মুক্তচিন্তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি সেখানে হুলুস্থুলু ঘটে গিয়েছে, সে সব খবরাখবর আপনারা দেখেছেন। একটি মেয়েকে ইসলাম-সম্মত পোশাক না পরার অপরাধে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, তাই নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলে রাষ্ট্রের তরফে নেমে এসেছে দমন-পীড়ন, এবং সদ্য-সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর সামনে তার প্রতিবাদ করায় সে দেশের জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখানে মৌলবাদের দাপটের ছবিটা একদমই স্পষ্ট, আবার গণমানুষের আপত্তিটাও খুব আবছা নয়।

    আসলে, এখানে ধর্মীয় রাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপের তলাতেই লুকিয়ে আছে অন্য এক বাস্তবতা। নেদারল্যান্ডের একটি গবেষণা সংস্থা (GAMAAN), ইরানই যাদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু, তারা ২০২০ সালে  ইরানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে। সে সমীক্ষার ফলাফল যদি বিশ্বাস করতে হয়, তো সেখানে সাঁইত্রিশ শতাংশ মত লোক নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেন (শিয়া-সুন্নি মিলিয়ে), যাঁরা কোনও ধর্মীয় পরিচয় দিতে রাজি নন তাঁরা বাইশ শতাংশ, যাঁরা পরিষ্কারভাবে নিজেকে নাস্তিক-অজ্ঞাবাদী-মানবতাবাদী এইসব বলে পরিচয় দেন তাঁরা সব মিলিয়ে প্রায় সতেরো শতাংশ, যাঁরা নিজেকে শুধুই 'স্পিরিচুয়াল' বলেন তাঁরা প্রায় সাত শতাংশ, এবং বাকিরা আরও নানা বিচিত্র ধর্মের মানুষ। নিচের ছবি দুটোয় সমীক্ষার ফলাফল এক নজরে পাওয়া যাবে। হ্যাঁ বন্ধু, একুশ শতকে পৃথিবী বদলাচ্ছে, এবং হয়ত বিশ শতকের চেয়েও দ্রুত গতিতে! এবং, ইসলামীয় দেশগুলো কোনওভাবেই এ প্রবণতার বাইরে নয়। নিচে সে সমীক্ষার ফলাফল দেখুন, চিত্রাকারে।
     
     
    ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, অবতার ইত্যাদি ধ্যানধারণা বিষয়ে ইরান-বাসীদের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) ঠিক কী রকম, সে চিত্রও উঠে এসেছে সমীক্ষা থেকে। নিচে দেখুন।
     
     
     
    তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের ধর্মপ্রীতি নিয়ে আমাদের অধিকাংশের মধ্যে যেসব জনপ্রিয় ধ্যানধারণা আছে, তার সমর্থন এইসব সমীক্ষার ফলাফল থেকে মিলছে না মোটেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইঙ্গিত এখান থেকে আমরা পাচ্ছি, সেটা সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, নাকি একটা সম্পূর্ণ আলাদা উল্টোপাল্টা কিছু। সেটা বুঝতে গেলে বর্তমান শতকের বিগত কয়েকটি দশকে গোটা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি এক নজরে দেখে নেওয়া দরকার। এমনিতে সেটা একটু মুশকিল, কারণ, তার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার করা অনেকগুলো সমীক্ষা-কর্ম খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর প্রাসঙ্গিক ফলাফলটুকু বেছে নিয়ে তুলনা করতে হবে। সেইজন্যে, আমি যতটা পেরেছি সেগুলোকে সাজিয়ে একটা মাত্র সারণিতে নিয়ে এসেছি, তাতে পাঠিকের কিছু সুবিধে হবার কথা। সেটা নিচে দিলাম, দেখুন। সারণির কোন সংখ্যাটি কোন সংস্থার করা কবেকার সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, সেটা ওখানেই দেওয়া আছে। প্রথম সংখ্যাটি অবশ্য কোনও সংস্থার তরফে দেওয়া নয়। এটি দিয়েছিলেন সমাজতত্ত্ববিদ ফিলিপ জুকারম্যান, তখন পর্যন্ত প্রাপ্য সমস্ত টুকরো টুকরো সমীক্ষার ফলাফল এক জায়গায় করে।
     
     
     
     
    এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আসলে, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার যে প্রবণতা রয়েছে, মুসলমানরা কোনও মতেই সে প্রবণতার বাইরে নয় (অবশ্যই, এ হিসেব সামগ্রিক ও বৈশ্বিক, এবং অঞ্চল ও অন্যান্য পরিস্থিতি-ভেদে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে)।

    কেন এই জগৎজোড়া প্রবণতা? আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি বলবে, সবই যুগের হাওয়া। মানে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র-মানবতাবাদ-যুক্তিবাদ এইসবের প্রভাবই এর কারণ। কথাটা সত্যি, কিন্তু সমাজবিদেরা এর চেয়েও বড় কারণ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা আজ সুপ্রচুর তথ্য-যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, মানব সমাজের উন্নতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিপ্রতীপ। দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে, সমাজকল্যাণে সরকার বেশি বেশি খরচা করলে, অর্থনৈতিক অসাম্য কমলে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হাল ভাল হলে ধর্মের রমরমা কমতে থাকে (এখানে আর বিস্তারে যাব না, যদিও আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পরেও করব)। সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়ম মুসলমান সমাজের ওপরে প্রযোজ্য হবে না, এমনটা  ভেবে নেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ইরানে যা ঘটছে, সেটা সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়মের চাপেই। নেটে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখতে পাবেন, ইরানের মাথাপিছু উৎপাদন ভারতের প্রায় আটগুণ, বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ প্রায় সাতগুণ এবং শিক্ষাখাতে তা দেড়গুণেরও বেশি, এবং নারী ও পুরুষ উভয়েরই আয়ু আমাদের থেকে ভাল (গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের দশা শোচনীয়, যদিও)। কাজেই, ইরানে মৌলবাদী রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর কেন গণ-অসন্তোষের চাপ আছে এবং পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে কেন তা ততটা নেই --- এইটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না।

    বলা প্রয়োজন, সমাজ-বিকাশজাত এই চাপের খেলা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোতেও, বিশেষত এই একুশ শতকে। এই সেদিন পর্যন্ত আমেরিকা আর আয়ার্ল্যান্ডে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য ছিল অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ধার্মিক সমাজবিদেরা তাই দেখিয়ে বলতেন, অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই ধর্মের রমরমা কমবে, এটা হচ্ছে গিয়ে প্রগতিবাদীদের বানানো একটা মিথ্যে কথা। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই বিষয়টা জলের মত স্বচ্ছ হয়ে আসছে, এবং আপত্তি তোলবার পরিসর হয়ে আসছে অতিশয় সঙ্কুচিত। মার্কিন সমাজে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন এক নজরেই, নিচের লেখচিত্রে। লক্ষ করে দেখুন, ১৯৫০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমেরিকাতে যখন খ্রিস্টানরা এসে ঠেকেছে ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৯-এ, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা যখন মোটের ওপর একই আছে, তখন ধর্মহীনদের শতকরা অনুপাত গিয়ে ঠেকেছে শূন্য থেকে একুশে (অন্য কিছু সমীক্ষায় এটি প্রায় তিরিশ বলে দেখানো হয়েছে, যদিও)।
     
     
     
    আর, এই শতকের প্রথম দশকে আয়ার্ল্যান্ড-বাসীর ধর্মবিশ্বাসে যা ঘটেছে, সেটা দেখে নিন নিচের সারণিতে। আয়ার্ল্যান্ড হল গোঁড়া ক্যাথোলিক অধ্যুষিত একটি দেশ। একটা উন্নত পশ্চিমী দেশের পক্ষে অবিশ্বাস্যভাবে, এই সেদিন পর্যন্তও এই দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, এবং গর্ভপাতের দরকার পড়লে আইরিশ নারীদেরকে পার্শ্ববর্তী ব্রিটেনে গিয়ে হাজির হতে হত। তারপর উন্নত আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে রক্ষণশীল ধর্ম-সংস্কৃতির দীর্ঘ সংঘর্ষের ফলাফল তখনই সারা বিশ্বের নজরে এল, যখন দু হাজার আঠেরো সালে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হয়ে গেল (আয়ার্ল্যান্ড নিয়ে আমার আলাদা একটি লেখা ‘গুরুচণ্ডালি’-তে পাবেন)।
     
     
    বলা বাহুল্য, মোটের ওপর এই একই ঘটনা ঘটবার কথা মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও, এবং ঘটছেও তাইই। বেশ কয়েকটি ধর্ম-শাসিত রক্ষণশীল দেশে কমছে কঠোর ধর্মীয় বাধানিষেধ, বাড়ছে ধর্মহীনতা, এবং সাধারণ্যে কমছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা  এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। বিষয়টাকে যদি খুঁটিয়ে নজর করা হয়, তাহলে এমন অনেক কিছুই হয়ত জানা যাবে, যে ব্যাপারে আমরা আগে সচেতন ছিলাম না। যেমন, ইরান-ইরাক-আফগানিস্তান যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে গেল, এবং যেভাবে তুর্কি দেশটিতে ক্রমেই শক্ত হচ্ছে মৌলবাদের মুঠি আর টলমল করছে ধর্মনিরপেক্ষতার আসন, সে নিয়ে আমরা প্রায়শই দুশ্চিন্তিত হই। ঠিকই করি। কিন্তু, আমরা কখনই খেয়াল করে দেখিনা যে, এই ধরাধামে একান্নটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে একুশটিতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই চলছে (সে ধর্মনিরপেক্ষতার দশা প্রায়শই আমাদের চেয়ে খুব একটা ভাল নয় যদিও, তবে সেটা তো অন্য চর্চা)। এবং, ধর্মনিরপেক্ষীকরণের প্রক্রিয়া এখনও চালু, সে তালিকায় এই সেদিনও যুক্ত হয়েছে সুদান।

    তবুও প্রশ্ন আসতেই পারে, এবং আসবেও, জানা কথা। ওপরে উদ্ধৃত আমার তরুণ বন্ধুর ভাষায়, সে প্রশ্নটা এ রকম --- “আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?”। সত্যিই তো, প্রশ্ন হতেই পারে। ওপরে ব্যাখ্যা করেছি (এবং পূর্ববর্তী পর্বগুলোতেও), মৌলবাদী উত্থান সব ধর্মেই হয়েছে, শুধু ইসলামে নয়। এবং, জঙ্গি ক্রিয়াকলাপও কম বেশি হয়েছে সব ধর্মের তরফেই। সেই সত্যে ভর করে আমি হয়ত তর্ক করতে পারতাম, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে ইসলামের তফাতটা তাহলে গুণগত নয়, নিছকই পরিমাণগত। এরা কম, ওরা কিছু বেশি, এটুকুই মাত্র। কিন্তু, এ তর্ক শেষতক দাঁড়াবে না। পাথরের নুড়ির সঙ্গে পাথরের টিলার গুণগত পার্থক্যকে স্রেফ পরিমাণের দোহাই দিয়ে নস্যাৎ করাটা বোধহয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইসলামীয় জঙ্গিপনার নিবিড়তা, ঘনত্ব, প্রচণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিকতা, এ সবকে নিছক কম-বেশির ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। যদি বলি, মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা এবং আনকোরা নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে তোলা, অনেকগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার উল্টে দিয়ে মৌলবাদী রাজত্ব কায়েম করা, প্রায় সবকটি মহাদেশে বড়সড় নাশকতা চালানোর মত সংগঠন তৈরি করতে পারা --- এত সব শুধুই জঙ্গিপনার কম-বেশির ব্যাপার, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মত গুরুত্বপূর্ণ গুণগত বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই --- তাহলে অবশ্যই বোকামি হবে, বাস্তবকে অস্বীকার করার বোকামি। কাজেই, জঙ্গিপনার এই ভয়ঙ্কর নিবিড়তা আর ব্যাপকতাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সেটা মেনে নিলেও আসল সমস্যাটা রয়েই যায়। সব মুসলমানই তো আর মৌলবাদী জঙ্গি নন, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশই কেবল মৌলবাদী জঙ্গি। কাজেই, এই জঙ্গিপনাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন থাকে, ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটির কোনও মৌল উপাদান থেকেই কি এই বৈশিষ্ট্যটি উৎসারিত হচ্ছে, নাকি, মুসলমান অধ্যুষিত সমাজ তথা রাষ্ট্রগুলোর  কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই এ বৈশিষ্ট্যের নির্মাতা?
     
