কালের স্রোত বয়ে যায় তার আপন গতিতে। তবু স্মৃতির সন্ধানে ছুটে আমরা হতাশ হই, খুঁজি তার চিহ্ন – একটা বট গাছ, স্কুলের মাঠের দেওয়াল। মনের পর্দায় তিনটে ছটা নটায় সেই চলচিত্রের প্রদর্শনী। জানি এই ছবি একান্ত আমারই, এখানে কোন সহমর্মী। পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে অতি উৎসাহে দেখিয়েছি গঙ্গার ভাঙা ঘাট, ‘জানো এখানে, ঠিক এইখানে বসে আমরা গুলতানি করেছি, গান গেয়েছি?’ অলস কৌতূহলে সে বলে, ‘তাই বুঝি? তখনও কি এই ঘাট এমনি ভাঙা ছিলো?’
আমার ভালবাসা শুধু আমারই এই দুঃখ নিয়ে চলে যেতে হবে একদিন।
এমন সময়ে, এবারের বই মেলায় হাতে পেলাম এমন একটি বই যা আমাকে মুহূর্তের মধ্যে ইংল্যান্ডের সারের গ্রাম থেকে উড়িয়ে নিয়ে গেল আমার বাল্যকালে, ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে আমরা যেদিন যুবক হলাম, সেই বয়েসে। আমার ফেলে আসা কলকাতায়, আমার বরানগর আমার সিঁথির মোড়ে, যাকে মুঠোয় ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা করে এসেছি এতদিন।
কুণাল চট্টোপাধ্যায়ের ‘আসুন, ভাজা মৌরি চিবোই’।
পড়তে গিয়ে জানলাম আমার রক্তে মিশে আছে যে ভূখণ্ড কুণাল সেই বরানগরের মানুষ। বরানগরকে ভালোবেসে সেখানেই কাটালেন এতোটা কাল। নিউ ইয়র্কে বলে, ‘ইউ ক্যান টেক দি গার্ল আউট অফ ব্রনক্স বাট ইউ ক্যান নট টেক দি ব্রনক্স আউট অফ দি গার্ল’। ভারমুক্ত আমি চলে এসেছি অনেক দূরে ইংল্যান্ডের সারেতে কিন্তু কুণালের লেখা মনে করিয়ে দিল, ‘ইউ ক্যান নট টেক বরানগর আউট অফ মি’। কুণাল আমার চেয়ে অনেক ছোটো হবেন, কিন্তু তিনি আর আমি দেখেছি এক আশ্চর্য উত্তাল সময়কে –দিকে দিকে ছড়ানো লাল আগুনের উত্তাল কলকাতা একাত্তর, সেখানে তিনি অর্থনীতি পড়ছেন, অমর্ত্য সেনের পভার্টি অ্যান্ড ফেমিনের কথা বলছেন আর তুষার রায়! রতন বাবু রোডের, আমাদের তুষারদার ব্যান্ডমাষ্টার অঙ্ক কষছেন ম্যাজিক লুকিয়ে চক এবং ডাস্টার। সন্দীপনদাকে, গৌরকিশোরদাকে দেখা যায় গোপাললাল ঠাকুর রোডে। অবলীলায় সেই সব দিনের কথা লিখেছেন কুণাল, যেমন এক রাস্তা তিন বাড়ি। সেই সময়ের এক অসামান্য দলিল (আমার একটি অভিযোগ আছে- কুণাল ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্মরণ করেছেন কিন্তু তাঁর নামাঙ্কিত, আমার গুরুপীঠ আলমা মাটের নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের নাম করেন নি)। আমার হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগালেন - বি আই কোম্পানি, তার সুরম্য এভিনিউ, বাঁধানো পুকুর, তিন দিক খোলা মঞ্চ মিলন চক্র (যেখানে আমাদের স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে) চোখের সামনে দেখতে পেলাম তাঁর লেখায়, ফিরে গেলাম সেইখানে, রেবেকা উপন্যাসের প্রথম লাইনটির মতন, ‘লাস্ট নাইট আই ড্রেমট আই ওয়েনট টু ম্যানডারলে এগেন’!
অসাধারণ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে খানিকটা নির্লিপ্ত ভাবে তিনি এঁকেছেন ছবি, তবু তাঁর দুঃখের সুর বেজে ওঠে যখন তিনি দেখেন বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির পুরনো পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশের আবর্জনার স্তূপ।
কাঁটাকলে অর্থনীতি পড়ার সময়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সিটিউট লাইব্রেরিতে যার গ্রন্থ সম্ভার ছিল অতুলনীয়, বিশেষ করে অর্থনীতিতে (ভি এন গ্যাডগিলের ইন্ডিয়ান ইকনমির কপি সেখানে পেয়েছি)। আই এস আই ক্যানটিনে পাঁচ পয়সায় শিঙ্গাড়া খাবার কথা মনে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, কাঁটাকল থেকে আই এস আই এর বাসের ভাড়া তার চেয়ে বেশি ছিল!
শুধু আমার আপন স্মৃতি চারণার ছিলিমে ধোঁয়া দেওয়ার জন্য কুণালের বইয়ের চর্চা করতে বসি নি। তিনি অনেক টুকরো টুকরো সময়কে মহাকালের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছেন, তা সে প্লেনে মল্লবীরের প্রথম শ্রেণিতে পলায়ন (গ্লরিয়াস রিট্রিট!) হোক বা শিল্পের অন্তর্জলী যাত্রায় এক অন্তিম রাগিণীর আলাপ জোর ঝালা গৎ হোক। তিনি সাময়িক কালের ইতিহাস ও অর্থনীতিকে অত্যন্ত সহজ করে নিয়ে এসেছেন আম জনতার কাছে, খুব কাছে। আমরা যারা অর্থনীতি পড়েছি তারা কি পারি কঠিন অঙ্ককে ছেলেখেলার মতো পাঠশালায় পড়াতে? কুণাল সেটি পেরেছেন কারণ এটি তাঁর বিধিদত্ত ক্ষমতা। পুরনো ইতিহাস, সাহিত্যকে আমাদের আজকের আলোয় চেনালেন, সঞ্জীবচন্দ্রের একটিমাত্র লাইন হয়তো সব বাঙালির চেনা, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। কিন্তু তিনি আরও অনেক বাক্য লিখেছেন যার খোঁজ আমরা রাখি না। ধৃষ্টতা হবে, তবু বলি তিনি সেই সঞ্জীবচন্দ্রের পরিচয় করালেন যিনি দাবার নেশায় এক পরীক্ষার দিন হাজিরা দিলেন না, জ্বরে পড়ে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় বসতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করলেন, ‘স্বশিক্ষিতরা সুশিক্ষিত’। লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে কলম পিষেও চার্লস ল্যাম্ব টেলস ফ্রম শেক্সপিয়ার লিখেছেন, যদিও মাত্র ৫৫ বছর বয়েসে তাঁর মহা বিদায়, সরকারি কাজ করেও সঞ্জীবচন্দ্র পালামউ ভ্রমণ লিখে আমাদের কাছে অমর হয়ে রইলেন। চশমার কাচ একটু মুছে নিয়ে ইতিহাসের দিকে তাকিয়েছেন কুণাল- কবি ও সন্ন্যাসী পর্বে সেটি স্পষ্ট। ‘বড়ো মানুষদের’ মাইক্রো স্কোপের নিচে এনেছেন – প্রশ্ন করেছেন। আমাদের প্রাপ্ত জ্ঞান (রিসিভড উইসডম) শেষ কথা নয়, এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আমার একটি তীব্র অভিযোগ আছে -ছাব্বিশটি পর্বই ফুরিয়ে যায় দ্রুত! শেষ হবার আগেই হইল শেষ! ব্রেভিটি ইজ দি সোল অফ দি উইট কথাটা আমাদের চেনা কিন্তু কুণালের লেভেল অফ ব্রেভিটি আমাদের রসগ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু প্রবঞ্চনা করেছে।
নামটা নিয়েও কিছু তির্যক মন্তব্য করবো ভেবেছিলাম কিন্তু শেষ পাতায় এসে মত বদলাতে হলো: আজকাল ব্লগ লেখার চল হয়েছে, কুণাল সেই ব্লগ লেখকদের পাঠ দিতে পারেন – তিনি দেখালেন সহজে সংক্ষেপে ইতিহাস ভূগোল অর্থনীতির গল্প করা যায়, বন্ধুর মতো ঘাড়ে হাত রেখে যেন গল্প করলেন, তাই সার্থক এর নামকরন, ‘আসুন, ভাজা মৌরি চিবোই’।