আক্রম ভাইকে বলতে সে করবেট জাতীয় উদ্যানে যাবার- থাকার জায়গা ঠিক করে দিল।
— কতগুলো এফ আর এইচ মানে ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে উত্তরাখণ্ডে ?
— কেন আছে এইসব রেস্ট হাউসরা ?
— কলোনির সাহেবদের কেনইবা দরকার পড়ে জঙ্গল বলে বিশেষ কিছু জায়গাকে চিহ্নিত করতে ?
অথচ এসব তারা করেছিল আর একটা বিশেষ অঞ্চলকে শহর বলে চিহ্নিত করে, যেখানে আপিস করে গাছ বা প্রাণীকুলের সব পরিচয় ঠিক করে দেবে একটা বিশেষ রকমের প্রাণী।
অথচ সেই প্রাণী তার মস্তিষ্কের ঘ্রাণের আশ্চর্য ক্ষমতা কবেই হারিয়েছে, হারিয়েছে মস্তিষ্কের সেই সব বিখ্যাত অঞ্চল যা দিয়ে বিশেষ রকম করে সামান্য শব্দও শোনা যায়।
অথচ হারিয়েছে সব যা তাকে শিকারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ করতে পারত। বিন্দুমাত্র ভায়োলেন্ট না হয়ে একমাত্র খিদের জন্য রক্তপাত ঘটাতে কাবিল করতে পারত।
—— অথচ সেই প্রাণী এতটাই নির্লজ্জ যে স্বীকার করতেও ভয় পায়।
—— কী স্বীকার করতেও ভয় পায় ?
—— অথচ সে স্বীকার করবেই না বলে ঠিক করেছে।
—— কী স্বীকার করবেই না বলে ঠিক করেছে ?
—— অথচ তার মস্তিস্কের বিশেষ বিবেচনা বোধ তাকে তৈরি করে চলেছে অনবরত।
—— কী তৈরি করেছে ?
—— তৈরি করেছে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে।
—— কী ভাবে ?
—— কলোনি তৈরি করে।
—— কলোনি তৈরি করে চলে , তার উন্নত বিবেচনা বোধ তাকে বলছে -লক্ষ বছরের বিবেচনা বোধ কাজে লাগাও। আর……
—— কী আর ?
—— তৈরি করিয়া চল কলোনি।
—— কী দিয়ে ?
—— অস্ত্র দিয়ে।
—— অস্ত্র ?
—— ভয় দেখানোর মতো ।
—— কী ?
—— অস্ত্র, সম্ভ্রম জাগানোর মতো অস্ত্র।
—— কী ?
—— ভাষার অস্ত্র। ল্যাটিন ভাষার অস্ত্র। রোমান হরফের অস্ত্র।
হ্যাঁ , এই ল্যাটিন কথিত হোমোসেপিয়ান যার মানে হচ্ছে গিয়ে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী আর তার শ্রেষ্ঠত্ব , অপরাজেয় পৌরুষ প্রমাণ দিতেই কলোনির সাহেবরা শহরের আপিসে বসে বসে আমাদের গাছপালা , বন , জঙ্গলের সব কিছুর ভিতরে ভিতরে ল্যাটিন নাম ঢুকিয়ে দিয়ে চিহ্নিতকরণের এই কায়দা চালু করল। এসব জঙ্গল হয়ে গেল লাটসাহেবের বিপুল এস্টেট আর রাজত্বের-কলোনির পরিসীমা। যেখানে এস্টেট গড়তে দেবেনা বলে হাতি আর বাঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে , জংলী অপরাধপ্রবণ আদিবাসী মানুষের এলাকা । সেখানের সাহেবি আরাম করতে দরকার ফরেস্ট রেস্ট হাউস , পরিখা ঘেরা ছোট ছোট কেল্লা যেখানে হাতের কাছেই ভয়ঙ্কর রক্তপাত ঘটানোর জন্য থাকছে রাইফেলের সারি।
কতগুলো এফ আর এইচ মানে ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে উত্তরাখণ্ডে ? একটা বই বলছে একশো আটষট্টিটা মানে ওয়ান হান্ড্রেড সিক্সটি এইট। বইটা ইংরেজিতে লেখা। মলাটে কৌশানির ছবি সূর্যোদয়ের, সেখান থেকে লাল আলো বইয়ের পাতা জুড়ে ছেয়ে গেল। বেশ মোটাসোটা বই প্রায় আড়াইশো তিনশো পাতার কফি টেবিল সাবসুবর্ণ, দামী আর্ট কাগজে ছাপা আর বড় সড় বইটা রাখতে গেলে কফি টেবিল লাগবেই। সেই বইয়ের পাতায় পাতায় সূর্যোদয়ের রঙ অন্যান্য হরেক কিসিমের ছবিগুলোর সঙ্গে লেপ্টে