২০২৩ সালে প্রকৃতির রুদ্ররোষে বন্যায় ভেসেছে হিমালয় সংলগ্ন উত্তর ভারতের বহু এলাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিমাচল প্রদেশ। চারটি নদী বয়ে যাচ্ছে এই রাজ্য দিয়ে। শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী এবং যমুনা। নদনদীকে ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরী রূপে উপাসনা করে মানুষ। নদীর উৎসে, তীরে তীরে গড়ে ওঠে মহাতীর্থ। নদী না থাকলে সভ্যতা তৈরি হত কী ভাবে? অথচ এই নদী হয়ে ওঠে প্রাণঘাতিনী। সেই ভয়েই কি উপাসনা করে তুষ্ট রাখবার চেষ্টা? কিন্তু শুধু উপাসনা যথেষ্ট নয়। হয়তো নদীকে বশ মানানোর চেষ্টার মাসুল অন্যভাবে দিতে হতে পারে, এই কথা প্লাবনে প্লাবনে বুঝিয়ে দিয়ে যায় নদী। সভ্যতা নদীর কাছ থেকে অতিরিক্ত লাভ আদায় করে নিতে চায়, অথচ তার প্রাপ্য প্রকৃত সম্মানটুকু দিতে নারাজ। শুধুই বাহ্যিক ধূপ, দীপের আরাধনা করে নদীকে সন্তুষ্ট রেখে মানুষ নিজের পাপক্ষালন করতে চায়। তারপর বন্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় যে শুধুই প্রকৃতির অভিশাপ নয়, মানুষেরও অনেকখানি দায় ছিল। সেই দায় সময়মত পালন করলে হয়তো বিপর্যয় এড়ানো না গেলেও কমানো সম্ভব হত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
প্লাবনের বিষয় হিমালয়ে নতুন নয়। ২০০০ সালে শতদ্রু নদের ভয়াবহ বন্যা দেখেছে হিমাচল। ২০২৩ সালে অবশ্য বার বার এসেছে বিপর্যয়। এই বছরে মেঘ ভাঙার ঘটনা এবং তার ফলে হড়পা বান, এসব ঘটেছে বার বার। সারা বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। হিমালয় ব্যতিক্রম নয়। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সঙ্গে যোগ হয়েছে মনুষ্যকৃত কিছু হঠকারী কার্যকলাপ। সেই কাজের মধ্যে অন্যতম হল যথেচ্ছ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি গড়ে তোলা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীর দু’পাশে বেড়ে ওঠে জনপদ। উন্নত হয় মানুষের জীবনযাত্রা। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। শক্তির যোগান অপ্রতুল ও মহার্ঘ। ফলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনও বাড়ে। জলের মত এমন সহজ নবীকৃত শক্তির উৎস পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু এই কেন্দ্রগুলি তৈরি করার অর্থ হল নদীতে বাঁধ দেওয়া। এই জায়গাতেই লুকিয়ে থাকে বিপদ এবং নদীকে বুঝে নেওয়ার সমস্যা। পাহাড়ি এলাকার নদী মানেই সাধারণত সে নদী খরস্রোতা, কারণ পাহাড়ের পাথর কেটে কেটে কঠিন বাধা সরিয়ে নামে সেই নদী। এই অঞ্চলে নদীর উচ্চগতির যাত্রাপথ। এই পথে নদীর কাজ হল ক্ষয় এবং ক্ষইয়ে নেওয়া ভার তীব্রবেগে বয়ে নিয়ে চলা। পার্বত্য এলাকায় নদীখাতের আকৃতি ইংরেজি আই অথবা ভি অক্ষরের মত হয়ে থাকে। ফলে নদীর উচ্চগতির যাত্রাপথেই সাধারণত গভীর গিরিখাতের সৃষ্টি হয়। খরস্রোতা সেই নদীকে বেঁধে ফেলাও খুব সহজ কাজ নয়। বাঁধ দেওয়ার ফলে গতিপথের ওই অংশে নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়, জল বহন এবং জল ধারণক্ষমতা দুইই হ্রাস পায় এবং সাময়িকভাবে নদীখাতের আকারও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কারণ উচ্চগতির যাত্রাপথে নদী খুব দ্রুত ক্ষয় এবং বহন করে, অথচ বাঁধ থাকার জন্য পলি বয়ে নিয়ে যাবার সুযোগ হ্রাস পাবে এবং নদীখাতে সঞ্চিত পলির পরিমাণ বেড়ে যাবে সহজেই। সেইজন্য পার্বত্য এলাকায় গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির জলাধারের ধারণক্ষমতাও খুব দ্রুত হ্রাস পাবে। এমনিতেও বেশি জল জমিয়ে রাখা পাহাড়ি জলাধারে খুব সমস্যা। জলের চাপে, বয়ে আনা নদীর পলির ভারে বাঁধ ভেঙে পড়লে সেই জল যে কোন পথে যাবে, কেউ জানে না। কিম্বা অতিবৃষ্টির ফলে বাঁধের যদি টইটুম্বুর অবস্থা হয়, তাহলে জল না ছাড়লে সে বাঁধ আপনাআপনি ভেঙে পড়বে। ২০২৩ সালে হিমাচলের বন্যায় এমনটিই হয়েছিল। জুলাই মাসে বিধ্বংসী আকার ধারণ করেছিল বিপাশা। সেই নদী তখন সার্থকনামা পাশমুক্ত জলধারা। সিমলা, মানডি এসব অঞ্চলে পাহাড়ের ঢালে গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, পাহাড় ভেঙে ধস নামছে, উপড়ে ভেঙে পড়ছে জাতীয় সড়ক। নিজস্ব নদীখাত ছেড়ে সে নদী তখন গড়ে নিচ্ছে নতুন খাত। প্রশ্ন উঠেছিল যে জুন মাসের শেষ দিকে বৃষ্টিতে বিপাশা নদীতে গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধারগুলির যখন বেশ ভরা ছিল, তখনই কেন জল ছাড়া হয়নি? কেন জুলাই মাসের মেঘ ভাঙা বৃষ্টি অবধি অপেক্ষা করা হল? ফলে কুলু মানডি এবং কাংড়া জেলার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো তখন শক্তির উৎস হিসেবে আর মানুষের পরিষেবা দেওয়ার কেন্দ্র নয়, বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল।
পরবর্তীতে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে দণ্ড দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের অঙ্কের হিসেবে বিপর্যয়ে নষ্ট হওয়া জীবন, সম্পত্তি… সবগুলো শূন্যস্থান পূর্ণ হয় না।
পাহাড়ি এলাকায় জনপদগুলো বেড়ে চলেছে বলেই বাড়ছে শক্তির চাহিদা। আসলে হিমালয়ের মত অঞ্চলে বিপদ তো শুধু নদীর বন্যার মধ্যে লুকিয়ে নেই। ভূমিকম্প, ধস এসবের কথা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বেড়েছে নগরায়ন পাহাড়ের ঢালে। বিপর্যয়ের পরে কারণ খুঁজতে গিয়ে ধরা পড়ছে যে অধিকাংশ জায়গায় মাটি পরীক্ষা না করেই দেদার বাড়িঘর বানানো হয়েছে। অনেক জায়গায় পাথরের ভূতাত্ত্বিক চরিত্র এখনো ঠিক ভাবে ম্যাপিং পর্যন্ত হয়নি। তাছাড়া হিমালয়ের শিবালিক পর্বতমালা, অর্থাৎ পাদদেশের সবচেয়ে নিচু যে দক্ষিণের অংশ, সেটা বেশির ভাগ নির্মিত হয়েছে নদীবাহিত বা হিমবাহ বাহিত ক্ষয়সঞ্জাত পাথর, পলি ইত্যাদি দ্বারা। ফলে মাটির কঠিনায়ন সম্পূর্ণ হয়নি। উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠ এবং হিমাচলের অনেকখানি এই শিবালিকের উপরেই অবস্থিত। তার উপর ভঙ্গুর ভূতাত্ত্বিক গড়ন বাড়িয়ে তুলছে বিপদ। কোথাও চ্যুতি ইত্যাদি থাকলে, সেখানে বাড়িঘর বসে যাবে, ফেটে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। যে মাটি নগরায়নের চাপ নেবার উপযুক্ত নয়, সেখানে যথেচ্ছ নগরায়ন হলে নানা দিক থেকে বিপদ আসে। বাড়িঘর, দপ্তর, হোটেল ইত্যাদি বানানো হলে স্বাভাবিক কারণেই প্রচুর গাছ কাটা পড়ে। গাছ মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা, পাহাড়ি এলাকায় ঢালের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সহায়ক। নগরায়ন হবার ফলে ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে উঠছে হিমালয়ের পরিবেশ। নগরায়ন না হলে স্বাভাবিক কারণেই এই সব অঞ্চলে এত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। অথচ সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী হিমাচল রাজ্যকে জলবিদ্যুৎ রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা হবে, এমনই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে হিমাচলে ১৬৮টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বছরে ১০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে নাকি ১০০০টা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে এই রাজ্যে, এমনই বলা হয়েছে। এই অঞ্চলে নগরায়ন এবং নগরায়নের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র যেন পরিবেশ ধ্বংসের বিষচক্রের বৃত্ত সম্পূর্ণ করছে।
অনেক ক্ষেত্রেই নগরায়নের আইনকানুন সাঙ্ঘাতিক ভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই অঞ্চলে আড়াইতলার বেশি উঁচু কোনো বিল্ডিং করবার অনুমতি নেই। অথচ শুধু ব্যক্তিগত সম্পত্তি, হোটেল এসবই নয়, সরকারি অফিসের প্রয়োজনেও কোথাও কোথাও যথেচ্ছ বহুতল নির্মাণ হয়েছে।
তারপর আছে বর্জ্যের বিপদ। নগরায়ন মানে শুধু মানুষের প্রতিদিনের বর্জ্য নয়। গড়ে উঠবে মানুষের জীবিকার প্রয়োজনে নানা কলকারখানা ইত্যাদি, সেগুলোর বর্জ্য। রাস্তা তৈরি হবে, মাটি কাটা হবে। সেসব কঠিন বর্জ্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পড়বে নদীতে, যে নদীর বহনক্ষমতা বাঁধ দিয়ে আগেই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার উপরে বর্ষায় তৈরি হওয়া ছোট ছোট প্রাকৃতিক ঝর্না অথবা বৃষ্টির জল, যা মাটির ঢাল বেয়ে সরাসরি নদীতে পড়ার কথা, সেটাও অনেক ক্ষেত্রে নদীর পাড় বাঁধিয়ে দেবার জন্য কংক্রিটে বাধা পাচ্ছে এবং পাহাড়ের ঢালের ফাটল ইত্যাদিতে আটকে পড়ে অনেক সময় ঢালের মাটি নরম করে দিচ্ছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে ধসের সম্ভাবনা। আবার হিমাচলে সিমেন্ট ফ্যাক্টরির সংখ্যা নেহাত কম নয় এবং তাদের বর্জ্য নদীর সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, এ কথা বিপর্যয়ের পরে বলা হল। কিন্তু তার পরেও কি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে? না, সেটা হয়নি। কারণ সেখানেও আসবে মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন। অর্থাৎ পাহাড়ের পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সদিচ্ছা মানুষের নেই। সভ্যতা এখানে সবসময় সাময়িক লাভের হিসেব করে চলেছে।
এ ছাড়া আছে খননকাজের সমস্যা। হিমাচলে নানা ধরনের খনন চলে। লাইমস্টোন, কয়লা, কোয়ার্টজ এসব ছাড়াও আছে বিল্ডিং স্টোন; এগুলির সঙ্গেও মানুষের জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে। বেআইনি খননের কথাও প্রায়ই শোনা যায়, যেগুলো বিশেষজ্ঞের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ঘটতে থাকে। যথেচ্ছ খনন নদীর পাড় কিম্বা পাহাড়ের ঢালকে ভঙ্গুর করে তুলতে পারে, ধ্বংস করে দিতে পারে অরণ্যের সবুজ।