এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • There is always a method in madness

    Sushovan Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩০ জুলাই ২০১৬ | ১৬২২ বার পঠিত
  • নাসা যখন ঠিক করলো স্পেস শিপ থেকে চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখবেন নিল আর্মস্ট্রং, তখন এডউইন অলড্রিনের খুব হিংসে হয়েছিল। তাঁর 'নো ড্রিম ইজ টু হাই' বইয়ে অলড্রিন লিখেছেন এর বদলা নিয়েছিলেন চাঁদে পৌঁছে স্পেস স্যুটের মধ্যেই প্রথম পেচ্ছাব করে। চাঁদে প্রথম পা হয়ত রেখেছিলেন নিল আর্মস্ট্রংই, কিন্তু চাঁদে প্রথম পেচ্ছাবটা করেছিলেন এডউইন অলড্রিন।
    রেলগেটে অপেক্ষারত দু’দিকের আমজনতা যেন যুদ্ধ উদ্যত দু-দেশের বিশাল সৈন্যবাহিনী। ট্রেনের ৩৭টা বগির ৩৩টা পেরিয়ে গেলেই সবাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রেডি। রেলগেট কিঞ্চিৎ উঠলেই তীব্র হর্নের ক্যাকাফনি, এর হেডলাইটে ওর লুকিং গ্লাসের গুঁতো,ওর ব্যাক লাইটে তার বাম্পারের ধাক্কা, ডাইনে-বাঁয়ে, আগে-পিছনে, কে কার আগে সে নিয়েই ধুন্ধুমার।
    রেলগেটের এই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সমাকলন ‘বাজারে’ও। এ বাজারে নিল আর্মস্ট্রং'র মত ফার্স্ট আপনাকে হতেই হবে। দরকারে পেচ্ছাব করে কিম্বা প্রতিপক্ষ কে দুমড়ে-মুচড়ে বিধ্বস্ত করেই। এ বাজারে সেকেন্ড'র গুরুত্ব নেই। দুর্বল'দের জায়গা নেই। এ বাজার ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের ক্যারিশমাটিক মডেলের অনুশাসনের, লগ্নি পুঁজির অঙুলিহেলনের, উদারনীতির হুকুমের। তবু পণ্ডিতরা বলেন এ বাজার ‘মুক্তবাজার’। এই অর্থনীতি ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’।
    সেই গা ঘেঁষাঘেঁষি বছরগুলোতে তখন সোভিয়েতের পতন আর গাল্ফের দখলদারির যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। ক্রমশ প্রলম্বিত হচ্ছে মার্গারেট থ্যাচারের TINA'র সাম্রাজ্য। এদেশের রাজনীতিতে তখন রামের মন্দিরের পদধ্বনি আর অভিভাবকহীন অর্থনীতি দেউলিয়াপনা। ইউ.এন চিফ ট্রেড ইকোনমিস্ট ও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ডিগ্রীধারী অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং অবতীর্ণ হলেন দেশোদ্ধারে। দেশের বাজারকে ‘মুক্ত’ করে, ১৯৯১’র ২৪’শে জুলাই বাজেট বক্তৃতায় ভিক্টর হুগো কে উদ্ধৃত করে বললেন "পৃথিবীর কোন শক্তিরই আর উদারনীতি কে আটকানোর ক্ষমতা নেই। গোটা দুনিয়া জানুক ভারতবর্ষ উদারনীতির জন্য তৈরি। অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী আর্থিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনবে। সামাজিক সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। সামাজিক প্রকল্পে ব্যয় সংকোচের পথে হেঁটে, সাধারণ মানুষের সার্বিক জীবনযাপনের পথে বাধা সরিয়ে তুলবে। পাঁচ বছর পর দেশে আর কেউ গরীব থাকবে না।" করতালি তে মুখরিত হয়েছিলো লন্ডন থেকে লোনাভেলা, কেন্ট থেকে ক্যাওড়াতলা। মুক্তবাজার অর্থনীতির ইনফ্যাচুয়েশেনের লুস-মোশেনে ভেসে গিয়েছিলো তাবড় সংবাদ মাধ্যমের দিস্তা-দিস্তা নিউজ প্রিন্ট।
    এখন দেশজুড়ে পালন হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির রজত জয়ন্তী। ‘ট্রিকল ডাউন পলিসির’ জোয়ারে গা ভাসিয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও বলেছেন "২৫ বছরের পার্থক্য চোখে পড়ার মত। গরিব কমে গেছে। বেড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান।” কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠছে ক্রমবর্ধমান জিডিপি গ্রোথের, এফ.ডি.আই'র, ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের, পার ক্যাপিটা ন্যাশনাল ইনকামের রঙিন পাইচার্ট আর পিক্টোগ্রাফ। নর্থব্লকের আদুরে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আর্থিক সংস্কারের লাভের গুড় খাচ্ছে গোটা দেশ। উদারনীতির সংশ্লেষিত উন্নয়নের সোমরস ঝরে পড়ছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। আপনি কি পেয়েছেন লাভের গুড়ের ভগ্নাংশ? কপালে জুটেছে উন্নয়নের সোমরসের মাদকতা?
    গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক বৈষম্য নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা ‘অক্সফাম’ তাদের “ইভেন ইট আপ” নামাঙ্কিত সমীক্ষায় বলেছে, দেশের প্রথম ১৫ জন ধনী ব্যক্তির সম্মিলিত সম্পত্তি আজ দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার সম্মিলিত সম্পত্তির সমান। দেশে শেষ ১৫ বছরে যে ১৪৪ ট্রিলিয়ন নতুন সম্পত্তি তৈরি হয়েছে তার ১১১.৩ ট্রিলিয়নই ধনী ১০%'র উদরস্থ হয়েছে। ২০০০ সালে যেখানে ধনী ১০%'র কাছে ছিল দেশের মোট সম্পত্তির ৬৬%, এখন সেটা ৭৪%। আর্থিক সংস্কারের আগে যেদেশে বিলিয়নারির সংখ্যা ছিল দুই এখন সেদেশে মোট বিলিয়নারি ৪৬। দেশের মোট আয় বিতরণের বৈষম্য মাপার একক ‘জিনি কফিসিয়েণ্ট’ ৯১'এ ভারতের ইনডেক্স ছিল ৩০.৮ বর্তমানে ৩৩.৬।
    কিছু উন্নয়ন অবশ্য গরীবরেও নসীব হয়েছে। ৯১’এ বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ ক্ষুধার্তের ঠিকানা ছিল ভারত, এখন বেড়ে এক-চতুর্থাংশ। ৯১’এ দৈনিক জরুরি ২১৫০ ক্যালরির থেকে বঞ্চিত হত ৫৭.৫% দেশবাসী, এখন ৬৬.৫%। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধা পীড়িত এদেশের শতকরা ৩৫% মানুষ। ৭৫% মানুষেরই দৈনিক আয়, রাষ্ট্রসংঘের দারিদ্র্য সীমার স্থিতিমাপ, মাথাপিছু ২ ডলারের থেকেও কম। ৯১’র বিশ্বের মোট নিরক্ষরতার ৩২.৬% ঠিকানা যেখানে ছিল ভারত, ২০১৪ তে তা ৩৫.৬৫%। এই ভয়াবহ চিত্রের সৌজন্যে থাকা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে ফিস্ক্যাল ডেফিসিটের লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে সরকারে ক্রমবর্ধমান ব্যয়সংকোচের কোপ থেকে বাদ যায়নি কৃষি ও সেচ। তুলে দেওয়া হয় ভর্তুকির নিয়ন্ত্রণ, প্রত্যাহার করা হয় বিভিন্ন শস্যের সহায়ক মূল্য। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ঋণখেলাপি হয়ে কৃষক আত্মহত্যার প্রবণতা।
    গত ৯ বছরে আমাদের দেশে কর্পোরেট’দের যে পরিমাণ মোট ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয়েছে, তাতে দেশের সবার শিক্ষা,স্বাস্থ্য, জল কিম্বা শৌচাগারের মত মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা যায়। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ১০৫ বছর আর বর্তমানে মূল্যে ও গঠনে খাদ্য নিরাপত্তা ৩১ বছর টানা চালানো যায়। ‘অক্সাফাম’ বলছে শুধু আর্থিক বৈষম্যর মাত্রা ৩৬% কমানো গেলেই বর্তমান মাপকাঠিতে দেশে আর কোন গরীব থাকবে না। কিন্তু সরকারে এসবে কর্ণপাত করার সময়, অবকাশ, সদিচ্ছা -কোনটাই নেই। আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতি ইউ.এস.পি হল বিগ বিজনেস হাউস’র বিশ্বাস। তাদের আস্থাভাজন লগ্নী। দেশ চলবে তাঁদেরই দয়া দাক্ষিণ্যে। ‘বিগ বিজনেস হাউজ’রা নির্বাচনী প্রচারের খরচা বহন করবে, আর ক্ষমতায় এসে নতুন সরকার লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মোকুব করবে। সাধের মুক্তবাজারে এ সম্পর্ক ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের। এ সম্পর্ক গিভ অ্যান্ড টেকের। তাই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের যে সরকার দেশের সব ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না, সেই সরকারই, ২০.৩ ইউএস বিলিয়ন ডলারের মালকিন নীতা আম্বানি’র সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত ১১জন সশস্ত্র পুলিশের সহ Y’ ক্যাটাগরির সিউকিউরিটি প্রদান করে। তাও আবার আমার-আপনার কষ্টার্জিত ট্যাক্সের পয়সায়। ঐ যে কথায় বলে “There is always a method in madness”…always
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩০ জুলাই ২০১৬ | ১৬২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন