গত সপ্তাহে একটা কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। সিম্পোজিয়ামের চেয়ার/ভাইস-চেয়ার হয়ে গাদা গুচ্ছ কাজ এবং তারও বেশী পেপার রিভিউ করে কেস এই দাঁড়ালো যে এক আমন্ত্রিত অতিথির সাথে ডায়াসে বসে ফাঁকে ফাঁকে ইংরাজী এবং হিন্দীতে কথা বললাম।
শেসন শেষে বাইরে বেরিয়ে দেখি সেই ভদ্রলোক ফোনে কথা বলছেন, "মামণি, তুমি খেয়ে নিয়েছো তো? মাকে ফোনটা দাও একটু"
আমি আর থাকতে না পেরে গিয়ে বললাম, "মামণির মায়ের সাথে পরে কথা বলবেন, আগে আমায় বলুন আপনি বাঙালি হয়ে আমাকে হিন্দী আর ইংরাজীতে কথা বলালেন সারা সকাল?"
- আরে তুমি বাঙালি নাকি? বুঝতে পারি নি তো!
- ছোট করে চুল কাটলে আমাকে অবশ্য পাবলিক হয় ব্রাজিলিয়ান নাহয় উত্তর ভারতের লোক ভাবে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে আপনার দোষ নেই তেমন! কিন্তু আপনি সেশন চেয়ারের নাম জানবেন না?
- আসলে তোমার টাইটেলটা খেয়াল করি নি!
- কিন্তু আমার হিন্দী শুনেও বুঝলেন না?
- সেটা অবশ্য বোঝা উচিত ছিল আমার!
ভদ্রলোক নিজের ভুল স্বীকার করে নিলেন। সন্ধ্যের দিকে বেগার খাটার স্বীকৃতি দিল একটা মেমেন্টো হাতে তুলে দিয়ে। তা সেই ছবি পরে দেখে বুঝলাম যে জামাটা পরে আছি সেটা গত বছর পুজোয় কেউ উপহার দিয়েছিল। ব্লেজার কেউ দেয় নি, ফলত: ব্লেজার পরিহিত একখানি ছবির স্বপ্ন এবারেও অধরা থেকে গেল।
যাই হোক ডিনার করতে গেলাম হাতে মেমেন্টো নিয়ে। ভারতীয় কনফারেন্সে যা হয় আর কি – সে এক এলাহী খাবার ব্যবস্থ। জিবে জল প্রায় গড়িয়ে পড়ল দুই পাক ব্যুফে অঞ্চলটা ঘুরে। ঘোরা শেষ করলাম একটা টার্গেট বসার জায়গা ঠিক করে – এবার খাবার নিতে গিয়ে দেখি প্লেট নেই ব্যুফে কাউন্টারের নীচে! কেস কি হল বুঝতে পারছি না। একজনকে জিজ্ঞেস করাতে বলল, ওপাশে গিয়ে ডিনারের কুপন জমা দিয়ে প্লেট নিতে হবে। একবারই প্লেট দেবে, এবং সেই প্লেটেই স্টার্টার থেকে ডেজার্ট সারতে হবে। তাই সই। কোণের দিকে এক মেয়ে দেখলাম যক্ষের ধনের মত প্লেট পাহারা দিচ্ছে এবং তার সামনে একটা কাঁচের জারে সবাই কুপন ফেললে তবেই সেই মেয়ে প্লেট হস্তান্তর করছে।
নিজের কুপন খুঁজতে গিয়ে দেখি সে জিনিস কোথায় হারিয়ে গেছে! খালি পেটে থাকতে হবে নাকি সেই ভাবনায় ডুবে গিয়ে মনে এল যে মেমেন্টো জিনিসটি মার্বেলের, সুন্দর প্লেটের আকারে। খিদের চোটে সেটাই বের করে খাবারের প্লেট হিসাবে ব্যবহার করব বলে এগিয়ে গেলাম
সেই দেখে কনফারেন্সের পাবলিক হাঁ হাঁ করে আটকালো - করেন কি, করেন কি বলে! মর্যাদার হানি হবে!
