একজন ওয়ার্ড্রেস আমাকে বুঝিয়ে বললো, এখানে কাজ এগোনোর জন্য চাই ঘুষ। জেল কর্মচারীদেরও বেতনের রসিদ, ভ্রমণ ভাতা, পিএফের টাকা তোলার জন্য দপ্তরীকে ঘুষ দিতে হয়। একজন ছেলের বিয়ের জন্য পাঁচশো টাকা তুলতে চাইছিল - একমাস অপেক্ষা করার পর কুড়ি টাকা ঘুষ দিয়ে তবে কাজ হয়েছে। বদলী হওয়া বা আটকানোর জন্যও ঘুষ একটা আবশ্যক শর্ত।
অফিস কর্মচারীদের ঘুষের জাল থেকে কয়েদীদেরও মুক্তি নেই। মাঝে মাঝেই কয়েদী বদলীর ভয় দেখানো হয়। একটা রব তুলে দেয়, ধরা যাক, দুশো কয়েদীকে এখান থেকে একশো মাইল দূরে বক্সার জেলে বদলী করা হবে। শুনে সবাই ভয় পেয়ে যাবে - যাদের বদলী হতে সব থেকে বেশি অনিচ্ছা আর যাদের সাধ্য আছে - তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী জেলারের কাছে টাকার পুঁটুলি নিয়ে হাজির। ঘুষ দেওয়া নেওয়া হয়ে গেলে হয়তো দেখা গেল পুরোটাই গুজব - আদৌ কোন বদলী হলো না।
কিন্তু এসব পরিস্থিতির জন্য নিজের কাছে টাকা থাকা দরকার - একমাত্র টাকা জেল জীবনকে যথাসাধ্য সহনীয় করতে পারে। কয়েদীদের তাই লক্ষ্য থাকতো যেন তেন প্রকারেন টাকা জমানো - সে লোকজনের কাজ করে দেওয়া, জেল কর্মচারীদের কাপড় কাচা রান্না করাই হোক, আর অন্য লোককে ঠকিয়েই হোক।
জুনের শুরুতে, আমার কারাবাসের দু'বছর পূর্ণ হওয়ার পরপরই, একজন সহকারী জেলার এসে বললো ডেপুটি হাই কমিশন থেকে আলাদাভাবে বিচারের ব্যপারে আমার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে টেলিগ্রাম এসেছে। আমি জানালাম আমার সঙ্গে আটক হয়েছে এমন যারা হাজারিবাগে আছে তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বিচার, আইনী সহায়তা, মামলা আদালতে না ওঠা পর্যন্ত জামিন - এই আমার আবেদন। বাবাকে ওরা জানিয়েছিল আমি নাকি "অস্পষ্ট" জবাব দিয়েছি। অমলেন্দুর বাবা আমার জামিনের আবেদন করেছিলেন কিন্তু তার শুনানি হয়নি।
এর দুমাস পর, ১৯৭২ এর জুন মাসে, জেল সুপার এসে বললো পরদিন আমাকে জামশেদপুর নিয়ে যাবে - বিচার শুরু হবে। জেলের দর্জিখানা থেকে আমার সব জিনিস, বইপত্র নেওয়ার জন্য দুটো বড় খাকি ব্যাগ সেলাই করা হলো। সকালে আমাকে এক সপ্তাহের রেশন দিয়ে দেওয়া হল, সেই রেশন দিয়ে আমার বিদায় উপলক্ষে সারা দুপুর জেলের সবাইকে খাওয়ানোর জন্য এক সসপ্যান ভর্তি আলুর তরকারি আর চাপাটি বানালাম।
সেই পরদিন এল, চলেও গেল - আমি হাজারিবাগেই বসে রইলাম। কী হলো কিছু বুঝলাম না, মাঝখান থেকে সারা সপ্তাহের রেশন একদিনে শেষ! এটা নিয়ে অবশ্য আদৌ সমস্যা হয়নি, অন্য মেয়েরাই ঐ সপ্তাহটা ওদের নিজেদের থেকে ভাগ দিয়ে আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিল।
অসংখ্যবার প্রশ্ন করার পর জেলার একটা জবাব হাজির করলো। এই মামলার সতেরোজন আসামী কলকাতায় থাকায় নাকি ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের শুনানি বাতিল করে দিয়েছে। এখন নাকি কলকাতার আসামী আর হাজারিবাগের আসামীদের বিচারপ্রক্রিয়া আলাদা করার জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে।
এর পর শুনলাম, অগাস্ট মাসে শুনানি হবে। এক রবিবার বিকেল পাঁচটায় সহকারী জেলার এসে বললো পরদিন পাটনা হাই কোর্টে শুনানি, উকিলের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারপক্ষ থেকে নাকি আবেদন করা হয়েছে যে পুরো মামলাটাই হাজারিবাগে নিয়ে আসতে হবে, কারন বর্তমান নক্শাল উপদ্রবের মধ্যে আমাদের জামশেদপুর আদালতে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। রবিবার বিকেলে জেল অফিসে গিয়ে জেলারের সঙ্গে কথা বলা বা জেল সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করাই সম্ভব না, কলকাতায় যোগাযোগ করে পাটনায় উকিলের ব্যবস্থা কী করে করবো? সব কিছুই এত দূরে দূরে যে এটুকু সময়ের মধ্যে আদৌ কিছু সম্ভব না। সেই আবেদনেরও শুনানি হল না। কয়েক মাস পরে মামলা বদলির আবেদন প্রত্যাহার হয়ে গেল, ততদিনে হাজারিবাগেও নক্শাল কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। সব রকম শুনানিই মুলতুবি।
১৯৭১এর অতিবৃষ্টির পর ১৯৭২এ এল খরা আর ভয়ানক তাপ প্রবাহ। প্রতিদিন সকালে উঠেই ব্যগ্র হয়ে আকাশে তাকাতাম - যদি একটুখানি মেঘের কুচি দেখা যায়। সন্ধ্যে থেকে ভোর পর্যন্ত মশার উপদ্রবে ঘুমনোর উপায় নেই। ঘুমের অভাবে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে গেল - সঙ্গে স্থায়ী একটা মাথাধরা। একটা শাড়ি বিছিয়ে শুতাম - সকালে উঠে তাতে মশার রক্তের ছাপ দেখে মনে হত ওখানে একটা ছোট আকারের যুদ্ধ হয়ে গেছে। কল থেকে হলদেটে জল - কখনো সরু ধারায়, কখনো ফোঁটা ফোঁটা। বাগান শুকিয়ে কাঠ। কোনদিন আবার জল একেবারেই চলে যেত - আমাদের চারজনের জন্য দু'বালতি জল বরাদ্দ - তাতে স্নান খাওয়া রান্না বাসন মাজা কাপড় কাচা। কারো অবস্থা আরো খারাপ - বেশ কয়েকজন মিলিয়ে কয়েকটা কলসী আর জং ধরা বালতি। জলের একটা পিপে ছিল - সেটা অনেক দিন আগেই ফুটো হয়ে বাতিল হয়ে গেছে। জেলের মূল অংশে কুয়ো - তাতে জল ছিল তখনও। কিন্তু সেখান থেকে আমাদের ফাটকে জল এনে দেওয়ার জন্য হাজার কাকুতি মিনতি করতে হতো।
সে বছর রোগশোকও খুব হচ্ছিল। আমাদের সেলে একজনের ম্যালেরিয়া হল - আমাদের সব কাঁথা কম্বল গায়ে চাপিয়েও সে সারা রাত ঠকঠক করে কাঁপে। আমার নিজেরও শরীর খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বমি হতে লাগলো - একেকদিন সারাদিন কিছু খেতেই পারতাম না। ডাক্তার বললো মানসিক চাপ থেকে এসব হচ্ছে। আমার নিজেরও বিশ্বাস হলো, হয়তো মার অসুস্থতা, অমলেন্দুর বিপজ্জনক অবস্থা, সামগ্রিক অনিশ্চয়তা - এইসবের উদ্বেগেই হয়তো হচ্ছে।
বাচ্চাদের লাগাতার পেটের গন্ডগোল শুরু হলো। মুর্তি বলে একটি বাচ্চা মেয়ে ছিল, তার আবার বিয়েও ঠিক হয়েছিল। মূর্তির একদিন ভয়ানক বমি আর পায়খানা শুরু হল। ওষুধের দায়িত্বে থাকা কয়েদী মূর্তির মাকে একটা বড়ি দিয়ে বললো চারভাগের এক ভাগ করে খাওয়াতে। দিশেহারা মূর্তির মা ভাবলো গোটা বড়িটা খাইয়ে দিলে হয়তো মেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। ছোট মেয়ে বেশি মাত্রার ওষুধ খেয়ে এমন অসুস্থ হয়ে গেল যে টানা দুদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। সেই দ্বিতীয় দিনে, দুপুরবেলা আমার নিয়মিত অসুবিধেগুলির ধাক্কায় কাহিল হয়ে সেলে শুয়েছিলাম এমন সম মূর্তির মা বাল্কো খুব সঙ্কুচিত হয়ে, আমাকে অসময়ে বিরক্ত করার জন্য মাফ টাফ চেয়ে বললো মূর্তি আমায় খুঁজছে। বেচারা অঝোরে কাঁদছিল, ধরেই নিয়েছিল ওর আকাটপনার জন্য হয়তো মেয়েটা মরেই গেল। আধাঅচেতন মূর্তি মেটিনের বিছানায় শুয়ে। প্রাণচঞ্চল মুখ্টা শুকিয়ে গেছে, উজ্জ্বল চোখদুটি কোটরাগত। ঐ অবস্থায় কোন রকমে আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো ওর পাশে এসে শুতে। মেয়েরা বললো জ্ঞান আসার পর মূর্তি আমাকেই খুঁজেছে প্রথম - শুনে আমি চোখের জল আটকাতে পারিনি সেদিন। রাতে আলাদা সেলে তালাবন্ধ থাকার সময়টা বাদ দিয়ে পরের ক'দিন আমি মূর্তির সঙ্গে কাটালাম। একটু সুস্থ হলে সাবধানে কম্বল মুড়িয়ে কোলে করে বাগানের যেটুকু বেঁচে ছিল তাই আমরা দেখতে যেতাম। অসুস্থ হওয়ার আগে মূর্তি আর আমি এসব গাছপালার যত্নআত্তি করেছি অনেক।
সব বাচ্চার ভাগ্য মূর্তির মত ভালো না। তিরিশ মাইল দূরের ছাতরার সাব-জেল থেকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে এল - কোলে তার কংকালসার ছেলে, শ্বাসটুকুই কোনরকমে চলছে। হাত পা সরু কাঠি, ব্যথায় মলিন বড় বড় চোখদুটি যেন মুখ থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কনুই, গোড়ালি, হাঁটু খোস পাঁচড়ায় ভরা, শরীর রক্তশূণ্য, চামড়া ঝুলে পড়ছে। বাচ্চাটার কাঁদারও শক্তি নেই - এমন ভাবে মায়ের কোল আঁকড়ে থাকে মনে হয় যেন কোনভাবে নতুন করে বাঁচার জন্যে ও মায়ের গর্ভে ফিরে যেতে চাইছে। দু'মাস ধরে আন্ত্রিক রোগে ভুগছে - ছাতরায় চিকৎ্সার কোন ব্যবস্থা নেই। বাঁচার আর আশা একেবারেই নেই বোঝার পর ওখানকার জেলার তড়িঘড়ি হাজারিবাগে পাঠিয়েছে "চিকিৎসা"র জন্য। ঠিক দু'দিনের মাথায় ছেলেটা আমার কোলেই মারা গেল। কী দুঃসহ অপচয় একটা জীবনের, আঠারো মাসের একটা শিশুর মৃতদেহ এই প্রথম আমি চোখের সামনে দেখলাম।
পাথরের মত বসে তাকিয়ে রইলাম - ডোম এসে কাপড়ে মুড়িয়ে কংকালসার দেহটাকে নিয়ে গেল - জেলখানার দেওয়ালের ঠিক বাইরেই ঝিলের ধারে ওর দাহ হবে।
আমার অন্য সঙ্গীদের কাছে এটা শোকের হলেও ভয়ানক অস্বাভাবিক কিছু ছিল না - ওদের কঠিন জীবনে শিশুমৃত্যু পরিচিত ঘটনা।
এর কিছুদিন পর সুপার আবার এক স্থানীয় অফিসারকে নিয়ে দেখা করতে এল। আমি বললাম আমাকে জামশেদপুর বদলী করা হোক যেন কেসের কী হচ্ছে তা নিয়ে খোঁজখবর করতে পারি। অফিসারটি দেখলাম হিংস্র হয়ে উঠলো - "কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় না বুঝলে মেরে দাঁতের পাটি খুলে নেবো। এই নক্শালগুলি মরে না কেন? আর পারা যাচ্ছে না এগুলোকে নিয়ে"। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম পুরুষ নক্শাল বিভাগে কিছু নিশ্চয় হয়েছে।
ক'দিন পর বুঝলাম ব্যাপরটা কী। ১৯৭১এর বন্দুকবাজির ব্যাপারটার তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তকারী বিচারক ওয়ার্ড পরিদর্শনে এসেছিল, ওরা "রক্তের বদলা রক্ত চাই" বলে স্লোগান দিয়েছে। তাতেই এদের মাথায় খুন চেপে গেছে।
গুলিচালনার এক বছর পূর্তির কাছাকাছি সময়েই আবার সুপারের আদেশ এল, গাছপালা সব ছাঁটতে হবে। জুঁই ফুলের কুঁড়ি আসছিল একটা দুটো, পেয়ারা গাছ নতুন পাতা আসছিল। নিম গাছের ক'টা নতুন কচি ডাল হয়েছে, আবার ছায়া দিচ্ছে একটু। সেসব আবার মুড়িয়ে দেওয়া হল। ২৫শে জুলাই নক্শাল বন্দীরা সারাদিন স্লোগান দিল। দখিনা বাতাস বইছিল সেদিন, ওদের স্লোগানগুলি ভেসে আসছিল ওপাশ থেকে। যেভাবে যতটা পারে প্রতিরোধ বজায় রাখছিল ওরা।
সে মাসেই খবরের কাগজে সিপিআইএমএলএর সাধারন সম্পাদক চারু মজুমদারের পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর খবর এল।
