সম্প্রতি, ১৯ মার্চ, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জামশেদপুর শহরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষজনদের এক বিপুল সমাবেশ দেখা গেল। প্রায় লক্ষাধিক বাঙালি বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেই একত্রিত হয়েছিলেন এমনটাই ভাবা যায়। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে, বাংলা ভাষাটিকে ধীরে ধীরে বিদ্যালয় পঠনপাঠন থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং বাংলা ভাষার পুন:বহালের দাবি নিয়ে জামশেদপুর শহরের, গোপাল ময়দান, বিষ্টুপুরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন। জানি না, সরকারের টনক কতটা নড়বে কিন্তু এই দাবি চাইতে আসা মানুষজনদের দেখে খুব আশাবাদী। তবে কি ২১শে ফেব্রুয়ারির মত, ১৯ শে মে -এর মত আরেকটি দিন ১৯শে মার্চ সংযোজিত হবে ভাষা আন্দোলনে? বাঙালি অলস জাতি এই অপবাদ মুছে ফেলে শুধুমাত্র ভাষার দাবিতে জেগে উঠবে ঝাড়খণ্ডের বাঙালি? কিন্তু এখনই এই আবেগে ভাসার চেয়ে বাংলা ভাষাটিকে বাঁচানো বেশি জরুরি। বিশেষ করে ভারতে এখন যে হিন্দি আগ্রাসন নীতি প্রয়োগ কিরা হচ্ছে, ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষা কতটা টিকে থাকবে তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বৈকি! কেননা, ঝাড়খণ্ড বিহারের অধীনে থাকাকালীন,১৯৫৫-৫৬ সাল থেকেই এক নিপুণ চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছিল বাংলা ভাষাটিকে মুছে ফেলার জন্য। গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষজনদের সামান্য কিছু টাকা পয়সা, চাল-ডাল দিয়ে তুলে আনা হত জামশেদপুরে এবং হাতে হিন্দিতে লেখা প্ল্যাকার্ড, মুখে বাংলা বুলি 'আমার ভাষা হিন্দি, আমার ভাষা হিন্দি ' -- বলে প্রমাণ করা হয়েছিল 'এই অঞ্চলের মানুষজন আসলে বিহারি এবং হিন্দি ভাষাতেই সরকারি কাজকর্মে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন'। বিষয়টা যতটা হাস্যকর ততটাই ট্রাজেডিময়ও। কেননা, এর সাহায্যেই তৎকালীন বিহারে হিন্দি ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত লাভ করে। তারও বহু আগে এর পেছনে একজন বাঙালির নাম জড়িয়ে আছে! "ভূদেব মুখোপাধ্যায়। তিনি (মাইকেলের বন্ধু, বিরাট মনীষী) ছিলেন 'ইন্সপেক্টর অব স্কুলস্'। তাঁকে ইংরেজ সরকার বলেছিল বিহার অঞ্চলে কোন ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করলে ভালো হয় তা দেখতে। ভূদেব বাবু দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করে রিপোর্ট দেন, যে উপভাষা গুলো এদিকে চলে (ভোজপুরি, মগহি, মৈথিলী,অঙ্গিকা ইত্যাদি) তাদের বাংলা বা হিন্দি কোনও ভাষার গ্রুপেই ফেলা যায় না তবে বাংলার চেয়ে এরা হিন্দির বেশি কাছাকাছি। অতএব হিন্দি মাধ্যমেই স্কুলে শিক্ষাদান করা উচিত হবে। ভেবে দেখ - ভূদেব বাবু বাংলা বললে বিহারের ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনো করত।"- এই সমগ্র তথ্যটি আমি পাই জামশেদপুরের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শ্রী দীপঙ্কর মুখার্জির কাছ থেকে। তিনি আরও জানান, "মানভূমের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে যেতেই বিহার প্রশাসনের একটা অংশ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়। ষাটের দশক থেকেই পরিকল্পিত ভাবে ঘাটশিলা, বহড়াগোড়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে বাংলাভাষী শিক্ষকদের উত্তর বিহারে আর সেখানকার শিক্ষকদের ঘাটশিলা অঞ্চলে বদলি শুরু করে। উত্তর বিহারের শিক্ষক বাংলা জানে না অতএব বাংলায় পড়ানোর দায়িত্ব নেই। এই ভাবে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে অনেকেই খানিকটা বাধ্য হয়ে হিন্দি পড়তে শুরু করে। প্ল্যাটফর্মে বাংলা নাম মোছা বিহার সরকারই শুরু করেছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে।"
ভারতীয় উপমহাদেশে সরকারের নীতি হল বিপন্ন ভাষা সহ সমস্ত ভারতীয় ভাষাকে উন্নত করা। ভারত সরকার তাই "ভারতের বিপন্ন ভাষার সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য স্কিম" (SPPEL) নামে একটি পরিকল্পনা আছে। বহু ভাষাভাষীর দেশ এই ভারত। একেকটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য আছে। আর আমরা জানি, একটা সভ্যতা, সমাজ গড়ে ওঠে এক একটি ভাষাকে কেন্দ্র করে। তৈরি করে একটি নিজস্ব সংস্কৃতি। চিহ্নিত করে একটা জাতিকে। জাতির ভাবনা-চিন্তাকে প্রসারিত করে ভাষা। আবার এই ভাষা থেকেই জন্ম নেয় জাতির ঐতিহ্য ও পরম্পরা। সুতরাং, বলা যেতে পারে ভাষা হচ্ছে একটা সমাজের ধারক এবং বাহক। সৃষ্টি, সংস্কৃতি, কৃষ্টির ঐতিহ্য। একটা যোগসূত্রের মাধ্যমও বটে। সুতরাং, ভাষাই মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম, কথার আদান প্রদান আর নিবিষ্ট ভাবে নিজেকে অনুধাবনের একটা সোপান। কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে একটা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ কথা নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে সারা বিশ্বে মোট প্রায় ৭০০০ ভাষা ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি অনুমানে বলা হয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে কথ্য ভাষাগুলোর প্রায় ৯০% বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আমরা জানি, কোনো দুর্বল ভাষা এমনিতেই কোণঠাসা হয়ে থাকে। এবং এই দুর্বল ভাষাকে, মৎস্য ন্যায় যুগের মত গ্রাস করে নেয় অপেক্ষাকৃত জরুরি এবং অধিক বলশালী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আগ্রাসী মনোভাব। কখনো রাজনৈতিক এবং সরকারি প্রয়োজন অনুযায়ী ভাষা তার জায়গা হারায়। একটা রাষ্ট্র বা রাজ্যের প্রকৃত পরিচয় কিন্তু তার ভাষা, সংস্কৃতি। কিন্তু রাজনীতির কূটজাল অনেক সময় ভাষা শহীদের রক্ত চিহ্ন মুছে দেয়। ঠিক এমনটাই ঘটছে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে। চলছে বাংলা ভাষাকে অবদমন করার বিপুল আয়োজন। প্রচেষ্টা। একটা ভাষাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার গূঢ় চক্রান্ত।
বর্তমানে ভারতবর্ষের যে অংশটিকে আমরা ঝাড়খণ্ড রাজ্য নামে চিনি, তার অবস্থা একই। এই রাজ্যটিতে বাংলার সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ছিল এদের নিজস্ব। ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন বাংলা উপভাষাকে যে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন সেখানে একটি ভাগ ঝাড়খণ্ডী উপভাষা। ঝাড়খণ্ডের রাজ্যের একটা বড় অংশ মানুষ বাংলায় কথা বলেন, বাংলায় লেখালেখি করেন, ভাবেন। ঝাড়খণ্ডে বিভিন্ন সময়ে বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে এই বাংলা ভাষায়। নিজেকে বাঙালি ভেবে মানভূম বিদ্রোহে লিখিয়েছেন নিজেদের নাম। শহীদ হয়েছেন। রক্ত স্রোতে ভাসিয়েছেন নিজেদের বাংলা ভাষার জন্য দুঃখ-ক্ষোভ-ভালোবাসা। কিন্তু রাজার খেলা যে বড্ড নির্মম, নিঃস্পৃহ। আবেগ নেই তার। ভালোবাসা নেই তার। রক্ত মানে সেখানে শুধু গ্রুপ। সংঘ। যে অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিদ্রোহে নেমেছিল, বাংলা ভাষাকে ওদের নিজের ভাষা করে রাখতে চাইছিল - আর সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে চাইছিল এই স্বতন্ত্র রাজ্য, তা আজ দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত। রাজনীতির করাল ছায়া তাকে বারবার খণ্ডিত করেছে। প্রথমে পুরুলিয়া প্রদেশ থেকে ভাগ করে এই বিরাট বাংলাভাষী অঞ্চলটিকে ঢোকানো হয়েছে বিহার প্রদেশে। তারপর ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে বিহার প্রদেশ থেকে খণ্ডিত হয়েছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে। জনজাতি তখন আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নিজস্ব আবেগ, ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে। কিন্তু ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সব স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পরিণত হতে সময় নিয়েছে মাত্র দশটি বছর। ততদিনে কার্যকর করা হয়ে গেছে গোপন বিষের চারণ। এখানকার মূল অধিবাসীরা যারা বাংলা লিখতে, পড়তে, বলতে ভালোবাসতেন তাদের ভেতর চারিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলা ভাষার স্বপ্ন। বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকাকালীনও বাংলা ভাষাভাষী প্রধান অঞ্চলে বাংলা পাঠ্যপুস্তক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা মাধ্যম বাংলা ছিল। বাংলা শিক্ষকের নিযুক্তি হত। কিন্তু এখন স্কুলে বাংলা বই পাওয়াই যায় না। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোকে পালটে ফেলে, জায়গা দখল করে নিয়েছে হিন্দি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাংলা না থাকার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা ভাষাশিক্ষা হচ্ছেই না। অথচ এরা বাংলাতেই বাড়িতে কথা বলেন,ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন। ফলস্বরূপ উচ্চশিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীদের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলা ছাত্র-ছাত্রী নেই বলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাংলা বিভাগ। ভাষা শেখা অবশ্যই দরকার। সমাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে কিংবা বিশ্বায়নের যুগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি, হিন্দি ভাষা শেখাটিও অবশ্যই জরুরি। তা বলে, নিজস্ব ভাষাকে ধ্বংস করে নয়! কারণ একটি ভাষার সাহায্যেই তো তৈরি হয় একটা জনজাতির মূল ঐতিহ্য। পরম্পরাগত সংস্কার, সংস্কৃতি। পরম্পরাগতভাবে চলে আসা এই বাংলা ভাষাতেই ঝাড়খণ্ডের মূল লোকসাহিত্য "টুসুগান" রচিত। যেটি আমাদের ঝাড়খণ্ডকে চিনতে সাহায্য করে। এই ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মূল ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিটাই গড়ে উঠেছে বাংলা ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। এখানকার মূল পরব করম, টুসু পূজা, ভাদু ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের গানগুলি রচিত বাংলার আঞ্চলিক ভাষায়। এই আঞ্চলিক বাংলার হরফ হচ্ছে বাংলা লিপি। এখানকার বিরাট জনজাতি নিজেদের মধ্যে ঝাড়খণ্ডী বাংলা উপভাষাতে কথা বলেন এবং নিজেদের বাঙালি বলে ভাবেন। এমনকি কোনও বিবাহ অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ - শান্তি, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি যেকোনো কাজে-কর্মে ঝাড়খণ্ডের এক বিরাট অংশ বাংলা পাঁজিপুঁথিকেই অনুসরণ করে চলেন।
বিহার সরকারের অধীনে থাকাকালীন বিহার সরকার এই সমস্ত অঞ্চলে বাংলা ভাষাটিকে কিছুটা মান্যতা দিয়েছিল অবশ্য বাধ্যবশত হয়ে। রাজনৈতিক কারণে হলেও বাংলা ভাষাভাষীদের খেপাত না। দলিল - পত্র বাংলাতেই লেখা হত বিহারের এই দক্ষিণ অংশটিতে। পাটনা বাংলা একাডেমির সহায়তায় বিভিন্ন রকম উন্নতমানের গবেষণামূলক এবং সাহিত্যের বই আমরা নিয়মিত পেতাম। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ নিজস্ব দায়িত্বে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছে। এক সময় রাঁচি, কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছিল জমজমাট বাংলার ক্লাস। তখন দক্ষিণ বিহারের সমস্ত অংশটির শিক্ষা ব্যবস্থা, জমি সংক্রান্ত দলিল - দস্তাবেজ সব বাংলাতেই লেখা হত। সরাইকেল্লা – রাজখরসওয়াঁ -ওই পুরো জেলাতে (কুকড়ু, চাণ্ডিল, নিমডি গামারিয়া ইত্যাদি) সবাই বাংলা বলেন। ধলভূমগড়, বহড়াগোড়া, ঘাটশিলা, রাঁচি সহ বিরাট একটা অংশে দেখা যেত বাংলা হরফে লেখা ফলক, দোকানের নাম, রেল স্টেশনের নাম ইত্যাদি। কালচারে ছিল বাঙালিয়ানার ছাপ। এখানকার আদিবাসী, সাঁওতাল, হো, মুন্ডা জনজাতিদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও তারা স্কুলে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে বেছে নিতেন বাংলা ভাষাকেই। এমনকি বাইরের সমাজের সঙ্গে নিজেদের পরিচয় দিতেন বাঙালি বলে। এখনও দেখা যায়, এই অঞ্চলে বসবাসকারী কুর্মি সম্প্রদায়ের মানুষজনেরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেন। বাংলাতে কথা বলেন এবং পুজো-পার্বণ ইত্যাদি শুভ অনুষ্ঠান বাংলা পাঁজিপুঁথি মেনেই চলেন।
ইতিহাস ঘেঁটেও দেখা যায় ১৯০৮ সালে যখন জামশেদশী টাটা, সাঁকচি টাটা কোম্পানির গোড়াপত্তন করেন, তখন এই সমস্ত পরগনা ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীন। প্রাক স্বাধীনতাকালে বিভিন্ন রকম ভাষা নিয়ে প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয় বটে কিন্তু রাজনৈতিক কূটচালে সেসব সাকার রূপ পরিগ্রহণ করেনি। ফলস্বরূপ যা হয়, দক্ষিণ বিহারের বাংলাভাষী সমস্ত অঞ্চলগুলোকে বিহার প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে জাতীয় কংগ্রেসের ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের নীতির বাস্তব রূপায়নের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষার মান্যতা পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। তৎকালীন বিহার সরকার রাজ্যের মানুষদের ওপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রাথমিক স্তরে ও সরকারি অনুদান যুক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দি মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ আসে। জেলা স্কুলগুলিতে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয় ও হিন্দি ভাষাকে বিহার রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিহার সরকার বাংলাভাষীদের প্রতিবাদসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করলে মানভূম জেলায় আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। লোক সেবক সংঘ ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সত্যাগ্রহ আন্দোলন এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই জানুয়ারি থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগদান করে। হাজার হাজার বাংলাভাষী মানুষ কারাবরণ করে। এই অঞ্চলের লোককবিরা বাংলাতে কবিতা রচনা করেন, গান বাঁধেন। ঝুমুর গান ও নাচের মাধ্যমে আন্দোলনকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।
১৯৫৫ সালে লোকসেবক সংঘের তীব্র প্রতিবাদকে সরকার উপেক্ষা করে। পেশ করা হয় ভুল মানচিত্র, ভুল তথ্য। কিন্তু সরকারী নীতি অনুযায়ী ধলভূম অঞ্চলকে বিহারের অন্তর্গত করা হলেও এই অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা, সরকারি দস্তাবেজ, দলিল পত্র সব বাংলা ভাষাতেই লেখা হত। দক্ষিণ বিহারের শাসনব্যবস্থা বাংলাতে রাখার সিদ্ধান্ত বিহার সরকার মেনে নিয়েছিল। এমনকি বিহার বিধান সভাতে বাংলা ভাষায় সওয়াল জবাব চালু ছিল। যদিও ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই প্রথা চলে। কিন্তু এরপরেও বিহার সরকার বাংলাভাষাকে মর্যাদা দিতে চলত। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলিকে সরকার সুচারুরূপে পরিচালনা করেছে। বাংলা বই পত্রের যোগান দেওয়া হয়েছে নিয়মিত। আবার শিক্ষক নিয়োগ, চাকরি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলা জানা ব্যক্তিদের কোনও অসুবিধা সৃষ্টি হতে দেয়নি। ঝাড়খণ্ড অঞ্চল যখন বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা ভাষার অবস্থা ভালোই ছিল। কিন্তু দক্ষিণ বিহারের এই বিরাট অংশ যখন ২০০০ সালে বিহার প্রদেশ থেকে ঝাড়খণ্ড একটি আলাদা রাজ্য বলে ঘোষিত হল, তারপর থেকেই বাংলা ভাষার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়ল। 'সুইট পয়জন' নীতিতে বন্ধ করা হল বাংলা মিডিয়াম স্কুল। দেখা গেল বাংলা পাঠ্যপুস্তকের অভাব। শিক্ষকের অভাব। আর এই অভাব কিছুতেই মিটল না আজ পর্যন্তও। নবগঠিত ঝাড়খণ্ডে এই কুড়ি বছরের ব্যবধানে দেখা গেল বাংলা ভাষা এক করুণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
যদিও বিহার রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক স্বতন্ত্র রাজ্য হওয়ার ফলে সংখ্যালঘু বাঙালিদের সংখ্যা বেড়ে গেল সংখ্যা গরিষ্ঠতায়। প্রায় ৪২%, যেটা অবিভক্ত বিহার রাজ্যে ছিল ১০%। আবার সরাইকেল্লা- রাজখরসওয়াঁ, পূর্ব সিংভূম, সরাইকেলা, ধানবাদ, পাকুড়, জামতাড়া, দুমকা, সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি বাংলা ভাষাভাষী জেলাগুলোয় এই পরিসংখ্যানটি আরও বেশি। এই অঞ্চলের বিরাট জনজাতিরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন এবং সমস্ত রকম সামাজিক, ধর্মীয়, লৌকিক, পারলৌকিক, বিবাহ ইত্যাদি কাজকর্ম বাংলা পঞ্জিকা মেনেই পালন করেন। এমনকি এসব এলাকার আদিবাসীরাও বাংলা সংস্কৃতিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে বাংলা নীতি নিয়ম মেনে চলেন। এই অঞ্চলের এম.এলো.এ. এবং এম.পি. এবং নেতারা ভালোমত বাংলা জানেন এবং বাংলাতেই বক্তব্য রাখেন। সাধারণ মানুষ থেকে উপর মহলের আমলা প্রায় সকলেই বাংলা জানেন। বিভিন্ন উঁচু উঁচু পদে বাঙালিরা চাকরি করছেন। অথচ, সবাই কেমন নিশ্চুপ। নিঃস্পৃহ।
বলাবাহুল্য, ঝাড়খণ্ডের মূল সংস্কৃতি টাই বাংলা কেন্দ্রিক। বাংলা ভাষাকেই কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসার। এই অঞ্চলের ঝুমুর, ভাদু, টুসুগান, মনসা মঙ্গল, বাউল, ছৌ নাচ, ষষ্ঠী গান, ঝাঁপান গান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে জাতীয় সম্পদ। কিন্তু এগুলি আজ বাংলা ভাষা ও লিপির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাচ্ছে, ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য। পৃথক রাজ্য গঠনের জন্য এখানকার জনজাতি যে ভাষার জন্য স্বপ্ন দেখেছিল, রাজনৈতিক কোন কূটচালে আজ সেটি দুঃস্বপ্নের রূপান্তরিত। নতুন রাজ্য গঠনের পরে দেখা গেল, ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নতির পরিবর্তে বাংলা ভাষার প্রতি নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক নিঃস্পৃহ ভাব কাজ করছে। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে কোনো বাংলা শিক্ষক-অধ্যাপক নিযুক্তি হয় নি রাজ্যে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলা পাঠ্যপুস্তক ছাপানো। বাংলা পড়তে উৎসাহী ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও বাংলা বই পাচ্ছে না। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো রূপান্তরিত হয়েছে হিন্দি মিডিয়ামে। প্রয়োজনানুযায়ী শিক্ষক নেই, পাঠ্যপুস্তক নেই। স্কুল নেই। বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলিতে হিন্দি মাধ্যমে রূপান্তরিত করার পন্থা চালু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এমন একটা পরিস্থিতির শিকারে পরিণত করা হয়েছে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে যাতে পাঠ্যপুস্তকের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলি। সরকারি হাই স্কুলে, অন্যান্য বিষয়গুলোয় শিক্ষক নিযুক্তি হলেও বাংলা ভাষায় শিক্ষক নিযুক্তি বহুদিন হল বন্ধ। প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলা না থাকায় বাংলা জানা ছাত্র-ছাত্রীর অভাব তৈরি হচ্ছে। ফলে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে কলেজগুলি থেকে বাংলা বিভাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে। বি.এড. ক্লাসের মেথড সেকশনে কোনও বাংলা অপশন নেই। কিন্তু পূর্ব সিংভূম, ধানবাদ, দুমকা প্রভৃতি জেলায় বহু ছাত্র-ছাত্রী বাঙালি। পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকেও বহু ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য এখানে আসেন। বাংলা নিয়ে পড়তে চান। বি.এড. কোর্সে ভর্তি হন। তাদের ইচ্ছা বাংলা মেথড নিয়ে কোর্স কমপ্লিট করার। যাতে তারা পরবর্তী কালে বাংলা শিক্ষক রূপে চাকরির আবেদন করতে পারেন। এমনকি বহু কলেজ থেকে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিগত দু-চার বছরের মধ্যে। "টাটানগর জংশন" সহ বিভিন্ন স্টেশনের নাম বড় বড় বাংলা হরফে লেখা থাকত দু’চারবছর আগেও। সেটিও যেন কোনও দৈত্য এসে রাতারাতি মুছে দিয়েছে।
ঝাড়খণ্ডে বাংলাভাষার এই দুরবস্থার জন্য ঝাড়খণ্ডবাসী বাঙালিরাও কম দায়ী নয়। মানভূম অঞ্চল যে ভাষায় জন্য আন্দোলনে নেমেছিল সেই আন্দোলন এখন আর দেখা যায় না। বাঙালিরাই তাঁদের বাচ্চাদের পাঠাচ্ছেন ইংলিশ মিডিয়াম পাবলিক স্কুলগুলোতে। বিশ্বায়নীভবনে অবশ্যই ইংরেজি ভাষা শেখা জরুরি কিন্তু বাংলাভাষাকে পুরোপুরি বর্জন করে নয়। এত অসুবিধের মধ্যেও খুশির খবর হল, জনসাধারণের মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছেন। ধানবাদ, দুমকা অঞ্চলে বিভিন্ন বঙ্গভাষী কমিটি তৈরি হয়েছে। পূর্ব সিংভূমের ঘাটশিলা, জামশেদপুর অঞ্চলেও বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করছেন আমাদের এই 'বঙ্গ উৎসব সমিতি'। তাঁরা নিয়মিত নেতাজি জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিভিন্নরকম বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করছেন। বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত ঘাটশিলায় গৌরীকুঞ্জে 'অপুর পাঠশালা' নামে একটি সংস্থা নিয়মিত বাংলা শেখাচ্ছেন, পড়াচ্ছেন বাংলা শিখতে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের। এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও তিনি সফল।
সমস্ত রাজ্য জুড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের ফলে, সরকারের তরফ থেকে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাজ্য ভাষা রূপে স্বীকৃত দিলেও - ওই স্বীকৃতিতেই থেকে গেছে। বাস্তবে তার কোনও সমাধান নেই। কোনও পদক্ষেপও নিচ্ছে না সরকার। এই অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙালিরাও কেমন যেন চুপ হয়ে আছেন। পাবলিক স্কুলগুলোতে থার্ড ল্যাংগুয়েজের অপশন হিসাবে বাংলাকে রাখাই যায়, তাতে বাঙালি কালচারের ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হয়। ভাষাটা শিখতে পারে। পারিবারিক ধারাটিকে বজায় রাখতে পারে। তাহলে ঝাড়খণ্ডের মূল সংস্কৃতিও বেঁচে যায়। কিন্তু সমস্ত সমাজ যেন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। আর কে না জানে, ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে জাগানো যদিও বা সম্ভব, জেগে জেগে ঘুমানো সমাজকে কখনোই তোলা নয়! শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, আমরা ঝাড়খণ্ডবাসীরা যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারছি। কেননা, ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলা ভাষাকে অবলুপ্ত করে দেওয়া মানে ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলা! বাংলা ভাষার অধিকার পেতে হলে সম্মিলিত আন্দোলন ছাড়া তা কখনোই বাস্তবে পরিণত হবে না বলা বাহুল্য!