রোদ ফিরে ফিরে আসে এমন দিনে। চকচকে আকাশ। মেঘও আসে। বর্ষার শুরু, কেমন ফুরফুরে এসব আষাঢ় শেষের বেলা। আর এইসব ওয়েদারেই যেন ঘোষণা হওয়ার কথা পরীক্ষার। ইউনিভার্সিটির মন-মেজাজ, মর্জি-খেয়াল মাফিক ঘোষণাও হয়েছে সেসব পরীক্ষা। আমারা ঘেমে নেয়ে শরিকও হলাম সেই অলীক কুনাট্যের। আমাদের দিন গড়ালো, পড়া গড়ালো, নোটস এর পাতা পিডিএফ থেকে হার্ড কপি হয়ে উড়ল, এ টেবিল থেকে ও টেবিল। আমরাও হঠাৎ দস্তুর মতো পড়াশুনো করলাম। এমন পড়া যাতে, হঠাৎ আবিষ্কার হওয়া শব্দবন্ধ "অফলাইন" কে জুজু দেখানো যায়। বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি এই সব শব্দ দের টের পেতে থাকলাম এই সময়েই। বাইরে আবার এই সময়ে অন্য আকাশ বয়ে যাচ্ছে, তবু তো এরই নাম সেমিস্টার। মন লাগাও বিনা কাজে..
এই কদিনে বুঝেছি কি ভাবে আকাশ আর আমরা বদলাই। আমাদের কলেজ পথ, মিনিবাস, ঘোমো শার্ট থেকে পদাবলীর ক্লাস। তারপর তপ্ত দুপুর। এই সবেই আসলে যে সুর ছিল তা ভরা পরীক্ষার মরশুমে উপলব্ধি করি, তখন সময় পেড়িয়ে এসছি অনেক। অভিসার থেকে শুরু হয়ে কখন সেইসব ক্লাস মাথুরে এসেছে খেয়াল রাখিনি। মানে এসব প্রয়োজনের ধার কাছ মারাইনি, অসহ্য ক্লাস এগিয়েছে তার তালে। আমি শুধু মিনিবাসের জানলার সিট চেয়েছি প্রতিদিন। আর কিচ্ছুটি নয়। আমার পদাবলী তাই এই বাজারে এসে মেলে, নোটস সমুদ্রে কোথায় যাব..
মেঘ রোদ বৃষ্টির কমপ্যাক্ট মিশ্রণে আকাশ এদিকে তৈরি। বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে, আটকে যাচ্ছি বারবার। কান থেকে ইয়ারফোনে মুহুর্মুহু বদলায় গান। অপরিচিত এক ব্যান্ডের প্লেলিস্ট চালিয়ে দিই। মর্ডান ফোক চলনের সেই সব গানই টানলো এই কদিন। ওদিকে আমার কলেজের পথ বদলেছে, এক্সামিনেশন সেন্টারে। চেনা রাস্তা যেমন খুঁজে পাইনা, তেমন চেনা গানও নেই। নতুন পথ যেন আরও বিস্তৃত। চৌবাচ্চার তেলাপিয়া কে যেমন পুকুরে এনে ফেললে কূল পায়না, আমিও তেমন কলেজ খুঁজতে খুঁজতে বৈঠকখানা বাজারের অন্য গলিতে মিশে যাই। মশলা, সবজি, লোকাল ট্রেনের মানুষ এই পথ সবারই। প্রথম দিন হেঁটেই তাই নতুন নতুন মানুষ দেখি। পুরনো মিষ্টির দোকানে শুকনো দানাদারের মতো বাজারের সমস্ত মানুষ যেন সাবজেক্ট প্রেডিকেট বিচার করতে করতেই দিন শেষ করে ফেলছে এখানে। এভাবেই কলেজ খুজে পাই, তারপর সিট নম্বর।
দুরন্ত বেগে পরীক্ষা চলে। আড়াই বছর পর যেন খাতা পেন্সিল ধরেছে সেমিস্টারের ছেলেমেয়েরা। তবুও লক্ষী ছেলের মতই, হাইকোর্ট না দেখিয়েই তারা পরীক্ষা দেয়। একটা পরীক্ষার পর তারা আর শুনানির কথা ভাবেনা। তারা পড়ে.. পাতার পর পাতা লিখেও ফেলে। আমিও ওদেরই দলে। শাক্ত পদাবলী লিখতে গিয়ে তাই দেখি সম্পূর্ন কমলাকান্তই ভুলে গেছি, মাথার মধ্যে রামপ্রসাদ বেজে চলেছে অবিরাম। তবুও ঠিক সাজিয়ে তুলি প্রশ্ন, উমা সঙ্গীত থেকে উজ্জ্বল নীলমণি। পরীক্ষাও চলে, পেপারও প্রসন্ন মুখেই জমা নেন পরীক্ষক। ওলট পালোট থেকে অভ্যাস সোজা হয় এই ভাবে।
পরীক্ষা শেষ হলে আবার সেই একই পথ, ফেরা ।বাজারের গন্ধ, ছানার গাড়ির আওয়াজ, কলেজের নীচে সস্তার হোটেলে তরকার মশলা কষার ঘ্রাণ.. এই সব সঙ্গে করে বাসের পথে হাঁটা। বিপর্যস্ত একটা দিনে আর কিবা অপেক্ষা করে থাকে? এইসব ভাবতে ভাবতেই যখন হাঁটি, দেখি দেড়টা দুটোর সূর্য আমার মাথার উপর। রাস্তার মোড়ে মোড়ে শহর মফঃস্বল থেকে আসা পরীক্ষার্থীদের ভিড়। তাদের বাবা মাও তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়। খেয়াল হতে হতেই বাস এসে পড়ে হঠাৎ, উঠতে হয়। অথবা কোনও কোনও দিন ধরতে হয় ট্রেন।
এমনই দিনে মেঘ রোদ্দুরে ইনিংস চলছে উপরে, আমি বাসের শেষ সিটের উপর থমকে যাই, বা-দিকের ভর্তি লেডিস সিট কাটিয়ে একটা মেয়ের জেনারেল সিটের সামনে এসে দাঁড়ায়। সম্ভবত মফঃস্বলের কোনো তরুণী, কলেজ ব্যাগ নিয়ে সেও হয়তো সেমিস্টারের পরীক্ষা দিয়ে ফেরে। মিনিট দুয়েক পর তার পাশে এসে দাড়ায় তার মা। আমায় সিটের কথা জিজ্ঞেস করলে, তাকে বসার মতো জায়গা করে দিই। ভদ্র মহিলা বসেন। কথা চলে তার মেয়ের সাথে তার, মাঝে মাঝে সেই কথায় যোগ দেয় পাশের সিট থেকে মেয়ের বন্ধুরাও। আমার ফিরতা ইয়ারফোন ভেদ করে তাদের সোচ্চার কথারা ঢুকে আসে যখন, ততক্ষনে সেই মেয়েটি একটি জেনারেল সিট নিয়ে আমার সামনে এসে বসেছে। ভদ্র মহিলার সোচ্চার কথারা আমার গান শোনাটাকেও খুব একটা পাত্তা দেয়না। তাই আমিও গান থামাই। শুনতে থাকি তাদের কথা। কথায় কোলে মার্কেট থেকে কেনা নতুন ফলের কথা যেমন আসে তেমনই আসে কলকাতার সাথে তার স্বাদের হেরফেরের কথা, আসে আমের দর। এর মাঝেই ভদ্র মহিলা দুবার আমার সাথে আলাপ জুড়েছেন, আমিও না ভালোলাগলেও মাস্ক ঢাকা বিরস মুখে সেসব প্রতিউত্তর করে গেছি। এখন শুনি তিনি তার মেয়েকে এবং তার বন্ধুদের ফল খাওয়ানোর জোরাজুরি করছেন, মেয়েটি তার মায়ের বায়নাও লোক সম্মুখে বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এসব কিছুই আমায় চমকায় না, আমি মাঝে মাঝেই চেষ্টা করি মেয়েটির দিকে তাকাতে, ওর অভিব্যক্তি দেখার চেষ্টা করি। গোটাটা বিরক্তি লাগলেও, আমার শহুরে মন সেখান থেকে উঠে যেতে পারে না। কোনো ক্লাইম্যাক্স এর অপেক্ষা করে। তখনই ভদ্রমহিলা আমার নেমে যাওয়ার স্টপ জিজ্ঞেস করেন, দু- এক কথায় উত্তর দিই। তিনিও অমনি তার ব্যাগ থেকে বাড়িয়ে দেন কিছু ফল আমার দিকে, আমি নিতে না চাইলে, তিনি আবার সাধেন সেসব ফল। সেই সব ফল প্রিয় হলেও শহুরে সহবৎ মেপে আমি অস্বীকার করি সেসব, তারপর বাসস্টপ এর নাম বলে তাদের সামনে থেকে উঠি, এবং কিছু পরেই নেমে যাওয়া।
নামতে নামতে তাদের গ্রাম্যতা যেমন চোখে পড়ে, তেমনই আমিও মিসফিট কতটা, তা বুঝতে পারি। শহুরে সহযাত্রীর সহবৎ আমায় তাড়া করে অনেকটা পথ জুড়ে। মনে পড়ে, এতো কিছুর পরেও তো তাদের জিজ্ঞেস করিনি, কতদূর যাবেন তারা? ফিরত চোখে দেখি বাসটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে এই মাত্র জোড়ামন্দির ছুলো..
প্রতিদিন এভাবেই বাড়ী ফিরি, রুটিন মেনে পরীক্ষাও শেষ হয়। বৈঠকখানা, বাগুইআটি, শিয়ালদা, সোনারপুর, মানিকতলা করতে করতে আমারও পথ শেষ হয় এক একদিন, একেক গন্তব্যে। বৃষ্টি আসে, জামা ভেজে সবই হয় আকাশের দায়ে। আমার তাই প্রতিদিনের ফেরার রুট বদলায়, মনে পড়েনা শেষ কবে লাইব্রেরীর মাঠে আড্ডা মেরেছিলাম, অথবা শেষ কবে কাউকে প্রাণ খুলে কোনো কথার রিপ্লাই লিখেছি। এই যত দোষ তাই আড়াই বছর পর গড়ে ওঠা পরীক্ষা বোধেরই, এসব করতে করতেই যখন আমার সহবৎ নিয়ে বাসটা মিলিয়ে গেল, তখনই বৃষ্টি আসে.. আমার ফোনে নোটিফিকেশন ঢোকে তখন, কেউ এই শহরেরই অন্য এক প্রান্তে বসে আমায় লেখে, বৃষ্টি এলে না ভেজার কথার, ছাতা সঙ্গে নিয়েছি কিনা.. এই সব। ব্যস্ত হাতে তার প্রতি উত্তর দিতে গিয়ে দেখি, পরীক্ষার কুনাট্য থেকে আমি এখন অনেক দূরে, একটা অদ্ভুত আকাশের তলায় আমি, অমনি লিখে ফেলি একটা টেক্সট। রিপ্লাই.. আমার আষাঢ় শেষের বেলা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।