সলিটারি
~~~~~~~
খবরের কাগজের বাইরে, জেল লাইব্রেরির বইপত্র আমরা পড়তে পেতাম। একবার বসওয়েলের লাইফ অফ জনসন আর শেক্সপিয়রের রচনাবলীর একটা খন্ডের ফরমাশ করে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার জন্যে উল্টো চমক অপেক্ষা করছিল। হলুদ ঝুরঝুরে পাতাওয়ালা শতচ্ছিদ্র যে বই পেলাম তার থেকে একপাল স্বচ্ছ পোকা হইহই করে বেরিয়ে আমার কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়লো, আর কিছুদিনের মধ্যে সেসব রোগা স্বচ্ছ পোকা পেট ভরে আমার রক্ত খেয়ে বেশ গাঢ় বাদামী, চকচকে মোটাসোটা হয়ে উঠলো। আমি তাদের বিটকেল গন্ধ আর চেহারার পরিবর্তনে বেশ অভ্যস্তও হয়ে গেলাম।
সারা দিনের মধ্যে ঘটনাবহুল ছিল আমার স্নান। ঐ সময় আমার সেল থেকে বেরিয়ে কুড়ি গজ হেঁটে চত্বরের একমাত্র জলের কলের কাছে যেতাম। সিমেন্টের একটা উঁচু ধাপিতে বসানো জলের কল, সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যার কিছু সময় সেই কল দিয়ে জল আসে। কলে একটা বালতি ঝোলানো, সেই বালতিতে আমার অ্যালুমিনিয়ামের গেলাস ডুবিয়ে জল তুলে রোদের তাতে গনগনে সিমেন্টের চাতালে বসে মাথায় ঢালতাম, আর সেই সময় বাকি সব কয়েদিরা তালাবন্ধ থাকতো। কলের জল আগুন গরম - রোদে তেতে থাকা মাটির ওপরে বসানো পাইপ দিয়ে, পুরুষ কয়েদীদের ফাটকের আবর্জনা ফেলার জায়গা পেরিয়ে। ঠাটাপোড়া মাঝ দুপুরে, হাজারিবাগের লু বওয়া চাতালে, গরম জলে স্নান করে গরম বালির ওপর দিয়ে খালি পায়ে সেলে ফেরার পর স্নান করে পরিচ্ছন্ন হয়েছি এমন মনে করার কোন উপায় থাকতো না। জামা কাপড় পাল্টানোর কোন উপায় ছিল না - আমার শুধু একটা টিশার্ট আর স্ল্যাক্স ছিল - সেটাই আমি কেচে পরতাম, আর ওগুলো যখন ভেজা থাকতো তখন জেল থেকে দেওয়া শাড়ি কোনরকমে পেঁচিয়ে রাখতাম। অনেক সময়ই এই বিচিত্র আব্রুতে জেলের কর্মচারীদের সামনে পড়তে হত, কিন্তু আমার পুরো পরিস্থিতিই এমন অদ্ভুত ছিল যে এর জন্যে আর আলাদা কোন বিড়ম্বনা বোধই করতাম না। একবার জেল সুপারের কাছে একটা ব্লাউজ চেয়েছিলাম, কিন্তু সুপার বললো আমাকে তো ছেড়েই দেওয়া হবে, অল্প দিনের জন্য এসব ঝামেলার কোন মানে নেই।
অনেক রাতে, দেওয়ালের ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে কল্পনার সঙ্গে কথা বলে ক্লান্ত হয়ে, সেলের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দেখতাম - জেলের দেওয়ালের বাইরের অশ্বত্থ গাছের মাথার ওপর ঝকঝকে পরিস্কার আকাশে চাঁদ উঠেছে, একটা সাদা প্যাঁচা স্থির হয়ে বসে পুরুষ ফাটকের ছাতে, উঠোনের অন্য প্রান্তে হাজার হাজার ঘুমন্ত পাখিকে বুকে নিয়ে শান্ত নিমগাছের নিচে নর্দমা থেকে বেরিয়ে ব্যাং গুলো লাফঝাঁপ করছে।
এক অচেনা দুনিয়া, অজানা ভাষা, অনিশ্চিত পরিস্থিতি - মনে হত এই প্রকৃতির টুকরো টুকুই শুধু আমার চেনা - ভাগ্যিস এইটুকু অন্তত আমার সামনে এখনো আছে।
আমরা শিখে গেছিলাম আমাদের পরিস্থিতির যদি কোন উন্নতি হয় তাহলে তা হবে জেল কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছা, অকর্মণ্যতা, উদাসীনতার সঙ্গে লড়াই করে - যেমন চলছে তেমনটাই চলবে, এই জিনিসটাকে ভাঙতে না পারলে কপালে দুঃখ আছে। কল্পনা অথবা আমি - আমাদের কারোরই জেল নিয়ে কোন অভিজ্ঞতা বা জেলের আইঅন কানুন নিয়ে কোন জ্ঞান ছিল না। কিছুদিন স্কুলে পড়িয়ে নিয়মনীতির প্রতি যে ঝোঁক হয়েছিল, তা থেকেই হয়তো, জেল ম্যানুয়াল দেখার আগ্রহ হল। আমার এই নির্দোষ অনুরোধের প্রতিক্রিয়া শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল- জেলে নাকি এক কপিই জেল ম্যানুয়াল আছে, তাই সেটা দেওয়া যাবে না! আইনে নাকি আছে জেল অফিসেই জেল ম্যানুয়াল থাকতে হবে। না, জেল অফিসে গিয়ে জেল ম্যানুয়াল দেখারও অনুমতি নেই। এও বললো যে ম্যানুয়াল অনুযায়ী জেল চালালে নাকি সেটা আমার পছন্দ হবে না! অবশেষে জেলার ঝেড়ে কাশলো - আদৌ কোথাও কোন জেল ম্যানুয়াল নেই - ম্যানুয়াল আউট অফ প্রিন্ট। যার যেটুকু যেমন মনে আছে তেমন ভাবেই জেল চলে। যেহেতু কোন লিখিত নির্দেশ নেই, তাই এটাও জানার উপায় নেই যে কয়েদীদের কী অধিকার বা তাদের কতটুকু চাহিদা কেমনভাবে মেটানো যেতে পারে। জেলের কর্মীদের সবারই হাবভাব এমন যে তুমি জেলে আছো তার মানে তুমি অপরাধী, তাই তোমাকে যে একটা আস্তানায় রেখে খেতে দিচ্ছে এ নেহাতই সরকারের, তথা জেল কর্মীদের দয়া। নিয়ম বা অধিকার নিয়ে কথা বলা মানে তাদের চোখে তুমি বাড়তি ঝঞ্ঝাট। শুরু থেকেই আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানান ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছিলাম- কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না, এইসব আজব দাবি মেনে নেওয়া মানে এরা আমাদের পরিস্থিতির সুযোগ নিতেই থাকবে।
প্রতিদিন মেটিন আমার গারদের তলা দিয়ে খাবার ঢুকিয়ে দিয়ে ইশারায় বলে খেয়ে নিতে। প্রতিদিন একই জিনিস - থকথকে ভাত আর ফ্যানের দলা, কালো কালো ডাল আর কয়েক টুকরো আলু - তার সঙ্গে প্রচুর কাঁকর, ধানের খোসা, হলুদ আর লঙ্কা দিয়ে রাঁধা। একদিনের খাবার দেখে মনে হল অন্য দিনের থেকেও বেশি অখাদ্য - থালার তলা দিয়ে কালো জল বেরিয়ে পড়ছে পাথরের মেঝের ওপর। আমি মনকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছিলাম জিনিসটা খাওয়ার জন্য, এমন সময় কল্পনা চেঁচিয়ে বললো খাবারে হাত না দিতে।
ঠিক করলাম আমরা ভুখ হরতাল করবো।
তিনদিন পর যখন অবশেষে জেলার এল, তখন ঠিক হল কল্পনা নক্শাল সেলের খাবার পাবে, ওখানেও তখন ভুখ হরতাল চলছিল খাবারের মান নিয়ে। আমার তখনও প্রচন্ড আমাশা, ঠিক হল আমার খাবার জেল হাসপাতাল থেকে আসবে। পরদিন আমার ডালের থেকে আমি চৌদ্দটা কাঁচালংকা বের করে জমিয়ে রাখলাম। আমাশার রুগীর পথ্য হিসেবে এগুলো কেমন তা জিজ্ঞেস করার জন্যে ডাক্তারকে দেখালাম, কিন্তু ডাক্তার কোন পাত্তা দিল না।
কল্পনার সঙ্গে একই সঙ্গে ধরা পড়েছিল একজন, নকশালদের সেল থেকে খাবারের সঙ্গে কল্পনাকে কিছু খবর পাঠানোর চেষ্টা করছিল। মাইমুন সব কিছু থেকেই নিজের ভাগ বুঝে নিত, তাই করতে গিয়ে কল্পনার থালায় রুটির মধ্যে ভাঁজ করে রাখা চিঠি আবিষ্কার করে ফেললো। তারপর থেকে ঠিক হল আমরা নিজেরাই রান্না করে খাবো। প্রতিদিন পালা করে একজন রান্না করবে - একজনকে সেল থেকে বের করা হবে। আমাদের কাছে এটা একটা বিরাট জয় - একদিন অন্তর, কিছুক্ষনের জন্যে সেল থেকে বেরুতে পারা বিরাট ব্যাপার।
আমাদের সাপ্তাহিক বরাদ্দ হল চাল, মুসুর ডাল, লাল আটা, আলু, পেঁয়াজ, হলুদ, লংকা, একটু সর্ষের তেল। প্রতি রোব্বার করে জোগান আসতো। এসব রাখার জন্যে কোন পাত্র ছিল না, কিন্তু ওয়ার্ডারের কাছ থেকে দুটো বস্তা জোগাড় করা গেছিল - কল্পনার সেলে এই বাজার স্তুপ করে বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। সপ্তাহে একদিন একটু করে শক্ত, খুব চড়া গন্ধের পাঁঠার মাংসও বরাদ্দ হয়েছিল - সেগুলো ঘন্টাখানেক সেদ্ধ করলেও চামড়ার মত শক্ত হয়ে থাকতো। ইওরোপিয়ান পরিচয়ের কারনে আমার আবার একটু অতিরিক্ত বরাদ্দ হল - একটু সরু চাল, একটু বেশি তেল, চা পাতা আর চিনি। এই নিয়ম হল বৃটিশ রাজের চালু করা - পরাধীন ভারতে ইওরোপিয়ান বন্দীদের জন্য, ভারতীয় বন্দীদের থেকে উন্নততর সুযোগ সুবিধে। বৃটিশ আমলে অবশ্য ইওরোপিয়ানদের জন্যে এই আয়োজন আরো অনেকটা রাজসিক ছিল, কিন্তু স্বাধীন ভারতেও এই আইন দিব্যি বহাল। আমি বলেছিলাম অন্যদের থেকে আলাদা ব্যবস্থা চাই না কিন্তু এটা চললো।
জেলের মজুতখানার দায়িত্বে দুর্ধর্ষ মত দেখতে, ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া চুল ওয়ালা এক কয়েদী। ও এই পদের কারনে বেশ বেশ দুপয়সা কামিয়ে নিত, কয়েদীদের জোগান বাইরে বেচে টেচে। মাঝে মাঝে মেটিন মাইমুনের জন্যে টুকটাক চোরাই উপহারও নিয়ে আসতো।
এরপর থেকে প্রতিদিনের কার্যক্রমে রান্না বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে উঠলো। আমরা চেষ্টা করতাম রান্নাটাকে যতদূর সম্ভব টেনে লম্বা করা যায় - যত বেশি সময় সম্ভব নিজের সেলের বাইরে থাকা যায়। যতক্ষন সব মন্ড না পাকিয়ে যায় ততক্ষন বসে ভাত ডাল সেদ্ধ করতে থাকতাম। ওয়ার্ড্রেস অধৈর্য হয়ে গেলে বলতাম 'ইংরেজি' খানা বানাতে একটু বেশিই সময় লাগে। গ্লাসের পর গ্লাস ট্যালট্যালে পাতলা লাল চা খেতাম সারাদিন ধরে - ঐ করে গরম জলে অ্যালুমিনিয়ামের ধাতব স্বাদই অভ্যেস হয়ে গেল। যত লম্বা পারা যায়, যত সময় পাওয়া যায় আমি আর কল্পনা নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলতাম। ক'দিনের মধ্যে এমন হল যে আমরা একজন আরেকজনের বিষয়ে এত কথা জানতাম যে আমাদের বাড়ির লোকজনও সেসব জানতো না। একটা খুব বড় ব্যাপার হয়েছিল, ভারতীয় রীতি নীতি, চালচলন নিয়ে আমি কল্পনার কাছে অনেক কিছু শিখেছিলাম। শুরুর ঐ মাসগুলিতে কল্পনার সঙ্গ যে আমাকে কী সাহায্য করেছে - ধৈর্য ধরে, আমার মাথা গরম সহ্য করে, অন্যদের আমার কথা আর আমাকে অন্যদের কথা বুঝিয়ে দিয়ে - অন্য মেয়েদের সঙ্গে, যারা কোনদিন কোন অভারতীয় মানুষ দেখেনি, আলাপ পরিচয় করিয়ে দিয়ে - কল্পনা ওখানে না থাকলে এই সময়টা আমি কী করে পেরোতাম আজ ভাবতেও পারি না।
সমস্যা শুরু হল বর্ষাকালে। প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি - বিকেলেবেলা কালো করে মেঘ, ঝমঝম বৃষ্টি আর হুহু হাওয়া। একেক পশলা বৃষ্টি আমাদের সেলের ভেতর ভাসিয়ে দিয়ে যেত - মেঝে, কম্বল সব ভেজা - এক কোণে গুটিশুটি মেরে জলের থেকে বাঁচার চেষ্টা করতাম। সুপার বললেন গরাদের ওপর দিকে চটের পর্দা টাঙানো যেতে পারে, কিন্তু নিচে যথেষ্ট ফাঁকা রাকতে হবে, নজরদারিতে যেন বাধা না হয়। বৃষ্টি তাতে কিছু আটকালো না। একেকদিন কয়লার উনুন জ্বালানো যেত না রাত পর্যন্ত - রান্না করা যেত না, আমাদের খাওয়াও হতো না।
শেষে হয়তো রাতে অনেক কষ্টে আধ কাঁচা, ধোঁয়ার গন্ধে ভরা পোড়া চাপাটি বানানো যেত দুয়েকটা। তবুও মনে হচ্ছিল বর্ষাকাল যেন দুয়েক পশলা বাড়তি মুক্তি নিয়ে এসেছে। ঐ ধুম বৃষ্টির সময় জেলের কোন অফিসার এদিকে আসতো না - আমরা কয়েক ঘন্টা নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারতাম নিজেদের মধ্যে। আমরা বসতাম, একজন সেলের ভেতর, আরেকজন বাইরের চৌকাঠে, চটের পর্দা থেকে বড় বড় জলের ফোঁটা ভিজিয়ে দিত আমাদের, আমরা কথা বলতাম। ওয়ার্ড্রেস ভাবতো আমরা নিশ্চয় পাগল, কিন্তু এত সপ্তাহের সলিটারির পর কথা বলতে পারার একেকটা মুহূর্তের নির্বিবাদে কথা বলার স্বাধীনতা মনে হত অমূল্য। আমরা আমাদের মুক্তি নিয়ে কথা বলতাম, কোর্টে তুললে কী বলবো, কীভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করবো! অদম্য আশা নিয়ে নিজেদের কতব্য মকশো করতাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে!
মাঝেমাঝেই শোনা যেত আমাদের আদালতে তুলবে, শেষ পর্যন্ত দেখা যেত জেল অফিসে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজিরা দিচ্ছি, আর মোটাসোটা, ক্লান্ত, বিরক্ত হতাশ ম্যাজিস্ট্রেট বলছে তার হাতে কিছুই নেই কারন আমাদের অন্য জেলা থেকে আটক করেছে। আর কিছু না হোক, জেল অফিস পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যাওয়াই মনে হত তাও একটা অন্য কিছু... আর মনে হত যদি অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়?
একদিন, আমাদের সঙ্গে একই দিনে আটক হয়েছিল এমন একজনের সঙ্গে দেখা হল - সে বললো আমরা রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা চেয়ে দরখাস্ত করি না কেন? তাহলে অনেক সুবিধে পাওয়া যাবে। আমি আর কল্পনা দরখাস্ত করলাম। আমাদের একটু ভয় ছিল যে সেটা হলে আমরা না অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যাই, তাও করলাম। কিন্তু ভয় অমূলক ছিল, সুপার বলে দিল আমরা পাতি অপরাধী, ওরকমই থাকতে হবে।
শুরুর হাজিরাগুলোর একটায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাদের কী অভিযোগে আটক করা হয়েছে তা জানতে চেয়েছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট ভারতীয় আইনের চারটে ধারা বললো। আমাদের, ঐ একই এলাকা থেকে আটক করা আরও পঞ্চাশ জনের সঙ্গে একগুচ্ছ ধারায় আটক করা হয়েছেঃ বিপজ্জনক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা, শান্তিভঙ্গ, সশস্ত্র ডাকাতি, আর খুনের চেষ্টা। আমার মনে আছে, এইসব শুনে আমার মনে হয়েছিল, যাক, বছর দশেকের বেশি তো জেল হবে না! কয়েকসপ্তাহ পর থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজিরা বন্ধ হয়ে গেল - আমাদের না দেখেই ও সমন রিনিউ করে দিতে লাগলো। মজার ব্যাপার হল, আইনে বলে অভিযুক্তকে আটক করার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে আর সাজা নির্ধারন হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতি পনেরো দিনে হাজিরা দিতে হবে! কিন্তু আইনের ব্যাখ্যা এখানে আলাদা!
একমাস বাইরের কারো আমার সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগের অনুমতি ছিল না; শেষে কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশনের অফিস থেকে এক বৃটিশ কন্সুলার অফিসারকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতি দেওয়া হল। ওকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের অভিযোগ নিয়ে ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ও শুধু আমার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা আর পেটভরে খেতে দিচ্ছে কিনা এটুকুই জানতে চাইলো। আমি কিছু অন্তর্বাসের জন্যে অনুরোধ করেছিলাম, বললো তার জন্য রাজধানী পাটনা থেকে অনুমতি আনাতে হবে। বিহার সরকারের মুখ্যসচিবকে অন্তর্বাসের জন্যে লিখিত দরখাস্ত দিতে হবে ভেবে আমার এসবের মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল।
অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ নিয়েও কনসাল অফিসার কোন উচ্চবাচ্চ করলো না - ভারত সরকার বলে দিয়েছিল আমার আর অমলেন্দুর বিয়ে আদৌ বৈধ না।
অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়ার জন্য ওদের দারুন একটা ফন্দি ছিল এটা, আর ওর সঙ্গে কথা না বলে আমার পক্ষে কিছুই স্থির করতে পারছিলাম না। ফিরে সেলের ভেতর এমাথা ওমাথা পায়চারি করতে করতে যেন হতাশা আরো জাঁকিয়ে বসছিল - এবারেও কিছু কাজের কাজ হলো না। কয়েকমাস পর আবার দূতাবাসের এক অফিসারের সঙ্গে দেখা - সেও ঐ এক লাইনই আমায় শুনিয়ে গেল - আমি কী ভাবি, কী বিশ্বাস করি, ভারতে কী চলছে, সেই সব পরের কথা, আগে আমার জেল থেকে বেরুনোর ব্যবস্থা যেন আমি করি। বৃটিশ দূতাবাসের প্রথম মিটিঙের সময় এক পাল স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার উপস্থিত ছিল - পরদিন সব খবরের কাগজে বেরিয়েছিল আমি আমার যত্নআত্তি নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কেমন উচ্চ প্রশংসা করেছি - !
এর ক'দিন পর, আমি জেলে আমার প্রথম চিঠি পেলাম! কোন কিছু স্কুলের ছেলে মেয়েরা আমাকে চিঠি লিখেছে - ভারতকে সঠিক পথের দিশা দেখানোর জন্যে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। আমার জন্যে অসম্ভব আনন্দের ছিল, কিন্তু খুব অবাকও হয়েছিলাম যে এতরকম সেন্সার বা আগে চিঠিপত্র নিয়ে এতরকম অসুবিধের পর এমন আবেগ ভরা এই চিঠি আমার কাছে কী করে এল। একই দিনে কল্পনার কাছেও একটা চিঠি এল - মাদ্রাজের এক "উচ্চ বংশজাত অভিজাত ভদ্রলোক" এর হয়ে মহিলা লিখেছে - সেই ভদ্রলোক কল্পনা অথবা আমি অথবা আমাদের দুজনকেই বিয়ে করতে চান - আমরা যদি সুন্দরী এবং পঁচিশ বছরের কমবয়সী হয়ে থাকি। এমনিতে আমাদের নাম তো খবরের কাগজ থেকে সারা দেশের লোকই জেনে গেছিল। মজা দেখার জন্যে ওয়ার্ডারের কাছ থেকে চিঠির ফর্ম নিয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে আমরা উল্টে চিঠিও লিখেছিলাম! তবে তার আর উত্তর আসেনি!
