সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মানস দেখল সৌম্য অনেক আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে। মানসের একটু বেলাতেই ওঠার অভ্যেস। তার ওপর আবার বেড়াতে এসে এই সকাল সকাল উঠে পড়া ওর পোষায় না। তাই বেশ কয়েকবার দার্জিলিং গেলেও আজ অবধি ওর কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখা হয়নি।
মানস হাতমুখ ধুয়ে নীচে নেমে দেখল সৌম্য এর মধ্যেই এই হোমস্টের মালিকের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। দু’জনে বিশাল বড় বড় দুটো মাটির মগে চা খাচ্ছে। মগটার গায়ে নানা রঙের চিত্রবিচিত্র করা। এইটাই এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। বাড়ির দেওয়ালে-পোষাকে-আসবাবে-তৈজসপত্রে রঙের ছড়াছড়ি। সম্ভবত প্রকৃতিতে রং কম, তাই মানুষ এইভাবে সেই খামতি পূরণ করেছে। হোমস্টেটাও সেই ধারার বাইরে নয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র বহু রঙের ছবি। তার মধ্যে নীল রঙের আধিক্য লক্ষণীয়। কোথাও পেখম মেলা ময়ূর, তো কোথাও হাওদা দেওয়া হাতি, কোথাও বা রাধাকৃষ্ণ। প্রতিটা ঘরের মধ্যে দেওয়াল জোড়া আয়না। দেখলে মনে হয় শিশমহলে রাত কাটাচ্ছি।
গপ্পোগুজব শেষ করে ওপরে দোতলায় উঠে এল সৌম্য। খানিক ফোন নিয়ে নাড়াঘাঁটা করল। তারপর বিছানায় শুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে রং বেরঙের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রইল। মানস ওকে আর না ঘাঁটিয়ে নিজের ফোনে গে ডেটিং সাইট খুলে আশপাশের লোকজনের প্রোফাইল দেখতে লাগল। উত্তর ভারতের এইসব ফর্সা, লম্বা, রোমশ পুরুষদের ওপর ওর একটা আলাদা দুর্বলতা আছে। ইন ফ্যাক্ট এই জন্যই লম্বা, সুঠাম সৌম্যকে দেখলে ওর একটু একটু বুকে কাঁপন ধরে।
বেশ খানিকক্ষণ বাদে সৌম্য মুখ খুলল। “কী রে, তখন থেকে ফোনে নিয়ে কী দেখছিস?”
মানস মুচকি হেসে বলল, “তুই তো আর পাত্তা দিবি না, তাই আশেপাশে কিছু পাওয়া যায় কিনা, দেখছি।”
- খুনের তদন্তে এসেও তুই ছিপ ফেলছিস? তুই আর শোধরালি না।
- আমি কি আর তোদের মতো ঘরেলু ইনসান? আমি হলাম যাকে বলে ফ্রি বার্ড।
- তা ছিপে কিছু উঠল?
- ধুস্! এই সব শালারা আমার মত টোপে পা দেয় না। এদের পছন্দই আলাদা।
- কী বললি, কী বললি?
উত্তেজনায় উঠে বসল সৌম্য। মানস অবাক হয়ে বলল, “বললাম যে এদের পছন্দ আলাদা। এরা আমার মতো মোটা কালো লোকজনকে পাত্তাই দেয় না। নিজেরা সব রাজপুত্তর তো।”
সৌম্য তড়াক করে খাট থেকে নেমে আইপ্যাড খুলে বসে পড়ল। খানিকক্ষণ গুগল করল কী সব। তারপর রজতকে ফোন করে কিছু নির্দেশ দিল ও। তারপর ফোন করল দিব্যেন্দুকাকুকে। একটা ফোন নম্বর দিয়ে বলল, এই নম্বর থেকে গত কয়েকদিনে কোথায় কোথায় কল হয়েছে একটু দেখতে। বিশেষত, ওদের জয়পুর আসার আগের রাত্রে, অর্থাৎ যখন ওরা জীবন লজে গিয়েছিল। তার সঙ্গে এটাও বলে দিল, যে উনি যেন এখানকার এস পি-র সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দেন। দরকার পড়তে পারে। সব কাজ শেষ করে মানসকে বলল, আজ দুপুরে পরোটা আর লাল মাস রান্না হবে। এখানকার লাল মাস দারুন টেস্টি। তবে লোভে পড়ে যেন বেশি খেয়ে না ফেলে। বিকেলের দিকে দৌড়োদৌড়ি করতে হতে পারে।
দুপুরে পরোটা আর লাল মাস খেয়ে উপরে আসার খানিক বাদে সৌম্যর ফোনে একটা কল এল। মানস কান খাড়া করল। ও জানে, যে এখানে সৌম্য কেস সল্ভ করতে এসেছে এবং সেটা গোপনীয়। তাই বলে মানস, যে কিনা এক কথায় সঙ্গে চলে এল, তাকেও কিছু জানাবে না? থাক, জানাতে হবে না। মানসও কিছু জানতে চাইবে না। তবে শুনতে আপত্তি কী? যদিও শুধু এক দিকের কথা, তবুও যদি কিছু আন্দাজ করা যায়।
- হ্যাঁ কাকু, বল। কিছু পাওয়া গেল?
……
- গ্রেট। আচ্ছা, নম্বরটা বল তো, একটু লিখে নিই।
……
- হুম। ফোন লোকেশন?
……
- আর এই নম্বর থেকে অন্য কোথাও ফোন গেছে?
……
- গুড। তুমি তাহলে একটু এখানকার এসপিকে বলে দাও, যে আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওঁর অফিসে পৌঁছচ্ছি। ততক্ষণ উনি যেন কাউকে পাঠিয়ে একটু নজর রাখেন। এত কাছে এসে পাখি যেন ফুড়ুৎ না হয়ে যায়।
……
- আরে না না, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। কোনো গোলমাল হবে না।
ফোন রেখে সৌম্য মানসকে বলল, “না উঠে পড়ে জামাকাপড় গুছিয়ে ফেল। রাজস্থান ভ্রমণ মনে হচ্ছে শেষ।”
মানস খানিক অবাক, খানিক হতাশ হয়ে বলল, “শেষ? এর মধ্যেই খুনি ধরা হয়ে গেল?”
সৌম্য একটু হেসে বলল, “ধরা এখনো হয়নি, তবে খুব শিগগিরই হয়ে যাবে। তবে আমি ধরি নি।”
মানস আরো খানিক অবাক হয়ে বলল, “তবে কে ধরল?”
- তুই আর তুহিন। না, আর দেরি করিস না। এরপর মুনলাইট সোনাটা শুরু হয়ে যাবে।” এইটুকু বলে ড্রেস চেঞ্জ করতে বাথরুমে ঢুকে গেল সৌম্য।
***
রজত যখন তুহিনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তুহিনদের বাড়িতে এখনো একটা চাপা শোকের ছায়া। রজত চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা প্রথম দিনের মতই আছে। শুধু দেওয়ালে ঝুলছে তুহিনের একটা হাসিমুখের বড় ছবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা।
রজত বসার খানিক পরে ঘরে ঢুকল পৃথা। আজকে পরনে একটা হাল্কা সবুজ রঙের চুড়িদার, সাদা ওড়না। চেহারায় শোকের ছায়া অনেকটা কম। সম্ভবত খানিক আগেই স্নান করে বেরিয়েছে। রজত লক্ষ্য করে দেখল, চুল থেকে এখনও অল্প অল্প জল ঝরছে।
রজত মাপ চেয়ে বলল, “সরি, হঠাৎ করে এসে পড়ে আপনাকে বিব্রত করলাম।”
পৃথা একটু শুকনো হেসে বলল, “না, কোনও অসুবিধে হয়নি। বলুন, এবার কী জানতে চান?”
রজত বলল, “কলকাতায় আপনার কেউ আছেন, যেখানে গিয়ে আপনি দু’-একদিন মেয়ে সমেত আত্মগোপন করতে পারেন? কেউ অনুমানও করতে পারবে না, যে আপনি ওখানে আছেন?”
পৃথা খানিক ভেবে বলল, “মহেশ থাকে টালিগঞ্জে। আমি ওর কাছে গিয়ে উঠলে কেউ জানতে পারবে না।”
রজত বলল, “তাহলে এক্ষুনি যেভাবে আছেন সেইভাবে বেরিয়ে, বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাতে উঠে পড়ুন। আপনার মেয়েকে আপনি রাস্তায় স্কুল থেকে তুলে নেবেন।”
পৃথা হতবাক হয়ে বলল, “কিন্তু কেন?”
রজত সংক্ষেপে বলল, “আপাতত এটুকুই জানুন, যে আপনার নিরাপত্তার জন্য এটা প্রয়োজন।”
“আর আমার জিনিসপত্র?”
রজত বলল, “একেবারেই যেটুকু না হলে নয়, সেটুকুই হাতব্যাগে নিন। বাড়ির কোনও লোক যেন কিছু সন্দেহ না করে। দরকার পড়লে আপনার বন্ধুকে দিয়ে কিছু কিনিয়ে নেবেন। সঙ্গে কিছু টাকা রাখতে চাইলে আমার থেকে নিতে পারেন। পরে শোধ করে দেবেন।”
পৃথা তবুও দোনোমনা করছে দেখে রজত বলল, “এটা আমার নয়, সৌম্যর ইন্স্ট্রাকশন।”
পৃথা বলল, “মহেশকে একটা কল করতে পারি?”
রজত বলল, “করুন। কিন্তু তাড়াতাড়ি করবেন আর কেউ যেন জানতে না পারে।”
পৃথা উঠে গিয়ে নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। মিনিট পনেরো বাদে বের হয়ে এল। রজত দেখল ঠোঁঠে হাল্কা করে একটু লিপস্টিক ছুঁইয়েছে পৃথা। চোখের পাতায় কাজল। রজত মনে মনে একটু হাসল।
পৃথাকে গাড়িতে বসিয়ে রজত বলল, “কোথাও থামবেন না। মেয়েকে নিয়ে সোজা মহেশবাবুর ওখানে চলে যান। নিজের ফোনটাকে অফ করে রাখুন। আর এই ফোনটা সঙ্গে রাখুন, বিশেষ দরকারে কাউকে কল করতে। মনে রাখবেন দু’-এক দিনের ব্যপার। এর মধ্যে টিভি, খবরের কাগজে যাই দেখুন না কেন, ভুলেও বাবা-মা আত্মীয়স্বজন কাউকে ফোন করবেন না।”
এরপর পৃথার হাতে একটা প্লাসটিকের জিপলক ব্যাগ দিয়ে বলল, “এতে ঋকের বাড়ি থেকে পাওয়া তুহিনের ইনহেলারটা আছে। সৌম্যর ধারণা, এর মধ্যেই বিষ মিশিয়ে তুহিনকে খুন করা হয়েছে। ও ঝুনঝুনু থেকে ফিরলেই আমরা এটার টেস্ট করব। তার আগে আপনি কিন্তু এটা খুলবেন না বা ধরবেন না। আপনার হাতের ছাপ যেন না লাগে।”
পৃথা অবাক হয়ে বলল, “এটায় তো আমার হাতের ছাপ থাকবেই। এটাই তো ওকে সেদিন যাওয়ার সময় আমি দিয়েছিলাম।”
রজত আরও অবাক হয়ে বলল, “তাই?” তারপর বলল, “ঠিক আছে, আমি সেটা সৌম্যকে জানিয়ে দেব। আপাতত, এটা আপনার কাছেই রাখুন। কাউকে বলবেন না।”
গাড়িটা পৃথাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর রজত পকেট থেকে নিজের ফোনটা বার করল। এতক্ষণ সাইলেন্টে থাকায় লক্ষ্য করেনি যে সোহিনীদেবী পাঁচবার ওকে এর মধ্যেই ফোন করে ফেলেছেন। রজত সৌম্যকে মেসেজ করে বলল, “পাখিকে দানাসমেত উড়িয়ে দিলাম।” তারপর ভয়ে ভয়ে সোহিনীদেবীকে কল করল ও।
“কোথায় যে থাকিস সব। সকাল থেকে অন্তত পঁচিশবার ফোন করেছি, ফোন তোলার নাম নেই। কী করছিস? বাড়ি কখন আসবি?”
রজত সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, “কেন ফোন করছিলে কাকিমা? কিছু প্রবলেম?”
“প্রবলেমের কি আর শেষ রেখেছ তোমরা দু’টিতে মিলে! ঘরে নুন পাই তো মরিচ পাই না, ছুরি পাই তো বঁটি পাই না। রান্না কি হাত পা দিয়ে করব?”
রজত কোথায় কী আছে ফোনে ভাল করে বুঝিয়ে দিল। সোহিনীদেবী ফোন রাখার আগে বললেন, “আর আজ বাড়ি আসার সময় দয়া করে একজন ফ্যানের মিস্ত্রিকে ধরে এনো। গত দু’-রাত তোমাদের ওই ঢিকিস ঢিকিস ফ্যানের কল্যাণে গরমে ঘুমুতে পারিনি। সংসারের হাল ধরার কেউ না থাকলে যা হয়।”
রজত সংক্ষেপে হুঁ বলে ফোন রেখে দিল। ধুর, ওর আর এই কথায় কথায় বাড়িতে বৌ নেই, বৌ নেই অনুযোগ শুনতে ভাল্লাগছে না। সৌম্যটা যে কবে আসবে। ও ফিরলে ওর হাতে জননীকে জিম্মা করে দিয়ে রজত নিজের বাড়ি যাবে। শাশুড়ির শখ ওর মিটে গেছে।