এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • মাই ইয়ার্স ইন অ্যান ইন্ডিয়ান প্রিজনঃ মেরি টাইলার। অনুবাদ

    বর্গীয় জ লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ২২ জুলাই ২০২৩ | ১৫৮১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • নকশাল! 
    ~~~~~~~
    একেবারে অন্যরকম একটা যাত্রাপথ পেরোলাম পরের ছ'সপ্তাহে - টার্কি, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের পথে। দিল্লি থেকে কলকাতা যাচ্ছিলাম কালকা মেলের থার্ড ক্লাস কামরায়, ভাবছিলাম কেমন ভাবে অমলেন্দুর সঙ্গে দু'বছর দেখা হয়নি, কেমন হবে এতদিন পর আমাদের দেখা হওয়া... অমলেন্দু আমার সঙ্গে দার্জিলিং যেতে পারবে? শ্রীলঙ্কা?
    এই ট্রেন সফরেই প্রথম মনে হয়েছিল ভারত ভ্রমণ হয়তো আমার কল্পনার সঙ্গে মিলবে না। নৌবাহিনীর এক অল্পবয়সী অফিসার কামরায় আমার সিট খুঁজে দিতে সাহায্য করেছিলেন। মাঝে মাঝে গল্পসল্প করার জন্যে আমার কামরায় চলে আসছিলেন ট্রেন ছাড়ার পর। অফিসার ভদ্রলোক সাবধান করছিলেন, কলকাতায় কেমন গোলমাল অশান্তি, বাংলা কেমন সরকারী শাসনের বাইরে চলে গেছে। চাষীরা জমি মালিকদের ফসল লুঠ করছে, শহরে রাজনৈতিক দলগুলির মারপিট, আইন কানুনের বালাই নেই। বলছিলেন কলকাতায় আমি যত কম সময় থাকি ততই ভালো।

    লন্ডনে খবরের কাগজে ১৯৬৭ সালে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়িতে কৃষকদের বিদ্রোহের, আর তার সূত্র ধরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক লাইনের কথা পড়েছিলাম। ভারতবর্ষে মত এমন একটি বিপুল, বিচিত্র জনগোষ্ঠীর দেশে বিপ্লব হলে কী হবে, আর বিশ্ব রাজনীতিতে তার কী প্রভাব পড়বে - এইসব সম্ভাবনা আমার কাছে দারুন কৌতুহল আর উত্তেজনার বিষয় বলে মনে হয়েছিল। তরুণ অফিসারটির কথা শুনছিলাম, বিনা মন্তব্যেই। আমার অবশ্য ওঁর মত জমি মালিকদের জন্য চিন্তা হচ্ছিল না, আমি ভাবছিলাম কতখানি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর ঐ দরিদ্র কৃষকেরা নিজেদের ফলানো ফসল ছিনিয়ে নিতে মরিয়া হয়েছিলেন।

    এত সতর্কবার্তা, ভারত বা কলকাতা সম্পর্কে এত জানার পরেও কলকাতায় পৌঁছে বুঝতে পারলাম, এর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে চেপে শুধু চোখে পড়ছিল ক্লিষ্ট মানুষের দুর্দশা আর দারিদ্র, প্রতিটি দেওয়ালে জুড়ে লেখা স্লোগানঃ বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, নকশালবাড়ি লাল সেলাম, চীনের পথই আমাদের পথ। ল্যাম্প পোস্টগুলিতে বড় বড় ম্যাপ ঝোলানো - জেলায় জেলায় সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগতি চিহ্নিত করে।

    অমলেন্দুর বাড়িটি যে পাড়ায় সেখানে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বাস। অমলেন্দুরাও ওদের প্রতিবেশিদের মতই ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে এসেছে। প্রথম ক'দিন আমার বাঙালী পরিবারে মানিয়ে নিতে কেটে গেল। অসংখ্য আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধবের আসা যাওয়া, হাজার রকমের খাওয়া দাওয়া! তবে কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে, বুঝতে আর চিনতে শিখে গেলাম বাইরে  দোকানের বারান্দায়, পুকুরধারে নারকেল গাছের ছায়ায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেদের পায়চারি, নজর। অমলেন্দুর দাদা তন্নতন্ন করে দেখে নিল, আমার বইপত্রের মধ্যে যেন পিকিং থেকে প্রকাশিত কিছু না থাকে। আশে পাশের বাড়ি থেকে চীন থেকে প্রকাশিত বইপত্র বাজেয়াপ্ত হয়েছে, যাদের কাছে সেসব পাওয়া গেছে তারা গ্রেপ্তারও হয়েছে। একজন প্রতিবেশী আমাকে বলেছিলেন, উনি ওঁদের পারিবারিক সম্পত্তি একটা পুরনো তরোয়াল পেছনে পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলেন - পুলিশ বেআইনী অস্ত্র রাখার দায়ে ধরতে পারে এই ভয়ে।

    জানুয়ারি মাসের গরমেই বুঝতে পেরে গেলাম, দক্ষিনের দিকে বেড়াতে যেতে চাইলে আরও গরম পড়ে গেলে আমি আর পারবো না! ঠিক করলাম পুরী যাবো প্রথমেই। ক'দিন কলকাতার আশপাশ দেখার পর মাস দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসবো এই কড়ারে আবার বেরিয়ে পড়লাম! আমি চাইছিলাম অমলেন্দুর সঙ্গে যেতে, কিন্তু ও পারলো না, তাই আমি একাই - ২৫শে জানুয়ারি, পুরী এক্সপ্রেস।

    এর পরের দু'মাস আমি গেলাম পুরী থেকে মাদ্রাজ, শ্রীলঙ্কা, বম্বে, কাঠমান্ডু। সব ট্যুরিস্টরা যেসব জায়গায় যায় সেসব জায়গা ঘুরলাম, অসাধারন সব মন্দির, স্থাপত্য, পাথর খোদাই, গ্রীষ্মদেশের সমুদ্র সৈকতে অলস বেলা! আমি মাঝে মাঝেই বড় ট্যুরিস্ট দলের সঙ্গে জুড়ে যেতাম, গাড়ি, বাস যাত্রাগুলিতে। কিন্তু সবসময়ই মনে হত আর পাঁচজন ট্যুরিস্টের সঙ্গে আমার যেন ঠিক মিলছে না - ভারত দেশটাকে আমি ঠিক ওদের মতন করে দেখছি না। কিছু কিছু জিনিস আমাকে গ্রাস করে নিত, চিন্তা ভাবনা, দেখাকে নাড়িয়ে দিত যেন। বেনারসে আমার সঙ্গী ট্যুরিস্টরা যখন বড় বড় মন্দির, রাজসিক প্রাসাদ দেখে মুগ্ধ, আমি মন ফেরাতে পারছিলাম না গঙ্গার ঘাটে দেখা একটা নোটিস থেকেঃ "ভিখিরি, স্নানার্থী, কুষ্ঠরোগী, মৃতদেহ - ইত্যাদির ছবি তোলা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।"

    আগ্রাতে আমি যেন প্রায় অনিচ্ছুক কর্তব্যের খাতিরে তাজমহলের ছবি তুললাম। আমাকে কুরে খাচ্ছিল রিক্সাওয়ালাদের অবস্থা - কতখানি দারিদ্রের মধ্যে থাকলে সামান্য কটা টাকার জন্যে একজন ট্যুরিস্টের পেছনে, সওয়ারি নেওয়ার জন্য ওদের ঘন্টার পর ঘন্টা এরকম ভাবে ঘুরতে হয়? পুরীতে গিয়ে পথের কুষ্ঠরোগীদের ভিড়ে, ভিক্ষার আকুতিতে মন্দির দেখার উৎসাহই চলে গেল। অন্য কোথায় কোন একটা মন্দিরের সামনে দেখলাম একজন পূর্ণগর্ভা ভিখারিনী রাস্তায় পড়ে, সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের পথে চলে যাচ্ছে। অন্য এক জায়গায় দেখলাম ফুটপাথের ভিখারিনী তার রান্নার বাসন ধুয়ে নিচ্ছে নর্দমার জলে - এ যেন একেবারের সাধারন দৃশ্য।
    আর কলকাতা - এমন এক শহর, কংকালসার অর্ধনগ্ন মানুষ জল কাদা ডিঙিয়ে হাতে টানা রিক্সা নিয়ে ছুটে চলেছে সওয়ারি বসিয়ে শহরের পথ ধরে।

    আমার মনে হচ্ছিল এই দেশটা কেন আর ধৈর্য ধরতে পারছে না তা বোঝা খুব সহজ। কলকাতা এসে প্রথম যা দেখেছি, শুনেছি, সেসব আসলে একটা সুপ্ত আগ্নেয়্গিরি জেগে ওঠার আগের নির্ঘোষ। মাসের পর মাস কাটতে লাগলো, আমার মনে হচ্ছিল পথের হতদরিদ্র ভিখিরী, কুষ্ঠরোগীদের জন্য - মানুষের প্রতি মানুষের যে দায় তা আমি এড়াতে পারবো না, আমি আর বহিরাগত বেড়াতে আসা বিদেশি নই এই দেশে।

    কলকাতায় ফিরে দেখলাম এই শহর আরো বড় ঝামেলা আর অশান্তিতে। যুক্তফ্রন্টের সরকার পদত্যাগ করেছে, বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন। ব্যাংকে টাকা ভাঙাতে গিয়ে শুনলাম ব্যাংক কর্মচারীরা গ্রামের দিকের সশস্ত্র প্রতিরোধের কৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন! কফি হাউসে ছাত্র, বুদ্ধিজীবিদের মুখে কেবল অন্ধ্রের শ্রীকাকুলামের তিনশো গ্রামের মুক্তাঞ্চল নিয়ে সাগ্রহ, উত্তেজিত আলোচনা! লোকজন বলছে শিগ্গিরি মেদিনীপুর মুক্ত হয়ে যাবে, বিপ্লবীরা কলাকাতাতেও আসছে দলে দলে!

    নক্শাল রাজনীতির সমর্থক, বা তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল যাদের সঙ্গেই আমি কথা বলছিলাম, মনে হলো সবারই মত যে সংগ্রামের লক্ষ্য হবে যেসব জায়গায় অন্তত ৭০% মানুষ আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে সেসব জায়গায় ভূমি সংস্কার করা, আর শিক্ষিত যুবকরা আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে যেতে থাকবে, কৃষিভিত্তিক সংগ্রামী রাজনীতির প্রচার করতে আর কৃষকদের সংগ্রামের সঙ্গী হতে। অমলেন্দুর এক তুতো ভাই আমাকে নিয়ে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেন বড় বড় জনবিরল ভুতুড়ে দালানগুলি আগাপাস্তলা স্লোগানে মোড়া। যেসব ছেলেমেয়েরা জীবন কাটিয়েছে এই শহরে, তারা তাদের আরাম, ভবিষ্যৎ, কেরিয়ার উৎসর্গ করে দিতে উদগ্রীব, কৃষকদের সংগ্রামে তাদের সঙ্গী হয়ে, একটা নতুন, সহমর্মী দেশ গড়ে তোলার জন্যে। আমার সঙ্গে যাদেরই দেখা হয়েছিল, আমি দেখছিলাম নকশালপন্থীদের প্রতি প্রকাশ্য অথবা প্রচ্ছন্ন সমর্থন, যেন সংসদীয় গণতন্ত্রে কারোরই আর আস্থা নেই, একটা বড় রকম বদলের জন্য সবাই উদগ্রীব।

    আমার দেশে ফেরার সময় এগিয়ে আসছিলো। অমলেন্দুর সঙ্গে কথা বলছিলাম, যারা এই দেশ, ভারতবর্ষ নিয়ে ভাবে, এই দেশটার জন্য কিছু করতে চায় - তারা কীভাবে সাহায্য করতে পারে। একদিন ওর এক বন্ধু বললো - "কিছু করতেই যদি চাও, থেকেই যাওঅ না আমাদের সঙ্গে?" 
    প্রস্তাবটা উড়িয়ে দেওয়ার স্বরে দেয়নি ও, কিন্তু একেবারেই অবাস্তব মনে হয়েছিল, প্রথম শুনে অন্তত। আমরা চাকরী, ফ্ল্যাট, ইংল্যাণ্ডে আমার মা বাবা আমার পথ চেয়ে বসে। একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল এইখানে এসে এত কিছু দেখে এত ভাবনা চিন্তা করে, কথা বলে একদিন যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে লন্ডনের নিশ্চিন্ত আরামের জীবনে ফিরে চলে যাওয়াটা যেন নিদারুন বিশ্বাসঘাতকতা - তা কার সঙ্গে জানি না। 
    কয়েকদিন ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলাম থেকেই যাই, অন্তত আরো কিছুদিন, ভারতের অবস্থা নিয়ে আরেকটু জেনে, পড়ে, বুঝে।

    ইওরোপের দেশে ট্রেনিং নিয়ে এসে অমলেন্দুর কাছে ভালো, বড়, অনেক টাকার চাকরীর প্রস্তাব ছিল। সেসব দিকে না গিয়ে অমলেন্দু একটা অতি সাধারন জীবন কাটাতো, আর বেশিরভাগ সময় কাটাতো সমাজের দরিদ্রতম মানুষজনের সঙ্গে। বিদেশে দেখে আসা চাকচিক্য আর ঐশ্বর্য ওকে আরো বেশি বেদনা দিত, ওর নিজের দেশের, নিজের মনুষের দুর্ভোগ দেখে। অমলেন্দু সবসময় বলতো, যতক্ষন না দেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত না হয় ততদিন স্বাধীনতা মূল্যহীন।

    কয়েকসপ্তাহ একসঙ্গে কাটানোর পর অমলেন্দু আমাকে প্রস্তাব দিল ওর এই জীবনের সঙ্গী হওয়ার।
    এই জীবন, যা আরাম, ঐশ্বর্য, স্বাচ্ছল্যের হিসেবে অতি নগন্য, সামান্য। আমাদের মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল তাতে এই দেশের মানুষের জন্য আমাদের যৌথ সম্পৃক্তি গভীরতর হচ্ছিল। আমরা একজন আরেকজনকে চিনতাম খুব ভালোভাবে, নীতি, আদর্শ, বোধেও আমরা একই রকম ছিলাম। আর অমলেন্দুর পরিবারের সবাই আমাকে ভালো বেসেই ফেলেছিল! শুরু থেকেই ওদের বাড়িতে আমি খুব নিজের মত থেকে গেছিলাম - একেবারে নিজের বাড়ির মত। এত কিছুর পরেও, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত খুবই কঠিন ছিল। মানসিক টানাপোড়েন চলতে থাকলো, কিন্তু তারপর স্থির মনে হল, ব্রিটেনে ফিরে যাওয়া, আর তারপর হয়তো আর কোনদিন অমলেন্দুকে দেখতে না পাওয়া - এর থেকে কঠিন, বেদনার আর কিছু হবে না।  ওর নিজের দেশের পটভূমিতে দেখে, ওর ইওরোপের ঐশ্বর্য, জাকজমকে না ভুলে নিজের দেশ, নিজের মাটির প্রতি দায়স্বীকারকে আরো অনেক বড় করে আমি দেখতে পেলাম। আমি আমার উত্তর নিয়ে প্রস্তুত হলাম অবশেষে।

    ১০ই এপ্রিল, ১৯৭০ সালে অতি সামান্য আয়োজনে, হিন্দু রীতিতে আমরা বিয়ে করলাম। ধর্মীয় রীতির কোন গুরুত্ব আমাদের কাছে ছিল না, তবে আমাদের সম্পর্ক আর প্রতিশ্রুতিকে রূপ দেওয়ার জন্যে এইটাই ছিল সবচে' সরল পথ।

    এর কয়েকদিন আগে আমি আমার জীবনের সবচে' কঠিন চিঠিটা লিখতে বসেছিলাম। আমার ফেরার পথ চেয়ে থাকা মা বাবাকে। স্বাভাবিকভাবেই ওরা খুশি হতে পারেনি। কিন্তু মা লিখেছিল, আমি যা চাই তার থেকে বড় আর কিছু নেই - আমি যা ঠিক মনে করি, তাই যেন আমি করি।

    আমি বুঝতে পারছিলাম ভারতে থাকতে চাইলে, ভারতকে জানতে চাইলে, আমাকে প্রথমেই ভারতের গ্রামগুলিকে চিনতে হবে, যা ছিল এই মুহূর্তের অভ্যুত্থানের কেন্দ্র। একের পর এক জার্নালে পড়ছিলাম ভারতের গ্রামগুলিতে সামন্ততন্ত্র, বেগার শ্রম, সুদখোর মহাজন, অ্যাবসেন্টি জমিদারদের প্রাবল্য, ভাগচাষীদের হাল হকিকত - আমি বুঝতে পারছিলাম এতদিনের ঘুরে বেড়ানোয় আমি গ্রামীন ভারতের কিছুই দেখিনি। আমি মন্দির, প্রাসাদ, সৌধ, সমুদ্রতীরের বালুকা বেলা দেখেছি, জনবিস্ফোরন নিয়ে আতংক ছড়ানো লোকেদের প্রিয় লক্ষ্য শহরের ঘিঞ্জি  বস্তির ধার দিয়ে হেঁটে গেছি - কিন্তু গ্রামীন ভারতে না দেখলে আমার ভারত দর্শনের বারো আনাই ফাঁকি। অমলেন্দুকে বলছিলাম আমি গ্রামীন ভারত দেখতে চাই। 
    মে মাসের শেষে আমরা ট্রেনে চেপে কলকাতা ছাড়লাম।

    গ্রেপ্তার হওয়ার সময় আমি ছিলাম বাংলা বিহার সীমান্তের সিংভুম জেলায়। আমরা কাদামাটি আর দর্মা বেড়ায় তৈরি ছোট নীচু একটি কুটিরে ছিলাম। গ্রামের এক কৃষকের কুটির - ওঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল কুটির থেকে কয়েকমাইল দূরে বাস স্ট্যান্ডে। ভারতের বেশিরভাগ গ্রাম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত - হোটেল গেস্ট হাউস কিছু নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অতিথিকে বাড়িতে থাকতে দেন, নিজের সামান্য খাবার ভাগ করে খান। হিন্দু ধর্মে বলে অতিথি নারায়ণ। 

    এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ আদিবাসী, সাময়িক চাষবাস করেন। কিছুদিন আগে খরা গেছে - ফসলি আর অনাবাদী জমি সব এক হয়ে গেছে। শুধু উষর মাটি, শুধু কিছু বন্য গুল্ম, ঝোপ, আর পুদিনার ঝাড়। গ্রামের চারদিক পাহাড়ি, বড় গাছপালায় ঘেরা। রাজ্যের সীমানা পেরোলেই মেদিনীপুর - সেখানে নক্শালরা এরকমই একটা বসতিতে আত্মগোপন করে আছে। সিংভুমেও ওদের আনাগোনা আছে, তবে এই গ্রামের কারোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়নি। এই গ্রামের একমাত্র লোক, যার জমিজমা আছে, তার কাছে পুলিশের নির্দেশ ছিল গ্রামে বাইরের লোক ঢুকলেই যেন খবর দেওয়া হয়। আমরা জানার আগেই তার কাছে খবর চলে গেছিল।

    সকালবেলা অমলেন্দু আর ওর ভাই ছ'মাইল দূরের গঞ্জ শহরের জন্য বেরুলো, ওখান থেকে বাস ধরে ওরা জামশেদপুর যাবে। সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে আসবে, তাই আমি আর সঙ্গে গেলাম না।
    ওরা যখন বেরুলো তখন আমি মাটির নিকোনো দাওয়ায় দর্মার ছাউনির নিচে পান্তা ভাতের বাটিতে হাত ডুবিয়ে বসে, রাতে জল দিয়ে রাখা, টক টক স্বাদের পান্তা, ছাঁচি পেঁয়াজের গন্ধে ভরপুর! মেয়েরা আর বাচ্চারা আমাকে ঘিরে - হাত দিয়ে খেতে গিয়ে আমার আলুথালু অবস্থা ওদের জন্যে একটা মজার জিনিস! সক্কালবেলা ভাত খেয়ে ঘুম পাচ্ছিল, তাই ওদের বললাম এই ছাউনির নিচে একটু শোব। 

    হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভাঙা অবস্থায় বুঝলাম মেয়েদের কেউ একজন আমাকে ধরে প্রাণপণে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ইশারায় বলছে এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। ঘুম চোখে ওর যেদিকে আঙুল ছিল সেদিকে উদ্ভ্রান্তের মত হেঁটে গেলাম - বাড়ির গেটের দিকে।
    বাইরের পথে পা দিতেই পাঁচজন অস্ত্রধারী পুলিশের লোক চোখের পলকে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমার গলায়, হাতে আর কোমরে দড়ি বেঁধে ফেলে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ২২ জুলাই ২০২৩ | ১৫৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত | 2600:1002:b138:2085:a566:85fd:ff58:***:*** | ২২ জুলাই ২০২৩ ০৭:২১521521
  • পড়ছি কিন্তু, বলা হবে না হয়ত সব সময়! 
     
  • aranya | 2601:84:4600:5410:2cbc:94b9:c8f6:***:*** | ২২ জুলাই ২০২৩ ০৭:৩০521522
  • অসাধারণ
  • যোষিতা | ২২ জুলাই ২০২৩ ১৬:৫২521538
  • এই লেখাটা একদম আলাদা।
  • Gobu | 2402:3a80:1cd6:e6d6:2593:ca13:785c:***:*** | ২২ জুলাই ২০২৩ ১৮:৪৫521541
  • খুব ভালো এগোচ্ছে ! পড়ছি .
  • বর্গীয় জ | ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৮:০৮521576
  • সবাইকে ধন্যবাদ। মতামত লিখেছেন সবসময় বলা হবে না, সে ঠিক আছে, প্রতিক্রিয়াহীন লেখালিখির ব্যাপারে আমি রুস্তম, এক সেরেস্তায় দশ বচ্ছর, হেঁহেঁ।
    সমস্যা অন্য জায়গায়, এমন টানা লেখার অভ্যাস কোনকালে নেই, ভেবেছিলাম একটা করে অধ্যায় করবো, কিন্তু প্রচুর সময় লাগছে।
    দেখা যাক।
    বইয়ে যেটা প্রাককথন আছে, বা বইয়ের অল্প পরিচিতি সেসব ইচ্ছে করেই শুরুতে দিলাম না, পরে দেওয়া যাবে। এমনিতে বোধহয় পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত বইটা এখনো পাওয়া যায়, আর পুরনো সংস্করণের পিডিএফ নেটে আছে।

    অনুবাদ আড়ষ্ট ও উৎকট লাগলে গাল দিতে ভুলবেন না যেন।
    আজকের দিনটা লেখা হলো না, তার জন্যে আত্মগ্লানি বোধ করছি, কাল ঠিক বসবো আবার।
  • aranya | 2601:84:4600:5410:942a:a2f7:9414:***:*** | ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৯:০৬521579
  • অনুবাদ তো জাস্ট টু গুড হচ্ছে। কাল রাতে দু লাইন পড়ব ভেবে শুরু করে , সেশ না করে থামা গেল না 
     
    আমি তো এখনই গুরু থেকে প্রকাশিতব্য অসাধারণ এক চটির স্বপ্ন দেখচি। দত্তক ও নেব। 
     
    অনুবাদকের আলসেমি-ই একমাত্র প্রতিবন্ধক হতে পারে, সে স্বপ্ন সার্থক হওয়ার পথে :-)
  • | ২৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:১৫521604
  • চমৎকার হচ্ছে। পড়ছি। 
  • Sara Man | ২৪ জুলাই ২০২৩ ১৯:১৪521655
  • আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম।
  • Samaresh Mukherjee | ২৮ জুলাই ২০২৩ ২০:৫৪521833
  • খুব ভালো হচ্ছে। ঝরঝরে, গতি‌ময় অনুবাদ। আগ্ৰহ নিয়ে পড়ছি। এটা শেষ অবধি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য - অগ্ৰিম অভিনন্দন র‌ইলো।
  • kk | 2607:fb91:87b:8018:ac4d:c579:e10:***:*** | ২৮ জুলাই ২০২৩ ২১:০৫521834
  • দেরি হোক, আপনি লিখুন। আপনার সময় মতোই লিখুন। এরকম লেখা পড়তে গেলে যদি একটু অপেক্ষা করতেও হয় তো সেটা পুরোপুরি ওয়ার্থ ইট।
  • Jhanku Sengupta | ০৭ আগস্ট ২০২৩ ১০:২৪522201
  • এক নিশ্বাসে শেষ করতে পারলে ভালো হতো !
     
  • Soumendu Mitra | 2409:4060:2d15:163c::ccca:***:*** | ০৯ আগস্ট ২০২৩ ০০:১৮522289
  • @বর্গীয় জ 
     
    আমি এই বইটি বহুদিন ধরে খুঁজছি। গবেষণার কাজেই দরকার। আপনার অনুবাদ অনেকটাই সাহায্য করবে। আপনি কমেন্টে লিখেছেন পুরনো সংস্করণের পিডিএফ নেটে পাওয়া যায়। আমি বহু খুঁজেও পাইনি। আপনার কাছে যদি থাকে আমাকে দিতে পারবেন? আমার খুব সাহায্য হয়। 
     
  • r2h | 165.***.*** | ০৯ আগস্ট ২০২৩ ০০:৪০522290
  • যতদূর মনে পড়ছে এর পিডিএফ ফেসবুকের মলাট গ্রুপে আছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন