রাজনৈতিক বন্দী
~~~~~~~~~~~
সলিটারি শেষ হওয়ার পর প্রথম দিন আমরা সারাদিন গারদের বাইরে থাকলাম। আর ঘটনাক্রমে সেদিনই মাইমুনও বিদায় নিল। মাইমুনের বিদায় বিরাট স্বস্তির ঘটনা ছিল - ওর উপদ্রব, অন্য কয়েদীদের উত্যক্ত করা - এসব সহ্য করা দিনে দিনে যেন বেশি করে কঠিন হয়ে পড়ছিল। মাইমুনের বিদায়ও এক আজব ব্যাপার। জানা গেল মাইমুনও গত ছ'বছর ধরে বিচারাধীন বন্দী। এই সবে ওকে আদালতে তোলা হয়েছে, আর আদালতে যাওয়ার পর দেখা গেল ওর বিরুদ্ধে যে দু'জন প্রধান সাক্ষী ছিল তাদের একজন মারা গেছে আর অন্যজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ ছিল মাইমুনের বর একটি অল্পবয়সী মেয়েকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে - আর মাইমুন ওকে সাহায্য করেছে। ওরা দুজনেই তারপর থেকে বিচারাধীন হিসেবে বন্দী ছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে দুজনেই ছাড়া পেয়ে গেল।
মাইমুনের উত্তরাধিকারী - পরের মেটিন হলো নাগো। খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে হামলার অপরাধে সাত বছরের সাজা হয়েছে বাইশ তেইশ বছরের নাগো-র। কয়েকবছর জেল খেটেছে, আরো বেশ কয়েক বছর বাকি। লম্বা সাজা হওয়া বন্দীরাই মেট বা মেটিন হয়, ভালো আচার আচরন, শঙ্খলা, কাজকর্ম দেখাতে পারলে ওদের একটু করে মেয়াদ কমে, এবং অবশেষে মোট সাজার কিছু আগে মুক্তি, অর্থাৎ রেমিশন পায়। অন্য কয়েদীদের ওপর জুলুম করার ব্যাপারে মাইমুনের থেকে নাগো তেমন আলাদা কিছু ছিল না, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ও ঝামেলায় যেত না। আমরা যেহেতু আর সারাদিন গারদের ভেতরে থাকতাম না, ও জানতো বেশি গোলমাল দেখলে আমরা একটা ঝামেলা পাকাবো।
তিন মাস সলিটারি সেলে থাকার পর এই জেল চত্বরই আমাদের জন্য দারুন ঘটনাবহুল, উত্তেজনাপূর্ণ মজার জায়গা!
আমরা সারাদিন সেলের বাইরেই থাকতাম। গরম কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি সুস্থও হয়ে উঠছিলাম, শরৎ কালের আলো বাতাসে নিজেকে চমৎকার চনমনে লাগতো! একেকদিন কল্পনা আর আমি সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠেই আমাদের চত্বরের চারদিকে গোল গোল করে হাঁটতে শুরু করতাম - হাত দুদিকে দুলিয়ে গান গেয়ে - ছোটবেলায় গ্রামের দিকে বেড়াতে গেলে মেঠো রাস্তায় যেমন করতাম! শেষে দুপুরের রোদ চড়া হলে হয়তো সেলের ভেতর ছায়ায় গিয়ে জিরিয়ে নেওয়া! দুপুরের পর আবার আমরা গিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে বসতাম। কল্পনার আগ্রহ ছিল জার্মান শেখায়, আর আমি শিখতে চেষ্টা করছিলাম বাংলা হিন্দি। আমাদের খাতা কলম তো ছিল না, কাঠি দিয়ে লাল মাটির ধুলোয় লিখে লিখে অক্ষর পরিচয় করতাম।
হাজারিবাগ জেল আসলে ছিল মূলত বিচারাধীন বন্দীদের স্বল্পকালীন আটকখানা। তাই এখানে অন্য বড় জেলের মত অত কাজকর্ম থাকতো না। সকালে, পুরুষ বিভাগের দর্জিখানায় তৈরি সরকারি উর্দিতে মেয়েরা বোতামের ঘর সেলাই করতো। তারপর উঠোন, আশপাশ পরিস্কার করা, বাগান করা, রান্না, আর গল্পগাছা। এখানে একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল - রোজ সকালে ডাল আর সব্জি রান্না করা দেওয়া হত, কিন্তু ময়দা আর চাল দেওয়া হত এমনি। এবার যে যারটা যেমন করে পারো ফুটিয়ে, বানিয়ে খাও। কোন জ্বালানী বা বাসন কিন্তু দেওয়া হত না! হয়তো একদিনের খাবারের বিনিময়ে একটু কয়লা পাওয়া যেত, কিন্তু রান্নার জন্যে, যে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না খাবার আসতো, ভাত রুটি তার মধ্যেই বানাতে হতো।
আমরা এখন সারাদিন বাইরে বসে সবার সঙ্গে গল্পগুজব করতাম। আমি কিছুই বুঝতাম না, কল্পনা দোভাষীর কাজ করতো, কিন্তু আমার মনে হত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হিন্দিটা আমাকে শিখতেই হবে।
একেকদিন সন্ধ্যের দিকে অল্পবয়সী মেয়েরা সব তাদের গ্রামের, লোকগান গাইতে শুরু করতো, সারি বেঁধে নাচ শুরু করতো।
আমরাও কিছু কিছু নাচ শিখে নিয়েছিলাম। শুরুর দিকের চাল গুলি বেশ একরকম, সহজ। যেমনি মনে হল এই তো বেশ শিখে গেছি - ওমনি নাচ গতি গেল বদলে, দ্রুত তাল লয়ে - আমি তখন খেই হারিয়ে অন্য দর্শকদের হাসির পাত্রী!
ধীরে ধীরে শীত পড়তে লাগলো। মেয়েদের যথেষ্ট কাপড় চোপড় নেই। কল্পনা আর আমার সব থেকে অসুবিধে চপ্পলের অভাব। সেই যে আমাদের আটকের সময় চপ্পল নিয়ে নিয়েছিল, সে আর ফেরত দেয়নি। হাজারিবাগের শুকনো ঠান্ডায় ক'দিনেই আমাদের পায়ের পাতা, গোড়ালি ফেটে চৌচির, রক্তারক্তি। আমাদের সহকয়েদীদের বেশিরভাগই কোনদিন জুতো চপ্পল পায়ে দেয়নি, কিন্তু এই ঠান্ডায় ওদের অভ্যস্ত, কঠিন গোড়ালিও ফুলে, ফেটে একাকার। ঠান্ডা পাথরের মেঝে যেন শীতে আরও কঠিন হয়ে গেছে, বাচ্চারা ঠান্ডায় কাঁদে, ব্যথা পেলে সহজে সারে না। আমাদের সকালের হাঁটা আর ব্যায়াম বন্ধ। জুতোর ব্যবস্থা করতেই হবে।
একজন দয়ালু ওয়ার্ড্রেস ছিল, তাকে গিয়ে ধরলাম, আমাদের কাঁচি চাই - চুল কাটবো। কাঁচি পেয়ে যখন আমরা আমাদের কম্বলের এক টুকরো কেটে ফেললাম তখন তো সে বেচারা ভয়ে অস্থির! আমরা বললাম ও না জানালে আমরা এমন সাবধানে লুকিয়ে রাখবো যে এই কম্বল কাটা কাকপক্ষীতেও টের পাবে না! পুরনো খবরের কাগজ, কার্ডবোর্ড, হাসপাতাল থেকে আনা কিছু গজ, আর ঐ কম্বলের টুকরো দিয়ে কিমাকারদর্শন কিন্তু মোটামুটি কাজের জুতো মত বানিয়ে নেওয়া গেল!
