নকশাল!
~~~~~~~
গলায় বাঁধা দড়ি এমন এঁটে বসেছিল যে আমি নিশ্বাসই নিতে পারছিলাম না - ইশারায় ওদের বলার চেষ্টা করছিলাম দড়িটা ঢিলে করে দিতে একটু। গ্রামের বাইরে একটু ফাঁকায় নিয়ে ওরা আমাকে বসালো একটা গাছের নিচে - পায়ের পাতা থেকে কোমর পর্যন্ত লাল পিপড়ে ছেঁকে ধরলো মুহূর্তের মধ্যে - তীব্র রোদের ছটায় আর তাপে মনে হচ্ছিল আমি যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। ওরা ওদের অফিসারের জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু পর আমাকে দাঁড় করিয়ে ওরা আমার শরীর তল্লাশি শুরু করলো - আর ঘড়ি, রুমাল, সঙ্গে যা টাকা পয়সা ছিল, চুলের ক্লিপ সব কিছু নিয়ে নিতে লাগলো। একজন যখন আমার বুকে, জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল, আর আমি কোন রকমে শরীর ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলাম, মনে হলো তখন ওরা প্রথম বুঝলো, আমার ছোট চুল আর পরনের স্ল্যাক্স সত্ত্বেও আমি একজন মহিলা। এইসবের পর আবার আমি বসলাম - একজন পুলিশ কর্মীর আমাকে দেখে দয়াও হলো - আমাকে উনি ওঁর জলের বোতল থেকে একটু জল খেতে দিলেন, আর একটা কাপড় দিয়ে আমার মাথাটা ঢেকে দিলেন। কিছুক্ষন পর অফিসার চলে এল - ইংরেজি জানা, উদ্ধত মেজাজ। আমাদের চলা শুরু হলো। পাহাড়ি, পাথুরে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় পরনের চপ্পল আমার পায়ে কেটে বসতে লাগলো। অফিসার বারবার ধাক্কা দিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে বলছিল - পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় এই অসমান পাথুরে জমির মধ্যে দিয়ে হাঁটা প্রাণান্তকর মনে হচ্ছিল আমার কাছে। গ্রামের দৃষ্টিসীমার থেকে ভালোরকম দূরে চলে আসার পর অফিসারটি বললো, এবার আমার তল্লাশি হবে। আমি বললাম তল্লাশি তো এক প্রস্থ হয়ে গেছে - অফিসারটি বললো, সব জামা কাপড় খুলে এবার একটু 'ভালো ভাবে' তল্লাশি করতে হবে। আমি মরিয়া হয়ে বললাম - আমি বিদেশি নাগরিক - আমার গায়ে হাত দিলে ওর চাকরি নিয়ে টান পড়বে। আমি মরিয়া হয়েই বলেছিলাম, জানতাম না সত্যিই এমন কিছু হবে কিনা, কিন্তু দেখলাম এতে কাজ হলো।
ঘন্টাখানেক হাঁটার পর ক্যাম্পে পৌঁছলাম - ওখানে বড় অফিসাররা বসে কোকা কোলা আর বিস্কিট খাচ্ছিল। ওরা আমার সঙ্গী সাথী, দলের লোকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলো - আমি কিছু জানি না বলায় একটা জিপে করে বেশ কয়েক মাইল দূরে যাদুগোড়া থানার দিকে পাঠিয়ে দিল। পথে এক বন্দুকধারী কনস্টেবল আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে বললেন - গত দুদিন ওঁদের কোন খাওয়া জোটেনি; নক্শাল শিকারের চিরুনী তল্লাশি চলছে, কিন্তু বড় অফিসাররা এঁদের খাওয়া দাওয়ার কোন ব্যাবস্থা করেনি।