নক্শালপন্থী আন্দোলনের মূল তাত্ত্বিক নেতৃত্ব মার্কসবাদী লেনিনবাদী ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির কাছে ছিল। সবার বিশ্বাস পুলিশই লকআপে তাকে খুন করেছে। লক্ষ্য করতাম, নক্শালদের মনোবল ভাঙতে পারে এমন কোন খবর সেন্সর কখনো আটকাতো না। আমি আবার উল্টো ভাবে ভাবতাম। আমার মনে হত যেসব জায়গা কালো করা, সেসব নিশ্চয় ভালো খবর - যত কালো করা খবর থাকতো তত আমার আনন্দ হতো।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে আমি আর উঠতেই পারছিলাম না। এত দুর্বল এর আগে কখনো হইনি। এই ক'দিনে আমার প্রায় বারো থেকে পনেরো কিলো ওজন কমে গিয়েছিল, ডাক্তার তার কোন কারন বলতে পারছিল না। শুধু খাওয়া দাওয়া করতে বলতো, কিন্তু খাবার দেখলেই আমার গা গুলোয়। সপ্তাহখানেক প্রবল জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে থাকলাম, অন্য ডাক্তারকে ডাকানো হলো, সে দেখেই বললো হেপাটাইটিস।
এরপর ক'দিন আমার নিজেকে একেবারে ভিআইপি মনে হচ্ছিল - সবাই ঘাবড়ে গেল - আমার সত্যি কিছু হলে সব দায় এসে এদের ওপর পড়বে। বাইরে লোকজন আমার সম্পর্কে জানতো, সবাই প্রশ্ন করতে শুরু করলো। অন্যদের খবর যেমন ভাবে ধামা চাপা দেওয়া যেত আমাকে নিয়ে সেটা সম্ভব ছিল না। পরের একমাস মশারির তলায় বিছানায় শোয়ার মত বিরল সৌভাগ্য জুটলো। আর ছিল পুষ্টিকর খাবার দাবার, তবে সেসব খাওয়ার মত শরীরে অবস্থা আমার ছিল না।
আমার সহবন্দীরা আমাকে সুস্থ করার জন্য প্রাণপাত করল। মালিশ করে দেওয়া, হাওয়া করা, কাপড় কেচে দেওয়া, সেল পরিষ্কার করা, জাউ ভাত বানিয়ে দেওয়া, কথা বলা, কেমন আছি খোঁজ নেওয়া। বারবার সবাই বলতো - বাড়ির থেকে দূরে আছো তাই তুমি এত ভুগছো। কিন্তু সব সময় মনে রেখো, আমাদের মধ্যেই তোমার মা আছে, বোন আছে, পরিবার আছে। আমরা তোমাকে সুস্থ করেই বাড়ি পাঠাবো।
সেই সেপ্টেম্বর মাসে যেন আমি জেলখানার সম্পর্কগুলিকে নতুন করে চিনতে শিখলাম। শান্ত, নিস্তরঙ্গ রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে দেখতাম মেয়েরা সব আসছে যাচ্ছে কথা বলছে, বাইরে নীল আকাশে সাদা মেঘ, বকের সারি দূরে অশ্বত্থ গাছে তাদের বাসায় ফিরছে, বাচ্চারা নিম গাছের তলায় খেলা করছে।
অবশ্য সে শান্তি নিরবচ্ছিন্ন ছিল তা বলা যাবে না - এসবের মধ্যেও কয়েকবার আচমকা তল্লাশি হল - বিছানা উল্টে পাল্টে, কাগজপত্র হাঁটকে। বিছানা থেকেই যখন উঠতে পারছি না তখন কী ষড়যন্ত্র করবো বলে ওরা ভাবছিল কে জানে!
ক'দিন পর তিনজন স্কুল শিক্ষিকাকে জেলে ঢোকালো আমাদের সঙ্গে। আমি তখনও খুবই দুর্বল। ১৪৪ ধারা বাতিলের দাবিতে জমায়েত হয়ে কয়েক হাজার স্কুল শিক্ষিকা গ্রেপ্তার হয়েছে সেবার। ওদের দাবি ছিল প্রাইভেট স্কুলগুলিকে অধিগ্রহন করে সরকার পেনশন, বাসস্থান, এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ - নিয়মিত মাইনে নিশ্চিত করুক। ওরা বলতো যে সব স্কুলে ওরা পড়ায় সেখানে একেক সময় মাসের পর মাস মাইনে হয় না।
এত বন্দীকে জায়গা দিতে গিয়ে সরকার চান্দোয়াড়াতে একটা বন্ধ হয়ে থাকা অস্থায়ী জেল খুললো। চান্দোয়াড়ার জেল খুব সম্ভবত বৃটিশ সরকার শুরু করেছিল। ঐ সময় বেশ কয়েকটা বন্ধ হয়ে থাকা অস্থায়ী জেল চালু হয়েছিল পরপর। পরবর্তী সময় বেশ কিছু ধর্মঘটি বন্দীদের দেখি - তাদের মধ্যে এই স্কুল শিক্ষিকারা প্রথম। সেবার ধর্মঘটিদের সহজেই ভয় টয় দেখিয়ে নিঃশর্তে কাজে ফিরতে বাধ্য করেছিল সরকার, কিন্তু পরে আর এত সহজে আন্দোলনকারীদের দমাতে পারেনি।
ঐ একবারই ধর্মঘটিদের সাধারন বন্দীদের তুলনায় একটু ভালো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। ওদের পুরো এক প্রস্থ জামাকাপড় দেওয়া হল জেল থেকে, আমি একটু বিরক্ত হয়েই লক্ষ্য করলাম সেসব আবার ওরা যাওয়ার সময় নিয়েও গেল। জেলের সাধারন বন্দীরা অনেকেই তখন কোনরকমে শতচ্ছিন্ন কাপড় জুটিয়ে আব্রু রক্ষা করছে। স্কুল শিক্ষিকারা চলে যাওয়ার পর জামা কাপড়ের দায়িত্বে থাকা সহকারী জেলারের সঙ্গে আমি বড় রকম ঝামেলা করলাম। একেক্জন মেয়ের কিছুই ছিল না গায়ে পরার মত। এদিকে শীত এগিয়ে আসছিল। এরপর একটা দায়সারা পরিদর্শনের পর বলা হল যাদের কিছুই নেই তাদের একটা করে শাড়ি আর ব্লাউজ দেওয়া হবে। আমি আপত্তি করে বললাম, অল্পদিনের জন্যে আসা শিক্ষিকারা, যাদের নিজেদের কাপড় জামাও ছিল, তাদের পুরো প্রস্থ পোশাক দেওয়া হলে এদের কেন হবে না। তার উত্তরে শুনলাম এরা চিরকালই হতদরিদ্র, বাইরেও এমন করেই থাকে, জেলে এসে বড়লোক হয়ে যাবে, এ তো হয় না। ওর কাছে জেলের নিয়ম অনুযায়ী যা ওদের প্রাপ্য তা না দেওয়ার যুক্তি ছিল বাইরেও অনেক লোক শীতকালে গরম কাপড় ছাড়া খালি পায়ে কাটায়। এদিকে কংগ্রেস সরকার ভোটে জিতেছে "গরীবি হটাও" স্লোগান দিয়ে।
সবাই জানতো সহকারী জেলার বন্দীদের প্রাপ্য জামা কাপড় বাইরে বেচে দেয়, আর খাতায় কলমে দেখায় সব বন্দীদের দেওয়া হয়েছে। কোন মন্ত্রী বা ইন্সপেক্টর জেনারেলের পরিদর্শনের খবর থাকলে অন্যরকম হতো - যাদের একেবারে কিছুই পরার নেই, তাদের দুয়েকটা শাড়ি ব্লাউজ দিয়ে, অন্যদের খুব করে ধমকে দেওয়া হত যেন কেউ কোন অভিযোগ না করে, স্টকে মাল এলেই সবাইকে সব দেওয়া হত। সেসব অবশ্য পরিদর্শন শেষ হতে না হতেই সবাই ভুলে যেত।
জন্ডিস থেকে মোটামুটি একটু সামলে ওঠার পর এক বৃটিশ অফিসার অপ্রত্যাশিতভাবে অতি-দীর্ঘ প্রতীক্ষিত - একটা কলম নিয়ে উপস্থিত হল।
তার সঙ্গে প্রস্তাব - বিনা বিচারে স্বেচ্ছা প্রত্যর্পণ। বললো ভারত সরকার এতে গররাজি হবে না, এ মোটামুটি নিশ্চিত।
আমি বললাম ভাববার জন্য এক মাস সময় চাই।