গেলো। আমি খুঁজতে লাগল আমাদের জন্য যে এফ আর এইচ বুক করা হয়েছে তার হাল হকিকৎ। পেয়েও গেলাম। একটা পাখি দেখলাম, বসে রয়েছে। সেই এফ আর এইচয়ে প্রাচীন ছাদে। ছাদটা টালির আর একটা চিমনিও আছে, সেখান দিয়ে ধোঁয়া বেরোনোর কথা। বেরোচ্ছে কিনা বোঝা জাচ্ছে না কারণ রান্নাঘরের ভেতরটা দেখা বড় মুশকিল সেখানে কেউ একজন নিশ্চয়ই রান্না করবে তবে বান্দা যেহেতু মানুষ তাই না দেখে তার আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। ব্যপারটা খতরনাক শ্বাপদকে দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করানো খুবই রিস্কি। খানা পাকানোতে যতই দড় হোক না কেন রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সে যদি বাতকম্ম করে তবে তার কাবাবের খুশবু দিয়ে তাকে ঢাকা যায় কীভাবে ? যদিও বন বাংলোয় মাংস চলে না। এটা ভাবতে ভাবতে আবার পাখির দিকে চোখ চলে গেল। আকারে ছোট পাখিটা দেখি নড়াচড়া করছে আর তারপর বার্ড ওয়াচারদের নজরে যে পড়ে গেল। ওমনি ইউটিউবে কথা শুরু হল মিঠে গলায় আর পাখি আস্তে আস্তে শ্যাডো করতে করতে ফুড়ুৎ। পাখির উড়ে যাবার শব্দ পেলাম আর তাতে কফি টেবিলে বইটার বাংলোটার ছবি আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলোটার হাতায় অনেকটা জায়গা ছবির মধ্যে দিয়ে সুস্পষ্ট হচ্ছিল।ছবি দেখতে দেখতে স্মৃতি বিনিময় হয়। গুলিয়ে গেল বইয়ের ছবি , চকচকে ছবি আর ধূসর কিছু ছবিরা। আমাদের মালানি এফ আর এইচয়ে কদিন যাপনের স্মৃতিরা কথা হয়ে ভনভন করতে থাকে। আবার আমাদের পাঁচজনের জুটি এক হই। আমি , বাঘা , রাজু , পার্থ আর কুমু।
পার্থ গাছ আঁকছিল। এক বিশেষ আলোয় সে দেখেছে গাছকে যার তলায় রাতের বেলা হরিণ ঘুরছিল। রাতের বেলা বলে তখন গাছকে দেখা যায়নি, রান্নাঘরের জানলার পাতলা জালের ওপাশে দলে দলে হরিণ দেখা গেছে — চিতল হরিণ। ছবি আঁকছে দেখে বাঘা তাকে বলল,“সূর্যের আলোয় তোর মাথা ধরে যাবে। ছাওয়ায় বস।” পার্থ বলল,“ হ্যাঁ রোদে আমার মাথা ধরে যাবে। সরে যাচ্ছি। ” বাঘা বলল,“ সূর্যের আলো পড়লেই রোদ হয় আর গরম চেপে আসে তখনই তোর মাথা ধরবে। এই জঙ্গলের মধ্যে মাথা ধরে গেলে রোদ লেগে গেলে বড় মুশকিল।” একটা বিশেষ কোণ থেকে পার্থ গাছটা দেখতে পেল আর আলো এসে তাতে এমনভাবে পড়ল যে সে থাকতে না পেরে ছবি আঁকছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বাঁদর হেঁটে হেঁটে আসছিল, কুমু মালানি বনবাংলোর চাতালে বসে বসে দেখছিল বাঁদরের হাঁটা — রাস্তা দিয়ে। সে সার সার বাঁদর আসতে পারে এই ভয়ে উঠে বাংলোর ডাইনিং হলের জাল লাগানো দরজাটা বন্ধ করে দিল যাতে ওরা ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা ফল টেনে নিয়ে না যায়। বারান্দার ওপর দিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে কুমু রাজুর পা মাড়িয়ে দিচ্ছিল আর বলে উঠল,“ সরি রাজুদা।“ রাজু সকালবেলা সাফারি করে ফিরে ঝিমোচ্ছিল, সে বলল,“ সরি ? কেন সরি বলছিস ?” কুমু বলল,“ এমনি। ” রাজু বলল,“ এমনি কেউ কাউকে সরি বলে ?” কুমু চুপ করে গেল। সে চুপ করে গেলে আসপাশও চুপ করে গেল কারণ এখন আর কোন আওয়াজ হচ্ছে না। কোন পাখি ডাকাডাকি করেনি, কোন জন্তুর ডাকও শোনা যায়নি। প্রসারিত হয়েছে জমিখানা, তারের বেড়া দিয়ে সুস্পষ্ট ঘেরা জায়গাটার যেন আরো বড় আরো বেশি হতে চাইছে। সামনে শুখনো রাস্তা সোজা চলে গেছে মালানি বনবাংলো ছেড়ে। সেটা গেট দিয়ে আলাদা করা আছে। পাতলা লোহার গেট আর তাতে রাত হলে সৌর বিদ্যুত লাগানো থাকে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে অথবা বেরতে। গেটের গা দিয়ে দিয়ে তার লাগানো থাকে, পাতলা তার অথচ আলো না জ্বালিয়ে তাতে বিদ্যুত সংযোগ করা হয়। রাজু প্রথম দিন সকালে ওই গেটের বাইরে যেতে গিয়েছিল, তাকে বলা হয়েছিল না যেতে, বারণ করা হয়েছে। গেটের ওপারে জীবজন্তুরা থাকে তাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে দেখাসাক্ষাৎ করা চলবে না। যা কিছু বাইরে যাবার তা ওই সকালবেলা বা বিকেলবেলা সাফারি করার সময়। বাংলোর ডান পাশ দিয়ে ওই যে রাস্তা ধারাবাহিক আসতে থাকে সেটা যেন সব সময় চোখে পড়বে সবারই অথচ তাতে হাঁটা যাবে না। আমি ,রাজু , বাঘা আর কুমু ছড়িয়েছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে ঝিমিয়ে বারবারই ওই রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম । একমাত্র পার্থই মাটিতে বসে। সে একটা গাছ একমনে তুলে এনে তাতে রঙের আঁচড় দিয়েছে আর আর তাও কাগজের ওপর সেখানে এখন অনেক ঘাস বানাতে হবে। সেটা রাস্তার মতো নেড়া হলে চলবে না — এপ্রিলের দুপুরের জঙ্গলের রাস্তার মতো। গরম দুপুরের হাওয়া চারপাশ থেকে ধুলোও আনছিল। গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো, কখনও দেখা যায় কখনও যায় না। রাজু কুমুকে বলল,“ চা করতে বল না ভিকিকে।” কুমু কিছু বলছে না দেখে সে বলল,“ বলবি না ?” কুমু তার ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে পড়ছিল। বাঘা এখনও ঝিমোচ্ছে, তার চোখ আধবোজা, সেকি একটু একটু করে সব দেখে ফেলছে বলে চুপচাপ ? কুমু বই বন্ধ করে বলল,“ বলছি। ” বলে সে মালানি বন বাংলোর কিচেনে ভিকি বলে যে ছেলেটা রান্না করে দিচ্ছে তাকে চা বানাতে বলতে গেল। বেতের আরাম কেদারায় তার বইটা পড়ে রইল। যতক্ষণ না কুমু ফিরে এসে আবার তাকে তুলে নিচ্ছে সে পড়ে থাকতেই পারে আর হাওয়া এসে তার পাতাকে মাঝমধ্যে তুলে ধরবে তখন তার ফাঁক দিয়ে শব্দরা গড়াতে থাকবে, গড়িয়ে গড়িয়ে মালানির চারপাশে শব্দরা দেওয়াল তুলতে থাকবে। সে দেওয়াল দেখা যেতে পারে নাও পারে। সেখানে অনেক কথা লেখা থাকবে। হিজিবিজি সব কথা। বই থেকে বেরিয়ে শব্দরা গরমের মধ্যে হাল্কা হয় উড়ে উড়ে এঁকেবেঁকে উল্টোপাল্টা কথা লিখেছে দেওয়ালের ওপর যার ভেতর দিয়ে অনায়াসে পারাপার করা যায় বলে বাঘা এক বড় হাই তুলে ঝিমুনি থামাল আর তখনই তার পার্থর দিকে চোখ পড়ল। সে দেখল পার্থ রোদ থেকে সরে এসে বনবাংলোর সামনে বারান্দার এক কোণে বসে , মাটিতে বসে , একমনে ছবি আঁকছে আর বাপ্পা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাঘা কীরকম করে দেখছে ছবি ? সে তো ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার কীরকম করে ছবি দেখার কথা ? আমি বাঘাকে বললাম,“ তুই কীরকম করে ছবি দেখছিস ?”
