২০১৮ সালে ইউরোপ উপকূল থেকে একটি বাচ্চা স্পার্ম তিমিমাছের মৃত্যুর খবরে ‘ইশশ’, ‘আহা’র বন্যা বয়ে যায়। জানা যায় যে তিমি মাছটির পেটে ভরা ছিল বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক ব্যাগ, জালের অংশ, বস্তা এমনকি জেরিক্যানও। বৈজ্ঞানিকদের অনুমান তিমি মাছটি না পেরেছে এই সব প্লাস্টিক শরীর থেকে বার করে দিতে, না পেরেছে সেসব হজম করতে। তার ফলে সম্ভবত পেটের প্রদাহ থেকে গ্যাস্ট্রিক শকে তার মৃত্যু হয়।
তবে টিভিতে, কাগজে ছবি দেখে ইসস বলা সহজ, তিমিশাবকটির অবশ্য এত ক্ষমতা নেই যে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক প্রোডাকশনের গ্রাফকে নিচের দিকে টেনে নামায়। তার ছবি দর্শকের মনে যতই আঘাত করুক না কেন! এই তিমিশাবকটি একা নয় কিন্তু, অনুমান যে বছরে প্রায় লাখখানেক তিমি, সীল ইত্যাদি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিকের কারণে মারা যায়, হয় ছেঁড়া জালের টুকরোতে জড়িয়ে ডুবে মরে, আর নাহলে এই বাচ্চা তিমিটির মতন কোন রকম শারীরিক শক পেয়ে। সেই সঙ্গে অনুমান লাখ খানেক সামুদ্রিক পাখি। তারা সমবেত ভাবে মানুষকে কাঠগড়ায় তুলতে পারে না, এই যা বাঁচোয়া।
আমরা ডাঙ্গার জীব, সমুদ্রের প্রাণীরা মারা গেলেও যতক্ষণ না আমাদের গায়ে মৃত্যুর ঝাপটা সরাসরি এসে লাগছে, ততক্ষণ আমরা নড়ে বসব কেন? না নড়ে বসতে চাইলে, কেউ অবশ্য জোর করছে না। কিন্তু মুষ্টিমেয় কেউ কেউ হয়ত বুঝবেন যে হয়ত অজানা শত্রু আমাদের দুয়ারেই হাজির।
শত্রুর নাম হল প্লাস্টিক। এমনিতে প্রচণ্ড দরকারি জিনিস। কিসে না লাগে! কিন্তু সমস্যা এইটাই যে প্লাস্টিক বলতে আমরা যে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য বুঝি, তাদের সবকটিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার কোন পকেটসই সুবিধাজনক পরিবেশ বান্ধব উপায় মেলে না। আবার সেটা এমনি ফেলে রাখলে প্রকৃতিতে মিশে যেতে অতি দীর্ঘ সময় লাগে। আর ততদিনে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সেটা ম্যাক্রো-প্লাস্টিক মেসো-প্লাস্টিক, মাইক্রো-প্লাস্টিক ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের চেহারা নেয়। ম্যাক্রোপ্লাস্টিক হল ২.৫ সেমির থেকেও দৈর্ঘে বা প্রস্থে বড় যে কোন প্লাস্টিকের টুকরো। ৫ মিমি – ২.৫ সেমি অবধি টুকরোকে বলে মেসো-প্লাস্টিক। আর মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হও ১ মাইক্রো মিলিমিটার থেকে ৫ মিলিমিটারের সাইজের প্লাস্টিকের কণা। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়েই আজকের কথা। কারণ আজকের দিনে এরা জলে স্থলে বাতাসে সর্বত্র ভেসে বেড়াচ্ছে। টেকনিক্যালি দেখলে রাসায়নিক দিক থেকে এরা সকলে অবশ্য এক নয়। পলিথিলিন বা পলিপ্রোপাইলিন বা পেট বা পিভিসি ইত্যাদি কোন রকমের প্লাস্টিকের থেকে তৈরি তার উপর নির্ভর করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গোত্র। তবে এক্ষেত্রে গোত্রে কি আসে যায়!
কেন মাইক্রোপ্লাস্টিককে বিপদ বলে ভাবছি? এক তো ভারতের অর্থনীতিতে প্লাস্টিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকার মোট ব্যবসা। ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালের আনুমানিক বার্ষিক বৃদ্ধি ৬.৬%। প্রচুর লোকের রুজি রোজগার জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। আবার এর মধ্যে মোটামুটি কুড়ি শতাংশের এদিক ওদিক এক্সপোর্ট হয়ে দেশের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত করে। প্লেক্সকনসিল (দ্য প্লাস্টিক এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল) সূত্রে পাওয়া যে সরকারি লক্ষ্যই হল ২০২৭ সালের মধ্যে এই বহির্বানিজ্যকে অন্তত আড়াইগুণ বাড়ানো। তাছাড়া নিজেদের জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, প্যাকেজিং থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বিলাস সামগ্রীর আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে সবেতেই প্লাস্টিক কিভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে। সহজে তাকে নিজের জায়গা থেকে নড়ানো যাবে না। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে যে প্লাস্টিক, ‘আপনি থাকছেন স্যার’। এদিকে সরকারি হিসেব মতে১, ২০২০-২১ সালেই (পরের বছরগুলির তথ্য মেলেনি) দেশে ৪১ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ বছরে ৪.২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে ২০২০-২১ সালের সরকারি তথ্য অনুসারে তৃতীয় স্থানে, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ুর ঠিক পরেই। এই সংখ্যাটাও বছর বছর বাড়ছে। অবশ্যই প্রথম সারির দেশের তুলনায় মাথা পিছু বিচারে কিছুই না এই সংখ্যাটা - আমাদের জনসংখ্যা বিপুল হওয়ায় সুবিধা। তবু সংখ্যাটা তো নিছক অঙ্কের দিক দিয়ে কম নয়। আরও সমস্যা হল আমাদের কথা আর কাজে খুব বেশি সামঞ্জস্য নেই। আর সরকারি হিসেব মতে এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের দুই তৃতীয়াংশ উৎপাদক কোম্পানির দায়িত্ব। তার পরেও এক তৃতীয়াংশের তো কোন হিসেবই নেই। বাস্তবে কি হয়? তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে কোম্পানিরও কিন্তু শুধু প্রসেসিং এর দায়িত্ব, কতটা সত্যি সত্যি কি হচ্ছে তার খবর সব কোম্পানি রাখে কি? এমনিতেও কতটা বর্জ্য কোম্পানি ফিরে পেল, সেগুলো কিভাবে প্রসেস করল, এই ধরণের কোন একাউন্টিং হয় কি? এই বর্জ্য যায় কোথায়? ব্যক্তিগত ব্যবহারের যে প্লাস্টিকের মগ, বালতি, ডাস্টবিন ইত্যাদি কিনি আমরা, সেগুলো কি উৎপাদককে ফেরত দেওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে? তার ব্র্যান্ড জিজ্ঞেস করলেই তো বিপদে পড়ে যাব! আর আমরা হেথায় হোথায় যেসব পুরোন প্ল্যাস্টিক ফেলে রাখি, বা সেসব জিনিস জঞ্জালের সঙ্গে ফেলে দিই, তার সামান্য অংশই বাস্তবে রিসাইকল হয়। বেশিটাই রোদে, জলে-বৃষ্টিতে পড়ে থাকে আর ক্ষয় হয়ে হয়ে মাটি-জল-বাতাসে মেশে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সেকেন্ডারি উৎস।
অবশ্য এছাড়া ব্যবসার জন্য আলাদা করে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি করাও হয়। সেটাই প্রাথমিক উৎস। ওই যে ফাঊন্ডেশনের টিউবটি আপনার ড্রেসিং টেবলে শোভা পাচ্ছে বা যে লিপস্টিক বা ফেস পাউডারটি ছাড়া আপনি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেন না, সেটি কি কি দিয়ে তৈরি আমরা আর কজন জানতে যাই? এই যে বিদেশে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে টিউবিং মাস্কারা এত জনপ্রিয়, সেই টিউবটি কিসের তৈরি জানেন কি? “বিট দ্য মাইক্রোবিড” ক্যাম্পেইনের মতে, মেবেলাইন কোম্পানির ৮৫% প্রডাক্টে মাইক্রোবিড ব্যবহার করা হয়। এমনকি আমাদের ঘরের পাশের ল্যাকমে কোম্পানির সানস্ক্রিন লোশন “সান এক্সপার্ট এস পি এফ ৫০ আলট্রা ম্যাট লোশন” এও মাইক্রোবিড মিলেছে। তবে এদেশে যেহেতু এইসব নিয়ে মানুষের মাথা-ব্যথা কম, তাই দেশজ ব্র্যান্ড নিয়ে এখানে মাথাব্যথাও কম। এদিকে বিশ্বজুড়ে কসমেটিকস কোম্পানিগুলোর সর্বমোট বাজার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাই এখানে মাইক্রোপ্ল্যাস্টিকের বহুল ব্যবহার চিন্তার বিষয় বৈ কি!
শুধু একা হরেক কসমেটিকসকে দায়ী করলে হবে না। বস্তুত ২০১৯ সালের নেচারে প্রকাশিত এক পেপারে২ জানানো হয়েছিল যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাধারণ সিনথেটিক জামাকাপড় বাড়িতে ব্যবহৃত ওয়াশিং মেসিনে কাচা হলে প্রতি কেজি কাপড়ে ১২৮ থেকে ৩০৮ মিলিগ্রাম মাইক্রোফাইবার বেরোয়। অবশ্যই কাপড়ের চরিত্রের উপর নির্ভর করে সংখ্যার এই হেরফের হয়। আর এই মাইক্রোফাইবারের একটা বড় অংশ আবার কোন অধুনা-প্রচলিত বর্জ্য-জল-শোধন প্রক্রিয়ায় আটকানো যায় না। ফলে সেসব সোজা গিয়ে পরিবেশে জমে। এই ডেটার থেকে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে বছরে যত মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, তার অন্তত ৩৫% আসে এই কাপড় কাচার থেকে। অবশ্য এই তথ্য মিলেছে ওয়াশিং মেশিনে কাচা কাপড় দিয়ে। এবার কেউ কেউ ভাবতেই পারেন যে ভারত উপমহাদেশে তো এখনও হাতে কাপড় কাচাই বেশি প্রচলিত। তাই বিপদ ওদের, আমাদের আর কি! কিন্তু আসলে সমস্যা আছে। কারণ সমুদ্রের জল আসলে কোন রাজনৈতিক সীমানা মানে না। আর দ্বিতীয়তঃ কাপড়ের থেকে মাইক্রোফাইবার ওঠে মেকানিকাল ও কেমিকাল স্ট্রেসের কারণে। হাতে কাচলে মেকানিকাল স্ট্রেস খানিকটা কম হলেও কেমিক্যাল স্ট্রেসের মাত্রার মনে হয় খুব হেরফের হবে না। আবার ধাই ধপাধপ কাপড় আছড়ে আছড়ে কাচলে কি হয় দেবাঃ ন জানন্তি। এছাড়াও ‘একবার কাচলে কাপড় আবার প্রায় নতুনের মতন হয়ে ওঠে’ এমন ধারার বিজ্ঞাপন দেওয়া বহু ডিটারজেন্ট বা ফেব্রিক সফটনার এর মধ্যেই মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক থাকে। ইউরোপের প্রচলিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অন্তত ১১৯ টা ব্র্যান্ডে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সে অবশ্য ইউরোপে বিধিনিষেধও কড়া, ফলে যে সব পদার্থ দিয়ে তৈরি তার সবিস্তার হিসেব প্যাকেটের উপর দিতে হয়। আমাদের অত নিয়মের কড়াকাড়ি নেই। আর ভারতের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে বিশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার হদিশও সহজে মেলে না। অন্য হাতে এক কনজ্যুমার রিপোর্ট৩ বহুল প্রচলিত ১২ টি ডিটারজেন্ট ব্রান্ডের তুলনামূলক পরীক্ষা করে জানিয়েছে যে এদের কোনটাতেই মাইক্রোবিড নেই। কাজেই বৈজ্ঞানিক ভাবে কেউ হাতে কাপড় কাচার পরের বেরোন জলকে পরীক্ষা না করে দেখা অবধি বা ব্র্যান্ডগুলির উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা না হওয়া অবধি আমরা এসব অমূলক ভয় বলে আপাতত নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাতেই পারি। আমাদের রোজের জীবনে অবশ্য গাড়ীর চাকা ইত্যাদি আরও অনেককিছু জানা-অজানা উৎস থেকেই নিয়ত প্লাস্টিক ক্ষয় হতেই থাকে।
তবে স্বস্তির জায়গা খুব একটা হয়তো নেই। এমনিতেই সমুদ্রের ধারে ধারে গবেষণা করে জানা গেছে পৃথিবীর ১৯২ টা উপকূলীয় দেশে যত প্লাস্টিক বছরে তৈরি হয়, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে গিয়ে জমা হয় উপকূল অঞ্চলে। আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর প্লাস্টিকজাত দূষণ-পদার্থ সমুদ্রের জলে ভেসে এসে জমা হচ্ছে। আবার ভিতর থেকে যেসব নদী বয়ে যাচ্ছে তারাও প্লাস্টিক দূষক নিয়ে গিয়ে ঢালছে। দুয়ে মিলে সুন্দরবনের অবস্থা করুণ হচ্ছে। আর আমাদের সাধের কলকাতার পাশের গঙ্গার জল নিয়ে পরিবেশবিদদের মাথা ব্যথা অনেকদিনই। সাম্প্রতিক গবেষণায়৪ তাঁরা হুগলি নদীর মিষ্টি জলের এলাকার (অর্থাৎ মোহনার কাছের নোনতা জল বা তারপরের মিশ্র জলের অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও উত্তরের অংশ থেকে) থেকে ১০ টি স্যাম্পল নিয়ে তার ভিত্তিতে পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে, সব কটি স্যাম্পলেই মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। সর্বোচ্চ মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে বালিখালের কাছে - ২০৬৯ টি টুকরো প্রতি মিটার কিউব মিষ্টি জলে। এঁদের সংগৃহীত তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমাদের আধা পরিশ্রুত বা অপরিশ্রুত বর্জ্য তরলই আসলে মিঠে জলের গঙ্গার জলের মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়াও অবশ্যই গঙ্গার ধারের বিভিন্ন কলকারখানার থেকে অন্য ধরণের জলদূষণও হয়। কিন্তু সেসব বলতে গেলে নিবন্ধের আকার শুধুই বাড়বে, তাই থাক সে কথা। জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কথা আগেই আগ্রা, হরিদ্বার, পাটনা এলাহাবাদ এসব জায়গায় নজরে এসেছে। কারোর কারোর মনে থাকতে পারে, কাগজে বেরিয়েছিল, ২০১৯ সালে পলতার জল পরিশোধন কেন্দ্রে মধ্যে ফিলটার করার জায়গায় মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল।৫ পাওয়া যাওয়ারই কথা। কারণ পলতার জল আসে গঙ্গার থেকে আর গঙ্গার জলই তো দূষিত। আর এটাও বুঝে নিতে কোন অসুবিধা নেই যে এখনও যেহেতু ফিল্টার করে সব মাইক্রপ্লাস্টিক আটকানো যায় না, তাহলে কিছুটা প্লাস্টিক শুদ্ধ জলই আমাদের বাড়ি বাড়ি এসে পৌঁছেছে। আমরা শোধিত জল জেনে সেই জলই পরমানন্দে পান করেছি। কিন্তু হায় এতকিছু জেনেও আমাদের ঘুম ভাঙ্গে না! বিপুল পরিমাণে প্রাত্যহিক বর্জ্য পরিশোধনের কোন মহতী পরিকল্পনাও নজরে এল কি? এই তো আমাদের অবস্থা!
অবশ্য জলের কথা বলছি যখন, তখন এই পৃথিবীর হাওয়া, মাটি কিছুই কি আর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ থেকে সংরক্ষিত? একেবারেই না। মাইক্রো প্লাস্টিক কণারা সহজেই হাওয়ায় ভেসে ভেসে দূর দূরে চলে যায়। অবশ্য কলকাতার ক্রমনিম্নমুখী হাওয়ার গুণগত মান গোটা পৃথিবীর মানুষের চিন্তার বিষয়। আর তাতে ভাসমান কণারা এতোই বিপজ্জনক মাত্রায় প্রায় সব সময়ই ঘুরে বেড়ায়, তাই সেটাই বড় চিন্তার বিষয়। আলাদা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। জাপানের বিজ্ঞানীরা অবশ্য শঙ্কা প্রকাশ করেছেন৬ যে বাতাসে ভাসমান কণাদের তো পিএম২.৫ মাপ দিয়ে মাপা হয় আর সেটাকেই স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক বলে ভাবা হয়, ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিক কণারা তার থেকে আকারে বড় বলে হয়ত তেমন নজরদারিতে আসছে না। তাহলে কি স্বাস্থ্যের পক্ষে কী বিপজ্জনক সেটাও নতুন করে ভেবে দেখা দরকার আছে? আর এখন তো (২০২৩ সালের কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা৭) হিরোশি ওকোচির নেতৃত্বে জাপানি বৈজ্ঞানিকরা মাউন্ট ফুজির উপর জমে থাকা মেঘের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছেন। সমস্যা এই আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রাখা বায়ুমন্ডলে উপস্থিত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণারা তারা সমবেত ভাবে মেঘ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াকেই ঘেঁটে দিতে পারে। সেই সঙ্গে মেঘের থেকে সূর্যালোক প্রতিফলন বা বৃষ্টি হওয়ার ধরণ ইত্যাদি বদলে দিতেও তারা সক্ষম। সব মিলিয়ে পৃথিবীর আবহাওয়াকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে এই অদৃশ্য কণাগুলো। এমনিতেই আবহাওয়ার বদলের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে আমরা নাজেহাল, সেই সঙ্গে আরও বারুদ হয়ত পরিবেশে জমা করছি নিজেদের অজান্তে।
আর যে দেশে অধিকাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যের ভবিতব্য জমি ভরাট করার কাজে লাগতে সেখানে মাটিও যে প্লাস্টিকময় হয়ে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? ২০২০ সালেই বর্ধমানের মেমারি অঞ্চলে সমীক্ষা করে গবেষকরা৮ দেখেছেন মাটিতে কিভাবে ম্যাক্রোপ্লাস্টিক ও মাইক্রো প্লাস্টিক দুইই মিশে রয়েছে। তাঁরা এও জানিয়েছেন যে মাটিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি কিভাবে মাটির জলধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি চরিত্র বদলে দিচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। আর সেই প্লাস্টিক গাছের মধ্যে দিয়ে খাদ্যে মিশে মানুষের প্লেটে এসে পৌঁছাচ্ছে। কারণ হিসেবে তাঁরা মূলত দায়ী করেছেন মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া আধা-তরল, আধা-কঠিন পরিশোধিত বর্জ্য-অবশেষকে। এতেই প্লাস্টিক ভরা। এছাড়াও আছে প্লাস্টিক আবরণে মোড়া সার (যতদূর পড়েছি, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ ধারনার নিতান্তই অভাব, সারের ধীরে ধীরে মাটিতে মেশা নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের মোড়ক দেওয়া হয়, অন্য কোন কারণ আছে কি?)। এমনিতেই বঙ্গোপসাগরের পাশের সুন্দরবন প্লাস্টিক সেসপিট বলে বহুদিন ধরেই আখ্যা পেয়েছে। সেখানকার মাটি, জল ও প্রাণী-উদ্ভিদের জীবনে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে অল্প কিছু কাজ তাও চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় এই হিসেব আদৌ হয়েছে কিনা জানা নেই। অথচ বিদেশে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে প্লস্টিক কিভাবে গাছের অঙ্কুরোদ্গমের হারকে বা অঙ্কুরের বাড়কে ব্যাহত করে।
মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিরও ক্রমশঃ প্রমাণ মিলছে। নেদারল্যান্ডের ২২ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ১৭ জনের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে। বস্তুত এখনও অবধি পরীক্ষায় আমাদের লালা, রক্তপ্রবাহ, প্লাসেন্টা, কোলন, ফুসফুস, মল ইত্যাদির মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে মাতৃদুগ্ধ ও সদ্যজননীর প্ল্যাসেন্টাতেও।
আজকের বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষের শরীরে তিনভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢোকে। প্রথমত শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ফাইবার বা হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা কণা হিসেবে এসে শরীরে ঢুকতে পারে। ইন্ডিয়া টুডে গত বছরের একটা খবরে জানিয়েছিল যে আমরা প্রতি সপ্তাহে একটা করে ক্রেডিট কার্ড তৈরি করার মতন যথেষ্ট পরিমাণে মাইক্রো প্লাস্টিক শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিই। গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা৯ মাইক্রোপ্লাস্টিক কিভাবে মানুষের শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তার একটা মডেল বানিয়েছেন। নাক দিয়ে ঢুকে শেষে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, তারপর চলতে চলতে সোজা ফুসফুস বা হৃৎপিন্ডে বা অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছে যায়। অবশ্য শুধু যে দূষিত হাওয়া দায়ী এমন তো নয়, খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে ঢুকতে পারে। এই যে গোটা শীতকাল জুড়ে ধাপার কাছের ইস্টার্ণ বাইপাশের ধারে ধারে কলকাত্তাই বাবুদের গাড়ি থামিয়ে নধর সবজি কিনতে দেখা যায়, সেই সব ‘ড্যাঞ্চি’ সবজির সঙ্গে সঙ্গে আমরা কী কী যে খাই কে জানে! তবে এইসব নিয়ে দেশজ রিসার্চ এখনও তেমন মেলে না। তাই আপাতত বিদেশী রিসার্চ থেকেই বলা যাক যে ইটালিতে রোজকার আলু, ব্রকোলি ইত্যাদি সবজির মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এমনকি যে আপেল নিয়ে বলা হয় যে ‘অ্যান অ্যাপেল আ ডে / কিপস দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে’, সেই আপেলেও এই দূষকের হদিশ মিলেছে। অবশ্য পরিবেশ-দূষণের আরেকটা ফল হল খাদ্য শৃঙ্খলে মাইক্রো প্লাস্টিকের ঢোকার পাসপোর্ট পাওয়া। ফাইটোপ্ল্যাংটন বা সায়ানোব্যাক্টিরিয়া মারফৎ তাদের খাদক বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে মানুষের শরীরে এসে ঢোকে। এই যে পাশের বাড়ির দত্তবাবুর বাড়িতে তিনদিন বর্ষার ইলিশ এসে গেল বলে ঈর্ষায় নীল হয়ে গিয়ে আপনি বাজার থেকে বিপুল দাম দিয়ে গোটা ইলিশ কিনে আনলেন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় করে ছবি পোস্টালেন, জানেন কি সেই ইলিশের মধ্যে কি কি আছে? অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন ত্বকের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেও শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক লেগে যায়, ভিতরে অনুপ্রবেশ না করতে পারলেও। তার গায়ে লেগে থাকা টক্সিক পদার্থ থেকেও বিপত্তি হওয়া সম্ভব।
