সলিটারি
~~~~~~~
সকাল দশটার মধ্যে আমার ঠাঁই হল সলিটারি সেলে। সেলে আছে একটা ছোট জলের কুঁজো, আর তিনটে কম্বল। বহু যুগের নোংরা, ধুলো, বহু কয়েদীদের ঘাম জমে কম্বলগুলো শক্ত হয়ে আছে। কম্বল ভাঁজ করে পাথরের মেঝের ওপর আমি একটা বিছানা মত পেতে নিলাম। গেটের থেকে দূরতম প্রান্তে উঠোনের একমাথায়, মূল দালানের কোনায় আমার সেল। দুটো দেওয়ালের মাথার দিক দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে একটুখানি যোগাযোগ - মাটি থেকে আট ফিট ওপরে চার ফিট মত প্রস্থের একটা করে ফোঁকর। সেলের দরজায় ভারী, বড় লোহার কুলুপ আর তালা, সেলের দেওয়ালে এবড়োখেবড়ো চুনকাম - তার মাঝে মাঝে পোঁতা পেরেক উপড়ে নেওয়া ফোঁকর। এক কোনে কোমরসমান একটা কাঠের আড়াল, তার ওপাশে খাটা পায়খানা। এখান থেকে বর্জ্য গড়িয়ে যায় অন্যদের পায়খানার দিকে - যার ঠিক পাশেই ফাটকের কয়েদীরা রাতে শোয়। এই পায়খানার আর কল্পনার সেলের থেকে বেরিয়ে আসা নর্দমা বয়ে যায় আমার সেলের দেওয়ালের ঠিক পাশ দিয়ে - গরমের রাতে এই নর্দমার দুর্গন্ধে আমার বমি ঠেলে ওঠে। এই নর্দমাগুলির ফাঁক ফোঁকরে কোটি কোটি মাছি আর দানবীয় সব মশার বাসা - মনে হয় যেন এরা পালা করে প্রতি রাতে আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য চলে আসে।
সলিটারির শুরু কদিন যেন ঘোরে মধ্য কাটলো - দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা চিফ হেড ওয়ার্ডারের তালা চাবি পরীক্ষা, ব্যস্তসমস্ত মেটিনের খাবার নিয়ে আসা, আর আমার দাঁতা মাজা আর স্নানের জন্য ওয়ার্ডারের কোন রকমে গেট খোলা।
তাই যখন আবার জেরা শুরু হল, মনে হল সাদাপোশাকের পুলিশদের আনাগোনা, অন্য কয়েদীদের তাদের জন্য চেয়ার বয়ে আনা - এসবেও যেন একটু লোকজন দেখে, কথা বলে বাঁচবো। একবর্ণও হিন্দি না জানায় মেটিন, ওয়ার্ডার বা ওয়ার্ড্রেসদের আমার সামান্য প্রয়োজনও বোঝাতে পারার উপায় ছিল না আমার - সলিটারি সেলের দমবন্ধ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পুলিশের লোকদেরই মনে হচ্ছিল যেন বাইরের পৃথিবীর দূত!
জেরার পর জেরায় এতদিনে আমি এই জেরার খেলাটা আসতে আস্তে বুঝছিলাম। এরা আমার সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ তথ্য নেবে, আমার জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানতে চাইবে, সেসবকে লিখে রাখবে, এই করে আমার ফাইল মোটা হতে থাকবে, কিন্তু পৃথিবীর কোন গোয়েন্দা বিভাগেরই এসব কোন তথ্য আসলে আদৌ কোন কাজে লাগবে না। এদের প্রধান আগ্রহ ছিল আমি নক্শালদের কোন বড় নেতাকে চিনি কিনা আর এই আন্দোলন বা বিপ্লব নিয়ে আমার কী মত - তা জানার। বিহারের গ্রামে আমার উপস্থিতিকে এরা ভারতের বর্তমান অশান্তির পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অস্ত্র পাচার এইসব প্রমাণ করার একটা সূত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। দেশের বিপ্লবী উন্মাদনা নিয়ে জনমত আর সংবাদমাধ্যমগুলিকে জবাব দেওয়ার জন্য, কেমন করে অশুভ বিদেশি শক্তি এইসব অশান্তিকে মদত দিচ্ছে সেসব প্রমান করার জন্য আমাকে দিয়ে একটা যোগসূত্র তুলে ধরা ছিল এদের লক্ষ্য। এমনকি দেশ থেকে আমার বন্ধুরা টেলিগ্রাম করেছিল - কেমন করে আমাকে এই অবস্থায় সাহায্য করা যায় বলে - সেটাকেও ওরা 'রহস্যময় টেলিগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ষড়যন্ত্র ফাঁস' বলে রিপোর্ট করছিল। এদের দৈনন্দিন তল্লাশি আর হানায় আটক হওয়া প্রতি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তিকে এরা গুরুত্বপূর্ণ নকশাল নেতা বলে প্রচার করছিল; আমিও সেরকমই একজন। নক্শাল দমনের জন্যে এদের ওপর সরকারের চাপ ছিল, আর এরা এদের অভিযানের ফলাফল দেখাতে চাইছিল।
আমার পাশের সেলে কল্পনারও একই রকম জেরা চলছিল। আমাদের দেখা হত না, কিন্তু অনেক রাতে যখন বাইরের দেওয়ালের গম্বুজের মত নজরদারী টাওয়ারের প্রহরীরা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়তো, তখন আমরা দেওয়ালের দু'দিক থেকে চেঁচিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতাম - সারাদিন কী হল, কী দেখলাম। আমার সুদূর কল্পনাতে ছিল না যে আমাকে এরা হয়তো সত্যিই সপ্তাহখানেকের বেশি আটকে রাখবে। ওরা নিজেরাই বলছিল আমাকে ধরে রেখে কোন লাভ নেই, এমনকি সবচে' সন্দিহান অফিসাররাও বলছিল আমাকে মাস তিনেকের বেশি রাখার কোন মানেই হয় না। কিন্তু বাইরে, খবরের কাগজ, সংবাদমাধ্যমে আমাকে নিয়ে কী আলোড়ন পড়ে গেছে আমি তা জানতাম না। খবরের কাগজে নাকি তখন আমাকে "গেরিলা গার্ল" তকমা দিয়ে, জঙ্গলের মধ্যে দুঃসাহসিক বন্দুক যুদ্ধে আমার ধরা পড়া, ইউরেনিয়াম প্ল্যান্ট উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত, বিস্ফোরক দিয়ে পুলিশ থানা উড়িয়ে দেওয়া - এইসব খবর বেরুচ্ছে হৈহৈ করে।
অবশেষে তদন্তকারীরা সব ফিরে গেল - দিল্লি, পাটনা, কলকাতা, পাঞ্জাবে, আমার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখা মোটা মোটা সব ফাইল নিয়ে - আমাকে আমার খুপরি সলিটারি সেলে ফেলে রেখে। বাইরের পৃথিবী, এমনকি জেলখানারও অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন আমার সেলে।
তখনই মনে হয় আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম - গত কদিন, কয়েক সপ্তাহ ঠিক কী হচ্ছিল। এর আগে পর্যন্ত আমি বোধহয় ঠিক বুঝতেই পারিনি, কী চলছে, কী হতে পারে, কী হবে। আমার মস্তিষ্ক বোধয় এই ভয়ানক চাপ থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার চিন্তা পদ্ধতিকেই কিছুটা অকেজো করে দিয়েছিল - অন্তত শুরুর কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আমাকে মানিয়ে নেওয়ানোর জন্য।
এখন সলিটারির সেলের নিশ্ছিদ্র একাকীত্বে আমি ভাবার অবকাশ পাচ্ছিলাম, নিরবচ্ছিন্ন। অদ্ভুতভাবে, আমার ঠিক আতংক হচ্ছিল না। আমি তখনো বোধহয় ধরেই রেখেছিলাম আমাকে শিগিরই ছেড়ে দেবে, আমার প্রধান দুশ্চিন্তা ছিল আমার মা বাবাকে নিয়ে। আমার গ্রেপ্তারির খবর ওরা নিশ্চয় পেয়েছে - ওরা এখন কী দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে, আতঙ্কে আছে, এটাই ছিল আমার সবচে বড় চিন্তা। আর আমার ভয়ানক উদ্বেগ হচ্ছিল অমলেন্দুর জন্য। আমাকে যারা জেরা করছিল তাদেরই একজন বলেছিল, আমার থেকে অমলেন্দু অনেক বেশি বিপদে আছে। বাড়িতে চিঠি লেখা, আর অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার জন্যে কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আমার করার আর কিছুই ছিল না।
আস্তে আস্তে জেলখানার গৎ আর আমার বর্তমান জীবনের চারপাশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে লাগলাম - সত্যি বলতে কী, খুব সময়ও লাগলো না, বা খুব সচেতন চেষ্টাও করতে হলো না।
সকাল সাড়ে চারটেয় প্রধান ফটকে বেসুরো বিউগল বেজে ওঠে রোজ - তাতে সকালের রাউন্ডের জন্য ওয়ার্ডাররা সব উঠে পড়ে। কিছু পরে, তিনটে ঘন্টি পড়ে, কয়েদীদের সারাদিনের কাজের জন্যে উঠে পড়ে তৈরি হতে। ভোর হতে না হতে আমার স্লের বাইরে চিফ হেড ওয়ার্ডারের ভারী বুটের ধুপধাপ আওয়াজে বুঝতে পারি আমার ঘুম থেকে ওঠার সময় পেরিয়ে গেছে। আমার সেলের তিন ধাপ ওপরের সিঁড়ি থেকে ঝুঁকে, গরাদের তালা চাবি ঝনঝন করে নেড়ে সে পরীক্ষা করে আমি আমার খাঁচায় ঠিক আছি কিনা। তারপর, প্রতি সকালে (এবং সন্ধ্যায়), ঠিক একটাই কথা হেঁকে বলে - "এক কয়েদী - ঠিক আছে?" একদিন, আগের রাতের কল্পনার সঙ্গে বেআইনী কথোপকথনে শেখা নড়বড়ে হিন্দিতে আমি ওকে অনুরোধ করলাম আমাকে একটু বাইরে বেরিয়ে হাত পা নাড়ানোর সুযোগ, চিঠি লেখার কাগজ, আর আর অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা করতে দিতে। বড় গোঁফ, বেরেট টুপি, খাকি হাফপ্যান্ট পরা দানবের মত বিশাল শরীর নিয়ে চিফ হেড ওয়ার্ডার মনে হল একই সঙ্গে হতভম্ব, সন্দিহান, দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লো। আমি বুঝতে পারছিলাম বেচারা একটু ধন্দে পড়ে গেছে - আর পাঁচজন কয়েদীকে সামলানো আর একজন 'মেমসাহেব' কয়েদীকে সামলানোর মধ্যে কী ফারাক হতে পারে স্থির করতে না পেরে। ও মাঝেমাঝে কল্পনাকে স্বান্ত্বনা দিত - আমাদের শিগ্গিরি ছেড়ে দেওয়া হবে আশ্বাস দিয়ে। সত্যি বলতে কী, ও এটা সত্যিই বিশ্বাসও করতো। খুব সম্ভবত ওর বহু বছরের চাকরী জীবনে ও কোন 'শিক্ষিত' 'ভদ্রমহিলা' কয়েদী দেখেনি।
প্রতি সন্ধ্যার রুটিন তালা চেক করার পর আধো অন্ধকারে ও খুব ঠাহর করে আমার সেলের কোনায় কোনায় দেখতো - কোন গোলমেলে বেআইনী জিনিস লুকনো আছে কিনা। একদিন জলের কলের পাশে বাঁধা একটা দড়ি পেয়ে নিয়ে এসে ওটা আমি ধোয়া জামাকাপড় মেলার জন্যে আমার সেলে টাঙিয়েছিলাম। চিফ হেড ওয়ার্ডার সেটা দেখে কিছুক্ষন স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকলো। তারপর ইশারায় আমাকে ওটা খুলে দিয়ে দিতে বললো। পরে কল্পনাকে ও বুঝিয়ে বলেছিল - জেলে নিজের কাছে দড়ি রাখা বেআইনি। আমার তখন নিজেকে বকুনী খাওয়া স্কুলের মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল!
