"মাসিমা মালপো খামু" - ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত নিরীহ আবদারই আজ বদলে গেছে হুকুমে। রাত বারোটার সময় সন্দেশখালির বাসিন্দা এক মহিলার ফোনে হঠাৎ ফোন আসে, দাদার জন্য পিঠে বানিয়ে দিতে হবে, তার চ্যালারা বাইকে করে পিঠে তৈরির উপকরণ পৌঁছে দিয়ে চলে যায়, ভোরবেলা নিয়ে যাবে তৈরি পিঠে, পিকনিকে। প্রস্তাবে রাজি না হলে বাড়ি ভাঙচুর, পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলার হুমকি। ক্রমাগত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সন্দেশখালির যে ছবি উঠে আসছে তাতে বলা চলে, যে মহিলা মধ্যরাতে পিঠে বানানোর আদেশ পেয়েছিলেন, তিনি হয়ত অল্পের উপর দিয়েই ছাড় পেয়েছেন, বাকিদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কিছু মহিলাকে টার্গেট করে তাদের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোনে আদেশ দেওয়া হত পার্টি অফিসের নৈশ মিটিংয়ে হাজিরা দিতে। কি হত সেই মিটিংয়ে, বলতে অস্বস্তিতে পড়ছেন অনেকেই, মুখে গামছা বেঁধে ক্যামেরার মুখোমুখি হচ্ছেন লোকলজ্জার ভয়ে। কেউ জানাচ্ছেন সন্দেশখালির এই সমাজবিরোধীরা, ডাক পাওয়া মহিলাদের মধ্যে বিভাজন করত সৌন্দর্যের নিরিখে, তথাকথিত কম সৌন্দর্যের অধিকারী যাঁরা, তাঁদের ওপর থাকত নৈশ মিটিংয়ের জন্য রান্না ও পরিবেশনের দায়িত্ব। আর দুর্ভাগা রূপবতীদের ঘিরেই বসত সমাজ বিরোধীদের বৈঠক। ভোর অবধি চলত সেইসব মিটিং। কোনো মহিলা সেই বৈঠকখানার ডাক অগ্রাহ্য করলে হুমকি ফোন যেত বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের কাছে, তাঁদের ফোনে না পেলে প্রতিবেশীদের কাছে। ডাক অমান্যে অকথ্য অত্যাচারের মুখে পড়ত তার স্বামী-সন্তান-স্বজনরাও। এ যেন সেই মহাভারতের একচক্রা নগরীর রাক্ষস যার প্রতিদিন একটি করে মানুষ ভেট লাগত খাদ্য হিসেবে। আজ ভাবতেও অবাক লাগছে এই ঘটনা মাসের পর মাস চলছিল সন্দেশখালিতে, মহিলাদের যেন সেবাদাসীতে পরিণত করে রাখা হয়েছিল, কেউ বিন্দুমাত্র প্রতিবাদও করার সাহস পাননি। নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে সেই সব মহিলাদের অনেকেই আজ গ্রামছাড়া।
রাতের বেলা যদি এই কাণ্ড চলছিল তাহলে দিনের বেলা? বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে যেসব বক্তব্য উঠে আসছে, তাতে জানা যাচ্ছে, ছাড় পেতো না ছোটরাও। স্কুল-পড়াশোনা-খেলাধুলা এইসব বাদ দিয়ে ছুটে যেতে হত মিটিং, মিছিল, পার্টির কর্মসূচিতে। গ্রামের মহিলাদেরও হাজিরা ছিল বাধ্যতামূলক। কোনো অনিবার্য কারণে না যেতে পারলে পার্টি অফিসে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে আসতে হত কারণ সহ। না গেলে বাড়ি ভাঙচুর, সরকারি প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া, ভাতা বন্ধ করে দেওয়া, বাড়ির পুরুষ সদস্যদের মারধোর - সাধারণ ঘটনা। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো যেত না কোনো থানাতেই, পুলিশ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিত, এই অভিযোগ অভিযুক্তদের অনুমতি ছাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ শাজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রকৃত অর্থেই ছিল আইনের ঊর্ধ্বে।
কিভাবে ভেঙে পড়ল সন্দেশখালির এই গণতান্ত্রিক কাঠামোর অবশেষটুকুও? উত্তর লুকিয়ে আছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে। কলকাতার বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অংশের কর্তৃত্ব আজ চলে গেছে বিভিন্ন সামন্তপ্রভুদের হাতে। অনুব্রত, কাইজার, আরাবুল, শাজাহান - এরাই সেইসব অঞ্চলের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। ওখানকার পুলিশ-প্রশাসন-পাবলিক কেউই এদের অনুমতি ছাড়া এক পা'ও নড়ার সাহস পায়না, প্রেসের কাছে মুখ খুলতে পারেনা, মামলায় সাক্ষ্যও নয়। কান