একবার শরীরে ঢুকতে পারলেই হল, তারপর যে কত রকমের বিপত্তি ঘটাতে পারে! যেমন বেয়াড়া আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিকের খোঁচা লাগতে পারে বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে। প্রদাহ তৈরি হয়। তার উপরে বিভিন্ন মাইক্রোপ্লাস্টিকের রাসায়নিক গড়ন আলাদা আলাদা তো, আর প্লাস্টিক তৈরির পর্বেও বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। সবে মিলিয়ে শরীরের ভিতরে বিভিন্ন এন্ডোক্রিন ডিসর্যাপ্টার বা তাদের ক্ষরণে সহায়ক পদার্থ ঢোকে, মোটাদাগের ভাষায়, বহুবিধ হরমোনের গণ্ডগোল সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। যার ফলশ্রুতি বাড় বৃদ্ধির সমস্যা, বিভিন্ন প্রজনন তন্ত্রের সমস্যা থেকে ক্যান্সার, নিউরোডিজেনেরেটিভ অসুখ অবধি অনেক কিছুই হতে পারে। আরও একটা সমস্যা হল যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গায়ে লেগে লেগে বিভিন্ন হেভি মেটাল বা অন্যান্য টক্সিক পদার্থও শরীরে ঢুকতে পারে, তারাও বিভিন্ন রকমের খেলা দেখায় শরীরে। বলে না একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর! নিরীক্ষায় দেখা গেছে এমনকি কম দূষিত হাওয়াতেও দীর্ঘদিন ধরে শ্বাস গ্রহণের ফলে হৃৎপিণ্ডের বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা হতেই পারে।১০ খুব সম্প্রতি কালে অবশ্য এক গবেষণায় ২৫৭ জনকে পরীক্ষা করে দেখানো হয়েছে যে যাদের গলার ধমনীতে জমে থাকা প্লাকের প্রলেপের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলেছে তাদের মধ্যে বছর তিনেকের ধারে কাছে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক ও তার থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। বিপদ বলে বিপদ! এছাড়াও বিজ্ঞানীরা হজমের গোলমাল থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কমে যাওয়া থেকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস জনিত টিস্যুর ক্ষতি ইত্যাদি বহু শারীরিক বিপদ সম্ভাবনার পিছনেও প্লাস্টিককে চিহ্নিত করেছেন১১ - উৎসাহীরা একটু নেট ঘাঁটলেই বহু তথ্য পাবেন। তবে এই নিয়ে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। যদি বিজ্ঞানীদের বলা এই সব সম্ভাবনা সত্যি হয়, তাহলে মাইক্রোপ্লাস্টিককে নিঃশব্দ ঘাতকের তকমা দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। অবশ্য ক্ষয়িত প্লাস্টিকের অপর ফর্ম মানে ন্যানোপ্লাস্টিককেও এই বিপদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবে না।
তবে অবশ্য এই দেড় কোটি মানুষের দেশে মানুষের প্রাণ ম্যাক্রো স্কেলে সব চেয়ে সহজলভ্য। কিছুটা ভারতীয় জীবন দর্শনও হয়ত মানুষকে কিঞ্চিৎ দার্শনিক করে দেয়, তারা ভাবে মরব তো একদিনই, এত না ভেবে আনন্দে বেঁচে নিই। হবে হয়ত। আর যে দেশে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ দৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে সেখানে আর অদৃশ্য শত্রু নিয়ে কেই বা ভাববে! তার উপর এদেশে গবেষণার খাতে যা সামান্য অর্থ ব্যয় হয় আর সম্প্রতিকালে সেই গবেষণা- অর্থের যে ধরণের গবেষণার দিকে গতি, তাতে এই ধরণের অনিশ্চিত গবেষণা তথা প্রকৃত ক্ষতি মাপার জন্য ক্ষেত্র সমীক্ষা কতটা হওয়া সম্ভব সেও বোঝা খুবই সহজ! কাজেই হয়ত না জানা থাকলেই জীবনে শান্তি বাড়ে। আর জেনে গেলে তখন হয়ত ওই বিদেশের মতন নো প্লাস্টিক উইক জাতীয় কিছু নিঃশব্দে পালন করে আত্ম-পাপ ক্ষালনের চেষ্টা করতে হয়। এও জানা যে তাতে সামগ্রিক কোন ছাপই পড়বে না হয়ত। কিভাবে কমানো যায়? ভোগবাদে রাশ টেনে? ব্যক্তিজীবনে বদল এনে? নাকি অন্য কিছু করা দরকার? অবশ্য কি করলে যে সত্যিকারের বদল আনা সম্ভব তাও কি কেউ একা একা বার করতে পারে? ‘একাকী গায়কের’ জন্য কি আদৌ এই গান? সামগ্রিক সর্বস্তরের ঐকান্তিক চেষ্টার দরকার। ব্যক্তি চেষ্টার সঙ্গে সরকারি নীতির সামগ্রিক মেলবন্ধন হলে তবে না কিছুটা কাজ হয়! আর না হলে এই সব লেখা শুধু ভীতি-উদ্রেককারী বলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে জমা হয়!