মেহের,
আমাদের এখনো দেখা হল না। এত ভিড়, নাও হতে পারে।
কোন শহরে, গ্রামে বা মফস্বলে তোমার এখনকার কাজ, কে জানে। The Economist, তার মে সংখ্যায় লিখেছে ১.৬ বিলিয়ন মানুষ ভালো করে ভাত রুটিটুকু খেতে পাচ্ছে না। ২৫০ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
আমি জানি, তুমি এসব শুনে কখনো বলবে না, "তাতে আমাদের কী?"
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কথা তো জানো। দুই দেশ থেকে বার্লি গম যব সূর্যমুখী তেল সব রপ্তানি বন্ধ। চিনে দেরিতে বর্ষা আসায় গম কতটা ভালো হবে, রপ্তানি হবে কিনা, এসব কিছু নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা।
জানি মেহের, তুমি প্রশ্ন করবে, এইসব খাবার বাইরে থেকে কিনতে হয় কেন?
কারণ উত্তর-উপনিবেশ আসলে তো আরেকটা উপনিবেশ মেহের! এগুলো এখনও তো উপনিবেশই। তাই গরীব দেশে অর্থকরী ফসল চাষ করিয়ে তাদেরকেই বিনে মাইনের শ্রমিক হিসেবে খাটিয়ে সব বাইরে নিয়ে যাও। বিনিময়ে দাও দুটো চাল ডাল গম যব। বেঁচে থাকুক। একেবারে যেন মরে না যায়। কিন্তু এখন এমন অবস্থা, বলছে অনেক দেশ খাবার রপ্তানী করার পর দেশের মানুষকে সেই খাবার কেনার জন্য সাবসিডি দিতে পারবে না। দেশের এমন দুর্দশা!
আধুনিক কৃষি প্রক্রিয়ার দাপটে হেক্টরের পর হেক্টর জমির উৎপাদনক্ষমতা কমছে। ছোটো চাষীরাও কেউ কেউ বলছেন, এরপর ঘরের জন্য পর্যাপ্ত খাবার উৎপাদন করতে পারবেন কিনা তার ঠিক নেই!
পরিস্থিতি কোন্ দিকে তা আন্দাজ করতে পারছ? হাতে টাকা থাকলেও খেতে পাওয়া যাবে না।
আমার ভাবনা ছোটো চাষীদের নিয়ে। একদিক থেকে দেখলে তাদের এখনো কিছু স্বাধীনতা আছে জানো। তারা চাষবাস এখনো অনেকটা বৈচিত্র্যময়। ফসলচক্র মেনে চলে মোটামুটি। সার বিষের ব্যবহার খুব কম করে। এরকম চাষীর সংখ্যা অবশ্য কম। অনেকেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে কৃষি পাঠশালায় ডেকে এনে সকলে মিলে বুঝতে চাইছি যে সার বিষ ছাড়া চাষ সম্ভব। তাতে খাবার খরচ, স্বাস্থ্যখাতে খরচ অনেক কমে যাবে। চাষীরা অনেকটাই বোঝেন। সমস্যা তাঁদের অন্য জায়গায়। তাদের একটু আর্থিক সুরক্ষা প্রয়োজন কারণ মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হলে ঠিক হতে সময় লাগে। সেসময় ফলনে সমস্যা হতে পারে। রোজগার কমে যাবে। সেই সময়টুকু তাদেরকে কে সাহায্য করবে? পুরো বাজারটাই তো উৎপাদক বিরোধী। এইসব কিছু গুছিয়ে আনতে পারলে গ্রামকে গ্রাম স্বনির্ভর হওয়া সম্ভব। অনেকে স্বপ্ন দেখছে। কাজ করছে। সিস্টেমটা তো মূলত ব্যক্তি পুঁজিতে চালায়। তাই তারা এসব কাজেই বাধা দেয়। বাধা দেবে। মারবেও। তবু এখন আমাদের আর পিছু হটবার জায়গা নেই।
পিছু হটলে খাবো কী? বাচ্চারা বাঁচবে না। তাদের মুখ ভেবে কষ্ট হয়। তারা তো আর সভ্যতার স্বরূপ জানে না। কী ভয়ংকর অবিচার তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে বল তো?
এর মধ্যে আশার আলো কী আছে? অতিমারীর পরে দেখা গেল ব্লক ও জেলাসদরের বাজারগুলো বিকেন্দ্রিত হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় উৎপাদন নিয়ে সবজি ও মাছমাংস বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই ভিনরাজ্য থেকে ফিরে এসেছে ঠিকের কাজ ছেড়ে। আর যাবে না। গ্রামে থেকেই রোজগার করবে। বেশ কিছু হাইব্রিড ও অর্থকরী খাবারের প্রতি অনেক মানুষের অনীহা এসেছে বলে তার জায়গায় দেশি বিকল্প ফিরে আসছে যেমন পোলট্রির ব্রয়লার মুরগি ও তার ডিম অনেক বর্জন করছে। সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক চাষী রাসায়নিক সার বিষ ছেড়ে বিকল্প খুঁজছে। শহরে মফস্বলে অনেকে নিজের ফসল অল্প অল্প করে ফলাচ্ছে। বিষাক্ত খাবারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলবার চেষ্টা করতে হবে।
কিন্তু এসব একটা পর্যায়ে থমকে যাবে, যদি না এই ব্যক্তিপুঁজিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা আনা যায়। তাই মনে হয় এসব কিছুকে একটা সুসংহত রূপ দিতে হবে। অনেক সময় লাগবে কিন্তু ডিপ্লোম্যাসি ছেড়ে বেরিয়ে যা সমস্যা তাকে পরিষ্কার চিহ্নিত করে সম্ভাব্য সমাধান ও সমাধান পরবর্তী কথাগুলো সকলে মিলে ভেবে রাখতে হবে। দেখতে পেতে হবে যে সমাজকে চাইছি তাকে দেখতে কেমন। তাতে সমস্যা কী কী আসতে পারে।
তোমার সঙ্গে দেখা হোক বা না হোক মেহের, তুমি জানবে আমার স্বপ্ন আমার উদ্যম তোমার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। তোমার মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেইসব দিন? জার্মান দেশে গুপ্তচরের কাজ করা। রুদ্ধশ্বাস সময়। কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প, ডিপোর্টেশান, শিল্পীদের দেশছাড়া করা, বই পোড়ানো।
আমি ঘুমের মধ্যে এখনও চমকে উঠি মেহের।
তোমাকে এভাবে কেন লিখি জানো। নির্দ্বিধায় তোমাকে "আমার" ভাবতে পারি বলে। আসলে এরকম কি হয়? একজন মানুষকে "আমার" ভাবা যায়? যায় হয়তো। আমি চাই। অনেকেই চায়।
এ লেখা দীর্ঘায়িত করব না মেহের। দেখা হলে ভালো হত। অনেক কাজ। ক্লান্ত বোধ করি মানবসম্পদের অভাবে। সম্পদ তো আকরিক থেকে গড়ে নিতে হয়। সেও কি সহজ?
যেদিকে তাকাই দেখি বেশিরভাগই শূন্য থেকে শুরু। দেখা হলে আরো অনেক কিছু বলা যাবে।
না দেখা হলেও বলা রইল।
সুস্থ থেকো। কী জানি, হয়তো অন্য কোনো পৃথিবীতে দেখা হবে। যেখানে এত হিংসা নেই। অনেক অবসর আছে জীবনকে পাওয়ার৷