পাতলে শোনা যায় শেখ শাজাহানও নাকি ছিল সন্দেশখালির মসিহা, রোয়াব-মোড়া রবিনহুড। তা এমন দানবীরের লক্ষীর ভান্ডার গড়ে উঠল কোন কৌশলে? একের পর এক চাষের জমিতে জোর করে নোনাজল ঢুকিয়ে ভেড়িতে পরিণত করে ও তার দখল নিয়ে, ভুয়ো জবকার্ড বানিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করে, রাজ্য সরকারের নানা প্রকল্পের টাকার অংশ তোলা হিসেবে আদায় করে, গ্রামের লোককে উচ্ছেদ করে তার বাড়ির দখল নিয়ে। স্থানীয় পুলিশ এই কাজে তাকে বাধা দেওয়ার বদলে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশ ও পার্টি এই যৌথবাহিনীর সম্মিলিত উদ্যোগে আরও বিভিন্ন এলাকার মতো সন্দেশখালিতেও সাধারণ মানুষের পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেওয়ালে।
তাহলে এখন প্রশ্ন হলো ইডি এসে শাজাহানকে ধরতে গিয়ে মার খেল, রাজ্যের মুখ পুড়ল, এলাকার পুলিশ প্রশাসন সব তাদের দলবলের হাতের মুঠোয় চলে গেছে, সে সিস্টেম এর বাইরে নয়, নিজেই সিস্টেমে পরিণত হয়েছে - এসব দেখেও রাজ্য সরকার চুপ কেন? প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরটাও জানা। শিয়রে লোকসভা ভোট। এই শাজাহানের মতো লোকেরাই ভোটকুশলী। এলাকার মানুষকে কন্ট্রোল করে নির্বিঘ্নে "ভোট করানো" এদের দায়িত্ব। কেউ টুঁ শব্দটি করার সাহস পায়না। ঠিক জায়গা মতো ভোট না পড়লে, ঘটে যেতে পারে আরেকটা বগটুই। ভোট বড় বালাই, আর তার পাশাপাশি আরেকটা কারণ হল তোলার ভাগ, যা দলকে মসৃণ ভাবে পরিচালনা করতে, নির্বাচনী প্রচারে ঢালাও খরচ করতে সাহায্য করে। প্রশাসন, পায়ের তলার জমি হারাচ্ছে জেনেও তাই এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনা। এমনকি প্রশাসনে পালাবদল ঘটে গেলেও এদের গায়ে আঁচড়টুকু পড়েনা, এরা পাকা খেলোয়াড়, সময়মত জার্সি বদলে নেয়, ক্ষমতা তাই এদের মতো সামন্তপ্রভুদের হাতেই রয়ে যায়। কখনো কখনো পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী পাওয়ার ভ্যাকুয়াম তৈরি হলে কেষ্ট, কাইজার, শাজাহানদের জায়গায় হয়তো নামগুলো বদলে গোপাল, ডলার বা সুলতান হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পাওয়ার ডায়নামিক্সটা একই থাকে।
আজ ইডির ভয়ে শাজাহান পালানোয়, তার রাশ সাময়িক একটু আলগা, তার দলবল একটু ব্যাকফুটে। এই সময়টুকুর জন্য দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এলাকার মানুষ একটু শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ঘরছাড়া পরিবাররাও গ্রামে ফিরে উগড়ে দিয়েছে এতদিনের জমা ক্ষোভ। সন্দেশখালি সাক্ষী হয়েছে এক গণআন্দোলনের। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় থাকা আশির দশকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহামস্তান হেমেন মণ্ডলের কথা। একসময়ে শাজাহানের মতোই তিনি এলাকা শাসন করতেন, তাঁর এলাকায় গাছের পাতাও নড়ার সাহস পেতনা তাঁর অনুমতি ছাড়া। পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষদের সম্মিলিত গণপ্রতিরোধ তাঁকেও এলাকা থেকে ল্যাজ তুলে পালাতে বাধ্য করেছিল। কুখ্যাত বামনেতা গাইঘাটার সুশান্ত ঘোষও ছিলেন শাজাহান, শিবু, উত্তমদের প্রকৃষ্ট পূর্বসূরি। তাঁর রোষের আগুনে অসংখ্য মানুষের পাশাপাশি বরুণ বিশ্বাসের মতো প্রতিবাদী স্বরও ঝলসে গিয়েছিলেন। মানুষের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত সেই সুশান্ত ঘোষেরও স্থান হয়েছিল জেলের কালকুঠুরিতে। আজ সন্দেশখালির ঘটনায় প্রশাসন,মিডিয়া, জনগণ সবাই কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। এতদিন সবকিছু জেনেও ঘাপটি মেরে থাকা প্রশাসন এর মধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে ড্যামেজ কন্ট্রোলে, দ্রুত এই আন্দোলন যেভাবে হোক ধামাচাপা দিতে হবে, নইলে এটাই ভোটের মুখে যদি বড় ইস্যু হয়ে ওঠে!
রাজ্য মহিলা কমিশন থেকে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছে খোঁজ নিতে। সেই প্রতিনিধি দলও পুলিশের সুরে সুর মিলিয়ে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে গ্রামে ঘুরে ঘুরেও নারী নির্যাতনের কোনো অভিযোগই তারা নাকি পায়নি। আর অন্যদিকে মিডিয়ার সামনে মুখ খোলার অপরাধে এক অভিযোগকারী মহিলার মুখে গরম লোহার ছেঁকা দেওয়া হয়েছে, আক্রমণের মুখে পড়েছে তার শিশুসন্তান, সমাজবিরোধীদের হাতে মার খেয়ে তার স্বামী ঘরছাড়া। সন্দেশখালির নিপীড়িত মহিলারা এতটাই সন্ত্রস্ত যে আগে যারা সরাসরি মিডিয়ার সামনে মুখ খুলেছিলেন, আজ গামছার আড়ালে পরিচয় লুকাতে হচ্ছে পাছে পরিচয় জেনে আবার গুন্ডাবাহিনী বাড়িতে হানা দেয়। অন্যায্য ভাবে পুরো এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে সন্দেশখালিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল, হাইকোর্টের দাবড়ানি খেয়ে সেটা খারিজ করে আবার অঞ্চল ভিত্তিক ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বিরোধীদলের প্রতিনিধিদের সন্দেশখালি যাওয়া আটকে, অন্য সময় টেবিলের নীচে লুকিয়ে থাকা পুলিশ অতিসক্রিয় হয়ে উল্টে প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক নিবারণ সর্দারকে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে স্লোগান উঠেছে, 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়', রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নানা সময়ে নারী ক্ষমতায়নের কথা আউড়েছেন। তা যে শুধুই কথার কথা, সন্দেশখালির ঘটনা আবার তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
সন্দেশখালিতে যে ঘটনা ঘটছিল, এরকম আরো নানা ঘটনা কাগজে বেরিয়েও আসে কখনো সখনো, মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় শুধু সেই খবরে কি মানুষ এতটা নড়েচড়ে বসত? খুন, ধর্ষণ, পার্টি অফিসে ডেকে শ্লীলতাহানি - এসব নিয়মিত মিডিয়ায় দেখতে দেখতে যেন অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল বাংলার মানুষের। আমরা চমকে উঠলাম যখন দেখলাম দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একদল মহিলাও লাঠি নিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ গুণ্ডাবাহিনীকে ধাওয়া করতে পারে। এ দৃশ্য দেখে বাংলার সাধারণ মানুষের বোধোদয় হবে নাকি এও পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, আনিস খান হত্যা, বগটুই ও আরো অনেক কালো অধ্যায়ের মতোই 'তুচ্ছ ঘটনা' হয়ে থেকে যাবে তা জানা নেই। পুলিশ প্রশাসন এবারেও নিজের ঐতিহ্যে দাগ লাগতে দেয়নি, পার্টির ঘনিষ্ঠ কোনো নামজাদা মাতব্বরকে কখনই তারা খুঁজে পায়না, এখানেও তার অন্যথা হয়নি, নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে বুক ফুলিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়ানো শিবু হাজরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আইনজীবী মারফত আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করে চলা শেখ শাজাহান এখনো অন্তরালে থেকে ইডিকে প্রমিস করতে বলছেন, আমায় দেখতে পারো কিন্তু ধরতে পারবে না। শাজাহানের বদান্যতায় বসিরহাটে জয়লাভ করা তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহান যিনি এত কিছুর মধ্যেও এক মনে নিজের সিনেমার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, বলেছেন, এই বিষয় নিয়ে রাজনীতি করার কী আছে? বাংলার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, তথা সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী, তথা, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী তথা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যদিও একটুও না ভেবে সটান জানিয়ে দিয়েছেন, সবাই তো ধরা পড়ে গেছে কিন্তু সন্দেশখালির ঘটনায় যাদের দিকে আসলে অভিযোগের তির, তারা আদৌ উপযুক্ত শাস্তি পাবে কিনা, সেটা সময়ই বলবে।
পুনশ্চ: বাম, কংগ্রেস, বিজেপির কিছু নেতা মাঝে মাঝে দাবি করেন 'পিসি-ভাইপোর' সব দুর্নীতির খবর তাঁরা জানেন, রাজ্যে কোথায় কি অরাজকতা চলছে সব তাঁদের নখদর্পণে। কিন্তু কই, সন্দেশখালিতে নিয়মিত ঘটে চলা এইসব অত্যাচারের কথা আগে কখনও তো এইসব ত্রিকালদর্শী নেতাদের মুখে শোনা যায়নি। তাহলে কি তাঁরা এতটাই জনবিচ্ছিন্ন যে রাজ্যে কোথায় কি চলছে খবরও রাখেন না, নাকি জনগণ নিজেরা প্রতিবাদ করে বিষয়টিকে একটি বড় ইস্যুতে পরিণত করার আগে পর্যন্ত তাঁরাও কোনো বিষয়কে ইস্যু বলে মনে করেন না!