সূচনা:
শিষ্য - এই অধম লেখক।
গুরু - শিষ্যের চেয়ে ১৬ বছরের কনিষ্ঠ শ্যালক। সে কবিতা ভালোবাসে, ঋদ্ধ সিনেমা দেখতে পছন্দ করে। বিভিন্ন বিষয়ে তার পড়াশোনা বিস্তারিত। মনেও থাকে অনেক, তাই হুড়হুড় করে কখনো স্মৃতি থেকে কোট করতে পারে। লেখ্য মাধ্যমেও সে সূচারুভাবে বক্তব্য পেশ করতে পারে। এই সব কারণে ইঁট, বালি, সিমেন্ট ঘাঁটা গদ্যময় বাস্তুবিদ শিষ্য তাকে কবিতা, সাহিত্য, চিত্রকলা, সিনেমা জাতীয় সুক্ষ্ম অনুভূতির ক্ষেত্রে গুরু বলে মানে।
দুজনের মধ্যে কখনো ফোনে দীর্ঘ আলোচনা হয়। কখনো হয় কোনো বিষয়ভিত্তিক দীর্ঘ লিখিত চ্যাট। যেমন এই প্রসঙ্গে।
= = = = = = = = = =
শিষ্য - জীবনানন্দের কবিতা আমি পড়িনি। বস্তুত কবিতা ব্যাপারটি আমার বোধবুদ্ধির অতীত। তবে বিভিন্ন সূত্রে ভাসাভাসা ভাবে জেনেছি - জীবনানন্দের কবিতায় নিসর্গের সৌন্দর্য (বিশেষতঃ গ্ৰামবাংলার) ছাড়াও, নির্জ্জনতা, একাকীত্ববোধ, বিপন্নতাবোধ, মৃত্যুভাবনা এহেন সব বিষয়ও চিত্ররূপময় ভাবে শব্দের আখরে ধরা পড়েছে। আমার জানা, বোঝায় ভুল হতে পারে। দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার আগে অবধি কিছু অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে এক কাব্যগ্ৰন্থের নাম তিনি ভেবেছিলেন - "বাংলার ত্রস্ত নীলিমা"। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তার ভাই অশোকানন্দ ও সুচরিতা মারফৎ সেই পান্ডুলিপি সিগনেট প্রেসে যেতে ডিকের হাতে পড়ে ঐ কাব্যগ্ৰন্থের নাম হোলো - "রূপসী বাংলা"। আমার জিজ্ঞাসা, ত্রস্ত মানে তো ভীত, সন্ত্রস্ত, বিচলিত - তা কীভাবে ঐ কাব্যগ্ৰন্থের কবিতার সাথে যায়? এ বিষয়ে আমি আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রার্থী।
গুরু - ঠিক জানিনা; তবে বুদ্ধদেব বসুর একটা যুক্তি আছে শুনেছি, এবং তদনুসারে কবি কর্তৃক নির্বাচিত নামটিই হয়তো অধিকতর মানানসই হোতো, ভেবেছিলেন বুদ্ধদেব। রূপসী বাংলা নামক চটি বই টি পড়তে গেলে এক আবিল মুগ্ধতা দেখা যায় কবির: তাকে নাম করে বাংলাদেশের পরিচয় দিয়েছেন স্বয়ং কবি। এ অব্দি কোনো গোল নেই। কিন্তু প্রথম পাঠে যদি নাও ধরা পড়ে, ঘুরে পড়তে গেলেই চোখে পড়ে এক গভীর বিপন্নতা।
এ বিপন্নতা কবির অন্তর্লীন বিপন্নতা নয় এ বিপন্নতার শরিক পেঁচা, শালিখ, খঞ্জনা, শুক, চাঁদা, সরপুঁটি, হিজল, জারুল, কাঁঠাল, আম, কলমি, ধান এমনকি নদী, নক্ষত্রের ও নিষ্কৃতি নেই এক সুদুরগামী মৃত্যুবোধে আক্রান্ত কবির দুই চোখে। মৃত্যুবোধ মানুষের স্বাভাবিক এবং সৃষ্টিশীল সত্তার ক্ষেত্রে আরো স্বাভাবিক। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হোলো, এরকম তুচ্ছ মৃত্যুবোধ জীবনানন্দে দেখা যায়নি আগে। কোনো দূরবাসনা নেই, কোনো প্রেম নেই হৃদয়ে, এমনকি অমরত্বের আশাও নেই মরণে। নেহাৎই তুচ্ছ মৃত্যু, ঘুমের মতো নিরাভরণ, স্রেফ এক জীবনের সমাপ্তি। এই মৃত্যু বড় অকিঞ্চিৎকর, বেদনার, ভয়ের।
মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় যদি জীবনে কোনো দাগ না কাটতে পারে। এক তুচ্ছতাবোধ ঘিরে ধরে তাকে। পূর্বাভাস ছাড়াই অমোঘ মৃত্যু এসে দাঁড়ালে সে ভীত হয়, ত্রস্ত হয় তার আকাশ। ১৯৩৩-৩৪ সালে লেখা এইসব অপ্রকাশিত লেখাগুলি, সংখ্যায় প্রায় গোটা ষাটেক, এই বিপন্নতা বোধ, মৃত্যুচিন্তা নয় আসলে এক ভীত সন্ত্রস্ত নিরাপত্তাহীনতা থেকে লেখা। সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ যখন য়োরোপের বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছিলেন, জীবনানন্দ তাঁর ত্রস্ত, চকিত, শশকগমনে বারবার মেপে নিচ্ছিলেন বারাসাত থেকে কলকাতার দূরত্ব। আসলে মাপতে চাইছিলেন গ্রাম থেকে নগর। আর এক অপ্রতিরোধ্য নষ্টালজিয়ায় ফিরতে চাইছিলেন গ্রামে, শৈশবের কাছে, নিরাপত্তার কাছে।
কিন্তু আকাশ তখন অপ্রতিরোধ্য ধোঁয়াটে, কোনোখানে এতটুকু নির্ভরতা নেই। এ এক অসুখের সময়, এক ব্যাপ্ত বিষাদের সময়। মানুষ, মানুষকে আড়চোখে দেখছে। আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনানন্দ দাশ তখন পরিণত কবি। ঝরাপালকের যুগ তিনি পেরিয়ে এসেছেন ঢের আগে। ধূসর পাণ্ডুলিপি এবং বনলতা সেন প্রকাশিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমরা নির্ভূলভাবে চিনে নিয়েছি তাঁর কাব্যলক্ষণ। আন্তর্জাতিকতা তাঁর অভিজ্ঞান, প্রগাঢ় এক সচেতন ইতিহাস বোধ তাঁর লেখনীর চালিকা শক্তি। বাংলাদেশে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট লিরিক কবিতার মঞ্চে তিনি, খানিকটা অন্ততঃ জ্ঞানমার্গী (সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে অথবা পরিচয় গোষ্ঠীর কারোর মতন অতোটা নন অবশ্যই)।
রবীন্দ্রনাথ যেমন যেখানেই থাকুন, বোলপুর কি বেলজিয়াম, এঁড়েদা কি আর্জেন্টিনা - তাঁর কবিতায় অবধারিতভাবে উঠে আসে বাংলাদেশের প্রকৃতি, তার অন্তর্নিহিত গূঢ়তাকে এক হৃদয়রসে জারিত করেন কবি, ঔপনিষদিক এক প্রজ্ঞায়; ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হয়েও জীবনানন্দ সেই ঔপনিষদিক প্রজ্ঞায় আস্থা না রেখে খোঁজ নিলেন জ্ঞানের বিবিধ শাখায়। ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতি আর ভূগোল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপথিক, কিন্তু তাঁর লেখায় ছেয়ে থাকে এই বাংলাদেশ; আর জীবনানন্দ এই দেশ ছেড়ে নড়লেন না কোত্থাও তবু তাঁর লেখায় আসে সিংহল, মালয়, গ্রীস, চীন, বেবিলন, মেসোপটেমিয়া, লিবিয়ার অরণ্য।
এহেন কবি যখন নিরবিচ্ছিন্নভাবে গোটা ষাটেক কবিতা জুড়ে এই বাংলায় আটকে থাকেন, তখন বোঝা যায় বহির্বিশ্ব বুঝি আর বাসযোগ্য নেই তাঁর কাছে। আর চিনে নেয়া যায় সেই বিপন্নতা, যার জেরে তাঁর মনের আকাশ সন্ত্রস্ত। তবে কিনা এ সমস্ত লক্ষণ বহু চর্চায় শনাক্ত করা যাচ্ছে। ঐ গ্রন্থ প্রকাশকালে ঐ নষ্টালজিয়াটিকেই দেখা গিয়েছিল স্পষ্টভাবে। কবির এই বাংলায় ফিরে আসার তীব্র বাসনা, পৃথিবীর মুখ দেখতে না চাওয়ার অভিমান (আসলে নিরাপত্তার সন্ধান), বাংলার নদী-মাঠ-ক্ষেত ভালোবাসা, এই বাংলায় কড়ি খেলবার ঘর ম'জে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারাবার মতো উদগ্র সন্ধানটিকেই লক্ষ্য করা হয়েছিলো। সত্যজিৎ রায়ের করা প্রচ্ছদটিও সেই ইঙ্গিতই দেয়। যদিও পরে সত্যজিৎ ও ডি-কে (দিলীপ কুমার গুপ্ত) দুজনেই ভিন্নমত পোষন করেছিলেন এ ব্যাপারে। তবে, রূপসী বাংলা নামটির মধ্যে এক মধুর সারল্য আছে আর আছে একটা ফোনেটিক তাৎপর্য, যা এমনকি উচ্চারণেই এক আরাম দেয় বাকযন্ত্রে, পরম একটি নিশ্চিন্ততার যেন আশ্বাস।
শিষ্য - প্রতিবেদনটি পড়ে ভালো লাগলো। অর্থাৎ ডিকে আপাত দৃশ্যময়তা কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে মনে হয় আপনার প্রতিবেদনে একটা factual error রয়ে গেছে। বনলতা সেন প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৩৫ এবং ধূসর পান্ডুলিপি ১৯৩৬ সালে। তাই ১৯৩৩-৩৪ সালে লেখা সেই অপ্রকাশিত কবিতার "ঢের আগে" প্রকাশিত হয়ে গেছে বনলতা সেন ও ধূসর পান্ডুলিপি - এই বক্তব্যটা কি ঠিক হোলো? সে যাই হোক - আপনার প্রতিবেদনে এই লাইনটায় শব্দটা আবিল হবে - না অনাবিল? "রূপসী বাংলা নামক চটি বই টি পডলে এক আবিল মুগ্ধতা দেখা যায় কবির: তাকে নাম করে বাংলাদেশের পরিচয় দিয়েছেন স্বয়ং কবি।"
গুরু - না ওটা আবিল-ই হবে।
শিষ্য - কলুষিত মুগ্ধতা?
গুরু - ঠিক কলুষিত অর্থে নয়। অবিশুদ্ধ অর্থে। জীবনানন্দের যে মুগ্ধতা তা অনেকখানিই নিরাপত্তাহীনতাপ্রসূত।(#) গ্রাম বাংলার প্রতি জসীমউদ্দীনের বা যতীন্দ্রমোহন বাগচীর (সেনগুপ্ত নয়) যে আকর্ষণ তাকে অনাবিল মুগ্ধতা বলা যেতে পারে কিন্তু জীবনানন্দের রক্তে নেই বিশুদ্ধ গ্রাম্য সারল্য প্রীতি।(&) তাঁর প্রগাঢ় প্রজ্ঞাঋদ্ধ বিশ্বনাগরিক মননে একটি গ্রামের প্রতি, গ্রাম বাংলার প্রতি একমাত্রিক প্রেম অসম্ভব।($) তা হবে স্বভাবতঃই বহুস্তর। আর যত বাড়বে স্তরভেদ আসবে অন্য অন্য অনুভূতি, প্রভাবিত করবে, মূল অনুভূতির বিশুদ্ধতা যাবে কমে। এই ভাবেই আবিল হবে মুগ্ধতা।
শিষ্য - আপনার ব্যাখ্যা ঠিক হজম হোলো না। যেন হাতে সাবান মাখিয়ে ছোট সাইজের চুড়ি জোর করে পরিয়ে দেওয়া। আবিল মুগ্ধতা - আমার মতে ভয়ংকর সুন্দর গোছের একটা oxymoron যা সচেতন ভাবে ব্যবহার করা হয় Gimmick বা চমক সৃষ্টিতে। যদি আপনি বলতে চান যে জীদার প্রকৃতিপ্রেম বিভূতিভূষণের মতো রোমান্টিক আপ্লুতায় মাখামাখি ছিলনা, তাতে ছিল ধারালো বৌদ্ধিক উপাদানও, তাহলে যুৎসই শব্দবন্ধ হতে পারতো - আপাত মুগ্ধতা। অর্থাৎ আপাত ভাবে লেখায় কবির যে মুগ্ধতা চোখে পড়ছে তা ছাড়াও বা তার প্রেক্ষাপটে আরো কিছু অদৃশ্য উপাদান আছে।
গুরু - সাবান মাখিয়ে ছোট চুড়ি পরিয়ে দেবার উপমাটি অনবদ্য এবং উপভোগ্য। (শিষ্যের টীকা - অর্থাৎ গুরু তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল)
শিষ্য - গুরুদেব যদি আমার আর একটা খটকার নিরসন করেন তাহলে ভালো হয়। আপনার আগের প্রতিবেদনের একটু অংশ তুলে দিচ্ছি:
"১৯৩৩-৩৪ সালে লেখা এইসব অপ্রকাশিত লেখাগুলি, সংখ্যায় প্রায় গোটা ষাটেক এই বিপন্নতা বোধ, মৃত্যুচিন্তা নয় আসলে এক ভীত সন্ত্রস্ত নিরাপত্তা হীনতা থেকে লেখা। সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ যখন য়োরোপের বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছিলেন জীবনানন্দ তাঁর ত্রস্ত, চকিত, শশকগমনে বারবার মেপে নিচ্ছিলেন বরিশাল থেকে কলকাতার দূরত্ব।"
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ছিল ২৮.৭.১৪ থেকে ২৮.১১.১৮ আবার ১.৯.৩৯এ হিটলার কর্তৃক জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ দিয়ে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয় তা মিত্র শক্তির কাছে ২.৯.৪৫এ জার্মানির পতনে শেষ হয়। জীদা ঐ কবিতাগুলি লিখেছিলেন ১৯৩৩-৩৪ সালে। তাহলে এই দুই মহাযুদ্ধের মাঝে সাময়িক শান্ত সময়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ৫ থেকে ৬ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ "য়োরোপের বাতাসে বারূদের গন্ধ" কী ভাবে পেলেন? তাহলে কী জীদার তখনকার বিপন্নতা আসলে ছিল সংসারে নিদারুণ অভাব ও নিজের অনিশ্চিত পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে? আলোকপাত প্রার্থী।
গুরু - জীবনানন্দের পেশা সংক্রান্ত বিপন্নতা সবসময়েই তাঁকে বিপন্ন করেছে, বিব্রত রেখেছে। সে তাঁর কবিস্বভাবের কবচ-কুণ্ডল, তাঁকে দাম্পত্য অশান্তিও আন্দোলিত করেছে অনুরূপ। সাধারণ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ইত্যাদি কবির প্রতিষ্ঠা ও বুদ্ধির বৈঠকখানায় সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে প্রমুখ কবির জাঁকালো পসার, কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বলে কাউকে লোক চেনেই না। এমনকি যে রবীন্দ্রনাথ, যিনি টাকের চুল গজানোর তেলেও ঢালাও সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তাঁর মতেও জীবনানন্দের লেখা নিছক চিত্ররূপময়। জীদাকে লেখা চিঠিতে মৃদু অনুযোগও করেছেন তিনি "উপমা প্রভৃতি নিয়ে এতো জবরদস্তি করো কেন বুঝতে পারিনে।" তাঁর কবিতার সমালোচনা প্রসঙ্গে একটি কবিতায় ৪২টি "মতো"-র উল্লেখ করে সজনীকান্ত দাস লেখেন "কেবল হাঁদার মতন কথাটি কোথাও নাই"। এ থেকে জীবনানন্দের প্রতি শনিবারের চিঠির মানসিকতা বোঝা যায়।
পরিচয় পত্রিকার আড্ডায় কখনো সখনো যোগ দিলেও জীবনানন্দ পরিচয়ের উচ্চবিদগ্ধ, উচ্চবিত্ত, জ্ঞানময় কাব্যপরিমণ্ডলে কখনোই খাপ খাওয়াতে পারেননি। এমনকি তাঁর কবিতা যখন প্রকাশিত হোলো তখনো জীবনানন্দ বুদ্ধদেবের ২০২, রাসবিহারী আভেন্যুর সমগোত্রীয় ও প্রায় সমমানসিকতার সহজীবি কবিবন্ধুদের সঙ্গেও অন্তরঙ্গ হতে পারেননি। এক-দুবার অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজনে শশকগমনে পদার্পন ভিন্ন কবিতা ভবনের পরিমণ্ডল থেকে তিনি তফাতেই থেকেছেন।
কল্লোল ও কালিওকলম পত্রিকায় তাঁর প্রথম দিকের লেখা প্রকাশিত হলেও এই পত্রিকাগুলির মেজাজ তাঁর কবিতার মেজাজের থেকে স্বতন্ত্র ছিলো। গোকুল নাগের কল্লোল ও শৈলজার (সম্ভবতঃ) কালিওকলম পত্রিকার প্রধান কবি ছিলেন যথাক্রমে প্রেমেন্দ্র মিত্র ও নজরুল। এঁদের মধ্যে নজরুলের প্রভাব তাঁর মধ্যে প্রথমদিকে (ঝরাপালকের যুগে) স্পষ্ট ছিলো। প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রতি তাঁর সম্ভ্রমও হয়তো কিঞ্চিৎ হীনম্মন্যতাবোধ থেকেও হতে পারে। তাঁর আচরণ কখনো কখনো এরকম ঈঙ্গিত দিয়েছে।
কিন্তু এসকল বিপন্নতা কবির সহজাত এবং যেমন আগে বলা হয়েছে, কবচ-কুণ্ডল স্বরূপ, কেননা এইসব বিপন্নতা অনেকাংশে তাঁকে রক্ষা করেছে নির্জনতায়। কোনো গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়েননি। নির্জন একাকীত্বে এ্যাকাডেমিক অর্থে য়োরোপীয় কাব্য পাঠে অধিকার, বিশেষতঃ ইংরেজী কাব্যে অধিকার থাকার দরুণ, দেশী ও বিদেশী মিশ্র পরিমণ্ডলে গড়ে উঠেছে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞান। কিন্তু কেবল এসবই নয়, রূপসী বাংলার কবিতা গুলির নির্মান প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক তাৎপর্য্য এইপ্রকার:
১. সেই সময় বিশ্বজোড়া মন্দা
২. আমেরিকায় বেসরকারী ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার পতন
৩. জানুয়ারী, ১৯৩৩ এ হিটলারের চ্যান্সেলার পদে মনোনয়ন ও থার্ড রাইখের দিগ্বিজয় (শিষ্যের টীকা - দিগ্বিজয়?? 39 এ পোল্যান্ড আক্রমণের ছ বছর আগেই)
৪. হিটলারের ইহুদী বিদ্বষ ও বেতারে গ্যোয়েবেলসের গুজব বিস্তার (শিষ্যের টীকা - তাতে গ্ৰাম বাংলার কবির নিরাপত্তাহীনতার কী কারণ হোলো? কেবল ভুগোল পড়ে বিশ্বনাগরিক হয়ে কোনোদিন বিদেশে না গিয়েও এমন চিত্তবিকলনের সম্ভাবনার ধারণা আমার কাছে দূষ্পাচ্য)
৫. অক্টোবর, ১৯৩২ এর পর থেকে মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্তদের বাড়বাড়ন্ত। (শিষ্য - ইতালি তো বহুদুরে!! এখনকার মতো যোগাযোগও তখন এত উন্নত ছিল না, তাই তাতে ব্যাক্তিগতভাবে বিপন্ন বোধ করার কী হোলো? প্রতিবাদে জ্বালাময়ী কবিতা লেখা যেতে পারতো)
৬. ভ্যাটিকানে নজরবন্দী পোপ ও দুনিয়াজুড়ে ধর্মভীরু খ্রীষ্টানদের সংকট।
৭. ১৯৩২ - ৩৩ এর কুখ্যাত সোভিয়েত ফেমাইন ফলে গণহত্যা ও গণমৃত্যু। যোসেফ স্তালিনের এই নারকীয়তায় প্রায় ৭.৫ লক্ষ্য মৃত্যু ফলে কম্যুনিজ্মের বিপন্নতা ও অস্তিত্বের সংকট।
৮. ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী পদে বল্ডুইনের ব্যর্থতা।
৯. ভারতবর্ষে আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যার্থতা। (শিষ্য - এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে)
১০. গোলটেবিল থেকে গান্ধীজীর শূন্যহাতে প্রত্যাবর্তন।
১১. গান্ধী-আরউইন চুক্তির ব্যর্থতা।
১২. বিহারের সাঙ্ঘাতিক ভুমিকম্প এবং সেই প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাকে গান্ধীজীর হরিজনদের প্রতি পাপের কর্মফল বলে আখ্যা দেওয়া ও রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তার ভর্ৎসনা। (শিষ্য - তাতে জীদার বিপন্ন বোধ করার কী হোলো?)
১৩. জাভা যাত্রার প্রাক্কালে য়োরোপীয় সভ্যতাপ্রসঙ্গে শ্রী দীলিপ কুমার রায় ও শ্রীযুক্ত অমিয় চক্রবর্তী সন্নিধানে রবীন্দ্রনাথের বিষোদগার। (শিষ্য - তাতে জীদার বিপন্ন বোধ করার কী হোলো?)
১৪. রোমাঁ রল্যাঁর কাছে জবাবী চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কিত মন্তব্য "য়োরোপের বাতাসে আজ বারুদের আগাম গন্ধ"। (শিষ্যের টীকা - তাতে জীদার বিপন্ন বোধ করার কী হোলো? এই "আগাম" বিশেষণটা আপনার বক্তব্যে আগে ছিলনা বলে খটকাটা লেগেছিল)
১৫. অক্টোবর, ১৯৩৩ হিটলারের জর্ম্মনির লীগ অব নেশন্স থেকে ইস্তফা এবং ইটালী, জাপান সহ অক্ষশক্তির জোটসঙ্গীদের পদানুসরণ। (শিষ্য - তাতে জীদার বিপন্ন বোধ করার কী হোলো?)
আমার ধারণা এই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংকট গুলিও জীবনানন্দের কবিমানসে বিপন্নতার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাময়িক কিন্তু প্রবল অনুঘটক রূপে ক্রিয়াশীল ছিলো।
শিষ্য - কাফকা একবার হৃদয় উজাড় করে এক চিঠি লিখেছিলেন তাঁর রাশভারী দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিতাকে। অবশ্য তিনি নিজে তা পিতাকে দিতে পারেন নি। দিয়েছিলেন মাকে। মা তা পড়ে কাফকেই ফেরৎ দিয়ে বলেছিলেন, এমন চিঠি দিসনে খোকা, অনর্থ হয়ে যাবে। কাফকা সেই চিঠি ও আরো কিছু লেখালেখির পান্ডুলিপি তাঁর নিকট বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের জিম্মায় রেখে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর সেসব জ্বালিয়ে দিতে। বন্ধু সেই কথা রাখেনি বলেই বিশ্বসাহিত্য কাফকার অনেক লেখা পেয়েছে including, "Letter to my Father". তাতে জানা যায় কাফকার বিপন্নতাবোধের পশ্চাৎপটে তাঁর পিতার বিরাট ভূমিকা ছিল।
জীবনানন্দর ক্ষেত্রেও তাঁর বিপন্নতাবোধের সঠিক কারণ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল হতে পারতো যদি তাঁর নিজের লেখা কোনো ডায়েরী পাওয়া যেতো যাতে তিনি আত্মকথনের মতো নিভৃতে লিখে গেছেন তাঁর ভাবনা। যদি তেমন কিছু পাওয়া গিয়ে থাকে জানতে ইচ্ছুক। আপনার প্রথম মন্তব্য থেকে কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি:
১. জীবনানন্দের যে মুগ্ধতা তা অনেকখানিই নিরাপত্তাহীনতাপ্রসূত (#)
২. জীবনানন্দের রক্তে নেই বিশুদ্ধ গ্রাম্য সারল্য প্রীতি (&)
৩. তাঁর প্রগাঢ় প্রজ্ঞাঋদ্ধ বিশ্বনাগরিক মননে একটি গ্রামের প্রতি, গ্রাম বাংলার প্রতি একমাত্রিক প্রেম অসম্ভব (&)
উপরোক্ত লাইনগুলোতে "হয়তো" বা "বোধহয়" গোত্রের কোনোরকম ক্রিয়া-বিশেষণ ব্যবহৃত হয়নি। অর্থাৎ বাক্যগুলি গভীর প্রত্যয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষকের মতো কয়েকটি Firm Statements. উপরোক্ত মন্তব্যগুলি "হয়তো" জীবনানন্দর জীবনসংকট সম্পর্কে আপনার পাঠাভিজ্ঞতালব্ধ অভিজ্ঞান বা সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞদের অভিমতজাত।
কোনো কবি, বিশেষ করে জীদার মতো একান্তচারী, নির্জনতা প্রিয় অন্তর্মূখী মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতি সম্পর্কে এহেন দৃঢ়তার সাথে এমন সংশয়হীন অভিমত দেওয়া যায় কিনা জানি না। জীদার লেখা ও ব্যক্তি জীদা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত আমার পড়া না থাকায় এ প্রসঙ্গে আমার তরফ থেকে আলোচনায় এখানেই ইতি টানছি।
আপনার শেষ মন্তব্যে নানা তথ্য সহকারে আপনি প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন যে জীদার বিপন্নতা ও নিরাপত্তাহীনতা অনেকাংশেই তৎকালীন কিছু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ঘটনাপ্রবাহের কারণে। হতে পারে। তবে কেন জানি না, আপনার বিশদ ব্যাখ্যা পড়েও আমার মনে হয় - জীদার বিপন্নতা, হীনমন্যতা, নিরাপত্তাহীনতা এসবের জন্য আপনার উল্লিখিত বাহ্যিক কারণসমূহ ছিল গৌণ। তাঁর নড়বড়ে আর্থিক অবস্থাজনিত দারিদ্র্যের কারণে সংসারে অবহেলা প্রাপ্তি এবং লেখালেখি সম্পর্কে সমসাময়িক বিদ্বজনদের কাছ থেকে স্বীকৃতি না পাওয়া (বরং কখনো বিদ্রুপ পাওয়া) - এ দুটিই হতে পারে প্রধান কারণ।
ব্যাঙ্কে মোটা ব্যালান্স, পেটে উপাদেয় খাদ্য পানীয়ের যোগান অব্যাহত থাকলে, দেশে বা বিদেশে শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল কক্ষে বসে গরীব, ক্ষূধার্তদের নিয়ে ক্ষুরধার গদ্য, পদ্য লেখায় মাথা ভালো কাজ করে। অতীতেও যেমন লিখতেন তৎকালীন কিছু বিচারক, জমিদার, বিশ্বপথিক বা ICS. নিজে দূর্দশাগ্ৰস্ত হয়েও বঞ্চিতদের নিয়ে দরদী সাহিত্য, সিনেমা করা যায় (মাণিক, ঋত্বিক)। তাঁরা ব্যতিক্রম। কিন্তু আমার মনে হয় - সেক্ষেত্রে বিপন্নতা বোধের শিকড় অনেকটাই তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো নিজের গভীরে ছড়িয়ে থাকে - যা সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
Some opinions are debatable when those are based on individual perspectives. Anyway, even if I am not fully convinced with your all arguments due to my own limitations and some inexplicable realisations and surely not having detailed factual information about JD, however I appreciate your meticulous presentation. Such discussions are indeed food for thought and quite engaging as well.
Wish to engage into such discussions in future dispassionatelyely without bias, prejudice. We can exchange openly about some topics in our zone of common interest. We should not indulge in thursting upon our views on others rather we should present it in a matter of fact manner. We should not spoil the mood of such discussion using unwanted sarcasm. Well done and keep alive your habit of healthy discussion with an academic flavour.
(যেহেতু শিষ্য গুরুর থেকে বয়সে এবং সম্পর্কে প্রবীণ তাই শিষ্য এই concluding statement দিয়ে সেদিন উপরোক্ত আলোচনার যবনিকা টেনেছিল।
তবে গুরুচণ্ডা৯তে ঋদ্ধজনের অভাব নেই। তাদের কেউ যদি এই গুরু-শিষ্য সংবাদ পড়ে নৈর্ব্যক্তিক আঙ্গিকে কিছু আলোকপাত করতে চায় - স্বাগতম)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।