অলংকরণঃ দিলীপ রায়
চিফ হেড ওয়ার্ডারের পর, তার পেছনেই মেটিন মাইমুনের পালা। সর্বদা নিজের রবরবা বজায় রাখতে ব্যাগ্র। মাথায় কাপড়, মুখে বাঁকা হাসি, মাথাটা যেন ওপরতলার আদেশ শোনার জন্যে সর্বদাই একটুখানি হেলানো, দুই হাত একসঙ্গে জড়ো করা। মাইমুন আমাদের কাচে সবসময় এইটা জানান দিয়ে রাখার চেষ্টা করতো যে ওও কর্তৃপক্ষেরই অংশ। সত্যি বলতে কী, ও'ই ছিল কর্তৃপক্ষের খবরি আর আজব সব আদেশ নির্দেশ ওকে দিয়েই কাজে পরিনত করা হত। ও ছিল জেলের অন্য সব মহিলাদের থেকে আলাদা, মোটাসোটা, পরিপাটি পোশাক, চকচকে মসৃন চেহারা। কিছুদিনের মধ্যেই ওর এত বোলবোলার রহস্য বুঝতে পারলাম - জেলের যা রেশন আসে সব ওর হাত দিয়েই বেরোয়, তার অনেকখানি ও হাতিয়ে নিয়ে বাইরে বেচে দেয়। আমাদের প্রাপ্য জিনিসপত্র হাওয়ায় হাপিস হয়ে যাচ্ছে দেখে রেগে গিয়ে ঠিক করলাম জেলারেরকে জানাবো - কিন্তু কল্পনা আমাকে আটকালো। কল্পনা মনে করালো, মাইমুন নিজেও বন্দী। বন্দীদের নিজেদের মধ্যে একতা থাকা উচিত, আর এক বন্দীর নামে অন্য বন্দীর কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করা বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। এছাড়াও, ওয়ার্ড্রেস বা মাইমুনের সঙ্গে শত্রুতা করে আমরা এখানে টিঁকতেও পারবো না। সেসব ভেবে চিন্তে অনিচ্ছাসত্বেও ঠিক করলাম জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে বিবাদে না যাওয়া সত্যিই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
জেনানা ফাটকের দায় দায়িত্ব ছিল সব মেটিনের, আর হুকুমের মালিক চিফ হেড ওয়ার্ডারের। এই দুয়ের মাঝখানে তিনজন ওয়ার্ড্রেস - তারা শুধুই রক্ষী। তারা কয়েদীদের সঙ্গে ফাটকের ভেতরেই থাকে - অনেকটা জেলের ভেতর আরেকটা জেল। বাইরে থেকে অন্য কোন ওয়ার্ডার গরাদ খুললে তবেই তারা বেরুতে পারে। ওদের ওপর হুকুম আছে আমাদের দিনরাত চোখে চোখে রাখতে, তাই আমাদের সেলের বাইরে উঠোন পেরিয়ে যে ছাউনি ওরা সেখানেই থাকে। সারাদিন কিছু করার না থাকায় ওরা ঐ ছাউনিতে কাঠের চৌকিতে শোয়, ঝিমোয়, যার যার পছন্দের কয়েদীদের সঙ্গে নিজেদের বাড়ি ঘর পরিবার, অন্য ওয়ার্ড্রেস, জেলের অন্য কর্মচারী, অন্য বন্দীদের নিয়ে গল্প এবং গুজব চর্চা করে। ওদের সবারই প্রিয় কর্মকান্ড মনে হতো কয়েদীদের দিয়ে সর্ষের তেল মালিশ করানো। ওয়ার্ড্রেসদের ওপর কড়া আদেশ ছিল আমাদের সঙ্গে কোনরকম কথাবার্তা না বলার।
কিন্তু কৌতুহলের বশে অনেক সময় ওরা কল্পনার সঙ্গে গল্পগাছা করে যেত। এই ওয়ার্ড্রেসরা অত্যন্ত গরীব, আর ওদের কাজের চুক্তি ক্রীতদাসদের থেকে সামান্যই উন্নত। ওদের কোন ছুটিছাটা নেই, এমনকি ছুটিতে থাকলেও, ডাকলেই যেন পাওয়া যায় তাই ওদের জেল চত্বরেই থাকতে হয়। এমনকি হাটবাজারে যাওয়ার জন্যেও ওদের চিফ হেড ওয়ার্ডারের অনুমতি নিয়ে তবেই বেরোতে হয়। আমরা প্রায়ই দেখতাম, শুধু জেল অফিসার না, এমনকি পুরুষ ওয়ারডারও ওদের উত্যক্ত, অপদস্থ, অপমান করেছে। ওরা আমাদের এমনভাবে আটকে রাখাটাকে মন থেকে মানতে পারতো না, এমনকি বেশি সাহসী ওয়ার্ড্রেস কেউ কেউ আমাদের তালা খুলে দিয়ে ঘন্টাখানেক নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও বলতে দিত।
দিনের বেলা জেনানা ফাটকের চাবি থাকতো জেলের দেড়শো জন "ডিউটি ওয়ার্ডার"এর মধ্যে একজনের জিম্মায়। সে সেই দিন গেটের তালা খোলার দায়িত্বে - সেটা খাবার দেওয়া, ডাক্তার, বা প্রয়োজনে অন্য কারো ঢোকা বেরোনোর জন্য। জেলের প্রাশাসনিক কাজকর্মের দায়িত্বে কয়েকজন সহকারী জেলার আর কেরানী - আর জেলের প্রাত্যহিক কাজকর্ম, শৃঙ্খলা - সবকিছুর সর্বময় দায়িত্বে জেলার। তার ওপর জেল সুপার। জেল সুপারের পদ খুবই বড় ব্যাপার, জেলারদের জবাবদিহির দায় তার কাছে। কালো চশমা, সোলার হ্যাট, বড় বড় লাল চেক কাটা কোট পরা হাজারিবাগের জেল সুপারকে মনে হত সিনেমার চরিত্র। ওকে দেখে আমার মনে হত শৌখিন শিকারী আর সিনেমা প্রযোজকের মাঝামাঝি একটা চরিত্র। উঁচুতলার সাহেবী কেতায় দুরস্ত জেল সুপারটি নাকি কিছুদিন কানাডায় থেকেছে - ওখান থেকে ও একটা নকল আমেরিকান অ্যাকসেন্ট শিখে এসেছে। কিন্তু আমেরিকান উচ্চারনে কথা শুরু করলেও মাঝপথে সেটা চালিয়ে যেতে লোকটি ভুলে যায়। ওর আজব প্রকৃতির হঠাৎ গরম মেজাজের কারনে আমরা, ওর অধস্তন কর্মচারীরা সবাই ব্যতিব্যস্ত, বিরক্ত, অতিষ্ঠ ছিলাম। ও ওর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এত রকম হুকুম জারি করতো, আর একেকটা হুকুম আগের হুকুমের উল্টো হত, যে শেষ পর্যন্ত কেউ বুঝতেই পারতো না ওঠিক কী চায়। জেল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করতো ওকে এড়িয়েই যতটুকু কাজ করে নেওয়া যায়, না হলে আবার পরস্পরবিরোধী হুকুমের গেরোয় পড়ে ফাঁসতে হবে।
জেলের শুরুর দিকের একঘেয়েমিতে ছেদ পড়তো মাঝে মধ্যে এই জেল সুপারের হঠাৎ ক্ষেপে ওঠার বাতিকে, আক্স্মিক পরিদর্শনে, অথবা যখন আশেপাশের কোন স্থানীয় প্রভাবশালী জেল দেখতে আসতো। ওয়ার্ড্রেসরা সারাক্ষন আতঙ্কে থাকতো এই না 'সাহেব'এর কোন হুকুম না বুঝে অমান্য করে বিপদে পড়ে। একদিন ফাটকের এক বন্দীর ছোট্ট মেয়ে আমাকে দুটো দুটো গোলাপ ফুল তুলে এনে দিল গেটের পাশে বাগান থেকে। আমি এত সুন্দর উপহার পেয়ে ফুলদুটিকে আমার জলের পাত্রে সাজিয়ে রাখলাম। সেই বিকেলেই জেল সুপারের আসার মর্জি হলো - আর আমার সেলে উঁকি দিয়ে ফুল দেখেই, অ্যাই গাধার বাচ্চা, এদিকে আয় - বলে ওয়ার্ড্রেসেস ওপর গর্জে উঠলো। আমার মনে হচ্ছিল যেন কোন মালিক রেগে গিয়ে তার কুকুরকে ডাকছে। হতম্ভব ওয়ার্ড্রেস, কী হয়েছিল বলতে চাওয়া আমি - সবাইকে উপেক্ষা করে সুপার ওকে সাসপেন্ড করে চলে গেল। আমি আর কল্পনা ঠিক করলাম আমরা ভুখ হরতাল করবো। এই ঘটনার পর ওয়ার্ড্রেসরা আমাদের সঙ্গে আরও একটু বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো, যদিও ওদের খুব বেশি দয়া দেখানোর কোন উপায় ছিল না - চাকরী যাওয়ার ভয় তো ছিল।
জেল সুপার এলেই আমি আর কল্পনা একটাই দাবী জানাতাম - আমাদের এক সেলে থাকতে দিতে হবে। জেল সুপার প্রতিবার একই গর্জন করতো - "প্রশ্নই নেই। দুই নক্শাল নেতা পালানোর ছক করবে আর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে"। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ নক্শাল নেত্রী হিসেবে কল্পনা করাটা হাস্যকর ছিল। আমরা ভাবতাম সারাদিন অলস বসে না থেকে যদি পড়াশুনো করা যায় - কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নক্শাল নেত্রী হওয়ার সম্ভাবনায় সেটা আর সম্ভব হতো না। জেলে পাওয়া আর জমানো সম্পত্তি, যেমন একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি আর গেলাস, একটা আয়না আর চিরুনি, কয়েকটা ওষুধের বোতল, দুটো পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো, জেল থেকে দেওয়া শাড়ি দিয়ে - এইসব নিয়ে নিজেদের ভুলিয়ে রাখার চেয়ে যদি কিছু করা যেত। চিবিয়ে ব্রাশের মত করা নিমের দাঁতন দিয়ে আমি আধ ঘন্টা দাঁত ঘষি। খাওয়ার পর সেলের ভেতরে রাখা কুঁজোর জল দিয়ে থালা ধুয়ে সেটাকে শাড়ি দিয়ে ঘষে ঘষে অনেকক্ষন ধরে চকচকে পালিশ করি। দিনের মধ্যে অনেকবার আমার দু ইঞ্চি লম্বা চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়াই, যত কবিতা মনে আছে একা একা আবৃত্তি করি। সেলের ভেতরেই ব্যায়াম করবো বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু ভয়াবহ আমাশা আর পাথরের মেঝেতে চোট পাওয়ার জন্যে তা আর করা হয় না। অনেক অনুরোধের পরেও আমরা লেখার কাগজ কলম পেলাম না। কিন্তু খুব করে সেন্সর করা খবরের কাগজ পেতাম - তার আর্ধেকই কালো কালি দিয়ে ঢাকা। কল্পনা আর আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাগজ পড়তাম - কিন্তু দেওয়া নেওয়া করতে গেলে ওয়ার্ড্রেসকে ডাকতে হতো। একদিন আবিষ্কার করলাম আমার সেল আর কল্পনার ল্যাট্রিনের দেওয়ালের মধ্যে একটা ফাঁক আছে - সেখান দিয়ে কাগজ দেওয়া নেওয়া করা যায়, কাউকে ডাকতে হয় না। একদিন মাইমুন সেটা দেখে ফেলে তড়িঘড়ি পুরুষ বন্দী ডাকিয়ে পেরেক দিয়ে কাঠের তক্তা বাসিয়ে ফাঁকটা আটকে দিল।
যদিও ঘন্টাখানেকের মধ্যে পেরেক সমেত কাঠের তক্তা খুলে পড়ে গেল পাথরের দেওয়াল থেকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।