বললাম, “নিজের নাম লেখা প্লেটে খেলে সমস্যা কি”? কিন্তু তারা গুঁই গাঁই করতেই লাগলো।
বললাম অন্য প্লেট দিন তাহলে।
কাউন্টারের মেয়েটি কানের কমিউনিকেশন ব্যবস্থায় হাত দিয়ে, “ব্যুফে ফ্রন্ট ডেক্স কলিং – উই হ্যাভ এ সিচ্যুয়েশন হিয়ার” এই সব করে শেষ পর্যন্ত আমাকে প্লেট হস্তান্তর করল। খাবার প্লেটেই খেলাম অবশেষে সেদিন
অবশ্য প্লেট না দিয়ে কনফারেন্স কর্তাদের উপায়ও ছিল না। কারণ সারাদিন পুরোদিন কাঁপিয়ে দিয়েছিলাম কনফারেন্স। এমনিতে এই সব কনফারেন্সে চেয়ার পার্সন হলেও আমার বিশাল কিছু বলার থাকত না। ছেলে পুলে প্রেজেন্ট করছে এতেই আমি আপ্লুত – কিন্তু বুঝলুম কনফারেন্সীয় কনটেক্সটে চেয়ারম্যান সুকান্তর কাছে আরো বেশী কিছু প্রত্যাশিত। তো এবারে শান্তনু-দার থেকে ইন্সপায়ারড হয়ে পুরো কাঁপিয়ে দিলাম –
ও হো – শান্তনুদার খেইটা তাহলে একটু ধরিয়ে দিই আগে -
সোফায় পা গুটিয়ে বসে গুছিয়ে ভাট শুনবেন যাঁদের এমন বাঙালী আইকনিক আঁতেল এখন বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু আঁতেল আইকন সামনে না থাকলে কি নিয়ে দিন কাটবে সেই চিন্তা থেকে ঋতুদা চলে যাবার পর চন্দ্রিলের আশ্রয়ে ছিলাম। তবে সেবারে ‘ক্যালকাটা লিটারেরী ফেষ্টিভ্যাল’ না কিসে যেন একটা চন্দ্রিলের বক্তৃতায় গোদার, বার্তোলুচি, বেলা লুচি, ফালুদা, ভারমিচিলি কি সব ঢুকে যাবার পর বুঝতে পারলাম চন্দ্রিল-দা আমার নাগাল ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল – মধ্যবিত্ত আঁতেল থেকে উচ্চবিত্ত আঁতেল পর্যায়ে উন্নিত হয়েছেন দাদা।
ফলে আমি আবার মধ্যবিত্ত আইকন খুঁজতে বসলাম – মার্কেটের অবস্থা খুব খারাপ। শেষে শরণাপন্ন হতে হলে শান্তনু মৈত্র মানে আমাদের সবার প্রিয় জি বাংলা সা রে গা মা পা-র শান্তনু-দা। তো শান্তনু-দাকে ফলো করেই আমার সেই কনফারেন্স কাঁপানো -
শান্তনু উবাচঃ এই যে এটা হল মঞ্চে, এ একমাত্র জি-বাংলা সা রে গা মা পা-র মঞ্চেই সম্ভব। আমার জানামতে এত ইনোভেটিভ জিনিস আমি তো আর কোন রিয়েলিটি শো-তে দেখি নি
এক প্রেজেন্টেশনের শেষে চেয়ারম্যান সুকান্তঃ এই যে তুমি প্রেজেন্টেশনটা শেষ করলে, এমন চমকপ্রদ পেপার কেবল এই কনফারেন্সেই সম্ভব। এমন উঁচু মানের কাজ আমার জানামতে অন্য কোন কনফারেন্সে অন্তত দেখি নি।
শান্তনু উবাচঃ রথি, কি জিনিস নামিয়েছিস রে ভাই! এই অ্যারেঞ্জমেন্ট জাষ্ট ভাবা যায়! কি ভাবে মেশাস রে গান গুলো! গঙ্গার জল যে টুপ করে যমুনার সাথে মিশে গেল – ঢেউ শুদ্ধু
কনফারেন্সের হলের পাশে একটা মেয়ে ছিল আমাদের রুম ম্যানেজের দায়িত্বে। তাকে উদ্দেশ্য করে চেয়ারম্যান সুকান্তঃ কিভাবে স্মুথলি ট্রান্সফার করছো প্রেজেন্টেশন গো তোমরা! কিভাবে এক টকের শেষে অন্য টকে চলে যাচ্ছে স্ক্রীণ – কোন গ্লীচ নেই! ভাবা যায়! গিভ দেম এ বিগ হ্যান্ড।
সেই মেয়ে আবার ফট করে বলেঃ স্যার, এর বেশীর ভাগ কৃতিত্ব তো কনফারেন্স কোর্ডিনেটর ঋষি-দার প্রাপ্য। আমরা তো শুধু অডিও-ভিজুয়্যালের লোক!
চেয়ারম্যান সুকান্তঃ ওকে, তাহলে এখানে রথী হল ঋষি! নো ইস্যু, গিভ এ বিগ হ্যান্ড ফর হিম অ্যাজ ওয়েল।
শান্তনু উবাচঃ তোমার গান তো পুরো ফ্ল্যাট – মডিউলেশন ইত্যাদি তো ছেড়েই দিলাম, কিন্তু গানটা তো আগে তোমাকে মনে মনে স্ক্যান করে নিতে হবে! কোথায় শ্বাস ছাড়বে, কোথায় কি করবে এটা তো প্র্যাকটিস করে নেওয়া উচিত ছিল তোমার!
চেয়ারম্যান সুকান্তঃ তোমার প্রেজেন্টেশন তো কেমন মনোটোনাস হয়ে গেল! ইন্ট্রোডাকশন দিলে, কিন্তু সেখান থেকে ধীরে ধীরে তো তোমাকে এক্সপেরিমেন্ট, রেজাল্ট, ডিসকাশন, সব শেষে কনক্লুশন এমন ভাবে ডায়নামিক্স-টা বিল্ড করতে হবে! তুমি তো প্রথমেই কনক্লুড করে দিলে! এমন করলে অডিয়েন্স ধরে রাখতে পারবে? কোথায় স্ট্রেস দেবে, কোথায় পজ নেবে এগুলো তো আগে প্র্যাক্টিস করে আসা উচিত ছিল! নেভার মাইন্ড! কিপ প্র্যাক্টিসিং – নেক্সট ইয়ার কনফারেন্সে ভালো করতেই হবে
শান্তনু উবাচঃ আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম – তুই গান গাইতে গাইতে আমাদের সবার এক্সপ্রেশন কি হচ্ছে সেটা খুঁজে বেড়াচ্ছিস! জাষ্ট ডোন্ট ডু দিস – মন দিয়ে গানটা গা।
চেয়ারম্যান সুকান্তঃ আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম – তুমি প্রেজেন্টেশন দিতে দিতে শুধু অডিয়েন্স নয় – চেয়ার এবং ভাইস-চেয়ারম্যানের, মানে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের এক্সপ্রেশন কি হল খোঁজার চেষ্টা করছ! জাষ্ট ডোন্ট ডু দিস – হ্যাভ সাম কনফিডেন্স ইন ইয়োর ওন ওয়ার্ক। মন দিয়ে সেটাই প্রেজেন্ট করো।
ও হ্যাঁ, এর মাঝে দু একটা প্রেজেন্টেশন ছাড়া ছাড়াই চেয়ারম্যান সুকান্ত বলে উঠছিল “এমন চমকপ্রদ পেপার কেবল এই কনফারেন্সেই সম্ভব। এমন উঁচু মানের কাজ আমার জানামতে অন্য কোন কনফারেন্সে আমি অন্তত দেখি নি”।
শান্তনু উবাচঃ তুই তো শুরুটা একদম ছড়িয়েছিলি – তুই সেটা নিজেও জানিস। ঠিক কিনা? মুখরা-তে চিন্টু-র তবলা ওদিকে বাজছে, তো গান বেতালে। শেষে অন্তরায় এসে তুই ব্যাপারটা ধরলি! দারুণ ম্যানেজ করেছিস – আর শেষটা তো একদম ফাটিয়ে!
চেয়ারম্যান সুকান্তঃ তুমি কিন্তু প্রজেন্টেশনটা শুরু একদম ভালো করো নি। তোমার ঘাড় নাড়া দেখে বুঝছি সেই গাফিলতি নিজেও জানো তুমি। ইন্ট্রোতেই তুমি নিয়ে নিলে সাড়ে সাত মিনিট। আমি তো ভাবলাম টাইমের মধ্যে তুমি শেষই করতে পারবে না। কিন্তু যেভাবে তুমি অ্যাডজাষ্ট করে নিলে মূল বক্তব্য থেকে না সরে – সেটা একটা বড় প্রেজেন্টার হবার লক্ষণ। শেষটা তো একদম অসাম ছিল। গুড জব – প্রাউড অব ইউ
শান্তনু উবাচঃ আজকে নাম্বার দেওয়া হচ্ছে না তাই – তা না হলে তোমার এই পারফর্মমেন্স এর জন্য তোমাকে আমি ডেঞ্জার জোনে পাঠাতাম।
লাঞ্চে বিশাল খাওয়া দাওয়া করে চেয়ারম্যান সুকান্ত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। এবং লাঞ্চের পরে এক পাবলিক ততোধিক বোরিং প্রেজেন্টেশন নামিয়ে প্রায় সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল – সেই টকের শেষে
চেয়ারম্যান সুকান্তঃ এখানে নাম্বারিং এর ব্যবস্থা নেই তাই। তা না হলে তোমার এই প্রেজেন্টেশন টু বি ফ্র্যাঙ্ক ডেঞ্জার জোনে যাবার যোগ্য।
সেই ছেলে ঘাবড়ে গিয়ে, “স্যারজী, ডেঞ্জার জোন ব্যাপারটা ঠিক কি? তাছাড়া এই পেপার তো আপনিই অ্যাপ্রুভ করেছিলেন”।
চেয়ারম্যান সুকান্ত এবার ফেঁসে গেছে – কিন্তু এখানেও বাঁচিয়ে দিল শান্তনু-দা। মনে পড়ে গেল সেই ডায়লগ, “প্রথম রাউন্ডে যা পারফর্ম করেছো, সেই একই লেভেলে থাকলে তো হবে না! ক্রমশঃ ফাইনালের দিকে এগুচ্ছি আমরা – ইমপ্রুভ করতে হবে।
চেয়ারম্যান সুকান্তঃ হ্যাঁ, অ্যাপ্রুভ তো আমিই করছিলাম অ্যাবস্ট্রাক্ট – সে ঠিক আছে। কিন্তু এটাও তো তোমাকে জানতে হবে যে এখন ব্যাপার প্রফেশন্যাল। অ্যাবষ্ট্রাক্ট-এর থেকে পেপারের লেভেল একটু ভালো এক্সপেক্টেড – আর তারপরে ভালো প্রেজেন্টেশন। তোমার প্রেজেন্টেশন সেই অ্যাবষ্ট্রাক্ট লেভেলেরই রয়ে গেছে বা তার থেকেও নীচে নেমেছে! নেভার মাইন্ড, একটা খারাপ দিন সবারই আসতে পারে। পরের বার কনফারেন্সে আমি সেই পুরানো তোমাকে দেখতে চাই আবার। অল দ্যা বেষ্ট!
শান্তনু উবাচ আরো অনেক নোট করা আছে – পরের কনফারেন্সে আবার হবে। মানে অনেক লেখা আছে স্টক ডায়লগ – এত কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করার নেই সামনে। তাই যদি অন্য কারো দরকার হয় আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন চেয়ারম্যানীয় ডায়লগের জন্য। গ্যারান্টিড সাফল্য -
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।