প্রত্যর্পণ
~~~~~~~
নতুন নতুন কয়েদী, উপচে পড়া ভিড়ের কারনে হাজার রকম অসুবিধে। তা সত্বেও পরিস্থিতিটা ভালো লাগছিল। এইসব মানুষজনকে দেখে শত অসুবিধের মধ্যেও ভারতের মানুষের অদম্য লড়াকু মানসিকতা দেখে খুব অনুপ্রাণিত মনে হত নিজেকে। আর তার ওপর আমরা, পুরনো ও সাধারন কয়েদীরা বেশ হাত পা ছড়িয়ে দিন কাটাতাম - এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারনে কারা দপ্তর আমাদের ওপর খবরদারি করার আর অবসর পেত না!
যদিও ভেতরে ভেতরে চাপা অশান্তি, উদ্বেগ ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকতো। স্বাস্থ্যকর্মীরা চলে যাওয়ার পর আবার একটা বড় গোলমালের আঁচ পেলাম। এক সকালে কয়েকজন বললো আগের রাতে বড় ফাটকে মেয়েদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। অনেকেই বছরের পর বছর ধরে বিনা বিচারে আটক - কোনদিন ছাড়া পাবে সেই আশাই দূরান্তে দেখা যাচ্ছে না। ওরা ঠিক করেছে ভুখ হরতাল শুরু করবে - দ্রুত বিচার, সেই সঙ্গে খাবারের মান আর আনুসঙ্গিক সুযোগ সুবিধের দাবিতে। আমি ওদের পইপই করে বললাম হরতাল করতে চাইলে, যাই হোক, সবাইকে এক থাকতে হবে, আর যতই ধমকানো চমকানো হোক, পেছন ফেরা চলবে না। আমিও হরতালে যোগ দেবো বলে কথা দিলাম।
সেই সকালে মেটিন ছাড়া কেউ বরাদ্দ ছোলা গুড় খেল না। চিফ হেড ওয়ার্ডার ছুটিতে ছিল, ওর বদলি ছিল এক শক্তপোক্ত পোড় খাওয়া বয়স্ক ওয়ার্ডার। ঝামেলা মেটাতে এসেই তার প্রথম কথা - "এই নকশালটা এখানে কেন? এটাই সবাইকে ওস্কাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওকে ওর সেলে ঢুকিয়ে তালা লাগা"। আমি চুপ করে থাকলাম। অন্য একজন মেয়ে দাবী দাওয়া গুলি বলতে শুরু করলো। ওয়ার্ডারটি বারবার ওর কথার মাঝখানে আমাকে সেলে ঢোকানোর হুকুম দিতে থাকলো। আমাকে আর ঐ মেয়েটিকে সেলে পোরা হল। তারপর শুরু হল ওর গালাগাল - কী করে এই অকৃতজ্ঞের দল, ঘৃন্য সব অপরাধ করে এসেও সরকারের এত দয়া, দুবেলা খাওয়া, মাথার ওপর ছাত ভোগ করার পর এমন নিমকহারাম হতে পারে? এমন সব বায়নাক্কার সাহস কী করে হয়? আস্তে আস্তে, এক এক করে সবাই তাদের ছোলা গুড় হাতে তুলে নিল। ভুখ হরতাল শেষ।
নকশালদের সঙ্গে কাউকে মেলামেশা করতে যেন আর না দেখা যায় এই আদেশ দিয়ে ওয়ার্ডার চলে গেল।
আমার সেলের তালা খুলে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমার সঙ্গে যেন কেউ কথাবার্তা না বলে।
সন্ধ্যেবেলা লোকটি টহল দিতে এলে বিলকিস ইচ্ছে করেই আমার হাত ধরে বললো, "চলো দিদি, তালা দেওয়ার আগে একটু ঘুরে আসি"।
একজন ওয়ার্ড্রেস আমার সঙ্গে কথা না বলার ব্যাপরটার তদারকি করতে চাইছিল, রাজকুমারী আর সোমরি ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল, ওর শোয়ার জায়গা তৈরি করতেও হাত লাগাবে না ঠিক করলো। আমি মুখে ওদের বলছিলাম ছেলেমানুষে না করতে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওদের রোখ দেখে খুশিই হচ্ছিলাম।
সরকার বলছিল নক্শাল সাফ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারতাম সরকারী লোকজন নকশালদের নিয়ে এখনো যথেষ্ট উদ্বেগে থাকে। এদিক ওদিক থেকে টুকরো টুকরো নকশালরা সক্রিয়তার খবর পেতাম। মাঝে মাঝে গৃহমন্ত্রী বিবৃতি দেয় - "উগ্রপন্থী শক্তি"গুলির ওপর "কড়া" নজর রাখা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে থেকে পুলিশের রাইফেল লুটের খবর এল। বর্ধমান জেলার কাঁকসাতে নকশালরা গ্রামের মানুষদের নেতৃত্ব দিয়েছিল জোতদারদের অত্যাচার, বেগার খাটানোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে - সেখানে বিশেষ পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে শুনলাম। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে গ্রামের মানুষের বন্ধু হতে। কিন্তু সত্তর একাত্তরে পুলিশ যা করেছে, তাতে বন্ধু হওয়ার সুযোগ পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। ৬৭ - ৬৯ এ আন্দোলন যে জায়গায় ছিল সেই জমি হারিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু আন্দোলন চলছে, ধীরে হলেও এগোচ্ছে।
সরকার তখন মিসা সহ বিনা বিচারে আটক রাখার আইনগুলি ব্যবহার করছে যথেচ্ছ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্টেট্সম্যানে একদিন বেরুলো ঐ সময় শুধু বাংলাতেই ৭৭৫ জন মিসায় আটক। ১৯৭৩এ আবার অন্ধ্রপ্রদেশে গণ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো। মানুষ রেল স্টেশন, ডাকঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে - সেনাবাহিনী, সিআরপিএফ পাঠানো হয়েছে আন্দোলন দমন করতে। দেশ যেন বারুদের স্তূপের ওপর বসে।
এইসব তালেগোলে প্রত্যর্পণের প্রস্তাব আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একদিন আবার কলকাতা থেকে দূতাবাসের লোক এল। ডেপুটি হাই কমিশন সচিব জানিয়েছে কথাবার্তা চলছে, সব ঠিক ভাবেই এগোচ্ছে। সরকারে চাকা লাল ফিতের ফাঁসে একটু আস্তে চলছে, কিন্তু আশা করা যাচ্ছে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার প্লেন ভাড়া কে দেবে, সেটা কি আমি জানাতে পারি? বন্ধুদের কাছে চাওয়ার আমার ইচ্ছে নেই - টাকা তো আমার আছে, কলকাতায় পুলিশ টাকা পয়সা বাজেয়াপ্ত করে রেখ্ছে। কিন্তু দূতাবাসের লোক জানালো প্লেন ভাড়ার টাকা কে দেবে সেটা লিখিতভাবে না জানালে পুরো উদ্যোগটাই বানচাল হয়ে যাবে। অগত্যা আমি রুথ ফস্টারকে চিঠি লিখে বললাম টাকার ব্যবস্থা করতে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে শুনেছিলাম দূতাবাস রুথকে বলেছিল টাকা নিয়ে তৈরি থাকতে - দিন রাত যেকোন সময় ডাক পড়বে। রুথ এমনই নিশ্চিত ছিল যে আমি কয়েকদিনের মধ্যে আসছি যে আমার জন্য ঘরে পরার চপ্পলও কিনে রেখেছিল!
