এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মুক্ত বাজার

    Sushovan Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ অক্টোবর ২০১৭ | ১৬৮৫ বার পঠিত
  • নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয় খুশি হয়েছেন। হওয়ারই কথা। প্রধানমন্ত্রী’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ১০০ জন ধনকুবের’দের ক্রমাঙ্কে টানা দশ বছর শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছেন। গত বছরে, রেকর্ড হারে, ৬৭% সম্পত্তি বাড়িয়ে, আজ তিনি ৩৮০০ কোটি ডলারের মালিক। লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, পুট ইওর হ্যাণ্ডস টুগেদার ফর ওয়ান অ্যান্ড অনলি, মু-কে-শ আম্বানি ¹।
    নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয় আরও খুশি হয়েছেন। হওয়ারই কথা। প্রধানমন্ত্রী’র ঘনিষ্ঠ সহযোগীর পুত্র, ‘লস মেকিং’ কোম্পানির মালিক থেকে রাতারাতি কোটিপতি বিজনেস টাইকুন হয়েছেন। গত বছরে, অলীক ক্ষমতায়, ১৬,০০০গুন বাড়িয়ে, তার কোম্পানি ৮০.৫ কোটি ‘টার্নওভার’ কুড়িয়েছে। লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, পুট ইওর হ্যাণ্ডস টুগেদার ফর ডি অনলি সান অফ অমিত শাহ, মি-স্টা-র জয় শাহ ² ।
    রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল অবশ্য বুক ফুলিয়ে বলছেন জয় শাহ’র ব্যবসার এই শ্রীবৃদ্ধি “সবটাই বৈধ” ³ । ইনিই সেই পীযূষ গোয়েল যিনি কিছুদিন আগে বলেছিলেন “দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই অর্থনীতির পক্ষে ভালো লক্ষণ। অর্থাৎ কর্মীরা অন্য কোম্পানির চাকরি না খুঁজে নিজেরাই কোম্পানি খুলছে” ⁴ ।
    যে অর্থনীতির লক্ষণ ভালো বলে পীযূষ গোয়েল আপাতত উদ্বাহু হয়েছেন, সেই অর্থনীতির নিয়মেই কিন্তু আপনার রেশনে চিনিটা বাদ পড়ছে; রান্নার গ্যাসে ভর্তুকিটা উঠে যাচ্ছে; পি.এফ’র সুদটা কমে যাচ্ছে; বাড়ির লোনের অনুমোদন পেতে আপনার জুতোর সুকতলা খয়ে যাচ্ছে। আবার, সেই একই অর্থনীতির নিয়মেই, সরকার বাজেটে নিয়ম করে কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় দিচ্ছে; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ‘বিগ-বিজনেস হাউস’র লক্ষ কোটির ঋণ ‘রাইট অফ করছে; মুকেশ আম্বানি আরও বড়লোক হচ্ছে আর জয় শাহ তুড়ি মেরে ১৫.৬ কোটি টাকার “বন্ধকহীন ঋণ” আদায় করছে ² । এই অর্থনীতি’কেই পীযূষ গোয়েলরা আদর করে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’ বলে ডাকেন।
    দেশের বাজারকে ‘মুক্ত’ করে, ১৯৯১’র ২৪’শে জুলাই বাজেট বক্তৃতায় ভিক্টর হুগো কে উদ্ধৃত করে মনমোহন সিং বলেছিলেন "উদারনীতি অপরিহার্য এবং অবশ্যম্ভাবী। অর্থনৈতিক সংস্কার আর্থিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনবে। সামাজিক সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। ব্যয় সংকোচের পথে হেঁটে, পাঁচ বছর পর দেশে আর কেউ গরীব থাকবে না।" করতালি তে মুখরিত হয়েছিলো লন্ডন থেকে লোনাভেলা, কেন্ট থেকে ক্যাওড়াতলা। বামপন্থী’দের প্রবল আপত্তি জাস্ট তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে, তাঁদের আদর্শ কে ‘বস্তাপচা’ দাগিয়ে দিয়ে, মুক্তবাজার অর্থনীতির ইনফ্যাচুয়েশেনের লুস-মোশেনে ভেসে গিয়েছিলো তাবড় সংবাদ মাধ্যমের দিস্তা-দিস্তা নিউজ প্রিন্ট। আর আজ, মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে ২৬ বছর চোখ বন্ধ করে পথ চলার পর, আমাশার বেগ যদি প্রশমিত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে, সেদিনের তাঁবেদার’রা কি একটু বলবেন দেশের ঠিক কোন চুলোয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে “সামাজিক সমতা ও ন্যায়”? কোন জন্নতে এসেছে "আর্থিক স্থিতিশীলতা"? কোথায় মিটেছে গরীবি? কেমনই বা আছে অর্থনীতি?
    বিশ্ব-বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৭৫% কমে যখন ১২.৫৮ টাকা/লিটার, ব্রিক্স’র অন্তর্ভুক্ত সমস্ত ‘ইমারজিং ইকনমির’ গ্রাফ যখন ঊর্ধ্বগামী, ঠিক তখনই গত ৬টি কোয়ার্টারে নিয়ম করে কমেছে দেশের জি.ডি.পি ⁵ বৃদ্ধির হার। এখন ৫.৭। প্রতি বছর যে দেশে ১.২ কোটি নতুন কর্মসংস্থান প্রয়োজন, সেখানে লেবার ব্যুরো জানিয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে বেকারত্বের হার ৫% -গত পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ ⁶ । আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট ফার্ম ‘ম্যাকেন্সি’র রিপোর্টে “দেশের ১৬.৬ কোটি অসংগঠিত শ্রমিক এই মুহূর্তে আশঙ্কাজনক ভাবে বেকার” ⁷। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’র গল্পের গরু আকাশে উড়লেও, বাস্তব এটাই যে, চলতি আর্থিক বছরের শেষ কোয়ার্টারে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে সূচক বৃদ্ধির হার ১.২% আর শিল্পোৎপাদনে গত ২৫ বছরের সর্বনিম্ন ⁸ ⁹ । কয়েক মাসে বন্ধ হয়েছে ২১২টি স্টার্ট-আপ কোম্পানি ¹⁰। দেশের অর্থনীতির ভয়ঙ্কর চিত্র বাই-মান্থলি রিপোর্টে কার্যত মেনেও নিয়েছে নিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ¹¹ । এস.বি.আই লিখেছে “দেশের অর্থনীতির নিম্নগামিতা দীর্ঘমেয়াদি। ¹² ” ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক জানিয়েছে “ভারতীয় অর্থনীতির প্রবণতা বিপজ্জনক” ¹³ । নোট বাতিলের তুঘলঘি সিদ্ধান্তের পর আই.এম.এফ’র মতেও ভারতবর্ষ আর ‘ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ইকনমি’ নয় ¹⁴ ।
    গর্ভাচেভ আর ইয়েলৎসিন দেখানো মুক্ত বাজার অর্থনীতির রঙিন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে তখন ভাঙ্গছে সোভিয়েত। জনৈক মিখাইল’র সেই সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর নোবেল জয়ী “সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইমঃ দ্য লাস্ট অফ দ্য সোভিয়েতস” বইয়ে লিখেছেন বেলারুশিয়ান সাংবাদিকা স্বেতলানা অ্যালেক্সিভিচ -“সোভিয়েত ভাঙ্গার খুশিতে আমি মস্কোর হোয়াইট হাউসের সামনে মানব বন্ধনে হাত মিলিয়ে ছিলাম। কমিউনিজম আর যাতে কোনদিন ফিরে না আসে তার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম। আমরা বলেছিলাম কমিউনিজম চিরকালের জন্য মৃত। তারপর কেটে গেছে ২৫টা বছর। আমার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কদিন আগে গিয়েছিলাম তার হোস্টেলে। দেখি ডেস্কের উপর পড়ে আছে মার্ক্সের দাস ক্যাপিটাল। আড়ি পেতে শুনলাম আমার ছেলে আলোচনা করছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নিয়ে। নিজের চোখ, আর কান’কেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল নিজের হাতে যে মার্ক্স কে কফিন বন্দী করে এসেছিলাম সেই মার্ক্সই কি আবার ফিরে এল?”
    আজ্ঞে হ্যাঁ, মার্ক্স ফিরে এল। ফিরে এল কারণ, তামাম দুনিয়া জুড়ে আবার দেউলিয়া মুক্ত বাজার অর্থনীতির। ফিরে এলো, কারণ উদারনীতির বধ্যভূমি আমেরিকা’তেও মানুষের প্রাণের থেকে সস্তায় বিক্রি হচ্ছে মানুষ মারা বন্দুক। ফিরে এলো কারণ, শ্রমিক ধর্মঘটে, কৃষক বিক্ষোভে, চাকরির দাবী তে, মজুরি আদায়ের লড়াইয়ে আবার উত্তাল বিশ্বের অলি-গলি।
    আপনি একটা কেন একশটা পার্টি অফিস ভাঙ্গুন; একশটা কেন হাজারটা কমরেড মারুন; হাজরাটা কেন লক্ষ রক্ত পতাকা পোড়ান; কিন্তু যতদিন অন্যের শ্রমের বিনিময়ে মুকেশ আম্বানি মুনাফা লুটবে, যতদিন হাঙ্গার ইনডেক্সে লজ্জার বিনিময়ে জয় শাহ পকেট ভরবে, ততদিন মার্ক্স ঠিক ফিরে ফিরে আসবে। ডিয়ার অমিত শাহ, আপনি শুধু কেরালা কেন, পারলে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, ২,৮৫৬ কিলোমিটার লম্বা “জন-রক্ষা” পদযাত্রা করুন, তাতে, আপনার ওজন কিছুটা কমতে পারে, মেদও কিছুটা ঝরতে পারে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মার্ক্স কিন্তু কফিন বন্দী থাকবে না। ইতিহাস সাক্ষী, মার্ক্স কোনদিন কফিন বন্দী থাকেনি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ অক্টোবর ২০১৭ | ১৬৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন