‘মানুষগুলি মোনাফিক। ইমান ঠিক নাই।‘
চমকে উঠি আমি, কিন্তু ধরা দেই না। ওর চোখ দুটো কৌণিক করে নামানো নীচের দিকে, একটা আড়ালের ভঙ্গি তার দর্শকের থেকে, যদিও দর্শক কতখানি আড়াল করতে পেরেছে নিজেকে সেই দর্পণ থেকে, বোঝার একদমই উপায় নেই।
‘কেউ যদি এক আঙুল পরিমাণ জমিও দখল করে, রোজ কেয়ামতের দিন সাত তবক জমিন তার গলায় লটকে দেয়া হবে। জাল হাদিস না, স্যার, একদম সহি।‘ দুলাল ধূলির জ্যাকেট পরা জানালাটা মুছতে মুছতে বলে। তার দরখাস্তটা তখনো ধরা আমার টেবিলে।
দুলাল চন্দ্র পাল - পুরো নামটা আবিষ্কার করেছিলাম ঋণের তালিকায়, সে একটি ক্ষুদ্র ঋণ করেছিল এবং বেশ ক’টি কিস্তি বকেয়া পড়ে গিয়েছিল। সে রাজধানীর ভাষায় কথা বলে, যদিও শব্দ ও উচ্চারনের টানে দূরের কোন জেলা থেকে এসেছে মনে হয়।
দুলাল ঋণের টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কেনার বায়না করেছিল, কিন্তু বছর দুয়েক হতে চলল, এখনো উঠতে পারেনি। দাতা খুব ভাল মানুষ, অন্য কেউ হলে নির্ঘাত নালিশ ঠুকে দিত, তো গেল মাসে দুলাল তার হাত দু’টো চেপে ধরে বলছিল, ‘আর কয়টা দিন…. শেষবারের মত, ভাইজান।‘ কিন্তু দুলালেরও সন্দেহ ছিল সেই ‘কয়টা দিনে’, সে তো এই দেখে দেখেই বড় হয়েছে যে দুনিয়াজোড়া মানুষ খালি দিন বড় করতে চায়…. দিন ছোট করায় কারোরই এতটুকু সায় নেই!
দলিলপর্চা নিয়ে গিয়েছিল ভূমি অফিসে, অফিসের কর্তাব্যক্তি এক ঝলক দেখে নিয়েই বুঝলেন, একদা নদীর পেটে চলে গেলেও চিহ্ন তো আর মুছে যায়নি। খুব বেশী নয়, দুই পাখি জমির মত- দুলালদের বাড়ি, আঙিনা, আর দুই ফসলি ক্ষেত। কিন্তু চরটি জেগে উঠার আভাস দিতেই সুরুজ মেম্বার লোকজন নিয়ে চক্কর দিতে শুরু করেন আর এক ইঞ্চি জমিও বেদখল হওয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করতে থাকেন লোকজনকে। এরপরও চরটি নদীর পেট থেকে বের হওয়ার আগেই পুঁজ পুঁজ রক্ত বেরুচ্ছিল, সংকটাপন্ন করে তুলছিল ডেলিভারি। খুব ছটফট করতে থাকে দুলাল, অনেকটা তড়িঘড়ি করেই তাদের অংশটুকু অর্ধেক দামে ছেড়ে দেয়ার বাজারি সমঝোতায় সই করে আসে সে। কিন্তু আধুলি তো দূরের কথা, সিকি পয়সাটাও চরকির মত ঘুরছে সেই থেকে।
দুলাল আমার কাছে একটা ছুটির দরখাস্ত নিয়ে এসেছিল। তিনদিন ধরে আর্জি পেশ করে করছিল সে, একটা নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে, সাথে ছিল যুক্তি ও তথ্যের ফুলঝুরি। আর এ ক’দিনে জানালার কাঁচটা সে এত বেশী ঝকঝকে করেছিল যে সামান্য আলোক রশ্মিও বিচিত্র সব প্রতিফলন তৈরী করছিল আর ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল দৃষ্টিকে। আমার রুমে একটাই জানালা ছিল, আর সে তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তেমনি করে, যেমনি ছিল অফিসটিতে আমার যোগদানের দিনে। সবাই যখন সাদর সংবর্ধনা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে রয়ে গিয়েছিল শার্সিগুলোকে শক্ত করে ধরে রেখে। সে মনের মধ্যে কিছু একটা ভাঁজ করছিল নিশ্চিত, কিন্তু সফেদ শ্মশ্রুরাজিতে আকর্ণ ডুবে থাকা হাজি সাহেবের মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হতেই ছিটকে গিয়েছিল হাতের গিঁটগুলো। অবশেষে খানাপিনার সরঞ্জামে কক্ষটি ছেড়ে গেলে তার মিলিয়ে যাওয়া বিন্দুগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখা গিয়েছিল হাজি সাহবেকে, ‘’হয়ত কোন ইশারা… হয়ত মানব জাতির জন্য কোন নিদর্শন… না হলে অনেক বড় কিছু হওয়ার যোগ্যতা ছিল আপনার ছেলেটার।‘’ আমার ছেলেটা বলা হলেও অফিসপাড়ার সকলেই জানতো কথাটা সত্য নয়, কারণ স্বয়ং হাজি সাহেবই, আমাদের সব থেকে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার, ফুরসৎ মিললেই লোকজনকে জানাতেন যে, দুলাল তার আর একটা ছেলে।
‘টাকার পাকা বন্দোবস্ত না করে কেউ বায়না করে? তাও আবার ব্যাংক থেকে ঋণ করে?’ – হাজি সাহেবের ‘পুত্রের’ দিকে চেয়ে বলি আমি। মানুষের নির্বোধ ও বিণাশী আর্থিক ব্যবস্থাপনা আমায় ক্ষুদ্ধ করে তোলে মাঝে মাঝে। কিন্তু সে তেমনি নির্বিকার, শীতল ও ঘামহীন, যেমনি ছিল পাশের দেশে মুসলমানদের গরু খাওয়া নিয়ে খুনোখুনির খবর অফিসের ডাইনিং রুম একদিন তাতিয়ে দেয়ার কালে। অফিসের সংখ্যাগরিষ্ঠ কোন কোন সদস্য জাতপাত তুলে অশ্রাব্য সব গালের তুবড়ি ছোটাতে থাকলে দু একটা সময় সে তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যাচ্ছিল আর বাকি সময়টা বেসিনের কলটা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সাবান মাখানো বাসনগুলো ধূয়ে নিচ্ছিল।
‘আমার বাবার হাতে তো আর বেশী সময় নাই, স্যার?’
আমি ফের চমকে উঠি। সে এখন গাছগুলিতে হাত দিয়েছে… খুব নিপুনতার সাথে শরীরটা ভেঙ্গে নিয়ে গাছগুলিকে সাজাতে থাকে, তাদের মাথা আঁচড়ে দিতে থাকে, কোথাও কোথাও চালাতে থাকে কাঁচি, সব শেষে ত্বকের উপর হাতের মোলায়েম ব্রাশ বুলাতে থাকে জলের ঝাপ্টা মারতে মারতে। গাছগুলো এই চারদেয়ালে ঠিকমত বাড়তে পারে না, রৌদ্র না পাওয়ায় গাছগুলি একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে থাকে, তখন কেটেছেঁটে দিতে হয় তাদের; তবে ক্রমেই আরো ছোট ও সরু হয় তারা, একটা সময় ছাঁটার জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে না আর, তখন তাদের জায়গা হয় আবর্জনা ঘরে।
দুলালের বাবার বয়স নাকি তখন পয়ঁত্রিশ, যখন ভাংগছিল তাদের বাড়ি-ঘর-শস্য ক্ষেত। তবে এক সাথে হুড়মুড় করে নয়, কাহিনিগুলো ঘটেছিল অনেকটা নীরবে, সয়ে সয়ে … যেন মানুষগুলো সামলে নিতে পারে … যেন মানুষগুলো একটা ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারে, মানে, কবে স্কুলঘরটা নিয়ে যাবে, কবে আলাউদ্দিনের সোনা ফলা ক্ষেতটা, কবে সারা গায়ের আকর্ষণ, সেই অশীতিপর আমগাছটা বা শতবর্ষী মসজিদটা…যেদিন গাঁ সুদ্ধ লোক গোল হয়ে দাঁড়াবে আর রুদ্ধশ্বাস প্রহর গুনবে - প্রকৃতির শক্তিকে ঠেকিয়ে দিতে কি জোরদার লড়াই-ই না চলবে, আর বিস্ফোরণ হবে বিপুল শক্তির দু তরফেই! আসলে নদীর ভাঙন তো সব সময় এক রূপকথা, আর তার চরিত্রের কোন ঠিক নেই, তাকে নিয়ে পরিকল্পণা করা, তাকে বাঁধের বেড়ি পরানো, কার সাধ্যি!
কিন্তু দুলালের বয়সও তখন দশ বছরের বেশি না। অনেক আগের তলিয়ে যাওয়া সেসব কথা সে এখনো শোনে মায়ের কাছে যখন রাজধানী ও জেলা শহর ছাড়িয়ে সে নদী পাড়ের সেই একটিমাত্র ঘরের বাড়িটিতে যায়, নদীর হাওয়া, রোদ ও ঝড়ের চিহ্ন যার সর্বাঙ্গে। দুলাল শুধু মা’কেই বলতে সাহস করেছিল তার সাথে থাকার জন্য যখন মা চোখ মুছতে মুছতে নদীপাড়ের ঘাসের উপর বিছিয়ে দিচ্ছিল পুরনো শাড়ি থেকে সেলাই করা কাঁথাটা, কী এক জং ধরা ধাতুর গন্ধ লেগে ছিল তাতে, এত কেঁচেছে তবু যায়নি, এখন সূর্যের গনগনে দাহে যদি শুধরোয় কিছুটা। বাবা তখন দুদিন আগের বাতাসে হেলে পড়া রান্নাঘরের বাঁশটাকে যথাস্থানে ঠেলে দিতে নিজের অধিকতর হেলানো হাত দুখানি দিয়ে প্রাণান্ত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল; সে যুদ্ধে অবশ্য সাথী হওয়ার সাহস হয় না দুলালের, দূর থেকে শূণ্যে হাত দুখানি জোড় করে বিদায় নেয় সে।
‘কিছু টাকা পরিশোধ কর, অন্তত একটা কিস্তি।‘
এতগুলো কিস্তি বকেয়া রেখে কোন কর্মচারীকে ছুটি দেয়ার বিধান নেই প্রতিষ্ঠানে। আমি দুলাল চন্দ্রের দিকে আবার তাকাই, নদীর বুকে জেগে উঠা চর যখন শুকিয়ে কাঠ হয়, দুলালের মুখখানি তার থেকেও খটখটে দেখায়। দুলালের বউ এবং এক মাত্র ছেলে একবার ঢাকায় বেড়াতে এল যখন, অফিসেও নিয়ে এসেছিল তাদের সে, কিন্তু এই একই রকম ছিল তার মুখের মানচিত্র। মেসের সঙ্গী সে ক’দিন দুলালকে একা ছেড়ে দিয়েছিল ঘরটা; তারপরো মা-ছেলেকে অবাক করেছিল ঘরের আকার-আকৃতি-বেশভূষা, দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিল তারা। এরা জেলা শহরের যেই প্রান্তে মানুষ অল্প টাকায় ঘর ভাড়া করে থাকে আর লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্না করে, ও কুপি জ্বালিয়ে পড়াশুনো করে, সেখান থেকে এসেছিল। দুলালের বউ যে ছেলের উন্নত লেখাপড়ার কথা তুলে মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছিল না, তা নয়; কিন্তু দুলালের মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল - রাজধানীতে নয়, বরং জেলা শহরে বাসা নিলে, নদী পাড়ের সেই ভাসমান, অভিশপ্ত বাড়িটা থেকে বাবা মাকে তুলে আনা যাবে। অন্তত তার ছেলে সুদীপ্তের টানে কি আর না এসে পারবে? ছেলেটাকে নিয়ে তার পরিবারের গর্বের শেষ নেই। বাবা-মায়ের চাপাচাপিতেই তো একটি ইন্সুরেন্স স্কিম খুলেছিল ওর নামে জন্মের দু মাস না পেরুতেই। গেল বছরে প্রাইমারি সার্টিফিকেটে এ প্লাস পেয়েছিল সুদীপ্ত; তারপরো যখন জেলা হাইস্কুলে একটা সিট জুটছিল না, অনেক লাইন ঘাট ধরে স্কুলের সাধারন সম্পাদকের রুমে হাজির হয়েছিল দুলাল দুরুদুরু বুকে… মনে আছে, এক একটা মুহূর্ত কি বিপুল বেগে ভাঙছিল, কিন্তু একটুও শব্দ না করে, যেভাবে এককালে তার ছেলেবেলার জমিগুলো ভেঙ্গে পড়েছিল নদীর বিরাট গহবরে।
‘স্যার, নতুন বাড়িটার রেজিস্ট্রি রবিবার। ‘
শুক্র-শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটির সাথে রবি থেকে বৃহস্পতি, মানে বাকি কর্মদিবসগুলো যোগ করে টানা সাতদিন ছুটি চাই দুলালের। এক-দুই দিনের আবেদন হলে তাও ব্যাপারটা সহজ হত। আমার ভ্রু পুরোটাই কুঁচকে যায়। আজো তার গায়ে ছিল সেই টি শার্টটা, উনিশ শো একাত্তর লেখা, লাল সবুজ পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র খোদিত। টি শার্টটা আমারই দেয়া, তবে পুরনো বলা যাবে না, গত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য অনলাইনে অর্ডার করা শার্টটা গায়ে চাপাতে গিয়ে দেখি সে কোমরের নীচে গলে পরছে না, প্যান্টের উপরের অংশে ইঞ্চিখানেক ফাঁক রেখে দিচ্ছে। যত সামান্যই হোক, অফেরতযোগ্য এই শার্টের মূল্যটা কাজে লাগাতে চাইছিলাম, ভাতের দানার মত এক কানাকড়ি টাকাও ফেলে দিতে আমার আপত্তি। হঠাৎ দুলালের কথা মনে পড়ে, ওর ছোট খাটো পেটানো শরীরেরর খোপে ভালমতই ঢুকে যাওয়ার কথা। আশ্চর্য হল, দুলাল সেই থেকে প্রতিদিনই এই শার্টটা পরে থাকে। তার মানে এই নয়, যে তার পরিবারে একাত্তরের ট্রাজেডি আছে খুব বড়সড়। আর সব পরিবারের মত ওরাও দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিল এদিক সেদিক, কিন্তু ফিরে এসে ঘরবাড়ি সব পেয়েছে। আর কারণেই নাকি আরো বেশী করে বুক চাপড়ায় ওর বাবা, একাত্তরের হায়েনাদের এড়াতে পারলেও নদীটাকে পারেননি! কি অপরাধ তার! কি কারণে দেবতারা রুষ্ট তার উপর!
‘তাহলে চরের জমি বিক্রির টাকাগুলি হাতে পেয়েছো?’
দুলাল খুব পান খায়, তার গালে সেই পানের লাল আভা ফুটে উঠে। তার মুখে যেটুকু মাংস অবশিষ্ট ছিল, তাও অপসৃত হতে শুরু করেছিল আশেপাশের বেয়াড়া হাড়গুলিকে জায়গা করে দিতে, সেখানেও যেন এক দখলের কাহিনি। তাছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্রনের বিচিত্র নকশা ছিল মুখ জুড়ে, আর সবার উপরে ছিল পলায়নপর চুলের বিধ্বস্ত ক্ষেত। পানের চিপড়ানো রসটুকু মুখে রেখেই সে যখন জানালো, সুরুজ মেম্বার তার সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, আর সে একটা নতুন ঋণ করেছে, হাজি কাকা যাতে সানন্দে জামিনদার হয়েছেন, আমি এতটা ক্ষুদ্ধ হই যে ছুটির দরখাস্তটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম! অর্থ নিয়ে এমন বিশৃঙ্খলা? অফিস থেকে বের হয়ে হাজি সাহেবের দোকানে সে অনেক রাত পর্যন্ত এক্সট্রা ডিউটি করে, বাবার হাতে একটি বাড়ি তুলে দেয়ার জন্য সে অনেক দিন ধরেই টাকা জমাচ্ছে - অফিসিয়াল নিয়মে না পড়লেও আমি এসব এড়িয়ে যাই, কিন্তু হাজি সাহেবকে ঋণের সাথে জড়ানো? আমি বিপন্ন বোধ করি।
‘স্যার, আমার বাবা গত ২৫ বছর কোন অনুষ্ঠানে যায় নাই, কারো সাথে ভাল কইরা একটা কথা কয় নাই….. একটা দানা ঠিকমত মুখে দেয় নাই …. স্যার, এই ছুটি না দিলে আমার আর কোন উপায় …..’
আমি থামিয়ে দেই, ওর কথাগুলো নদীর ঢেউ যেমন ভেঙ্গে যায়, সেভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছিল, আর ও প্রথমবারের মত চোখদুটো সরাসরি আমার দিকে তাক করেছিল। ওর মুখে রিজাইনের থ্রেট শুনতে আমার খুবই অপমান বোধ হত। আমি সই করে দেই।
সে সাড়ে সাত শতাংশের উপর বাড়িটা কিনেছিল। এতে লটকন আর জামবুরা গাছ ছিল। সাথে জেলা শহরের সুন্দর রাস্তা। চারটে রুম, পাকা দেয়াল, উপরে অবশ্য টিন। একটি সেকেলে পুজো মন্ডপও ছিল। এসব অবশ্য দুলালেরই কাছে শোনা। দুলাল তার অনুষ্ঠানটার একটা ভিডিও পাঠায় আমায়, তবে সেই ছবি হোয়াটসঅ্যাপেই পড়ে থাকে - আসলে ওকে অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম আমি, টাকাপয়সার হোলি খেলা অসুস্থ করে তুলছিল আমায়।
তিন-চারদিন পরের কথা। রাস্তার নারকীয় জ্যাম আমার অফিস টাইমের আয়ু আধা ঘন্টা কমিয়ে দিয়ে মেজাজকে সপ্তমে তুলে রেখেছিল। এই সময়টুকুতে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারতাম দিনের কাজে, যতবারই ভাবছিলাম, আমার স্নায়ুদেশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। কোন কাজে মন বসছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সেদিনের স্থিতিপত্র হাতে তুলে নিতেই চোখ চলে গেল ঋণের ফিগারে। বেড়েই চলেছে, প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ে, মনে হয়, দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত বেড়ে চলবে, কারণ যত না ঋণ শোধ হয়, তার থেকে অনেক অনেক বেশী ঋণ অশোধিত থাকে এই পৃথিবীতে। প্রায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু একটা ছায়া সংকেত আমায় চোখ তুলতে বাধ্য করল, দেখি দুলাল একটা ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে, সেই আগের মত, কিছুটা বাঁকানো, ঝুঁকে পড়া দেহ, আর চোখ তেমনি আবডালে রাখা। পরিচিত দৃশ্য, তবু চমকে উঠি আমি। পুরো এক সপ্তাহ ছুটিই তো আমি মঞ্জুর করেছিলাম। তবে দ্রুতই সামলে নিলাম, আর ব্যাপারটি নিয়ে মাথা না ঘামাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে তাকে সময় দিতে মোটেও ইচ্ছুক ছিলাম না । কিন্তু তার ঋণের বকেয়া দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আরো বিস্তৃত হয়েছিল। নিতান্তই কর্তব্যের খাতিরে শেষমেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ ধরার চেষ্টা করলাম , ‘‘তোমার ছেলে কেমন আছে? সে তো মহাখুশি, নিজের এত বড় একটা বাড়ি নিয়ে, তাই না?’’
দুলালের মুখটা এ কদিনে আরো ভেঙ্গেছে, মাটির পাত্র যেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে চিমসে যায় সেরকম। অনুষ্ঠানের সব কিছু নির্ঘাৎ এক হাতেই সামলেছে! আমার ইশারা পেয়ে ফাইলটা টেবিলের এক কোণে রাখতে রাখতে সে জানায়, ছেলের তার উপর অনেক রাগ - সুদীপ্ত যখন গেলবার পুজোয় কিনে দেয়া সাইকেলটা উঠোনে চালাচ্ছিল, ঠিকমত প্যডেল হচ্ছিল না দেখে সে তাকে নামতে বলে খানিক ইঞ্চিনিয়ারিং করতে গিয়েছিল, কিন্তু সাইকেলটির স্বাস্থ্যের ক্রমেই অবনতি হতে থাকে আর ছেলের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, চালাতে গিয়ে বাবাই সাইকেলটাই ভেঙ্গে ফেলেছে; ছেলে নাকি মাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘বাবা, সাইকেলও চালাতে জানে না?’ শুধু তাই নয়, মাকে নাকি কয়েকবার এই প্রশ্নও করেছেঃ ‘’বাবা কি আগের বাসাটাতেই বাড়িটা কিনতে পারতো না?”
আমি হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিওটি দেখতে শুরু করি। অতিথি সংখ্যা পঞ্চাশের কম হবে না, দুলাল জানালো, এদের বেশীরভাগই আত্মীয়স্বজন। হাজি সাহেবকেও দেখা যাচ্ছে ভিডিওতে সপরিবারে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ শুনছে তার বয়ান। বেশ খোলামেলা বাড়ি, ছিমছাম গুছানো, কিছু সাজগোজ চোখে পড়ল, উঠোনে লম্বা লাইন করে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে লং ক্লথ। রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, মাছের বড় স্তুপের ছবিও তোলা হয়েছিল।
‘যাই হোক, তোমার বাবা তো খুশী হইছে!’
‘হ্যা, বাবাই ঢোকছে ঘরটাতে সবার আগে। জানেন, স্যার, বাবা গত ত্রিশ বছরে এই প্রথম কোন অনুষ্ঠানে আসলো। ‘ বাইরে থেমে থেমে মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। এদিকে সেই আগের মত জানালার শিক ধরে রয়েছে দুলাল। জানালাটা আগের মতই বন্ধ অদূরেই অবস্থান নেয়া এসিটাকে কার্যক্ষম রাখতে। আর জানালাটার ভার্টিকাল ব্লাইন্ডও সরিয়ে রাখা হয়েছে বরবারের মত, তাতে ভেতরের বাল্বের আলোর সাথে বাইরের আলোর এক অদ্ভুত সংকর তৈরী হয়েছে।
‘বাহ্। খুব ভাল কথা। আচ্ছা, আগের, মানে, নদীপাড়ের ঐ ঘরগুলো তো এখন আর দরকার নেই, ওগুলো বিক্রি করে কিছু ঋণ শোধ করতে পারো।‘ আমি আসল কাহিনিতে প্রবেশ করতে শুরু করি। ঋণের দায়ে বাড়িঘর নিলামে তুলে সর্বস্বান্ত হওয়ার একটা চিত্র বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমি।
‘বাবা, মানে, …… বাবা নতুন বাড়িতে… তো… উঠে নাই… স্যার!’
আমি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকি। কিন্তু সেইরকম দুর্বোধ্য চোখ-মুখ। রোদ জ্বলে নিপাট শুকনো কাঠ, একেবারেই বৈশিষ্ট্যহীণ। জিজ্ঞাসা করতে যেয়েও আমার গলায় আটকে যায়, কেন, কি আছে সেই বাড়িতে…।
‘কতক্ষণ পায়ের উপর পইড়া ছিলাম, খেয়াল নাই, স্যার…. কত মানুষ বুঝাইতে চেষ্টা করল, এমনকি হাজি কাকার মত মানুষ বাবার হাত দুইটা ধইরা এত কাকুতি-মিনতি করল , কিন্তু…কিন্তু…. তার…তার… একটাই জবান, সবাই কি আর বাড়িঘর ছাড়তে পারে, বাজান?’ কিছুক্ষণ ধরে মেঘের ডাকটা আর শোনা যাচ্ছে না। দুলালের সেই কৌণিক চোখ তখন পুরো নিবদ্ধ হয়েছে মেঝের স্কোয়ারগুলিতে, ইদানিং খুব অল্পেই ধুলো জমে টাইলসগুলিতে, কোথাও কোথাও তো চ্যাড়চ্যাড় করে উঠে কেউ দ্রুত পা ফেললেই, তলার ক্ষয় কতদূর বিস্তৃত হয়েছে পুরো প্লেট তুলে ফেলার আগে তা অবশ্য বোঝার একদমই উপায় নেই।
‘অনেক খাটাখাটনি গেছে, এখন একটু গুছিয়ে নাও। এই মাসে বকেয়া কিস্তিগুলা না দিলে খেলাপিদের খাতায় ঢুকে যাবা, খেয়াল রাইখো।‘ একটা গুমোট হাওয়া দৌরাত্ম্য চালাচ্ছিল তখন ঘরে-বাইরে সর্বত্র। দুলালের জন্য কিছু সান্ত্বনাবাক্য, যেমন, ‘কি আর করবে’, বা, ‘তোমার যা দায়িত্ব, তা তো করছো’ – ইত্যাদি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাই আমি। ওর পুরো বাড়িটা দাড়িয়ে আছে ঋণের উপর। ঝোঁকের মাথায় এরা যেকোন কিছু করে। টিপিক্যাল লোয়ার ক্লাস মেন্টালিটি!
‘স্যার, আমি অনেক আগেই খেলাপির খাতায় নাম লেখায় ফেলছি…কখন কোন খেয়ালে যে ঋণ… এত… এত… বড় হয়ে গেল …‘ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কি মনে করে হঠাৎ থেমে গেল… সেইরকম ঝুঁকে পড়া মাথা ও পদের একটি বৈশিষ্ট্যহীন মূর্তি … কিসের যেন একটা তাড়া … একটা সময় কোন কথা না বলে, অনুমতি না চেয়ে সে বেরিয়ে গেল আমার রুম থেকে।
হঠাৎ জানালাটা কেঁপে উঠে তুমুল বর্ষণের আঘাতে। এই মৌসুমে কালবৈশাখীটা আগেভাগেই হানা দিয়েছে। চারপাশ অন্ধকার করে নামতে থাকা বৃষ্টির তীরগুলো বিপুলবেগে আঘাত করতে থাকে জানালার কাঁচকে, একটা কৌণিক ভঙ্গি তাদেরও, যেন দর্শকের কাছ থেকে একটি আড়ালের চেষ্টা। তন্ময় হয়ে দেখছিলাম; হঠাৎ সকালের যানজটের কথা মনে পড়ল, আর টেবিলের উপর রাখা ফাইলের বিশাল স্তুপটার দিকে চোখ চলে গেল। সব থেকে হালকা ফাইলটিই তুলে নিলাম হাতে। মাত্রই দুটো চিঠি সেখানে। একটি ঋন ক্লোজের আবেদন, একটি ইন্সুরেন্স স্কিম ভাঙ্গানোর টাকা থেকে। আর একটি রিজাইন লেটার। আজকের কম্পিউটারাইজড দুনিয়ায় স্বহস্তে মুক্তোর মত লেখা। তবে কোন স্বাক্ষর নেই। পুরো নামটাই লেখা সেখানে। দুলাল চন্দ্র পাল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।