নক্শাল সেলের অন্য কয়েদীদের হাল হকিকত জানার জন্যে আমরা খুবই কৌতুহলী ছিলাম, কিন্তু সেসব খোঁজ নেওয়ার জন্যে একে তো প্রচন্ড সাবধানে আর গোপনে চেষ্টা করতে হত, আর ধরা পড়ার বিপদও ছিল খুব।
আমাদের সেলের কাছাকাছি এসে পড়ার জন্য অন্য কয়েদীরা হামেশাই ধমক খেত। তাও যারা দুঃসাহসী, তারা একেক দিন গরমের দুপুরে অন্য সবাই যখন বিশ্রাম করছে, আমাদের গরাদের কাছে নিঃশব্দে ছায়ার মত এসে দাঁড়াতো। তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করার কোন উপায় আমার ছিল না, কিন্তু আমার জন্য তাদের সহানুভূতি আমি খুব বুঝতে পারতাম। রাতে ওদেরই একজন, একটি আঁটোসাঁটো গড়নের অল্পবয়সী গ্রাম্য মেয়ে আমার সেলে তেলের বাতি এনে দিত। বাতিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেই আমার দিকে হেসে মেটিনের দিকে ইশারা করতো - কথা বলতে নিষেধ আছে! ডাক্তার আমার জন্য কমলালেবু বরাদ্দ করেছিল - আমি আধখানা ওর জন্য রেখে দিতাম - ও ঐ আধ্খানা কমলালেবু নিয়ে ছুটে পায়খানায় চলে যেত - মেটিন আর ওয়ার্ড্রেসের চোখের আড়ালে শান্তিতে খাওয়ার জন্য! কল্পনার কাছ থেকে জেনেছিলাম এদের বেশিরভাগই সাজাপ্রাপ্ত না - বিচারাধীন বন্দী। অনেকেরই অনেক বছর হয়ে গেছে বিচারের অপেক্ষায় জেলে থেকে থেকে। এদের কারো কারো আট্ক হওয়ার সময় বাচ্চা খুব ছোট - ওরা মা-র সঙ্গে জেলে এসেছে, এখন জেলের ভেতরেই বড় হচ্ছে। এইসব বাচ্চারাই জেলখানায় আমার আনন্দের সবচে বড় উৎস ছিল - বড়রা যাই বলুক, এরা আমার সেলের কাছে আসবেই আসবে! একেকজন আমার সেলের গরাদ বেয়ে উঠে ওদের চুল আঁচড়ে দিতে বলবে, অথবা আমার আয়নায় মুখ দেখার বা আমার চশমা পরে দেখার দাবি করবে! সেল ঝাড়ু দেওয়ার জন্যে আমার একটা ঝাঁটা ছিল - তার কাঠি দিয়ে আমি এই বাচ্চাদের জন্যে ছোট ছোট খেলনা তৈরি করে রাখতাম! কখনো আমার খাবার থেকে কিছু বাঁচিয়ে রাখতাম ওদের জন্য।
তিনমাসের আধা সলিটারির পর, কল্পনার সঙ্গে এক সেলে থাকার আশা ছেড়ে দিলাম। এমনকি নিজেকে বোঝালাম, কর্তৃপক্ষ যা না দিয়ে তোমাকে যন্ত্রনা দিতে চায় তা না পেয়ে যন্ত্রনা পাওয়া মানে ওদের খুশি করা। সেপ্টেম্বর মাসে একদিন সুপার আমার সেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাতই দাঁড়িয়ে, যেন মাথায় কিছু এসেছে এমন ভাবে বললো, বললো, "তোমরা দু'জন কি এক সেলে থাকতে চাও"?
পরদিন সকালে আমাদের সেলের তালা খুলে গেল - দিনের বেলা, খোলা আকাশের রোদের তলায় - বাধাহীন - মুক্তি!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।