জেল কর্তৃপক্ষের কাছে তো জুতোর দরবার অবশ্যই করেছিলাম, কিন্তু আমরা যেহেতু 'রাজনৈতি বন্দী' নই, তাই আমাদের জন্য চটি জুতো বরাদ্দ ছিল না। যদিও হাজারিবাগের ঠান্ডা শীতকালে হিমাঙ্কের কাছাকাছি।
১৯৭০এর নভেম্বর মাসের একদিন আমরা আবিষ্কার করলাম রাজনৈতিক বন্দী ব্যাপারটা আসলে ঠিক কী। এক রাতে হঠাৎ একদিন আমাকে বলা হল আমার সেল খালি করে কল্পনার সেলে চলে যেতে। মহা উৎসাহে কল্পনার সঙ্গে এক সেলে থাকতে পাবো বলে চলে গেলাম। দেখা গেল কয়েকজন পুরুষ বন্দী বিছানা বালিশ, টেবিল চেয়ার, রান্নার বাসন ইত্যাদি নিয়ে আমার সেলে ঢোকালো। আর সেই রাতে আরেকজন বন্দী এসে আমার পুরনো সেলে ঢুকলো। সকালে চিফ হেড ওয়ার্ডার যথাবিহিত কয়েদী গুনতি করে গেল, নতুন সেলের কয়েদী দেখি তখনো ঘুমোচ্ছে। আমরা কৌতুহলী হয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলাম ভালো, দামী নীল শাড়ি পরনে কেউ মশারির তলায় ঘুমোচ্ছে। এমন কয়েদী এখানে কেউ কখনো দেখেনি! একটু বেলায় ওর সঙ্গে গিয়ে আলাপ করলাম - ও এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে কেডলা কোলিয়ারির খনি শ্রমিক ইউনিয়নের সচিব - এক ম্যানেজারের খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে। এই উচ্চবিত্ত সৌখিন ভদ্রমহিলা খনিতে কাজ করা হতদরিদ্র শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব কী করে করে ভেবে আমার খুবই অবাক লাগছিল।
কর্তৃপক্ষের নজরে ও আমাদের তুলনায় অনেক উঁচুতলার, দূর গ্রহের জীব। সারাদিন ও জেল অফিসে কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেই কাটাতো, অন্তত রাত নটা দশটা পর্যন্ত। প্রতিদিন সকালে ও বাজারের লিস্টি দিয়ে দিত, সেসব বাইরে থেকে কিনে এনে পৌঁছে দেওয়া হত। দেশি বিদেশী দামী খাবার দাবার আসতো নিত্যদিন। নামী দামী দর্জির দোকান থেকে বানানো জামা কাপড়, বেছে নেওয়ার জন্য একশো রকম জুতো চপ্পল - রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে এইসবই ছিল বরাদ্দ।
ও সারাদিন অন্য মেয়েদের ওপর হুকুম চালাতো, সব রকম ব্যক্তিগত কাজ করাতো অন্য মেয়েদের দিয়ে - এতে ওর বিন্দুমাত্র কোন দ্বিধা বা সংকোচ ছিল না - একদিন আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম ও আরেকটি মেয়েকে দিয়ে ওর ঋতুশ্রাবের রক্ত মাখা কাপড় কাচাচ্ছে!