বেশ কয়েক মাস কেটে গেল, আবার সব চুপ। লন্ডনে ফেরার চিন্তা আবার আমি শিকেয় তুলে রাখলাম। বন্ধু বান্ধবদের চিঠি আসতো, লন্ডনের স্বপ্ন দেখতাম ঘুমিয়ে - আর বৃটিশ দূতাবাসের প্রত্যর্পণ নিয়ে বড় বড় বাতেলা দেওয়ার কথা ভেবে মাথায় খুন চেপে যেত। মা বাবা, রুথ, আত্মীয় বন্ধুরা সব আমার কথা ভেবে অষ্টপ্রহর উদ্বিগ্ন - মার শরীর তখনও, হার্ট অপারেশনের পর, খুবই খারাপ। আমি একবার নিজেই ডেপুটি হাই কমিশনারকে চিঠি লিখলাম - প্রত্যর্পণের অগ্রগতি জানতে চেয়ে - কিন্তু আমার চিঠি হয়তো পৌঁছালোই না- মোটের ওপর কোন জবাব আমি পেলাম না।
১৯৭৩ এর ফেব্রুয়ারিতে দেখলাম অনেকদিন আগে জামিন পাওয়া দুজন কয়েদী জেলে ফিরে এল। বছর পঁচিশেকের বুধনি আর তার শাশুড়ি। বুধনির বর জেলেই আছে, কিন্তু গত বছরখানেকের মধ্যে পয়সার অভাবে ওরা কেউ গ্রাম থেকে দেখা করতে আসতে পারেনি। এই দুই মহিলা "জামিন অমান্য" করার অপরাধে আবার গ্রেপ্তার হয়েছে। ওদের গ্রাম থেকে হাজারিবাগ আদালতে আসতে বাস ভাড়া লাগে ছ'টাকা। সেই টাকা ছিল না বলে আদালতের হাজিরার দিন ওরা আসতে পারেনি। বাড়িতে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রাখার দায়ে আটক হয়েছিল - কেস মিটমাট করার জন্য জমি, গয়না, বেচার মত সব জিনিস বেচে দিয়েছে। সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার পরও আদালতে মামলা ওঠেনি। এই ক'দিন দু'জন লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে কোন রকমে দিন গুজরান করেছে।
ওদের এইভাবে ফিরে আসা দেখে খুবই খারাপ লাগছিল।
মার্চ মাসে হোলি পরব চলে এল - আমার কোন খবর এল না। প্রত্যর্পণের প্রাথমিক প্রস্তাবের পর ছমাস কেটে গেছে ততদিনে। একবার ভাবলাম দূতাবাসের লোকেদের সঙ্গে আর দেখাই করবো না, বলবো এইসব আবেদন বাতিল করে দিতে। তারপর পিছিয়ে এলাম - এসব করলে আবার আমার মা বাবাকে, আত্মীয়দের এমন ধারনা ওরা দেবে যে আমার আচরনের জন্যই কিছু হচ্ছে না। এমনকি বাড়িতে লেখা চিঠিগুলিও দূতাবাসের দপ্তরের মাধ্যমেই যেত - সেসবও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।
কী করা যায় আকাশ পাতাল ভাবছিলাম এমন সময়, ১৯৭৩ সালে এপ্রিল ফুল্স' ডে-র আগের দিন শুনলাম পরদিন আমাকে জামশেদপুর বদলি করা হবে।
টাটা
~~~~
রাজকুমারী মাটির কল্কেতে তামাক খায় - চাল বাঁচিয়ে রাখে তামাক কেনার জন্য। সেই রাতে ও যত্ন করে কয়েকমুঠো চাল মেপে নিয়ে ভিজিয়ে রাখলো। ভোর হওয়ার আগে ভেজা চাল বেটে আমার প্রিয় চালের পিঠে - চিল্কা বানালো। নাগোর পর নতুন মেটিন হয়েছিল বাল্কো - আমার জন্যে বানিয়ে দিল গুড় আর সুজির হালুয়া। সকালে ওদের ফাটকে বসালো আমাকে কম্বল পেতে - চলে যাওয়ার আগে সকালের জলখাবার খাবো। খাওয়া শেষ হতেই ডাক পড়লো। প্রায় তিন বছর আমরা দিন রাত এক সঙ্গে থেকেছি।
রাজকুমারী, লেওনি কাঁদছিল - আমিও চোখের জল আটকাতে পারলাম না।
আবেগ স্থায়ী হল না। বাইরে বন্দুক্ধারী প্রহরী, স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অপেক্ষা করেছিল। বেরোতেই তল্লাশি করার জন্য আমার সব জিনিস হাঁটকে ফেলে দিল। এক গাদা অফিসের লোক, কয়েদী, বাইরের কৌতুহলী লোকের সামনে আমার জামা কাপড়, চিঠি, মায় স্যানিটারি কাপড় - পাথুরে উঠোনের ওপর ছত্রাখান। পাটনা থেকে দুজন মহিলা পুলিশ এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওরা সুপারের অফিসের পেছনের বাথরুমে নিয়ে জামা কাপড়ের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তল্লাশি করলো। একজন আমার পরনের সস্তা শাড়ি আঙুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো আমার বর আমাকে আরেকটু ভালো শাড়ি কিনে দেয়নি কেন। এই শাড়িটা অবশ্য অন্য একজনের - আমার শাড়িটা ওর পছন্দ হয়েছিল বলে বদলাবদলি করেছিলাম।
সতেরোজন বন্দুকধারী পুলিশ নিয়ে তিনটে পুলিশের গাড়ি, বেশ কয়েকজ্ন স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক, দু'জন মহিলা পুলিশের ঘেরাটোপেও এত বছর পর, জেলখানার পাথরের চার দেওয়ালের বাইরে খোলা রাস্তায় বেরুচ্ছি ভেবে কি উত্তেজনা সেদিন আমার! পুলিশের লোকেরা বেশ খোশ মেজাজে, কয়েকজন গলপ শুরু করলো, একজন গান ধরলো। ড্রাইভার আবার মাঝে একটা দোকানে আমাদের সবার জনয় পাওপাও কিনলো। অমলেন্দু, আমার বাড়ি, বৃটেন এসব নিয়ে ওদের নানান প্রশ্ন! আবার রাজনীতি নিয়েও কথা হল। আগেও দেখেছি পুলিশের অনেকেরই নকশালদের প্রতি অল্পবিস্তর সহানুভূতি আছে - এরাও ব্যতিক্রম না।
জাম্শেদপুর হাজারিবাগ থেকে ১৩০ মাইল দক্ষিন পূবে। পোঁছতে রাত হয়ে গেল। জেলার ওর ছোটো অফিসে বসে অপেক্ষা করছিল। আমার খুঁটিনাটি খাতায় লিখে নিয়ে বললো খাকি ব্যাগটা অফিসেই রেখে যেতে - তল্লাশি করে তারপর দেওয়া হবে। একজন ওয়ার্ডার আমাকে আমার সেলে নিয়ে গেল। হাজারিবাগের সেলের আর্ধেক হবে, চারদিকে দেওয়াল ঘেরা - বাকি ফাটক থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। আমি কম্বল বিছিয়ে শুলাম - অনভ্যস্ত জিপ যাত্রায় সারা শরীর ব্যথা। একজন বয়স্কা ওয়ার্ড্রেস এসে তালা পরীক্ষা করে গেল - একটু খোঁজ খবরও নিল। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। জেলার বলেছে দু'দিন পর আদালতে মামলা উঠবে।
ঘুম ভাঙলো - মনে হল যেন আলো ফুটেছে আকাশে। আমি কম্বল ভাঁজ করে উঠে বসলাম। ঘন্টাখানেক কেটে গেল - কেউ এল না। পরে আবিস্কার করেছিলাম - ভোরের সূর্যের লাল আভা যেটা দেখে আমি উঠে বসেছিলাম সেটা আসলে শহরের অন্য প্রান্তে ইস্পাত কারখানার চুল্লির আলো।
জামশেদপুর হাজারিবাগের থেকে একেবারে অন্যরকম জায়গা। শান্ত শহরতলী, আবহাওয়া হাজারিবাগের তুলনায় ঠান্ডা - আর সেই কারনে মিশনারী আর বসরপ্রাপ্ত সরকারী অফিসারদের প্রিয়। জামশেদপুর ভারতের অন্যতম পুরনো শিল্পনগরী। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে টাটা পরিবারের প্রতিষ্ঠিত ইস্পাত কারখানাটি এখনো দেশের অন্যতম ও অগ্রনী। সেই কারখানাকে অনুসরন করে আরো ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে আশে পাশে। ভূগর্ভে ধাতুর আকরিক, তামা, ইউরেনিয়ামের খনির আকর্ষনে দেশ বিদেশের পুঁজি এসে জুটেছে পুরনো আদিবাসী গ্রামগুলিকে উচ্ছেদ করে। জনজাতি সম্প্রদায়ের আদি বাসিন্দারা জামশেদপুর শহরকে জায়গা করে দিতে আশে পাশের জঙ্গলগুলিতে সরে গেছে। টাটা স্টিলের প্রতিষ্ঠিত শহরকে লোকে টাটা নামেই ডাকে। এই জেল যেখানে তৈরি সেই জমিও এক সময় টাটাদেরই সম্পত্তি ছিল।
জামশেদপুর জেল ভীষন ছোট আর প্রচন্ড ভীড়। সেই সময় ১৩৭ জনের জন্য তৈরি জেলে ৭০০ জন বন্দী। তাদের মধ্যে একমাত্র আমারই একটা পুরো আলাদাস সেল। জেলে কর্মী সংখ্যা অপ্রতুল, আর তার জন্যই একমনি হাজারিবাগের থেকেও বিশৃংখল। মেয়েদের মূল ফাটক আর আমার সেলের মধ্যে আট ফিট উঁচু দেওয়াল, তাতে লোহার মোটা শিক দেওয়া ফটক। সেখান দিয়ে ওদের চৌখুপি বাক্সের মত থাকার জায়গাগুলি দেখা যায়। হাজারিবাগের খোলমেলা চত্বরের সঙ্গে কোন মিলই নেই - যেদিকে দেখি শুধু দেওয়াল। আমার সেলটা বেশ ঝকঝকে, নতুন চুনকাম করা। তার মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে, রীতিমত বিলাসিতার ব্যবস্থা শুধু আমার নিজের জন্য একটা জলের কল আর চাতাল! সেই সময় পুরুষ বিভাগে কয়েকশো জন কয়েদীর জন্য মাত্র দুটো জলের কল।
মেয়েদের অবস্থাও খারাপ। সেই সময় অন্তত তিরিশজন, আর আমি যখন দু'বছর পর বেরুই, তখন চুয়াল্লিশ জন মেয়ে একটা পনেরো বাই পনেরো ফিট খাঁচায় থাকে। রাতে এমন গাদাগাদি করে শোয় যে ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরা যায় না। ছোট বড় বৃদ্ধা শিশু সুস্থ অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীন - সবার এক ব্যবস্থা। একেকজন পায়খানার সামনে শোয় তাদের ডিঙিয়ে অন্যরা সেখানে যায় আসে। সেখান থেকে বেরনো নর্দমা উঠোনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে - তার দুর্গন্ধে সারাক্ষন বাতাস ভারী হয়ে থাকে।
দিনগুলিও একই রকম। এখানকার গরম আর হাওয়ার অস্বস্তিকর আর্দ্রতা কুখ্যাত। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা পঁয়্তাল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। বেলায় রোদ চড়লে জেল চত্বরে কোথাও এক ফোঁটা ছায়া নেই। মেয়েরা আর বাচ্চারা সারাদিন খোলা নর্দমা আর ঘেমো দুর্গন্ধ, ভনভনে মাছি, অসুস্থ, ঘেয়ো, পাঁচড়া ওঠা সহবন্দীদের মাঝে শুয়ে বসে ঝিমোয়। পুরনো স্যঁাত্লা পড়া চৌবাচ্চায় জল, নোংরা পুরনো কাপড় দিয়ে তার ছ্যাঁদা আটকানো। কোথাও কিছু করার নেই, এক দন্ডের শান্তি নেই, কাপড় কাচার বালতি, এমনকি খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত থালা বাসনও নেই।
আদালতে আমার প্রথম হাজিরার দিন ঠিক হল মঙ্গলবার, এপ্রিলের ৩, ১৯৭৩। আগেরদিন দুপুরে একজন সাদা পোশাকের পুলিশ আমার সেলে এল। আমি চিনতে পারলাম - গ্রেপ্তারির পরপর আমাকে জেরা করেছিল। এ এখন নক্শাল কেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমি কেমন রোগা হয়ে গেছি, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে এসব নিয়ে কিছু ছদ্ম ভদ্রতাসূচক কথাবার্তা বলে আসল কথায় এল। আমার কেস নিয়ে মোটামুটি একটা ফয়সলা হতে পারে, স্বীকারোক্তি, মার্জনা ভিক্ষা এবং খালাস - এইভাবে মিটিয়ে নেওয়া যায়। এতে করে ব্যাপারটা সহজে মিটে যাবে, আমিও চটপট দেশে ফিরে যেতে পারবো। জিজ্ঞেস করলাম স্বীকারোক্তি না দিলে কী হবে। ও খুব সহজ সুরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, "রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর দেশদ্রোহ - এই কুড়ি বছর"।
আমি বললাম তোমরা তোমাদের নীতি অনুযায়ী এগোও, আমি আমার নীতি অনুযায়ী যা বলার বলবো।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।