যাদুগোড়া থানার পেছনের একটা কামরায় আমাকে বসানো হয়েছিল - সেখানে একদল সিআরপিএফ সৈন্য আমাকে ঘিরে বসলো, সবার চোখ আমার শরীরে ঘোরাফেরা করছে। একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল নানা ভাবে। আমি আড়্ষ্ট হয়ে বসেছিলাম একটা কাঠের চৌকিতে। একের পর এক উর্দিধারী অথবা সাধারন পোশাকের লোক এসে আমাকে একই প্রশ্ন করছিল - আর আমার উত্তর লিখে নিচ্ছিল তাদের ছোট নোটবইয়ে। ওরা আমাকে স্নান করতে পাঠালো - স্নান করার সময় আমি বুঝতে পারলাম দরজার ফাটল দিয়ে কেউ আমাকে দেখছে। এরপর আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে ছবি তুললো ওরা। অসংখ্যবার, লাগাতার, একইরকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি হাক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম - কিন্তু ঐ জায়গায় আমার শুয়ে ঘুমোনোর সাহস ছিল না। খোলা দরজা দিয়ে আমি একটি ছেলেকে দেখতে পাচ্ছিলাম - হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি, একটা চোখ ফুলে কালশিটে পড়ে বুজে আছে, গাল বেয়ে রক্ত পড়ছে - পরনে একটা ছোট প্যান্ট, মনে হচ্ছে যেন জ্বরে কাঁপছে।
ওদিকে ওরা সিজার লিস্ট মেলাচ্ছিল।
"অমলেন্দু সেন - চারশো টাকা"
বিদ্যুচ্চমকের মত মনে হলো - তার মানে অমলেন্দুকে ওরা আটক করেছে। কাছেই একজন অফিসার ছিল - তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমাকে অমলেন্দুর সঙ্গে এক জায়গায় রাখা যায় কিনা। অফিসারটি তখন আমার কথায় কোন ভ্রূক্ষেপ করলো না, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা আমাকে অন্য একটা কামরায় নিয়ে গেল - সেখানে অমলেন্দু, ওর ভাই, আর আরো জনা পনেরো ছেলেকে একসঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। ওখানে আমাদের খাবার দেওয়া হল - পুরুষ বন্দীদের এক হাত বাঁধন খুলে দেওয়া হল খাওয়ার জন্যে। কিছু পরে অমলেন্দু আর কয়েকজনেক সেলে নিয়ে যাওয়া হলো, আমরা কয়েকজন ঐ কামরাতেই রইলাম। আমি শুয়ে ছিলাম। চোখে কালশিটে ছেলেটির আবার প্রবল কাঁপুনী হচ্ছিল। ছেলেটি ওর জামা কাপড় ফেরত চাইছিল, পুলিশের লোকটি একটা টিটকিরির হাসি হেসে চলে গেল। গাছতলায় কনস্টেবল যে মাথা ঢাকার কাপড় দিয়েছিলেন, সেটা আমার কাছে ছিল - সেটা দিয়ে ওকে যতটা পারা যায় ঢেকে দিলাম।
বন্দুকের কুঁদো দিয়ে নাকি মেরেছে ওকে।
পরদিন সকালে আমাদের ওরা সিংভুমের জেলাশহর চাইবাসায় নিয়ে গেল। জেলার আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি ছেলে না মেয়ে, তারপর ওয়ার্ডেনকে বললো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে নিতে।
অবশেষে আমি গেলাম জেনানা ফাটকে। রাতে সব গাদাগাদি করে ফাটকে, পায়খানার তীব্র গন্ধে, ভয়ানক গরমে, বমি চলে আসছিল। এই ফাটকের পাহারাওয়ালী ফাটকের ভেতরেই ওর বিছানায় শোয় - রাতে কয়েকবার উঠে পায়খানার কাছে শোয়া বন্দী মেয়েদের লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে গালাগাল করে এল।