—— মানে ?
—— তুই তো ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছিস।
—— পার্থর ছবি দেখছি।
—— পার্থ তো বসে রয়েছে।
—— তাতে কী ?
—— পার্থ বসে বসে ছবি আঁকলে তোরও বসে বসে দেখার কথা।
বাঘা কোন উত্তর দিল না, পার্থ বলল,“ আমি গাছের ছবি আঁকছি। ওই গাছটাকে ওপাশ থেকে দেখেছিলাম। ওখানে আঁকতে শুরু করেছিলাম কিন্তু গরম পড়ে গেল। ছাওয়ায় চলে এলাম। বারান্দায় ফ্রেমটা তুলে নিয়েছি। আঁকছি। আলোটা কীরকম যেন পড়েছিল ?” বাঘা বলল,“ পড়েছিল বলছিস কেন ? এখন নেই ?” পার্থ বলল,“ না নেই। আলোটা অন্যরকম হয়ে গেছে। গরমটা বেড়ে গেছে দেখছ না।” বাবাই বলল,“ আর গাছটা ?” এই সময় কুমু চা নিয়ে এল। সে সবাইকে চা দিতে লাগল। এ এরকম ঠিকই হয়ে গেছে মেয়েরাই সবাইকে চা দেবে তাই কুমু দিচ্ছিল। রাজু বলল,“ কুমু ছেলেদের নামও হতে পারত।” কুমু বলল,“ কিন্তু চা-টা বানিয়েছে ভিকি - সে ছেলে। ”
চায়ে একটা লেবু দেওয়া ছিল। তার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল হাওয়ার মধ্যে। চার দিকে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ার কথা। মালানি বন বাংলোটা -এফ আর এইচটা জঙ্গলের হাতার মধ্যে থেকেও অনেকটা পাহাড়ের ওপরে । জঙ্গলের এই বিজরানি রেঞ্জে ঢোকার মূল গেট দিয়ে ঢুকেও অনেক উঁচুনিচু পেরিয়ে তাতে যেতে হবে। তখন জঙ্গল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দেখে আর তার গা থেকে থেকে সব পাতারা খসে গিয়ে মাটিতে পড়ে আছে , ফলে তারা তাপমাত্রা কমা বাড়া খুব বুঝতে পারে। রাতে যখন বাঘ তার ছানাকে নিয়ে হাঁটা দেয় তখন হিম পড়ে পড়ে পাতারা নেতিয়ে থাকায় কোন আওয়াজ দেয় না। সে সময় তাদের রঙও বদলে অনেকটা কালো মতো হয়ে যায় আর তার ওপর দিয়ে বাঘ তার ছানাদের নিয়ে অনবরত নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে থাকে। সে বাঘকে কি শেরনি বলা ঠিক হবে ? সে কি জেনেশুনে মেয়ে বাঘ হয়েছে ? তবে তার বোধ তাকে বলছে , অন্য কিছু থেকে, যার মধ্যে বাঘও পড়ে, ছানাদের বাঁচাতে হবে। না হলে ছানারা মরে যাবে আর সেটা তার সহ্য হবে না। কুমু কি এইভাবে না জেনে মেয়ে হয়ে জঙ্গলে এসেছে ? তবে বাঘ তার ছানাদের নিয়ে নিঃশব্দ রাত্রিতে হাঁটতে হাঁটতে কখনও কখনও রাস্তাতেও এসে পড়েছিল। এখন রাস্তায় পুরু ধুলো আর তাতে জিপসির টায়ারের দাগ কারণ অন্য কোন গাড়ি এখানে আসা নিষেধ। মাঝে মাঝে বনবিভাগের মাল বওয়া ট্র্যাক্টর আসা যাওয়া করতে পারে আর সরু সরু মটোর বাইকের চাকা দেখা যেতে পারে নাও পারে যা বনরক্ষীদের নিজস্ব। টায়ারের দাগের পাশাপাশি বাঘ ও তার ছানাদের তেরছা দাগ দেখতে পেয়ে কুমু বলেছিল,“ ওই দেখ। ” সবাই দেখল বাঘের ছাপ। আলম নাম করে যে গাইড অথবা ড্রাইভার ছেলেটি আছে তারই প্রথম দেখার কথা কারণ সে ধিকালাতেই জন্মেছে যা করবেটের প্রাণ — ওই বনবাংলোর আসপাশের কোন স্টাফ কোয়ার্টারে তার বনরক্ষী বাবা ও মায়ের ঘরে। জঙ্গলের কথাতে আলমের হক আছে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। সে হয়ত সামনের দিকে তাকাতে গিয়ে টায়ারের একদম পাশে পাগ মার্ক দেখতে পায় নি। কুমুর দেখান বাঘের পা ও তার ছাপ দেখতে দেখতে সকালের সাফারির উদ্দেশ্য ঠিক হয়ে গেল আর তা হল বাঘ ও তার ছানাদের সঙ্গে মোলাকাত। আলম বলল,“ ক্যামেরা রেডি কিজিয়ে। '' চারজনের হাতেই ক্যামেরা ছিল আর ছিল ভোরের হিম যা ক্রমশ কমে আসছিল। তাপমাত্রা আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর বাড়ছিল। যতই বাড়ছিল ততো কি আরো গাছেদের পড়ে থাকা পাতাদের ওপর হাঁটার শব্দ বাড়ছিল, যার ফলে বাঘ ও তার ছানারা আরো দূরে সরে যাচ্ছিল কিনা কে জানে ?
আলম কান খাড়া করে শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল যা সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে। যা করবেট সাহেব শুনে আসছিল ছোটবেলা থেকে সেই — ‘কল’য়ের শব্দ , জীবজন্তুর ডাক। এটা হলে বোঝা যাবে বাঘ হাঁটছে আর বন্ধ হলে তার চলা থেমে গেছে এরকমটা ধরে নেওয়া যাবে কি ? এটাকে ওরা ইংরিজিতে ‘কল’ বলে কেন ? সেকি সাহেবরা আলাদা করে জঙ্গল দেখতে শিখিয়েছে বলে ? আগে কি কুমায়ুন গাড়োয়ালের লোক জঙ্গলকে আলাদা দেখতেই শেখেনি বলে আলাদা করে ডাক শুনতেও শেখেনি। তাই বোধহয় হবে, তবে আলমই কি করবেটের মতোই একটা কিছু যে জঙ্গলের ভেতরে একটা সভ্য মানুষ বলে প্রতিটি ‘কল’ই তার মুখস্থ হবে এমন কথা দেওয়া আছে। মুখস্থ এবং অভ্রান্ত তার লক্ষ্য। সে সব জানে , কোনখানে মহিলা শম্বররা চরে, কোনোখানে পাহাড়ের ওপর থেকে বুনো শুয়োরেরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তলায় জিপসি চড়া সাফারির দলকে যেন ছবির মতো করে দেখছে। বাঘা যে রকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বসে আঁকা পার্থর ছবি আঁকা দেখছিল, এইভাবে অভ্রান্ত লক্ষ্য হয়ে বাঘ ও ছানাদের খোঁজ করতে করতে গাড়ি গড়াতে গড়াতে নিয়ে এসে আলম একটা খাদের ওপর দাঁড় করাল । তার তলায় এক প্রাচীন জলাশয় দেখা যাচ্ছিল। চারজন সাফারির দল ওরা খুঁজতে লাগল এই জলাশয়ে হরিণ এসেছে কিনা আর বাঘ কোণ কোণ থেকে গুঁড়ি মেরে হরিণকে দেখছে কিনা। বাপ্পা, বাবাই, পার্থ আর কুমু প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব ক্যামেরা নিয়ে জিপসির ওপর থেকে অথবা নেমে হেঁটে গুঁড়ি মেরে নানারকম ভাবে ছবি শিকার করছিল। আলম তখন তার বায়োনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে চারপাশে একটা বড় ভাবে প্যান করে করে দেখার ও দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তখন খাদের ওপর আর তলা থেকে আস্তে আস্তে পাতার আওয়াজ বাড়ছে দেখে হাওয়া যেন আর একটু জোরে বইতে আরম্ভ করে দিয়েছে। বাঁদরেরা ঘুরে ঘুরে আরো বেশি করে লাফালাফি করায় আধ খাওয়া ফলেরা পাতার পুরু আস্তরণের ওপর পড়ছে। টুপটাপ টুপটাপ টুপটাপ। মনে হচ্ছে কে যেন পাতার ওপর দিয়ে আসছে। বোঝা গেল জঙ্গলের তাপমাত্রা অনেকখানি বেড়ে বেড়ে এমন হয়েছে যে গায়ে আর পাতলা সোয়েটার রাখা যাবে না। আলম খাদের ধারে চলে গিয়ে জলাশয়ের দিকে বায়নোকুলার দিয়ে দেখছে আর বলছে,“ দো মগরমছ হ্যায় তলাও মে।” সবাই আবার তাপমাত্রার কথা ভুলে জলাশয়ের কুমিরের নড়াচড়া দেখতে গেল। তারা ঘামছিল ও বোধহয় বাঘের কথা ভুলে গিয়েছিল , শুধু বাঘা বলল,“ এ ভাবে হয় না।”
—— কেন ?
—— গাড়িতে হয় না।
—— তবে ?
—— হেঁটে যেতে হবে।
—— কোথায় ?
—— হাঁটবি ?
—— পাগল !
—— হাঁটা বারণ।
—— জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে চলে যেতে হবে।
—— পাগল !
—— বাঘেরা আওয়াজ পেলে আগেই পালাবে।
—— না।
—— গাড়ির আওয়াজে পালাবে না ?
—— না। ওরা ‘ইউজড টু’ হয়ে গেছে।
—— ইউজড টু ?
—— কে বলল ?
—— আলম।
—— কখন ?
—— আমি শুনেছি।
—— ও বলছে যে সব বাঘেরা ‘ইউজড টু’ হয়ে গেছে তারা ভয় পায় না। মানুষের কাছাকাছি চলে আসে।
—— আর গাড়ির ?
—— জানি না।
—— ওরা গাড়ির কাছাকাছি চলে আসতে পারে হয় বাঘেরা নয় হরিণেরা অথবা বুনো শুয়োর সবাই চলে আসতে পারে।
—— যদি তারা ‘ইউজড টু’ হয়। আর ভয় পাবে না।
—— কেন ?
—— আলম বলেছে।
—— ও কি করবেট — যে সব জানে ?
—— ও কি সব জানে ?
—— করবেট সব জানত ?
—— জানি না।
—— জানতো না।
—— কী করে বুঝলি ?
—— সব জানতো ?
—— তা বটে।
—— ধিকালায় ঢোকার মুখে করবেটের একটা ছবি দেখলাম। জঙ্গল আর তার মধ্যিখানে করবেটের মুখ।
—— আর করবেটের বন্দুক ?
—— সেটা আমি কালাধুঙ্গির মিউজিয়মে দেখিনি।
—— তবে ?
—— বন্দুকের আলমারি দেখেছিলাম ।
—— কী ?
—— খালি।
—— করবেটের বন্দুক কোথায় ?
—— জানি না।
—— আলমের কি বন্দুক আছে ?
—— ওর বায়নোকুলার আছে।
—— করবেটের বায়নোকুলার ছিল কি?