মজার ব্যাপার হল, এসব কাজের জন্যে কয়েদীরা কোন মজুরী পেত না - যেহেতু এরা সব বিচারাধীন, তাই এই সব কাজই খাতায় কলমে "স্বেচ্ছাশ্রম"! পুরো জেলে বোধহয় মেরে কেটে দশ শতাংশ বন্দী আদালতে সাজাপ্রাপ্ত - তাই সব কাজই এইরকম।
পরে যখন অবস্থা আরো খারাপ হয়েছিল আর কয়েদীরা রুখে উঠলো, তখন কাজের বিনিময়ে জিনিসপত্রের মাধ্যমে মজুরী, যেমন একটু বেশি রেশন - এইসব জিনিস শুরু হয়েছিল।
সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে, এই রাজনৈতিক বন্দীর জামা কাপড়, খাবার দাবার, ব্যাক্তিগত জিনিসে সেল ভরে উঠলো - সবই সরকারী পয়সায় কেনা। ওর খাবার ছিল ডিম, দুধ, মাংস - ভারতের বেশির ভাগ মানুষ এত সুখাদ্য চোখেই দেখেনি, আর জেলের ভেতর তো ভাবাই যায় না। তিন সপ্তাহের মাথায় ও জামিনে ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় একজন ওয়ার্ড্রেসের জন্য কয়েকটা আলু ফেলে গেল।
ও যখন যাচ্ছিল, ওর পেছন পেছন এক দল কয়েদি ওর জিনিস পত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল - যেন কোন মহারানী পাত্র মিত্র আমাত্য নিয়ে সভায় যাচ্ছে।
এই রাজনৈতিক বন্দী খুবই উঁচুতলার মানুষ, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তৈরির একটা ভালো সুযোগ হিসেবে মজদুর সংঘ দিয়ে শুরু করেছে। কিছুদিন পর খবরে দেখেছিলাম ও বিহারের এমএলএ হয়েছিল। ততদিনে অবশ্য হাওয়ার গতি বুঝে ডান দিকে ফিরে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে। টাকা পয়সা প্রভাব প্রতিপত্তির কারনেই হবে হয়তো, ততদিনে অবশ্য ঐ খুনের মামলাও সবাই ভুলে গিয়েছিল।
তবে ওর একটা উপকার আমি ভুলবো না। আমাদের যে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল সেটা ও জানে - এটা বুঝতে পারছিলাম। তাই একবার অনেক সংকোচ করেও, ওকে গিয়ে বলেছিলাম, আমাদের লেখাপড়া করার কিছুর ব্যবস্থা যদি ও করতে পারে। আমাদের জন্যে জেল সুপারের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধানোর কোন ইচ্ছে ওর ছিল না, তবে ও বলেছিল যে ওর ডেস্কের ওপর একটা পেন্সিল আর কাগজ রাখা থাকবে, ও যখন জেল অফিসে থাকবে তখন যদি সেটা "চুরি" হয় তাহলে তো কারো কিছু বলার নেই।
সেই "চুরি"টা সফল ভাবেই হয়েছিল!
এর পরের ক'বছরে এই রাজনৈতিক বন্দীর মত আরো চরিত্র আমি দেখেছি। জেল কর্তৃপক্ষ এদের তোয়াজ আর খাতির করে চলতো - ওরা জানতো যেকোন দিন পাশার দান উল্টে যেতে পারে, তখন এদের হুকুম শুনে সরকারী কর্মচারীদের চলতে হবে। ওয়ার্ড্রেসরা এও বলতো যে কোনদিন যদি দেশে আমাদের মতাদর্শের দল সরকার বানায় তাহলে আমাদেরও ওরা সেলাম ঠুকবে!
অনেক সময়ই মনে করা হয় জেলখানার কাজে যারা আসে তাদের অনেকেরই আগে থেকেই দুর্নীতি বা ক্ষমতার ক্ষিদে থাকে। কিন্তু ভারতে বোধহয় তা না। যেখানে জীবিকার নিশ্চয়তা কম, সেখানে মানুষ যে কাজটা পায়, সেটাই করে - প্রাথমিক উপার্জনটাই বড় কথা। বেশিরভাগ জেলে কর্মী জেলে কাজ করতো কারন এই চাকরীটা এরা পেয়েছে, আর বেঁচে থাকতে গেলে চাকরী, বা যেকোন পেশা দরকার। এরকম কাজ মানুষের সুপ্ত হিংস্র প্রবৃত্তি গুলি জাগিয়ে তোলে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ওপরতলার অন্যায় আদেশ এদের চাকরী বাঁচানোর জন্যেই পালন করতে হয়, কিন্তু এমন জেল কর্মচারী আমি বেশি দেখিনি যারা বন্দীদের অত্যাচার করে সত্যিই মজা পায়। কিছু কিছু ওয়ার্ডার আমাদের প্রতি রীতিমত সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল - আমাদের খোঁজখবর নিত, বাইরের খবরাখবর দিত।
একজন ওয়ার্ডার আমার খুবই খোঁজখবর করতো, আমি অপেক্ষা করে থাকতাম ওর ডিউটি কবে পড়বে। ও আমাকে অমলেন্দুর খোঁজখবর এনে দিত। অমলেন্দু, মাত্র দুয়েকটা দেওয়ালের অন্যদিকে, কিন্তু আমাদের আসল দূরত্ব যেন হাজার হাজার মাইলেরও বেশি। একদিন ও খবর দিল অমলেন্দুর মা এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও দেয়নি ওরা, আমার জন্যে কিছু জামা কাপড় এনেছিল - ফিরিয়ে দিয়েছে।
মাসের পর মাস কাটতে লাগলো, আমরাও আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম যে এই বন্দী জীবন যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে ভেবেছিলাম আসলে তা হওয়ার নয়। একবার শোনা গেল অক্টোবরে দুর্গা পুজোর ছুটির শেষে আমাদের বিচার শুরু হবে - পুজো টুজো সব শেষ হয়ে গেল তাও কিছুই হলো না। জীবন যেন আস্তে আস্তে অসহনীয় হয়ে পড়ছিল। বাড়িতে চিঠি লিখতে চাইলে, চিঠির ফর্ম পেতে পেতেই পাঁচ ছদিন লেগে যেত। আমাদের খাবার দাবারের সাপ্তাহিক বাজারের জন্য ওয়ার্ডারকে দশবার করে মনে করাতে হতো। খবরের কাগজ সেন্সর হয়েই আসতো, লেখার কাগজ কলমের অনুরোধও মঞ্জুর হলো না। আমাদের বিকটদর্শন জুতো ছিঁড়ে পড়ে গেল, ঠান্ডায় হাঁটা দুষ্কর হয়ে উঠলো। কয়েকবার ইট পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়লাম - পা কেটে দু-ফাঁক হয়ে গেল। শীতের রাতে পাথরের মেঝেতে শুয়ে গাঁটে গাঁটে ব্যথা, দিনের বেলা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে সেলের ভেতর কনকনে ঠান্ডা। বাইরের প্রবল ঠান্ডা হাওয়ায় নিজের গায়ের দিকে তাকালে মনে হয় কুমীরের চামড়া! তাও আমরা অন্যদের থেকে অনেক ভালো ছিলাম - কল্পনার মা আমাদের জন্য কিছু জামা কাপড় শীতের পোশাক নিয়ে এসেছিল। অন্যদের খাবারও আমাদের তুলনায় খারাপ - ঐ কালো কালো ডাল ভাতের মন্ড।
ডিসেম্বরের শুরুতে ঠিক করলাম - আবার ভুখ হরতাল ছাড়া উপায় নেই। দাবী ছিল আমাদের আর অন্য কয়েদীদের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলির দিকে নজর দেওয়া। জেলার বললো ওসব হরতাল টরতাল করে লাভ হবে না, তাও আমাদের জেদ দেখে ওয়ার্ডারকে বললো আমাদের আলাদা সেলে তালা দিয়ে রাখতে। আমরা পাঁচদিন উপোস করলাম - এই ক'দিনে মুখ দেখলাম শুধু চিফ হেড ওয়ার্ডার, ওয়ার্ড্রেস, আর ডাক্তারের। ছ'দিনের দিন সকালে জেলের এক কেরানী কল্পনার জন্য একজোড়া গোলাপী আর আমার জন্য একজোড়া বেগুনি রঙের রাবারের চটি নিয়ে হাজির হলো। কল্পনা ওর চটি দেখে ক্ষেপে উঠছিল, কিন্তু আমি বললাম এ নিয়ে ঝামেলা না করতে, একটা যখন হয়েছে, বাকিগুলিও নিশ্চয় হবে। বেলার দিকে খবর এল সব বন্দীদের আরেকটু ভালো খাবার দেওয়া হবে, সবাইকে শীতের কাপড় দেওয়া হবে। সেন্সর চলতেই থাকবে, আর দ্রুত বিচারের ব্যাপারে জেলে কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই, আমরা ধলভূমের মহকুমা শাসকের কাছে দরখাস্ত করতে পারি, ওখান থেকে আমাদের আটক করা হয়েছিল।
আমর বুঝতে পারলাম এই যাত্রায় আর কিছু হবে না, তাই হরতাল ভাঙা যায়। এইসব দরখাস্ত যদিও কোন কাজে আসে না, এসব কয়েদীদের সামনে ঝোলানো গাজরের মত, সে আমরা বুঝে গেছিলাম। তবে দরখাস্ত লিখে একটা কাজ হত - প্রতি সপ্তাহে এক ঘন্টার জন্য একটা কলম পাওয়া যেত। আমি কলম খুলে তার কালি জমিয়ে রাখতাম একটা ওষুধের শিশিতে, আর রাতে ঐ কালি দিয়ে, তেলের বাতির আলোয়, সেলে বসে লিখতাম। গল্প, কবিতা, রোজনামচা, কী দেখলাম। কাগজ জোগাড় হত চা পাতার প্যাকেট, লাইব্রেরির বইয়ের শুরুর সাদা পাতা, সাপ্তাহিক রেশন সই করে নেওয়ার নোট বই থেকে। আর ঝাঁটার কাঠি দিয়ে কলম।
ভুখ হরতালের পর একমাস আমাদের খবরের কাগজ বন্ধ হয়ে গেল শাস্তি হিসেবে। কিন্তু সব মেয়েরা জেলের তাঁতে তৈরি একটা মোটা শাড়ি, আর একই কাপড়ের আরেক প্রস্থ কাপড় পেল, ব্লাউজ আর পেটিকোট বানানোর জন্য। ছুঁচ সুতো কাঁচি ছাড়া সেসব কী করে বানানো হবে তা রহস্য ঠেকছিল, তবে পরে জানলাম একজন ওয়ার্ড্রেস জনপ্রতি একবেলার চালের বিনিময়ে সবাইকে তার সেলাই মেশিনে এসব সেলাই করতে দিয়েছে।
চিফ হেড ওয়ার্ডার একদিন পরীক্ষা করে দেখলো কল্পনার সেলের তালা নাকি ভয়ানক নড়বড়ে হয়ে গেছে। ঠিক হল তালা বদলানো পর্যন্ত কল্পনা আমার সেলে শোবে, আর পাহারা দেওয়ার জন্য অন্য একজন কয়েদী আমাদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু বেশি মাখামাখি যেন না হয়ে যায় বা পাছে আমরা মেয়েদের মাথায় আমাদের "রাজনীতি ঢুকিয়ে দিই", তাই প্রতিদিন আলাদা আলাদা কয়েদী। সহবন্দীদের সঙ্গে চেনাশুনো হওয়ার বিরাট সুযোগ পেলাম এতে।
বেশিরভাগ মেয়ে অনগ্রসর শ্রেণীর, তপশিলী জাতি বা উপজাতির।
ছোটনাগপুরে, অর্থাৎ হাজারিবাগ যে অঞ্চলে, নানান জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের বাস। তাদের নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম।
তপশিলী জাতির মানুষদের মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছেন হরিজন - অর্থাৎ ঈশ্বরের মানুষ। তার আগে পর্যন্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাদের বলতো অচ্ছ্যুৎ।
আমাদের রাতের সহকয়েদীদের কেউ আটক হয়েছে বেআইনী চোলাই বানাতে গিয়ে, কেউ জমি জিরেতে ঝামেলায়, কেউ বা খুন বা খুনের চেষ্টার দায়ে। এদের প্রায় কারোরই বাড়ির কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই - কারন এরা এতই গরীব যে বাড়ির লোকজনের পক্ষে গাড়ি ঘোড়ার ভাড়া জুটিয়ে আসা বা চিঠি লিখিয়েকে পয়সা দিয়ে, ডাকখরচ দিয়ে চিঠি পাঠানোর উপায় ছিল না। এইসব হৃদয়বিদারক গল্প শুনে মনে হত, আমাদের এই বন্দী জীবনের যদি আদৌ কোন উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তা হলো এইসব মেয়েদের যেটুকু সাহায্য, যা আমাদের সাধ্যে কুলোয়, করা সম্ভব, সেটুকুই করা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।