সকালে ওর ডিউটি শেষ হলে পর দেখলাম পুরুষ পাহারাওয়ালা এসে ওর বিছানায় শুয়ে পড়লো - ফাটকের কিছু মেয়ে ওর সঙ্গে নানান ফষ্টিনষ্টি করতে শুরু করলো - ওর কোমর থেকে বেল্ট খুলে, চাবি লুকিয়ে... আমি এতটাই স্তম্ভিত, ক্লান্ত ছিলাম, চারদিকে কী হচ্ছে তাতে আমার কিছু যেন কোন প্রতিক্রিয়াই হচ্ছিল না। কিছু মেয়ে তেল সাবান দিয়ে আমাকে স্নান করিয়ে, আমার কাটা, ফোলা পা যত্নে মালিশ করে দিল।
ফাটকের তৃতীয় রাতে, কল্পনা নামে একটি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালী মেয়ে ফাটকে এল। ও আমার পরদিন আটক হয়েছে, একই রকম নক্শাল শিকারের চিরুনী তল্লাশীতে। কল্পনা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছিল - গত দুদিনের দেখা পুলিশি অত্যাচারের বাইরে ও কিছুই বলতে পারছিল না। বললো ও চোখের সামনে দেখেছে পাঁচজন বন্দীকে কব্জিতে দড়ি বেঁধে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বেধড়ক মারতে, এরপরও পুলিশের কাছে মনে হচ্ছিল যারা ঠিকঠাক কথা বলছে না, তাদের পায়ু দিয়ে রড ঢুকিয়ে দিচ্ছিল পুলিশ।
কল্পনাকে যখন জেরা করা হচ্ছিল না তখন ওকে একটা সেলে রাখা হয়েছিল যেখানে বাকি আঠারোজন পুরুষ বন্দী।
চাইবাসা জেল অফিসে জেরা চলতে থাকলো। ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে - ওরা আমাকে ওদের জামা কাপড় পরতে দিয়েছে - এটা দেখে ইন্টেলিজেন্স অফিসার প্রচণ্ড রেগে গেল। ওরা ভাবছিল ফাটকের অন্য বন্দীদের থেকে আমি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবো। বড় অফিসাররা নিজেরা গ্রামের এই সাধারন সরল দরিদ্র মানুষদের বুঝতে পারতো না আসলে, সংস্কৃতি, ভাষা, আর্থসামাজিক অবস্থানের মিল না থাকলেও পারস্পরিক সমানুভূতির ভিত্তিতে মানুষে মানুষে সম্পর্ক তোরি হতে পারে - এটা ওরা বুঝতেই পারতো না। এইসব বড় অফিসারদের তাদের নিজের দেশের দরিদ্র সরল মানুষদের সঙ্গে বিন্দুমাত্র কোন রকম সংযোগই ছিল না।
নিজের প্রতিপত্তি দেখানোর জন্যে জেলার আমার হাতে পরা ফাটকের মেয়েদের দেওয়া কাচের চুড়ি ভেঙে দিয়ে আমাকে সাবধান করে দিল, এইসব "চোর খুনে বদমাশ"দের সঙ্গে যেন আমি খবরদার ভাব না জমাই।
পয়লা জুন, ১৯৭০, সোমবার। আমাদের বদলি করা হল। ডজনখানেক বন্দুকধারী রক্ষী ছিল আমাদের ঘিরে, তাও আমি আর অমলেন্দু প্রিজন ভ্যানে একসঙ্গে ছিলাম - আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতেই গেলাম। অমলেন্দু বললো আমরা ১৪২ মাইল দূরে হাজারিবাগ জেলে যাচ্ছি। আমি হাজারিবাগের নাম আগে কখনো শুনিনি। আমাদের সঙ্গে একজন ছিলেন, সংশোধনমূলক আটক হয়েছে তাঁর দুমাসের জন্যে, আমাদের বলছিলেন জেলের জীবন নিয়ে, জেলখানার খাবার দাবার, জামা কাপড় - কী, কেমন এইসব। আমাদের অবশ্য মনেই হয়নি আমাদের আদৌ বেশিদিন জেলে থাকতে হবে - সামান্য দিনের ব্যাপার হয়তো। কয়েক বছর জেলে থেকে বুঝতে পেরেছিলাম আমরা কেমন মূর্খের মত অতিসরলীকরন করছিলাম পুরো অবস্থাটার।
হাজারিবাগ জেলে ছোট চশমা পরা একজন কেরানী আমাকে কল্পনার পেছন পেছন জেনানা ফাটকের দিকে যেতে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো পুরুষ বন্দীদের সঙ্গে উবু হয়ে বসতে। শুনে সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেলে - তাতে কেরাণীবাবুটি আরো রেগে গিয়ে আমার নাম কী, বাবার নাম কী, কোন জাত এইসব প্রশ্ন করতে শুরু করলো।
আমি এখানে শেষবারের মত অমলেন্দুর সঙ্গে কথা বললাম - বিদায় জানাতে।
অমলেন্দুর মাথায় হাত ছুঁইয়ে, ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে কল্পনার সঙ্গে ফাটকের রক্ষীর পেছন পেছন বিশাল উঁচু কাঠের গেটের ছোট্ট নীচু দরজা পেরিয়ে জেলের অন্দরমহলে ঢুকলাম। পাথর বিছনো অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত পথ, খালি পায়ে, রক্ষীর লন্ঠনের আলোয়, আরেকটা লোহার তারকাঁটা বসানো বড় গেট।
আমরা ভেতরে ঢুকলাম, পেছনে সশব্দে গেট বন্ধ হল।
সলিটারি~~~~~~~
ভোর সাড়ে পাঁচটায় মেটিনের খোঁচা খেয়ে ঘুম ভাংলো।
মেটিন হলো স্থানীয় ভাষায় মেটের স্ত্রীলিঙ্গ। মেট-রাও বন্দী, সাধারনত দীর্ঘকালীন, কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসভাজন বন্দী। তাদের হাতে জেলের শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদির ভার থাকে। কল্পনা আর আমি ফাটকের দাওয়ায় ডজন খানেক উবু হয়ে বসা কয়েদীদের সঙ্গে যোগ দিলাম - হেড ওয়ার্ডার গুনতি করবে। মাথা ঢাকা, মুখ নীচু, স্থির, নিস্তব্ধ, দীন একদল বন্দী - হেড ওয়ার্ডার একজোড়া করে লাঠি ঠুকে গুনতি করে হাতের কাগজ মিলিয়ে যাচ্ছে। মেটিনের আদেশ অমান্য করে কল্পনা আর আমি পেছনে নীচু হয়ে গুঁজে না বসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওয়ার্ডার চলে যাওয়ার পর আশপাশ দেখলাম একটু। প্রথম দর্শনে হাজারিবাগের জেনান ফাটককে বেশ ভালোই লাগলো! নীচু ছাতের মেটে হলুদ রঙের টানা দালান, চারদিকে লাল মাটির উঠোন, তারপর সব্জি ক্ষেত, গেট থেকে ফাটক, ডানদিকের দেওয়ালে জুঁই ফুলের ঝাড়। আম, লেবু, পেয়ারা, নিম গাছ ইতিউতি, বোগানভিলিয়ার কেয়ারি। পুরো চত্বরটা ছাই রঙের হরেক রকম এবড়ো খেবড়ো পাথরে গাঁথা বারো ফিট দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।
অলংকরণঃ দিলীপ রায়আমাদের পায়চারি শেষ হওয়ার আগেই আবার গেট খুলে গেল - দুজন সাদা নীল ডোরাকাটা জেলের পোশাক পরা পুরুষ বন্দী ঢুকলো নোংরা বালতি ভরে সকালের খাবার নিয়ে। দেওয়ালের ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো বন্দীদের বাটিতে কোনরকমে বালতির খাবার ঢেলে দিয়েই তারা আবার বাইরে ছুটলো। মেটিন মাইমুন আমাদের ডেকে একটা আধ লিটারের অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে এক মুঠো কাঁচা ছোলা আর দানাদার কালো আখের গুড়, আর নিমের দাঁতন ধরিয়ে দিল। বুভুক্ষুর মত ওখানেই দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে ছোলা খেতে শুরু করলাম আমি - চারদিকে অন্য মেয়েরা আমাকে হতভম্ব হয়ে দেখছিল - ওদের রীতি অনুযায়ী অবস্থা যাই হোক, সকাল বেলা দাঁতন না করে মুখ না ধুয়ে খাবারে হাত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!
কয়েক বছর পর, যখন ওদের সঙ্গে আমার খুব চেনাশুনো হয়ে গেছিল, ওরা বারবার আমার প্রথম দিনের এই কদাকার কান্ড নিয়ে হাসাহাসি করতো!
কল্পনা আমার মত এতটা কষ্টসহিষ্ণু ছিল না - ওর প্রবল চা তেষ্টা হচ্ছিল, কোনরকমে কয়েকটা ছোলা মুখে দিয়ে এই 'ঘোড়ার খাবার' আর খেতে পারবে না এই বলে বারান্দায় রাখা জলের পাত্রের ঢাকনার ওপর ওর ছোলার পাত্রটা নামিয়ে রাখলো।
চোখের পলকে মাইমুন এসে ছোলার পাত্র ঠেলে ফেলে দিয়ে জলের পাত্র নোংরা করার জন্যে কল্পনার ওপর চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না - কল্পনা পরে আমাকে বললো - হিন্দু মতে এটা ওর এঁটো, তাই নোংরা অথবা অপবিত্র। এদিকে পরে আমি আবিষ্কার করলাম মাইমুন ধর্মে মুসলিম!
এসবের পর আমরা আবার আমাদের নতুন আস্তানা পরিদর্শনে লেগে গেলাম, কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবার কী একটা শোরগোল পড়লো, সব মেয়েরা শাড়ির আঁচলে মাথা ঢেকে মাটির দিকে তাকিয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লো। এদিক ওদিক কতগুলি গোলাপি প্লাস্টিকের চপ্পল পড়েছিল - মাইমুন তাড়াতাড়ি পা দিয়ে ঠেলে সেগুলিকে কতগুলি খাকি উর্দির স্তুপের তলায় ঢুকিয়ে দিল।
কয়েকমাস পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, চপ্পলগুলি জেলে থেকে দেওয়া না, ওয়ার্ডার বেআইনীভাবে ওগুলো কয়েদীদের বিক্রী করে।
বাইরে পাগলের মত ঘন্টা বাজতে লাগলো - হাট করে গেট খুলে গেল আর মুখ্য হেড ওয়ার্ডার, বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী খাকি উর্দির রক্ষী সহ দুজন অফিসার ঝড়ের মত ভেতরে ঢুকলো। পরের কয়েকমাসে বুঝতে পেরেছিলাম জেল সুপার আর জেলার কখনো অস্ত্রধারী রক্ষী ছাড়া কয়েদীদের মধ্যে আসে না। ওয়ার্ড্রেস বিসদৃশভাবে স্যালুট করে সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে - স্যালুট করা হাতে তার খাকি শাড়ির আঁচল জড়িয়ে গেছে। কল্পনা আর আমাকে মেটিন লাইনের শেষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অফিসাররা সব বন্দীদের উপস্থিতি একেবারে উপেক্ষা করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ড্রেসকে হিন্দিতে কিছু আদেশ নির্দেশ দিল। সব শেষে কালো চশমা পরা জেল সুপার জিজ্ঞেস করলো আমাদের কিছু চাই কিনা। কল্পনা বললো সাবান আর কিছু জামা কাপড়। কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না কোনদিক থেকে। যেমন এসেছিল সব তেমনি হঠাৎ ফিরে চলে গেল। ওয়ার্ড্রেস দেখলাম অন্য বন্দীদের বললো একদম শেষে দুটো সেলে কম্বল আর বাসন রাখা আছে - ওগুলো ফাঁকা করতে।
কল্পনা একটু একটু হিন্দি বোঝে - ও বললো আমাদের সলিটারি সেলে পাঠানো হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।