    কেউ কেউ এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত দিয়ে ফেলতে ভালবাসেন। তাঁরা বলেন, এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটিরই মৌল উপাদান থেকে নিঃসৃত, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার অনুমোদন আছে। এ যুক্তিটি যে ভুল, সে আলোচনা ওপরে করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর তবে কীভাবে খোঁজা যায়? আজকের দিনে বিজ্ঞানে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে, এ ধরনের প্রশ্নের সমাধানের জন্য যা করা হয় তাকে বলে ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ এক্সপেরিমেন্ট’। সমাজের ওপর তো আর পরীক্ষা চলবে না, অতএব সেখানে দরকার ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ, পুরোপুরি একই রকম করে তৈরি (বা সংগ্রহ) করে রাখা দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটিতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক উপাদান যোগ করে (বা একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে), এবং অপরটিতে তা না করে, শুধুমাত্র প্রথম ক্ষেত্রটিতে কোনও এক নির্দিষ্ট প্রত্যাশিত ফলাফল এলো কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, যাতে ওই নির্দিষ্ট উপাদানটির (বা প্রক্রিয়াটির) সঙ্গে ওই ফলাফলটির কার্যকারণ সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোনও ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যেমন একই ধরনের দু দল রুগির মধ্যে একদলকে সে ওষুধ দিয়ে এবং অন্যদলকে তা না দিয়ে পরীক্ষা করা হয় যে দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের কিছু বেশি উপকার হল কিনা, এও তেমনি। মনে করুন প্রশ্ন উঠল যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের যে মৌলবাদী উত্থান দেখা গেল, ইরাকের খনিজ তেল এবং আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানগত সামরিক গুরুত্ব না থাকলেও কি তা ঘটতে পারত, শুধুমাত্র ইসলামীয় শাস্ত্র, সমাজ ও সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই? এ প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ উত্তর বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র সেই ধরনের পদ্ধতিতেই, অর্থাৎ, ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যেখানে ইসলামের প্রবল প্রভাব আছে অথচ কোনও বড়সড় অর্থনৈতিক বা সামরিক লাভালাভের পরিস্থিতি নেই, সে রকম সমস্ত জায়গাতেও কি মৌলবাদী জঙ্গিপনার উদ্ভব ঘটেছে? আবার, যেখানে ওই ধরনের পরিস্থিতি আছে অথচ ইসলাম নেই, সে রকম কোনও জায়গাতেই কি জঙ্গি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেনি? এই ধরনের অনুসন্ধান হয়ত আমাদেরকে এ ধরনের প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ প্রসঙ্গে এ রকম গবেষণার কথা আমাদের জানা নেই।
     
    এই যে মুসলমান মৌলবাদের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে ইসলামের আভ্যন্তরীণ কারণকে পুরোপুরিই দায়ী করা, ওপরের দুই অনুচ্ছেদে যার কথা বললাম, এর ঠিক উল্টো প্রবণতাটা হচ্ছে এর পেছনে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ (বা আরও সাধারণভাবে ‘পশ্চিমী চক্রান্ত’) বা ওই জাতীয় ইসলাম-বহির্ভূত কোনও কিছুকে পুরোপুরি দায়ী করা (এবং সেইহেতু ইসলামীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে সাব্যস্ত করা)। মুসলিম মৌলবাদের উত্থানের পেছনে পাশ্চাত্য শক্তি, বিশেষত আমেরিকার ভুমিকা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিশ শতকের পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে ঘটছে, চোখ বুজে এইটা বলে দিলে আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তাকে নিন্দা করা হয়, কিন্তু আসলে শেষ বিচারে তার ক্ষমতাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেখা হয়। আমেরিকা (বা সাধারণভাবে ‘পশ্চিম’) মুসলমান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, শুধু এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না --- আসল প্রশ্ন হচ্ছে তারা তা পারল কী করে --- পৃথিবীর সব জায়গাতেই যে তারা যা চেয়েছে তাইই পেরেছে এমন তো আর নয়। মুসলমান সমাজ ও দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট বিন্যাস ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, বিকাশের সুনির্দিষ্ট অবস্থা, তাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাদের তরফে নানা মতাদর্শ ও গোষ্ঠী-পরিচিতি নির্মাণের খেলা, এবং কখন ঠিক কোন তাড়নায় তারা কোন বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে, আর কোন বৃহৎ শক্তিই বা তাদেরকে সামলানো বা ব্যবহার করার জন্য ঠিক কী চাল চালছে --- এই সবের ভাল বিশ্লেষণ ছাড়া বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝাই যাবে না। তাছাড়া, এই দেশগুলোতে 'সেক্যুলার' শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও প্রায়শই শাসকরা স্বৈরাচারি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেন, এবং, কেনই বা মৌলবাদীরা বারবার তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থাকার ভাণ করতে পারে, এটাও এ প্রসঙ্গে গভীরভাবে বোঝার বিষয়।  

    বলা বাহুল্য, এ সব প্রশ্নে যথার্থ ও যথেষ্ট বিশ্লেষণ এবং নিষ্পত্তিমূলক উত্তর এখনও আসেনি সমাজবিজ্ঞানীদের তরফ থেকে। যতদিন তা না আসে, ততদিন আমরা কী করতে পারি? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি, বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা জানা গেছে সে সব জানার চেষ্টা করতে পারি, যুক্তিসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার অভ্যাস করতে পারি …………… আর কিছু পারি কি?

    হ্যাঁ, পারি বোধহয়। মন থেকে অকারণ সন্দেহ ঘৃণা হিংসা বিদ্বেষ এইসব চিহ্নিত করে তা বর্জন করার অনুশীলনটা চালিয়ে যেতে পারি।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬০৪৬৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:198b:aeed:94b0:e70e:90a6:***:*** | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:০১515369
  • @yours faithfully  
    এই আলোচনায় আপনাকে বেশি করে পাওয়ার আগ্রহ থাকলো।
  • Debasis Bhattacharya | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫৩515382
  • guru,

    জবাব দিতে দেরি হল বলে দুঃখিত। আসলে কী জানেন, সংগঠন ও আন্দোলনের খাতিরে নানা বিষয় নিয়েই আমাকে লিখতে হয়, কিন্তু আমি তো আর বিশেষজ্ঞ নই, একটি বিষয় নিয়ে পড়ে থাকার কোনও উপায় আমাদের মত অ্যাক্টিভিস্ট-দের থাকেনা। মানে, এই ধরুন আজ মৌলবাদ আধুনিকতা এইসব নিয়ে লিখছি, আবার কালই হয়ত কেউ বলল যে বিদ্যাসাগর সাম্রাজ্যবাদের দালাল ছিলেন, তখন তাকে নিয়ে পড়লাম, পরশু কেউ হয়ত উপনিষদের ভেতরে কোয়ান্টাম থিওরি আবিষ্কার করে ফেলল, তখন তাকে তাড়া করতে হল, আবার তার পরের দিনই একজন অ্যান্টি-ভ্যাক্সার বলল যে কোভিড ভ্যাক্সিন নিলেই সব বুকে ব্যাথা হয়ে পটাপট মরে যাচ্ছে, এবার গিয়ে তার সঙ্গে কুস্তি লাগাও, এইসব আর কি! ফলত, আপনার প্রশ্নগুলো পেয়ে খানিক পুরোন জিনিসপত্তর ঘাঁটতে হল, তাতে সময় লেগে গেল।

    যাই হোক, আমার আগের লেখাটি এত মন দিয়ে পড়েছেন, তার জন্য একটি বড় ধন্যবাদ আপনার অবশ্যই প্রাপ্য, আমার তরফে। আপনি যে সমস্ত প্রশ্ন/প্রস্তাব ইত্যাদি করেছেন, সেগুলো মন দিয়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। যতদূর বুঝলাম, সেগুলোর  জবাব দেবার চেষ্টা করছি।

    (১) আপনি টমাস পিকেটির যে পেপার-এর লিঙ্ক দিয়েছেন ওখানে কিন্তু পেপারটা নেই, তবে ওটা আমার কাছে ছিল, খুঁজে বার করলাম। ওই পেপার-এর যেটুকু ইন্ট্রো বা অ্যাবস্ট্রাক্ট আপনি দেখেছেন, তাতে বিষয়টা বোধহয় ঠিকঠাক বুঝতে পারেন নি। পেপার-টি বড়, একাত্তর পাতার, এবং তাতে স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনীতির আলোচনাই বেশি আছে। আপনি যা বলছেন তার নির্যাস ধরা আছে এই গ্রাফ-টিতে, এটা আছে পঁয়তাল্লিশ পাতায়। দেখুন।
     
     
    দেখতেই পাচ্ছেন, ১৯২২ সালে ধনীতম ১ শতাংশের আয়ের ভাগ ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ, ২২ নয়। সেটা বেড়ে বেড়ে ৩-এর দশকের শেষে প্রায় বাইশ হয়েছিল, কিন্তু আবার নেমে যায় পরের দশকেই, সম্ভবত মন্বন্তরের কারণে। এ দিয়ে মুঘল আমলের অসাম্য নস্যাৎ হয়না।

    আমি যে সারণিটি দিয়েছি, সেটা বানানোর জন্য মুঘল আমলের একেবারে শেষদিককার নড়বড়ে সময়টাই (১৭৫০ সাল) কেন বেছে নেওয়া হল, এ প্রশ্ন আপনি তুলেছেন। আসলে, আমি ওটা তুলে নিয়েছি আমার কাজে লাগবে বলে, কিন্তু গবেষক তো আর আমার কাজে লাগবে ভেবে ওটা বানান নি! সংশ্লিষ্ট পেপারটির মূল গবেষক ব্রাঙ্কো মিলানোভিচ অসাম্য বিষয়ের একজন প্রথম সারির আন্তর্জাতিক গবেষক। অর্থনৈতিক ইতিহাসের গবেষণায় কোনও একটি বিশেষ সালকে তুলে আমার নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন, ওই সালটিতে হয়ত কোনও কারনে তথ্য বেশি সংগ্রহ হয়েছে। আরও নানা কারণই থাকতে পারে, সহজবোধ্য এবং অবোধ্য। তবে, এক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত মুঘল আমলের শেষদিকের তুলনায় ব্রিটিশ আমলের শেষদিককার অসাম্যের তুলনা করতে চেয়েছিলেন, সেইজন্যেই ও রকম বাছাই। তাঁর গবেষণাপত্রে তিনি দুটো সারণিই পরপর দিয়েছিলেন। এই নিন, এটা ওই গবেষণাপত্রের পঞ্চান্ন পাতায় আছে।
     
     
     
     আর, তখনকার কিছু প্রতিনিধিস্থানীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক অসাম্যের দশা (‘গিনি ইন্ডেক্স’ মাপকাঠিতে), আমাদের কালের কিছু নমুনার তুলনায়, তার মোদ্দা চিত্রটি পাওয়া যাবে ওই গবেষণাপত্রেরই সাতাত্তর পাতায়। নিচে দেখুন।
     
     
    (২) হ্যাঁ, অঞ্চলভেদে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তফাত হয় বইকি, এবং গড় হিসেবে সে সব তফাত ধরা পড়েনা, এটাও ঘটনা। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঘটনা যে, এশিয়া আর আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপের মোদ্দা তফাতটা এই তিন মহাদেশের ভেতরকার আঞ্চলিক পার্থক্যের চেয়ে অনেক বেশি। সেইজন্যেই, মোদ্দা মহাদেশীয় গড় সংখ্যাগুলো কিছু অন্তত তাৎপর্য বহন করে। যেমন ধরুন, ক্লাস সেভেন এবং ক্লাস টেনের ছাত্ররা --- উভয় ক্লাসের ছাত্রদেরই নিজেদের মধ্যে বয়েসের অনেক তফাত থাকতে পারে, যেমন একটা ছেলে হয়ত যথা বয়েসের আগেই তীব্র মেধার কারণে দশম শ্রেণিতে উঠে গেছে, আবার সপ্তম শ্রেণির একটা ছেলে হয়ত ফেল করে বেশ কয়েক বছর রয়ে গেছে অথচ তার বয়েসটা আসলে দশম শ্রেণির উপযুক্ত --- হতেই পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কেউ যদি বলে যে সপ্তম শ্রেণির ছেলেদের চেয়ে দশম শ্রেণির ছেলেদের সাধারণত তিন বছর বড় হওয়ার কথা, সে প্রত্যাশাকে অন্যায় বা অর্থহীন বলা যাবে না। যে কোনও কিছুর মোদ্দা চিত্রটা এক নজরে বোঝার জন্য ‘গড়’ ব্যাপারটা খুব কাজের, এটা বোধহয় সর্ববাদীসম্মত।

    (৩) এবং (৪) মাথাপিছু আয় অতি অবশ্যই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি। এটা অর্থনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত যে, মাথাপিছু আয় যে দেশের ভাল, তার বিজ্ঞান প্রযুক্তি স্বাস্থ্য শিক্ষা আইনশৃঙ্খলা সাধারণত ভাল হয়। তবে, সবকিছু এ দিয়ে বোঝা যায় না, অবশ্যই। যেমন, দেশে অসাম্য মাত্রাছাড়া হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল অত্যল্প সংখ্যক ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা লুটে নেবে, আর বেশির ভাগ দুর্দশায় থাকবে, সেক্ষেত্রে নিছক মাথাপিছু আয় দিয়ে দেশের অবস্থা ধরা পড়বে না। কাজেই, কিছু ব্যতিক্রম আছে। তবে, অসাম্যকে আলাদা করে মাপার ব্যবস্থা আছে। আর, আয় স্বাস্থ্য শিক্ষা সবকিছুকে হিসেবে নিয়ে সার্বিক মানবোন্নয়ন মাপারও চেষ্টা চলছে, যেমন, ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডেক্স’ বা সংক্ষেপে ‘এইচ ডি আই’। আপনিও কয়েকটি ইন্ডেক্স-এর কথা বলেছেন। প্রাচীন সমাজের ক্ষেত্রে এই মাপকাঠিগুলো প্রয়োগ করার সমস্যা হচ্ছে, উপযুক্ত তথ্যাবলী পাওয়া যায় না। তবু চেষ্টা চলছে। যেভাবে প্রাচীন কালে মাথাপিছু আয় আন্দাজ করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেভাবে নিশ্চয়ই অন্যান্য বিষয়গুলো মাপার পদ্ধতিও গড়ে উঠবে ধীরে ধীরে (তার কিছু নমুনা আমিও হাজির করেছি)।

    (৫) আন্তর্জাতিক জোট তৈরির মত পাকা বুদ্ধি তখনও জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর গজায়নি বলেই তারা তা বানাতে পারেনি। পারবে কিভাবে, এশিয়া আর আফ্রিকা দখল করার জন্যে নিজেদের মধ্যেই তো হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা! আর, কলোনি তো স্বল্প-উন্নত রাষ্ট্রেই বানাতে হবে, আরেকটা উন্নত দেশে কলোনি বানাতে গেলে আরেকটা সমকক্ষ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হবে, সেটার ঝুঁকি নেই?

    (৬) না, আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবে বোধহয় ‘কোর-পেরিফেরি’ সম্পর্ক মাপা যাবেনা। দুটো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পার্থক্য হয়ত ওভাবে খানিকটা বোঝা গেলেও যেতে পারে (তাতেও সমস্যা আছে), কিন্তু সেটা ‘কোর-পেরিফেরি’ সম্পর্কের কতটা প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে সেটা কীভাবে বুঝবেন? কথার কথা বলছি, ধরুন, তাতে দেখা গেল যে, ঔপনিবেশিক যুগের কোনও এক নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের সাথে ব্রিটেনের পার্থক্য হাজার ডলার, আর স্পেনের সাথে ব্রিটেনের পার্থক্য হয়ত পাঁচশো ডলার, এবং ওদিকে আফ্রিকার গড়ের সঙ্গে ভারতের তফাত হয়ত দুশো ডলার। তা থেকে কি বোঝা যাবে? কোনটা কতদূর ‘কোর’, আর কোনটা কতদূর ‘পেরিফেরি’?
     
    অন্য টেকনিক্যাল সমস্যাও আছে। ধরুন, ‘ক’ দেশের মাথাপিছু আয় ১০০০ ডলার, আর ‘খ’ দেশের আয় পাঁচশো ডলার। দুটোর তফাত পাঁচশো ডলার, এবং তফাতটি বিরাট, প্রথমটির আয় দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ। এবার ধরুন, অন্য এক মহাদেশের দুটি দেশ ‘গ’ এবং ‘ঘ’ --- প্রথমটির আয় ৪৫০০০ এবং দ্বিতীয়টির ৪৫৫০০। এদেরও পার্থক্য পাঁচশো, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তুল্যমূল্য। তাহলে, এই ‘মেট্রিক’-টি কোনও কাজে এল কি?
     
    তাই আমার ধারণা, ওই ধরনের ব্যাপারগুলো আবিষ্কারের কাজটা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের হাতে ছাড়াই ভাল। তাঁরা আবিষ্কার করলে আমরা জেনে নেব, তাতে ঝামেলা কম।
  • Debasis Bhattacharya | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৫515383
  • আলোচনার পাহাড় থেকে মোদ্দা বিষয়গুলো ছেঁকে বার করে যে তালিকাটা বানিয়েছিলাম সেটা বরং আরেকবার দিই, যদি তাতে সবার সুবিধে হয়।
     
    (১) আধুনিকতা কি, প্রাগাধুনিক সময়ের তুলনায়, বেশির ভাগ মানুষকে আগের চেয়ে বেশি বিপন্ন করে তুলেছে, অতি অল্প কিছু মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি ধনী ও ক্ষমতাশালী বানাবার বিনিময়ে?
     
    (২) আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের মধ্যে কি কোনও ক্ষমতা-তান্ত্রিক হিংস্রতা অন্তর্নিহিত আছে?
     
    (৩) ঔপনিবেশিকতা, যুদ্ধ, গণহত্যা, দাস-ব্যবসা, পরিবেশীয় বিপর্যয় এবং ইউরোপ-কেন্দ্রিকতা কি আধুনিকতার অনিবার্য ও অপরিহার্য উপাদান?
     
    কেউ কি কিছু বলবেন? 
  • Debasis Bhattacharya | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:০৬515386
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    আপনার 'ডিস্টোপিয়া' এবং 'আমাজনের রূপকথা' লেখাদুটি পড়ে ফেললাম। চমৎকার লাগল, বিশেষত দ্বিতীয়টি। সত্যিই ভাল লেখেন আপনি। দ্বিতীয়টা বেশি ভাল লাগল, তার এক নম্বর কারণ, ওটা মানুষের হেরে যেতে যেতেও না হারার গল্প, যেভাবে আমরা অনেকেই রোজই মুছে যেতে যেতে শেষে টিঁকে যাই। আর, দ্বিতীয় কারণ আপনার কলমখানি।
     
    প্রথমটি যেন বড্ড বেশি ভয় পাওয়ার গল্প। নানা সম্ভব-অসম্ভব ভয় তো আমাদের থাকেই। অসম্ভব ভয়কে অসম্ভব বলে বুঝে নিতে হয়, যুক্তি প্রয়োগ করে। আর, সম্ভব ভয়ের সীমাটা চিনে নিয়ে তার সঙ্গে বাস করতে শিখতে হয়, সেও তো যুক্তি দিয়েই। কী হবে, সব কিছুকেই এত ভয় পেয়ে! 
     
     
  • Debasis Bhattacharya | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:১০515387
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    আপনার 'চাঁদের পাহাড়'-এর অনেকগুলো পর্ব দেখলাম। আগ্রহী। শিগগিরই পড়ব বলে রেখে দিলাম। 
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:8904:ccb1:b235:da79:***:*** | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:৩১515388
  • @দেবাশিসবাবু 
    আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। আমি নিশ্চিতভাবে অনুপ্রাণিত হলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ। 
     
  • guru | 103.17.***.*** | ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:০৯515389
  • @দেবাশীষ বাবু 
     
                         অনেক ধন্যবাদ আরো তথ্য দেবার জন্য |
     
    ১ | দেখুন যে টমাস পিকেটির তথ্য আপনি দিয়েছেন সেই অনুযায়ী বোঝাই যাচ্ছে আর্থিক বৈষম্য মুঘল আমলের তুলনাতে ব্রিটিশ আমলে কমেনি বরঞ্চ বেড়েছিলো (যেমন আপনি বলেছেন ১৯৩০ এর দশকে ) |  তাছাড়া নিচের যেদুটি টেবিল আপনি দেখিয়েছেন সেইখানেই দেখা যাচ্ছে যে ট্রাইবাল শ্রেণীর ও গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা মুঘল আমলের তুলনাতে ব্রিটিশ আমলে স্বল্প হলেও পড়ে গেছে | কাজেই ব্রিটিশ আমলে মুঘল আমলের তুলনাতে বিশাল আর্থিক সাম্য এসেছিলো এটা নিশ্চয় বলা যাবেনা |
     
    অবশ্য যেহেতু ব্রিটিশ শাসনে আরো আধুনিকতা এসেছিলো কাজেই এটা প্রমাণিত যে আধুনিকতা আসলেই অসাম্য বেড়ে যায় | এছাড়া আরো একটি বিষয় এখানে দেখতে হবে যে ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ ভারতে পাকাপাকিভাবে থাকতেননা মুঘল সম্রাটদের মতো কাজেই ভারতে অসাম্য এলো না গেলো তাতে তাদের কিছু যেত আসতোনা যেহেতু ভারতে কোনো ক্ষতি হলে তাদের বিশেষ কিছু যেত আসতোনা | আমি সম্প্রতি বিখ্যাত আম্রিকি লেখক নাসেম নিকোলাস তালেৰ এর "স্কিন ইন দি গেম " পড়েছি সেখানে এইরকম একটি তত্ত্ব আছে যে যেহেতু যেখানে শাসক নিজে যদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার নিজের সিদ্ধান্তে তাহলে তার ভুল সিদ্ধান্ত নেবার ও তা সংশোধন না করার  প্রবণতা বেড়ে যায় অনেক |  এখানে সেটাই হয়েছিল বলে আমি মনে করি |
     
    আরো একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে যে বর্তমান ভারতেও টপ ১ % এর কাছে ৪০ % এর মতো সম্পদ আছে বলা হচ্ছে এই নিচের রিপোর্টটিতে যা কিনা টমাস পিকেটির দেওয়া ব্রিটিশ ভারতের তথ্যের থেকেও অনেকটাই বেশী, মুঘল আমলের তুলনাতে তো বটেই  | 
    এখন যদি ধরে নি বর্তমান ভারত ব্রিটিশ ভারতের তুলনাতে বেশি আধুনিক , তাহলে আপনার , টমাস পিকেটি ও আমার উপরের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে যত বেশী আধুনিকতা আসে তত বেশী আর্থিক অসাম্য আসে | এটা মেনে নিলে অনেক সমস্যাই মিটে যাবে |
     
    ২ | আপনার দ্বিতীয় পয়েন্টটির উত্তর দেবার আগে আমি আপনার প্রফেসর শঙ্কুর উপরে একটি অত্যন্ত খেটে কাজ করার জন্য অভিনন্দন জানাতে চাই | আপনি সত্যি খুবই খেটে কাজ করেছেন | আপনার নিচের এই লাইনগুলো খুবই ভালো লেগেছে |
     
    "উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া কোনও বড় আবিষ্কার সম্ভব নয়, এটুকু না মানলে মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞান সবই আকস্মিক ও দৈবনির্ভর হয়ে পড়ে। আমরা মানতে বাধ্য, নিউটন সাহেব অ্যারিস্টটলের সময় জন্মালে বিশেষ সুবিধে করতে পারতেন না, তেমনি সেই বৈদিক যুগে জন্মালে আইনস্টাইনেরও মাথায় আসত না আপেক্ষিকতাবাদ।"
     
    আমি আপনার এই লাইনগুলোতে অনুপ্রাণিত হয়েই angus ম্যাডিসন এর কৃত সারণীটি এবং তার বানাবার পিছনে লেখকের উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত কি ভেবে দেখলাম | | দেখুন সেই সময়ে তার মাত্র কয়েক বছর আগেই ঘটে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন , তৈরী হয়েছে একমেরু বিশ্ব , ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলছেন "এন্ড অফ হিস্ট্রি"  ও টমাস ফ্রীডম্যান কম্বু কণ্ঠে চিৎকার করছেন "ওয়ার্ল্ড ইস ফ্লাট " এবং এইসব আম্রিকি প্রচারকরা বিশ্বকে বোঝালেন যে যেহেতু একমেরু বিশ্ব কাজেই পৃথিবীর কাছে একমাত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল আম্রিকি শ্রেষ্ঠতার মডেল | নিয়াল ফারগুসন তো "এম্পায়ার" নামক একটি বই লিখে আম্রিকাকে ইংল্যান্ডের ফেলে যাওয়া সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিতে অনুরোধই করে ফেললেন | এই ভদ্রলোকই পরে আবার দাবি করেন যে ব্রিটিশ শাসনে ভারত সহ বাদবাকী এশিয়া ও আফ্রিকার অপরিসীম কল্যাণ হয়েছিলো |
     
    আমার মনে হয় angus তার বইটিকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে | তাহলে যদি মেনেই নি angus তার সময়ের এইসব প্রচলিত ইউরো সেন্ট্রিক ধারণার উপরে নির্ভর করেই এই বইটি লিখেছিলেন | তাহলে তার এই বইটিকে কতটা নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে ? 
     
    এটি তো পরিষ্কার যে আঙ্গাস ম্যাডিসন সারণিটি করতে গিয়ে "আফ্রিকা", "জাপান বাদে সমগ্র এশিয়া" এইসব ক্যাটাগরি তৈরী করে  তার বর্তমান সময়ের ইউরো সেন্ট্রিক বায়াস কে নিয়েই কাজ করেছিলেন যেটি ঐতিহাসিক ভাবে হিস্টোরিক্যাল di-contextualisation এর পরিচয় দেয় | এ ঠিক সেই ধরণের অবৈজ্ঞানিক কাজ যেটি আপনার মতানুযায়ী সত্যজিৎ শঙ্কুকে নিয়ে করেছেন | কাজেই আঙ্গাস ম্যাডিসন ও তার কাজকে কতটি আপনার মতে নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে ? 
     
    আঙ্গাস ম্যাডিসন ছাড়া এই ধরণের কাজ কোনো অন্য assumption নিয়ে কেউ করেছেন কিনা জানলে ভালো হতো |
     
    ৩ | "কথার কথা বলছি, ধরুন, তাতে দেখা গেল যে, ঔপনিবেশিক যুগের কোনও এক নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের সাথে ব্রিটেনের পার্থক্য হাজার ডলার, আর স্পেনের সাথে ব্রিটেনের পার্থক্য হয়ত পাঁচশো ডলার, এবং ওদিকে আফ্রিকার গড়ের সঙ্গে ভারতের তফাত হয়ত দুশো ডলার। "
     
    আমি আমার যে মেট্রিকটি অর্থাৎ কোর পেরিফেরী ইকোনমিক ডিফারেন্স পরিমাপ করতে বলেছি বিভিন্ন কোর ও পেরিফেরীর মধ্যে এবং অবশ্যই ইতিহাসকে মাথায় রেখে | আমার মনে হয়না আমি আফ্রিকা ও ভারতের জিডিপির তুলনা করতে বলবো যেহেতু ঐতিহাসিক ভাবে কোন আফ্রিকার দেশ ভারতকে সেইভাবে colonize করেনি কোর পেরিফেরী সম্পর্কে যেইভাবে ইংল্যান্ড ভারতকে করেছিল | বরঞ্চ এক্ষেত্রে ফ্রান্সের সঙ্গে কোন আফ্রিকার দেশ যেমন আলজিরিয়া বা সেনেগালের তুলনা করা যেতে পারে যারা সত্যি সত্যি ফ্রান্সের কলোনী ছিল |
     
    ব্যাপারটা এরকম হতে পারে কোনও এক নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের সাথে ব্রিটেনের পার্থক্য এবং সেইসময়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কোন আফ্রিকার কলোনী যেমন আলজিরিয়া বা সেনেগালের তুলনা এবং তারপর এই দুটি সংখ্যার তুলনা | এইভাবে দুটি বিভিন্ন কলোনিয়াল সিস্টেমের তুলনা করা যেতেই পারে | অর্থাৎ এইখানে উদেশ্য হলো দুটি কলোনিয়াল সিস্টেমের তুলনা করা |
     
    আর দেখুন বিজ্ঞানে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে তো বারে বারে ঠেকে শিখে সাফল্য আসে | 
     
    আপনি যে টেকনিকাল সমস্যার কথা বলেছেন সেইরকম সমস্যা যেকোনো রিসার্চ পেপার লিখতে গেলেই হতে পারে | এমনকি আঙ্গাস ম্যাডিসন ও টমাস পিকেটির যে ভারতের টপ ১ % এর সম্পদের শতাংশের পরিমাপ সেখানেও একটু লক্ষ্য করে দেখলেই দেখবেন এরকম একটি ব্যাপার হচ্ছে | আঙ্গাস ম্যাডিসন মুঘলে আমলে ভারতের টপ ১ % এর সম্পদের শতাংশের পরিমাপ দেখাচ্ছেন ১৫ % ও টমাস পিকেটি দেখাচ্ছেন ব্রিটিশ আমলে ১৪ %-২২ % বিভিন্ন সময়ে | যেমন ৪৫০০০ ও ৪৫৫০০ সমতুল্য তেমনি ১৫ % ও ১৪ % কি সমতুল্য নয় ? 
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:১০515390
  • guru, 
     
    আপনার এই ব্যাপারটা কিন্তু দারুণ --- দ্রুত এবং সিনসিয়ারলি উত্তর দেওয়া। ওই ব্যাপারটায় আমি কমপ্লিট ফেলটুস!
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:8904:ccb1:b235:da79:***:*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ০২:১২515391
  • @দেবাশিসবাবু ও গুরু 
     
    আপনাদের আলোচনা দুর্দান্ত চলছে। এরমধ্যে বিরক্ত করতে চাইছিলাম না। কিন্তু হতভাগ্যকে আবার তিনদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। তাই আমারটা অনিচ্ছাস্বত্বেও দিয়ে গেলাম। আপনাদের কথা হয়ে গেলে চোখ বুলিয়ে নেবেন। 
     
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:8904:ccb1:b235:da79:***:*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ০২:১৪515392
  • @দেবাশিসবাবু ও অন্যান্য সবাই 

    প্রথমেই বলে রাখি আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমি কোনো রাজনীতি-ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান কোনও বিদ-ই নোই। ডেটা নিয়েও আমার দখল শূন্য। ঘটনাক্রমে এই অসাধারণ আলোচনাতে সৌভাগ্যক্রমেই জড়িয়ে পড়েছি। কিন্তু আমার এক্ষেত্রে একমাত্র পুঁজি হলো আমার অনুভব। তাই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা তো রয়েছেই। নিজগুনে ভুল ধরিয়ে দেবেন। যে প্রশ্নোত্তরটা আমার সবচেয়ে জরুরি মনে হয়েছে সেটা নিয়েই কথা বলবো। তবে অলোচনা এত বিস্তৃত ডাইমেনশনে চলছে যে দেবাশিসবাবুর সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের ধারাবাহিকতা ধরে বলা হলেও শুধু সেখানেই হয়ত আর সীমাবদ্ধ নেই বলে আমার ধারণা। আরেকটা কথা বারবার বলছি, কোনো কথাই পার্সোনালি কারোর উদ্দেশ্যে লেখা নয়। আলোচনার স্পিরিটেই লেখা। তবে সেগুলো যদি একান্তই প্রলাপত্বের গন্ডি না ডিঙোতে পারে তবে এই আলোচনায় আমার কন্টিনিউ করার আর মানে থাকে না। আর যদি তা সংলাপে উর্ত্তীর্ণ হয় তাহলে নিশ্চয়ই বাকিগুলো নিয়ে কথা বলবো। যাক শুরু করি। 

    “৩    প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অবিচ্ছিন্ন হয়ে আপনি শেষতক বনমানুষে ফিরতে চান কিনা  …………
    সরলীকরণের মজাটুকু থাক। সে খুব একটা খারাপ হতো না। এই ক্রান্তীয় গরমে জামাকাপড় পড়ার চাপ থেকে মুক্ত হওয়া যেত। আরো কত কি! সে ভাবতেই আমার কেমন একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে।”
    উত্তর --- মজা তো একটু ছিলই, কিন্তু সরলীকরণ বোধহয় ততটা ছিল না। তর্কটাকে টেনে একটা আইডিয়ালাইজ্‌ড্‌ অসম্ভাব্যতায় নিয়ে ফেলা, যাতে ধারণার অন্তর্নিহিত অবাস্তবতাটুকু মূর্ত হয়ে ওঠে, এই ছিল তার্কিক উদ্দেশ্য। আর, মজাটুকু নেহাতই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। যখনই কেউ আধুনিকতার বিরোধিতা করে, তখনই কি এ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় না? আপনি আধুনিককে চান না, তাহলে নিশ্চয়ই তার পূর্ববর্তী কোনও সময়ে ফিরতে চান। ঠিক কোন সময় --- এ প্রশ্ন কি সেখানে অনিবার্য হয়ে পড়েনা?

     
    যাই হোক, কথা এখানে অবশ্য শুধু এই একটামাত্র নয়। এই যে বললেন, ব্যাপারটা হলে নাকি আপনার খুব খারাপ লাগত না, সেটা আমাদের পরীক্ষা করে দেখবার কোনও উপায় নেই বটে, কিন্তু কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য হল? আর কিছু না হোক, অন্তত গুহাচিত্রী আর ভ্যান গঘের আশ্রয় তো চেয়েছিলেন (শুধু ওইটুকু আলাদা করে চাওয়া যায় কিনা, সে প্রশ্ন থাকুক)। বনমানুষ হলে সে সুযোগ পেতেন? আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার এ উত্তরে রোমান্টিকের তৃপ্তি হয়ত ছিল, কিন্তু সত্যের কমিটমেন্ট ততটা ছিল কি? 

    আপনারা যদি বলেন বনমানুষে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার রোম্যান্টিক স্বপ্নই তাতে আমার কোনোই অসুবিধে নেই। (কিন্তু হোমো সেপিয়েন্স কি ফিরে গিয়ে বনমানুষে পরিণত হতে পারে আমি ঠিক জানি না। বিজ্ঞানে যে অজ্ঞান তা তো আগেই স্বীকার করে নিয়েছি। কেউ আলোকপাত করবেন প্লিজ।) এবং রোম্যান্টিক হওয়ার ক্ষমতাটিকে আমি একটি বিশিষ্ট মানবিক গুন বলেই মনে করি। যাই হোক, এই প্রতিপ্রশ্নটা কিন্তু খুব পরিচিত। বারংবার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি হালকা ভাবেই নিয়ে গিয়েছি এতদিন। ধন্যবাদ দেবাশিসবাবুকে, উনি আমাকে সিরিয়াস হতে বাধ্য করেছেন। প্রশ্নের মূলে ঢুকতে সহায়তা করেছেন। তাই শুরুটা করি এইটা ধরে নিয়ে যে, এটাই সবচেয়ে মোক্ষম এবং মৌল প্রশ্ন। যদি আধুনিকতাকে না চাই তাহলে কোথায় যেতে চাই? প্রশ্নটা আমার কাছে একটু পার্সোনাল-ও বটে। তাই আপনাদের অনুমতি চেয়েই হয়তো কোথাও কোথাও একটু পার্সোনাল হয়ে পড়তে পারি। 
     
    তো টাইম মেশিন ছাড়া পূর্ববর্তী কোনো সময়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেউ যদি ফিরে যাওয়ার সেই মহামূল্যবান টিকিটটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো - যা ব্যাটা যা, তোর যেখানে খুশি গিয়ে সেঁধো। তাহলে খুব সম্ভবত আদিম সাম্যবাদের কালে ফিরে যেতে চাইতাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম একলা তো যেতাম না! মানে যাওয়া সম্ভবই নয়। সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো যে অনেক কিছু! মনের মধ্যে করেই নিতাম না হয় রবীন্দ্রনাথের গান-জীবনানন্দ-লোরকা-বোদলেয়ার। কিন্তু মার্কেজ-মানিক-কমলকুমারের ধোয়াঁ গন্ধওয়ালা বইগুলো? অনেক কষ্টের জমানো বাখ-হ্যান্ডেল-বেঠোফেনের সিডিগুলো? গোদার-ব্রেসোঁ-তারকোভস্কির ডিভিডি গুলো? ওগুলো যে নিতেই হতো! যাওয়ার জায়গাটা যদি বড় হতো তাহলে হয়তো শীতের ভোরের আগ্রাগলির ধোয়াঁ ওঠা নাল্লি নেহারির হাঁড়িটাও নিতে হতো। (ও হ্যাঁ, র২হ বোধহয় বলেছিলেন ওটার ধ্রুবত্বের কথা। আহা মনের কথা। তাই আদিম যুগেও বোধহয় ছিলিম ছিল। নিয়ে যাওয়ার চাপ নিতে হতো না। :))  সুতরাং আমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছতো আধুনিক যুগ এমনকি মধ্যযুগ এমনকি আদিমতার যা কিছু উত্তরাধিকার আমি বহন করে চলেছি। এছাড়া আমার সঙ্গে যেত আমার ক্রমে বেড়ে ওঠা হিংসা-আমার দ্বেষ-আমার স্বার্থপরতা-প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার নির্দয় মানসিকতা যা আমার যুগ-যুগের অর্জন। বিশুদ্ধ নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে আমার সেখানে পৌঁছনো কোনো ভাবেই হতো না। তাহলে আমি কোথায় যাবো? আমি তো যেতে পারি একমাত্র আমারই বর্তমানে আর খুঁজতে পারি আমারই ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ যা প্রতিদিনই বর্তমান হয়ে যাচ্ছে আর তার পরেরদিনই ইতিহাস। আর দেখছি এই বিপুল অনাবিল ক্রিয়ার অনিন্দ্যসুন্দর অধিত্যকাটিকে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে, প্রগ্রেস ফর প্রগ্রেস নামের প্রবল পুরুষকারের সশক্ত মনোলিথ উঁচিয়ে সর্বদাই নাকি এগিয়ে চলেছি - এই ধারণার এক প্রলয়ংকর স্রোত। এই অসম্ভব স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি আমার নিদারুন খর্বত্ব স্বীকার করে নিচ্ছি। তবু কোনো এক বোধ কাজ করে। আমি ক্রমাগত আহত হতে হতে আমার ক্ষমতানুযায়ী এই ভীষণ স্রোতটাকে প্রানপণ প্রশ্ন করতে পারি -ওহে স্রোত, তুমি আমাদের নিয়ে এগিয়ে তো চলেছ, কিন্তু কোনদিকে এগিয়ে চলেছো? বাসের কন্ডাকটর ক্রমাগত হেঁকে চলে - পেছনের দিকে এগিয়ে চলুন! পেছনের দিকে এগিয়ে চলুন! একরাশ মানুষ পিলপিল করে আমাকে নিয়েই পেছনের দিকে সেঁধোতে থাকে। সেই সব মানুষের ফাঁক গলে আমি অন্য কোনো জায়গার জন্য হাঁকপাঁক করতে থাকি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি প্রানপনে একটু আকাশ দেখতে চাই। কিন্তু ততক্ষনে পেছনের দিকে ভয়ঙ্কর গতিতে এগোতে থাকা পিলপিলে স্রোত আষ্টেপৃষ্ঠে অক্টপাসের মতো আমাকে জড়িয়ে ফেলেছে। আমি কী-ই বা করতে পারি! 

    'আলো –অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
    স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে !
    স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
    হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
    আমি তারে পারি না এড়াতে,
    সে আমার হাত রাখে হাতে;


    বলতেই পারেন এ কে রে! সাহিত্য মারাচ্ছে! যুক্তি ফুক্তির ধার কাছ মাড়ায় না। শুধু প্রলাপ আর প্রলাপ! 

    ও হ্যাঁ! ওই প্রতিপ্রশ্নটা! কোথায় ফিরে যেতে চাই! আমার বাবা ছিলেন মফস্বলের যুক্তিবাদী সমিতির এক অতি সাধারণ সংগঠক। প্রবীর ঘোষ-রাজেশ দত্ত-মরুৎ দেবের বইপত্র, ভস্তক আর রাদুকা পাব্লিকেশন, চাকা আবিষ্কারের কাহিনী, চাঁদের পাহাড়-লিভিংস্টোন, রাহুল সাংকৃত্যায়নএর বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ এবং আমার বাবার সদাসতর্ক যুক্তি-পাহারার পরিবহেই কেটেছিল আমার ছেলেবেলা। ডাকযোগে সোভিয়েত লিটারেচার বলে সুন্দর গন্ধওয়ালা দামি তেলতেলে কাগজের একটা পেটমোটা পত্রিকা আসতো। সেটারই একটা সংখ্যার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল সোভিয়েত পোস্টার আর্ট। তাতে ছাপা দুটো পুরো পাতা পোস্টার আমি এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই। একটায় এক সোভিয়েত মহাকাশযান মহাকাশে ছুটে চলেছে। আর তার জানলায় হাসি হাসি মুখে বসে রয়েছে লাইকা। এই পোস্টারটা ছিঁড়ে নিয়ে আমি দেওয়ালে সাঁটিয়েছিলাম। (তখনো জানতাম না যে বৈজ্ঞানিক প্রগতির স্বার্থে হাসি হাসি মুখের ছোট্ট লাইকার আর এই পৃথিবীতে কখনোই ফিরে আসা হয়নি।) আরেকটা পোস্টারে কমরেড লেনিন আঙ্গুল তুলে সামনের দিকে দিক নির্দেশ করছেন। নিচের দিকে আঁকা ভারী শিল্পের কারখানার সারি। তার অজস্র চিমনি থেকে গলগল করে বেরিয়ে আকাশ ভরিয়ে দিচ্ছে দর্পিত কুজঝটিকার মতো ধোঁয়ার কুন্ডলি। উপরে বড় বড় করে লেখা NEP . আমি প্রগতিকে আঁকড়ে ধরতে শিখলাম। প্রগতির পথে অপ্রাসঙ্গিক সবকিছুকেই ছেঁটে ফেলতে শিখে গেলাম। এরপর যখন বহুদিন পরে একদিন কলকাতা থেকে মফস্বলের বাড়িতে এলাম, দেখলাম যে পুকুরটায় আমি দাপিয়ে বেড়াতাম, যার তলার পাঁকে লুকিয়ে থাকা শোল-বোয়াল অনায়াসে পায়ের পাতায় খেলিয়ে বেড়াতে পারতাম, তার জলে এবার আমি আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি, আমার গা গুলিয়ে উঠল। পুকুরে আর কোনোদিনই নামতে পারলাম না। মুথাঘাসে ঢাকা যে পুকুরপাড়ের পিছনে জমিতে আমি হলুদ প্রজাপতিটার পেছনে পাগলের মতো দৌড়োতাম, সেই স্যাঁতস্যাঁতে কাদা কাদা জমিতে পা দিতে আমার ঘেন্না হলো। আমি কলকাতায় ফিরে দেওয়ালের হুকে ওডোনিল টাঙিয়ে ইফ আর দেন-এর চার দেওয়ালি হিসেবে থিতু হলাম। এরপর বহুদিন পর একদিন এক ছোট্ট মেয়েকে কাঁধে চাপিয়ে আলিপুর চিড়িয়াখানায় পৌঁছলাম দারুন চমক দেব বলে। কিন্তু ছোট্ট মেয়ে আমাকে অবাক করিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। হাপুস নয়নে ভাঙা আধো গলায় বললো - একি! এদের খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে কেন? আমার পিঠ দিয়ে হঠাৎ একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি প্রানপনে দৌড় দিলাম। কিন্তু পুকুরপাড়ে পৌঁছতে বড় দেরি হয়ে গেল। মুথাঘাসের বাস্তুতন্ত্র চাপা পরে গেছে সদ্য মাথা উঁচানো শপিং মলের নিচে। শপিং মলের স্বয়ংক্রিয় দরজা দিয়ে যাতায়াত করছে কোলাহলরত আধুনিক নরনারীর দল। তাঁদের ফাঁক দিয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মৃত্যুশিতল ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক এসে লাগল আমার গালে। হলুদ প্রজাপতিটা মরে গেছে। বলুন, ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়? 

    ফিরবো বললে ফেরা যায় নাকি
    পেরিয়েছো দেশ কাল জানো নাকি এ সময় 


    এই প্রতিপ্রশ্নটার মুখোমুখি বারবার হতে হয়। শুধু এখানে নয়, সর্বত্র। এটা কি এইজন্য যে যখনই আত্মসমর্পনের বদলে কেউ মূলস্রোতকে প্রশ্ন করে ফেলে তখনি তার জন্য এই আইডিয়ালাইজড অসম্ভাব্যতার ফাঁদ পাতা হয়!  
    যেমন খুব রিসেন্ট একটা ফেনোমেননের কথা বলি। ১৯৭০ থেকে ২০২২ - এই মাত্র পঞ্চাশ বছরের সময়ে পৃথিবীর ৬০ শতাংশ বন্যপ্রাণী চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা গেছে। মানুষের প্রেক্ষিতে এই হিসেবটা সারা উত্তর আমেরিকা-দক্ষিণ আমেরিকা-আফ্রিকা-ইউরোপ-ওসেনিয়ার জনসংখ্যার সমান। এবার আমি যদি প্রশ্ন করি এ কোন প্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? যদি বলি এই পঞ্চাশ বছরে আমরা যা ধ্বংস করে ফেলেছি, তার প্রাকৃতিক পুরুদ্ধারে অন্তত ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন বছর লাগবে; আমাদের প্রগতি ধারণায় বড়োজোর ১০০-২০০ বছরের ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার মায়োপিক দৃষ্টি দিয়ে সেই ক্ষতির মাপ অনুধাবন করতে আমরা সক্ষম তো? যদি বলি এই বিপুল নিশ্চিহ্নকরণের বিনিময়ে কেবলমাত্র মানুষের লাইফ এক্সপেক্টেন্সি বেড়ে চলাটাকে আমার অশ্লীল বলে মনে হয়; সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপ্রশ্ন ধেয়ে আসবে - তবে কী বাপু তুমি বনমানুষে ফিরতে চাও? 
    আমার অতি প্রিয় যে সিডিগুলোর কথা বলেছিলাম , সেই সিডিগুলো এখন আর শোনার উপায় নেই। কারণ চালানোর মতো ডিভাইস আর বাজারে পাওয়া যায় না। এই যে প্রতিদিনই সদ্য নতুন প্রযুক্তিগুলি প্রতিস্থাপিত হয়ে চলেছে আরো নতুন প্রযুক্তির জোয়ারে, প্রতিদিনই পুরোনো মোবাইল ফোনের মডেলটি পরিত্যক্ত হচ্ছে আর হাতে উঠে আসছে নতুন মডেল, যদি বলি এই প্রগ্রেস ফর প্রগ্রেস কিসের বিনিময়ে? একবার চোখ মেলে দেখুন কঙ্গোর গর্ভ ফাঁক করে চলতে থাকা, মোবাইল ফোনের ম্যানুফ্যাকচারিংএ ভীষণ প্রয়োজনীয় যে কোল্টন; সেই কোল্টন মাইনগুলোর অন্দরে। খোঁজ নিয়ে দেখুন সেখানে যে শিশু-কিশোর শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয় তাদের জীবন ও ওয়ার্কিং কন্ডিশন দাসপ্রথার থেকে কোনও অংশেই উন্নত নয়। এবার যদি আমি বলি, এই মুনাফাকেন্দ্রিক নৃশংসতার বিনিময়ে আমি আমার ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল শোনার স্বার্থপর শখটি চালিয়ে যেতে চাই না, আমি এই প্রগতির এই নৃশংস রূপটিকে নাকচ করি, তবে আবার প্রতিপ্রশ্ন ধেয়ে আসবে - বাপু হে, তুমি কি তাহলে শাখামৃগ হয়ে ল্যাজ নাড়িয়ে কচিপাতা চিবুতে চাও? 
    আমার অর্ধাঙ্গিনীর গবেষণা সূত্রে মরুভূমির একজন অসাধারণ দরিদ্র শিল্পীকে চেনার সুযোগ হয়েছিল, যিনি বংশপরম্পরাগত মান্দনা আর্টে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর অসামান্য কল্পনার জগৎ। তখনো তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দশ বছর পরে তাঁকে আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে দিল্লির এক গলিতে আবিষ্কার করি। তিনি তখন সিমেন্ট-কালি-ঝুলি মাখা রিয়েল এস্টেট শ্রমিক। সেদিন আমরা আসলে এক গ্রামীণ শিল্পীর বদলে একটি শবদেহ আবিষ্কার করেছিলাম যা ছিল শিল্পকৃতি-দক্ষতা ও কল্পনার অনুপম পৃথিবী থেকে নির্বাসিত উন্নতির হাড়িকাঠে বলিপ্রদত্ত বিচ্ছিন্ন শ্রমের এক করুণ একক মাত্র। এবার আমি যদি বলি, এই প্রবল অবমানবায়নের প্রগতি আমি চাই না; সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপ্রশ্ন ধেয়ে আসবে - তবে কি তুমি সবচেয়ে প্রাচীন বনমানুষটি হয়ে সবচেয়ে প্রাচীন বৃক্ষটির মাথায় গিয়ে বসতে চাও? 
    আর উদাহরণ বাড়াতে চাই না। সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্ট দিতে পারার মতো যোগ্যতা আমার সত্যিই নেই। কিন্তু পৃথিবীতে অসাম্য যে কী হারে বেড়ে চলেছে, জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা যে কী হারে বেড়ে চলেছে, আসলে যে একটা বিশাল সংখ্যার মানুষ ভালো নেই. সেটা বোঝার জন্য ফ্যাক্টশিটের পাহাড় বানানোর দরকার পড়ে কি? একটু প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ, একটা সংবেদনশীল মন নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি, একটু সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশামেশি করলেই সেই জানাটা কঠিন নয়। 
    যাই হোক, এই আইডিয়ালাইজড অসম্ভাব্যতার ফাঁদ কেন পাতা হয়? প্রতিপ্রশ্নকর্তারা কি ডায়ালেক্টিক্স বোঝেন না? খুব বোঝেন। কিন্তু তবু তাঁরা এরকম প্রতিপ্রশ্ন কেন করেন? আসলে বোধহয় তাঁরা জেনেশুনেই প্রশ্নটাকে বাইনারিতে নিয়ে ফেলতে চান। ইফ তুমি আধুনিকতাকে প্রশ্ন করো দেন তুমি নিশ্চয়ই তেলপড়া জলপড়ায় বিশ্বাস করো। যে যুক্তিতে আদিম শিকারী সমাজ (এখনো মুন্ডাদের মধ্যে প্রচলিত, আমার নিজের অভিজ্ঞতা) মাদী পশুদের শিকার করা থেকে বিরত থাকতো, সেই মিথস্ক্রিয়ার যুক্তিকে শয়ে শয়ে গবাদি পশুকে কনভেয়ার বেল্টে মুড়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিফ-পোর্ক-হ্যামে পরিণত করে ফেলার যুক্তি যে পশ্চাদপদ বলে দাগিয়ে দেবে তাতে সন্দেহ কী? আমার মতে এইটাই ইউরোসেন্ট্রিজমের সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রবণতা। এই ইউরোপীয় সভ্যতাই পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত বস্তুর জন্য শেষ কথা আর বাকি সব কিছুই বর্বর পিছিয়ে থাকা - এই ধারণাটির হেজেমনিকে সর্বত্র গুঁজে দেওয়ার হোয়াইট ম্যান'স বার্ডেনটিকে প্রতিপ্রশ্নকারীরা যেন নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নিজেদের প্রগতির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন যে কোনো সম্ভাবনাকে সমূলে নিধন করার উদ্দেশ্যে প্রথমেই তাকে রিগ্রেসিভ বলে দাগিয়ে দিতে তাঁরা যেন সদা উদ্যত। প্রতিপ্রশ্নটি কিছুতেই এমত হবে না - তা হে বাপু , আধুনিকতাকে প্রশ্ন করে তুমি কোথায় এগিয়ে যেতে চাও? না, তাঁরা তা বলবেন না। তাঁরা আসলে আধুনিকতার আড়ালে পুঁজিবাদের অনিবার্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করে চলবেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের সাম্যবাদী বলে পরিচয় দেন তাঁরাও এই ক্ষয়াটে যুক্তিটি অর্থাৎ আগে পুঁজিবাদ তবেই সমাজতন্ত্রে পৌঁছনো যাবে - এই আপ্তবাক্যটিকে শিরোধার্য করে পুঁজির যুক্তিকেই সর্বমান্য যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন। এবং এই করতে গিয়ে তাঁরা ভুলে যাবেন যে স্বয়ং মার্ক্স তাঁর শেষদিকে বহুবার সামন্ততন্ত্র থেকেই সাম্যবাদে সরাসরি উত্তরণের কথা বলেছেন যেখানে মাঝখানের ধাপ হিসেবে পুঁজিবাদকে অনিবার্য বলে মার্ক্সের মনে হয়নি। তাই বলাই বাহুল্য প্রতিপ্রশ্নটি কিছুতেই এমত হবে না - তা হে বাপু, আধুনিকতাকে প্রশ্ন করে তুমি কোথায় এগিয়ে যেতে চাও? 

    মুষ্কিল হচ্ছে একধরণের কেঠো যুক্তিবাদ শুধুই ফ্যাক্টশিট চেয়ে বসে। বোধ-ফোধ সব তার কাছে বাতিল রোমান্টিক ব্যাপার। তাই একটা গল্প বলি। ১২০০ বিসি নাগাদ বিসমার্ক আর্চিপেলাগো থেকে কৃষি, মৎস্যশিকার ও সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্ত একটি মানবগোষ্ঠী পলিনেশিয়ান দ্বীপপুন্জে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে থেকে একটি দল নিউজিল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছয়। এরা হল মাওরি। আরেকটি প্রশাখা একই সময়ে চ্যাথাম আইল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে। এরা ছিল মোরিওরি। এবং তারপরের প্রায় পাঁচ শতক তারা একে অপরের থেকে যোগাযোগহীন থাকে। মজার ব্যাপার, একই আনসেস্ট্রি থেকে আসা দুটি মানবশাখা দুটি বিপরীত অভিমুখে এগিয়ে চলে। মাওরিরা আরো জটিল সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে। তারা আরো আধুনিকতর অস্ত্রশস্ত্রে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মোরিওরিদের ক্ষেত্রে হয় ঠিক উল্টো। তাদের সমাজ আরো সরল হয়ে আসে। তারা যুদ্ধাস্ত্র বানানো থেকে বিরত হয়ে যুদ্ধের ধারণাটিকেই নিজেদের সমাজ থেকে বাতিল করে ফেলে। চ্যাথাম আইল্যান্ডের পর্যাপ্ত রসদের সাস্টেনেবল ব্যবহারের ফলে তাদের কৃষির প্রয়োজনটুকুও চলে যায়। শিকারের উপায়ও হয়ে আসে তাদের দক্ষতানির্ভর কিন্তু অতি সরল। প্রায় খালি হাতেই অথবা অত্যন্ত সরল উপায়ে তারা শিকার করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে তারা ফিরে যায় বহু বহু সহস্রাব্দ আগের শিকারী-কুড়ুনি যাপনে। এখানে এসে আবার কেন জীবনানন্দ এসে ভর করেন আমার মাথায়?  

    সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
    কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
    সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
    কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
    কে জানিতে পারে আর?
     

     
    আধুনিকতার যুক্তিবাদ যদি এই প্রতিপ্রশ্নটি করতো - তা হে বাপু , আধুনিকতাকে প্রশ্ন করে তুমি কোথায় এগিয়ে যেতে চাও? তখন আমি মোরিওরিদের এই উদাহরণটি সামনে আনতে পারতাম। আমি বলতে পারতাম ফিফ্থ সিম্ফনির থেকে বর্বর আফ্রিকার লোকসংগীতও কোনও অংশে কম নয়। (জ্যাজ ও ব্লুজ তা সপাটে প্রমাণও করে দেখিয়েছে।) সুতরাং আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন-দুনিয়ায় দুটোই থাকুক সমান ভাবে। আমি বলতে পারতাম আমাকে পশ্চিমি আধুনিকতা থেকে কেন সাম্য মৈত্রীর পাঠ নিতে হবে, আমি তো বুদ্ধ-চৈতন্য-কবির-সন্ত রবিদাসের থেকেই তা শিখতে পারি। আমি বলতে পারতাম আমাকে পশ্চিমি আধুনিকতা থেকেই কেন ধর্ম নিরপেক্ষতার পাঠ নিতে হবে, আমি লালন ফকিরের থেকেই তা শিখতে পারি। আর সেই পাঠের ধারাবাহিকতা আমার প্রার্থিত ভবিষ্যতের পথে বয়ে নিয়ে যেতে চাইতে পারি।  আমি বলতে পারতাম আমি আমার কাঙ্খিত ভবিষ্যতে সম্পদের প্রতি উদগ্র লোভের অবিশ্ব নিয়ন্ত্রণকে বিলুপ্ত দেখতে চাই। আমি বলতে পারতাম এলন মাস্কের মঙ্গলগ্রহকে ঘিরে মাল্টি-প্লানেটারি ভবিষ্যৎ আমার চাই না। আমি এই পৃথিবীটাকেই প্রানপনে বাঁচিয়ে রেখে ভালোবেসে যেতে চাই। কিন্তু প্রতিপ্রশ্নটি তা করে না। দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে সে অন্য সমস্ত সম্ভাবনাগুলোকে মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিয়ে একটি আইডিয়ালাইজড অসম্ভাব্যতায় নিয়ে যেতে চায়।  

    যাই হোক গল্পটার শেষটা বলি। অস্ট্রেলিয়ার এক সিল শিকারী জাহাজ নিউজিল্যান্ডের ভূখণ্ডে একটি খবর বয়ে এনেছিল। 
    ... there is an abundance of sea and shellfish; the lakes swarm with eels; and it is a land of Karaka berry... the inhabitants are very numerous, but they do not understand how to fight, and have no weapons.   
    খবরটি যথেষ্ট ছিল। ১৮৩৫ এর ডিসেম্বরে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মাত্র  ৯০০জন মাওরি যোদ্ধা আক্রমণ করলো চ্যাথাম আইল্যান্ড। অনেক বেশি সংখ্যক মোরিওরি প্রতিরোধ করলে হয়তো মাওরিদের হারানো সম্ভব ছিল। কিন্তু মোরিওরিরা তা করেনি। শমন যখন তাদের শিয়রে, তখনও তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করেছিল শান্তির বিরুদ্ধে গিয়ে কোনোভাবেই তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। তার চেয়ে তারা মাওরিদের সঙ্গে রসদ ভাগ করে নিতেও রাজি ছিল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হল , খুব অল্পসংখ্যক মোরিওরি প্রাণে বেঁচেছিল যারা মাওরিদের দাসত্ববৃত্তিতে নিযুক্ত হল। 

    এইবার যদি বলেন এতো খেটেখুটে ছাইপাঁশ লিখলে ভায়া কিন্তু কিছুই তো দাঁড়ালো না, তাহলে বলবো কী আর করা! দাঁড়াতে যে সব সময় হবেই তার দিব্যি কে দিয়েছিলো! মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে পড়ায় কী আনন্দ সেটা অন্তত আর কেউ না হোক র২হ জানেন। :) স্কুলের মাস্টারমশাই আমার মেয়েকে আঁকার পরীক্ষায় একবার শূন্য দিয়েছিলেন। কারণ ছোট্ট মেয়েটি আকাশের রংটি করেছিল হলুদ আর মাটির বদলে তার বাড়িটিকে সে এঁকেছিল মেঘের মধ্যে। সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি - আধুনিকতার যুক্তিবাদ কি সেই শূন্য দেওয়া মাস্টারমশাই? 
       
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:০৮515393
  • guru,
     
    তথ্যগুলো খুঁটিয়ে অনুধাবন না করলে আলোচনা অর্থপূর্ণ হবে কীভাবে? ভাল করে দেখুন, পিকেটি বা মিলানোভিচ বা অক্সফ্যাম বা ম্যাডিসন --- এদের দেওয়া তথ্যে সামান্য গরমিল থাকতেই পারে, কিন্তু কোনওটাই অপরকে খারিজ করেনা। ব্রিটিশ আমলে অসাম্য বিভিন্ন সময়ে বেড়েছে এবং কমেছে। স্বাধীনতার পরে আশির দশক পর্যন্ত প্রায় একই ছিল বা কমেছে। তারপর নব্বই দশক থেকে লাগামহীন বাড়ছে, এবং আমরা এখনও সেই পর্যায়ের ভেতরেই আছি, এবং এই দশকের দ্বিতীয় শতক থেকে এ প্রক্রিয়া আরও গতি পেয়েছে। অতীতের বিভিন্ন স্থান ও কালে অসাম্য এর চেয়ে কম ও বেশি ছিল। আবার, এই আধুনিক কালেও বিভিন্ন জায়গায় এর চেয়ে কম ও বেশি অসাম্য আছে। ওপরে দেওয়া তথ্যগুলো ভাল করে দেখলে এ জটিল সত্য ধরা পড়বে। তখন হয়ত 'আধুনিকতা মানেই অসাম্য' গোছের লোভনীয় ও অপুষ্টিকর সরল-সিদ্ধান্ত এড়াতে পারবেন।
     
    অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসন বা পিকেটি বা মিলানোভিচ যে গবেষণা করেছেন তার পেছনে কোনও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত থাকতেই পারে, নিশ্চয়ই আছে, সব গবেষণাতেই তো থাকে! কিন্তু, শুধু ওইটুকুর জন্যই যদি তাঁর কাজকে নস্যাৎ করেন, তাহলে ওই একই যুক্তিতে পৃথিবীর সব আবিষ্কারই তো নস্যাৎ হয়ে যাবে, তাই না? সেইজন্যেই, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে, 'কনটেক্সট অফ ডিসকভারি' থেকে 'কনটেক্সট অফ জাস্টিফিকেশন' আলাদা করতে হয়, না হলে সবই ঘেঁটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ম্যাডিসন ইত্যাদিরা যে কাজ করেছেন তাতে কোথাও ভুলচুক আছে বলে যদি মনে হয়, বা অন্য কোনও গবেষক তেমনটা প্রমাণ করেছেন বলে যদি জানা থাকে, তাহলে নির্দিষ্ট তথ্য-যুক্তি সহকারে সেইটা সোজাসুজি আলোচনা করাই তো ভাল। উড়ো কতাবাত্রা কয়ে কী লাব মোয়ায়!
     
    আপনার আবিষ্কৃত বা প্রস্তাবিত রাশিটি খুব কাজের জিনিস হতেই পারে, তবে তা মূল্যায়ণের ক্ষমতা বা অধিকার কোনওটাই আমার নেই। সম্ভবত ইকোনোমেট্রিক্স-এর কোনও বিশেষজ্ঞ আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। 
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:১১515394
  • ওপরে নবম লাইনে 'এই শতকের দ্বিতীয় দশক' হবে‌। লেখার সময়ে উল্টে গেছে।
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:১৪515395
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    না, আপনার কথাগুলোকে আমি পার্সোনালি নিচ্ছি না, বরং এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন হাজির করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদই দেব। যতটা পারি, আপনার কথাগুলো নিয়ে গুরুত্ব সহকারে এবং নৈর্ব্যক্তিকভাবেই আলোচনা করার চেষ্টা করব। অনুরোধ, আপনিও আমার কথাগুলোকে পার্সোনালি নেবেন না। কথোপকথন চলুক, এবং যথাযথ মর্যাদা সহকারে চলুক, এটাই চাই।
     
    ব্যস্ত আছেন যখন, কিছু সময় নিশ্চয়ই মঞ্জুর করতে পারবেন আমার জন্ম। 
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:৩৫515396
  • মানে, "কিছু সময় নিশ্চয়ই মঞ্জুর করতে পারবেন আমার জন্য।" ফোনে টাইপ করার কি জ্বালা রে বাবা! 
  • guru | 115.187.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:০৮515397
  • @দেবাশীষ বাবু ,
     
                            অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপনার ফিক্শন লেখা গুলো শেয়ার করবার জন্য | আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন কিছু কালজয়ী সাহিত্যিকের সায়েন্স ফিক্শন গল্প অনুবাদ করে এই নতুন জগৎটির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়ে | অনেক ধন্যবাদ |
     
    কিন্তু আপনি আর কি সম্প্রতি এরকম কিছু লিখছেননা ? বেশ কিছুদিন গুরুর লিস্টে শুধু আপনার থেকে প্রবন্ধ দেখছি কিন্তু ফিক্শন বা ছোট গল্পের অনুবাদও খুব একটি দেখছিনা | আপনি কি আর লিখছেননা এখন ফিক্শন ?
     
                           আরেকটি প্যাটার্ন এখন দেখছি আজকাল সাইন্স ফিক্শন গল্পের থেকে হরর গল্পের চাহিদা অনেক বেশী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে | এই লোকডাউন পিরিয়ডে দেখলাম হরর গল্পের অনেক YouTube চ্যানেল বেশ ভালো কাজ করে নিলো | রে ব্রাডবারি আসিমভ ক্লার্কের থেকে HP লাভক্রাফ্ট বা রবার্ট ব্লচ অনেক বেশি জনপ্রিয় |  হরর গল্পে কিন্তু আপনি যাকে অবৈজ্ঞানিক উপাদান বলছেন সেসবও অনেক থাকে আজকাল | মানুষ কি তাহলে কল্পবিজ্ঞানের থেকে বেশী করে ঝুঁকছে হরর গল্পের এইসব উপাদানের দিকেই  ? এটা কেন হচ্ছে আপনি কি বলেন আপনার বিপুল অভিঞ্যতা থেকে ?
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৮515399
  • guru,
     
    আমার কল্পবিজ্ঞান-সংক্রান্ত লেখাগুলো পড়ে দেখার যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন, অনেক ধন্যবাদ। না, সত্যিই নানা ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত থাকায় এখন আর ও নিয়ে কিছু লিখিনি বহুদিন। তবে, জিনিসটা যখন ভাল লাগে, বেশিদিন ছেড়ে থাকতে পারব বলে মনে হয়না। একটু হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু আবার ফিরব ওখানে। 
     
    এক সময় তো ফিকশন খুবই পড়তাম, এখন আর সুযোগ পাইনা সেভাবে। ভাল মানের হরর ভালই লাগত। ওগুলোর রসগ্রহণ করতে গেলে কাণ্ডজ্ঞানকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি দিতে হয়, ইংরিজিতে যাকে বলে 'উইলিং সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ'। যে রকম মন নিয়ে আমরা মিকি মাউসের কার্টুন দেখি বা রূপকথা পড়ি, অনেকটা সেই রকম। কিন্তু, সাহিত্যের একটা নিজস্ব আভ্যন্তরীণ যুক্তি-কাঠামো আছে, সেটাও নস্যাৎ হয়ে গেলে জিনিসটা বাজে হয়ে যায়। হরর থিম কল্পবিজ্ঞানেও হয়। সে সব ঠিকঠাক লিখতে অনেক এলেম লাগে, বাংলায় খুব কম লোকেরই আছে। নামী লোকেরা এত খারাপ লেখেন, খুব হতাশ লাগে। আবার খুব ভাল লিখেছেন অথচ প্রায় কেউই তাঁর নাম শোনেননি, কোনও নামী প্রকাশনা এগিয়ে আসেনি, এমনও দেখেছি, সেও কম হতাশার কারণ নয়। 
     
    বাংলায় তন্ত্রমন্ত্র গোত্রের হরর খুব ছাপা হচ্ছে সম্প্রতি, এমন খবর কানে আসে, কিন্তু সেভাবে পড়ে দেখা হয়নি। সেগুলো খুব ভাল না হওয়া সত্ত্বেও নাকি অনেক বিক্রি হচ্ছে, এই রকম শুনেছি। বাঙালি পাঠকের কথা ভেবে একটু কষ্টই হয়। ইংরেজি সাহিত্য অনেকেই ভাল পড়তে পারেন না, বা পারলেও পড়ে সেই আরামটা পান না, আর ইংরেজি বইয়ের দামও বেশি, ফলে আন্তর্জাতিক মানের ভাল লেখা বেশির ভাগ বাঙালি পাঠকেরই অধরা। লেখক আর প্রকাশকরা যদি ভাল লেখা সরবরাহ করতে না পারেন, তারা বুঝতেই পারবে না যে কী মিস করছে, আর নিকৃষ্ট বস্তুর পেছনেই ছুটবে। কী আর হবে! 
     
    ইউটিউবে কিন্তু ইংরিজিতে ভাল ভাল শর্ট মুভি প্রচুর আছে, হরর আর সাই ফাই দু ধরনেরই, দেখেছেন? মাঝে মাঝে দেখি, সময় পেলে। সবগুলো ভাল লাগেনা, কিন্তু কয়েকটা বেশ ভাল! 
  • guru | 115.187.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৮515400
  • @দেবাশীষ বাবু 
     
                       আপনি কাইন্ডলি ইংরিজিতে ভাল ভাল শর্ট মুভি হরর আর সাই ফাই দু ধরনেরই একটু ইউটিউবের লিংকস দিলে খুবই ভালো হয় | আমি ভালোই বাসি কর্মব্যাস্ত জীবনে একটু সময় নিয়ে এসব দেখতে | ইংরেজি বই এর মধ্যে রাসকিন বন্ড , MR জেমস আলজেরনণ ব্লাকউড ট্রাই করে দেখতে পারেন |
     
    "আবার খুব ভাল লিখেছেন অথচ প্রায় কেউই তাঁর নাম শোনেননি, কোনও নামী প্রকাশনা এগিয়ে আসেনি, এমনও দেখেছি, সেও কম হতাশার কারণ নয়। "  
     
    এইরকম কয়েকটি লেখা লিংক শেয়ার করবেন প্লিজ ?
  • একটা প্রশ্ন  | 165.225.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:২৩515406
  • 'আধুনিকতার খোঁজে'র জন্য প্রশ্ন ছিল, সামান্য। 
    এই যে দুনিয়াজোড়া আট বিলিয়ান লোক - আপনার প্রস্তাবিত জীবন কি তাকে ধারণ করতে, মানে খাওয়াতে পড়াতে, সমর্থ? 
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 110.227.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:২২515407
  • @একটা প্রশ্ন 
    যদ্দুর মনে হয় আমার প্রস্তাবিত জীবন আকারে আমি কিছু পেশ করিনি। সেরকমটা করার জন্য যে প্রাজ্ঞতা দরকার তা আমার মতো সামান্য মানুষের নেই। আরো অনেকেরই মতো আমিও কেবল আমার সমকালের (অবশ্যই সেটা আধুনিক কাল) রাজনীতি-অর্থিনীতি-সমাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে যে দর্শন, তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাইছি। তার কোনও কোনও দিককে নেগেট করতে চাইছি। তার পরিবর্ত খুঁজতে চাইছি। সেটুকু অধিকার বোধহয় আমার থাকে। 
    আর খাওয়া-পরার কথায় মহাত্মা গান্ধীর একটা কথা মনে পড়ে গেল। “There are sufficient resources on this planet to answer the needs of all, but not enough to satisfy everyone’s greed.”  
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 110.227.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:২৫515408
  • @দেবাশীষবাবু 
     
    অবশ্যই। আপনি আপনার যথাসময়ে বলবেন। 
  • মহাত্মা গান্ধীর একটা কথা | 165.225.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:২৬515410
  • ইয়ে, সে সময় দেড় বিলিয়ন মানুষ ছিল দুনিয়ায়। 
    জাক্সটাপোজিসানটা বললে তো সবাই বলবে - হয়ত আমিও, যেহেতু আলোচনাটা সত্যি ভাল লাগছে - ফাজিল পাবলিক, মস্করা কচ্ছে! 
    কিন্তু সত্যি, কিছুতেই ভেবে পাই না, আজকের বিজ্ঞানের ধারেকাছে কি চরকা কেটে যাওয়া যেত? মানে, ঐ ধারণার মধ্যে কোথাও বিজ্ঞানমনস্কতা ছিল? 
    ডিঃ দেখুন, আর কিছুতে বিশ্বাস করি আর না করি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিকে ঘোর বিশ্বাস করি।  
     
  • তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাইছি | 165.225.***.*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:২৮515411
  • সেটা তো মানতেই হচ্ছে 
  • ন্যাঃ | 2405:8100:8000:5ca1::1e:***:*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৬515412
  • হিরোসিমা বা জোশীমঠের ধারেকাছে চরকা কেটে যাওয়া যেত না।
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৫৩515413
  • guru,
     
    রাস্কিন বন্ড পড়েছি, অন্য যাঁর কথা বলেছেন তাঁর লেখা পড়িনি। অন্য অনেকের লেখাও পড়েছি।
     
    খুব ভাল কল্পবিজ্ঞান লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন অথচ কোনও বড় প্রকাশনা প্রকাশ করেনি --- এ রকম একজন হলেন সলিল বিশ্বাস। পরবর্তীকালে তিনি এ সব ছেড়ে দিয়ে বয়স্ক ও অপ্রথাগত শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে এবং লিখতে থাকেন। তেমন লেখা বোধহয় গুরু-তেও লিখেছেন, কিন্তু কল্পবিজ্ঞান আর লেখেন নি। একেবারে শেষের দিকে এ নিয়ে আবার উৎসাহী হয়েছিলেন, এবং কিছু আলোচনাসভায় অংশ নিয়েছেন, কিছু লেখালিখি করেছেন। হয়ত আরও কিছু লিখতেন, কিন্তু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। চারনম্বরপ্ল্যাটফর্ম-এ গোটা দুয়েক লিখেছিলেন, লিঙ্ক দিচ্ছি। 
     
    আর, ওঁর প্রায় সবগুলো গল্প, অনুবাদ ও একটি বড়সড় প্রবন্ধ নিয়ে একটি গোটা বই প্রকাশিত হয়েছে 'ঋতাক্ষর' থেকে, নাম 'খোয়াবওয়ালা ও আরো বারো'। দেখতে পারেন। 
     
    ইউটিউবে সাই-ফাই এবং হরর শর্ট মুভির লিঙ্ক-ও নিচে দিচ্ছি। 
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:১০515414
  • guru,
     
    সোয়া দুই মিনিটেরও কম এই সাই-ফাই শর্ট-টা দেখুন, আমার মতে অসাধারণ। 
     
  • আধুনিকতার খোঁজে | 2402:3a80:1cd3:8904:fa60:2bf0:32dc:***:*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:১৫515415
  • @একটা প্রশ্ন 
    আপনার কাছে আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন  - 
    চরকা কাটাকে কি আপনি অপবিজ্ঞান বলে মনে করেন? 
     
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:১৯515416
  • guru,
     
    এই নিন একটা মিনিট দশেকের হরর শর্ট মুভি। আমার মতে, চমৎকার নির্মাণ।
     
  • Debasis Bhattacharya | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৩515417
  • guru,
     
    'DUST' ভাল এবং নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান শর্ট মুভি বানায়, আর 'ALTER' বানায় হরর। খোঁজ করে দেখতে পারেন। অবশ্য, যে দুটো দিলাম তার একটাও ওদের বানানো নয়। 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 2402:3a80:1cd3:8904:fa60:2bf0:32dc:***:*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৭515418
  • দেবাশিসবাবু ও guru কে আমি একটা ছবির নাম বলতে পারি। Adam McKay র Don't look up. নেটফ্লিক্সে পাওয়া যায়। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন