সিগারেটটা ধরানোর আগে একবার আড়চোখে রজতকে দেখে নিল সৌম্য। ডাইনিং টেবিলে বসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে একমনে শশা কাটছে। শশা কাটার প্রতি এতটাই মনোযোগ, যে দেখলে মনে হবে এই শশার কুচির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ওপর পৃথিবীর ভবিষ্যত নির্ভর করে আছে। সৌম্য জানে এটা আসলে শীতল যুদ্ধের লক্ষণ। ঝড়ের আগের থমথমে অবস্থা। যে কোনো সময় কালবৈশাখী এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে।
কাল রাতে একপ্রস্থ ঝগড়ার পর থেকে আপাতত কথা বন্ধ। এই গুমোট কতক্ষণ চলবে ও জানে না। তবে নিশ্চিত আরেক দফা কথা কাটাকাটি হওয়ার আগে এই মেঘ কাটবে না। মোটামুটি প্রতিবারই, রজতের মা – মানে সোহিনীদেবীর – এই ফ্ল্যাটে আসার আগে এটা ওদের ধরাবাঁধা রুটিন। তার মানে এই নয়, যে রজত চায় না সোহিনীদেবী এখানে আসুন। বরং উল্টো। নিজের মা না থাকায় সোহিনীদেবী এলে রজতের ভালই লাগে। কিন্তু উনি এলেই ওকে এই বাড়ি ছেড়ে বাবার কাছে চলে যেতে হয়, এটা ওর না-পসন্দ। নিজেকে কেমন অপাংক্তেয়, অচ্ছুৎ মনে হয়। সৌম্যই বা কী করতে পারে? বাবা অল্প বয়সে চলে যাওয়ার পর এই মা ওকে একা হাতে বড় করেছেন, পড়াশুনো করিয়েছেন। যদিও পেশায় স্কুল শিক্ষিকা, তবুও শহরের হাওয়া থেকে দূরে থাকা সোহিনীদেবী যে এই সম্পর্কটা মেনে নেবেন না, সে ব্যাপারে সৌম্য ষোলোআনা নিশ্চিত। তাই এই বয়সে মাকে আর কোনো ধাক্কা দিতে চায় না ও।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সৌম্য সবে সিগারেটটা ধরাতে যাবে, এমন সময় সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা বেজে উঠল। ডিলানের “হাও মেনি রোডস মাস্ট আ ম্যান ওয়াক”। সৌম্যর খুব প্রিয় গান। রজতেরও। বিশেষত ওই লাইনগুলো,
“And how many years can some people exist, before they’re allowed to be free? Yes, and how many times can a man turn his head and pretend that he just doesn’t see?”
সত্যি আর কতদিন এইভাবে নিজেদের সম্পর্ককে পরিবার পরিজনের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে কে জানে?
সৌম্য ফোনটা তুলল। দিব্যেন্দুকাকু, মানে রজতের বাবার ফোন।
“গুড মর্নিং, কাকু।”
দিব্যেন্দুকাকু ওপার থেকে ভারী গলায় বললেন, “আর গুড মর্নিং। সকাল থেকে যা দৌড় চলছে।”
- কেন কাকু? কী হল?
- আর বল কেন? সকাল সকাল মিনিস্টার তুষার মিত্রর ছেলের বডি পাওয়া গেছে দমদম সেভেন ট্যাংকসের কাছে এক গলির মুখে। সেই নিয়ে চলছে তুলকালাম।
- তুষার মিত্রর ছেলে? মানে তুহিন মিত্র?
- তুমি চেন নাকি?
- আমরা তো একসঙ্গে প্রেসিতে ছিলাম তিন বছর। রজতও কমবেশি চেনে। কী হয়েছিল? এনি ফাউল প্লে?
- সেটা এখনও জানি না। তবে কিছু খটকা আছে। তাই তোমাকে ফোন করলাম।
- কাকুর কি তবে ছেলে আর জামাইয়ের গোয়েন্দাগিরির ওপর একটু হলেও ভরসা হয়েছে?
সৌম্যর প্রশ্নে অট্টহাস্য করে উঠলেন দিব্যেন্দুবাবু। তারপর বললেন, “অতটাও বিশ্বাস হয়নি যে একটা হোমিসাইডের কেস তোমাদের দেব। সে গুড়ে বালি। তোমাকে ফোন করলাম অন্য কারণে। আসলে কানাঘুষোতে শুনলাম যে ছেলেটি গে। এদিকে বাড়িতে বৌ-বাচ্চা আছে। যা তদন্ত করতে হবে সেটা পাঁচকান বাঁচিয়ে। তাই সরকারিভাবে এই গে অ্যাঙ্গেলকে বেশি নাড়াঘাঁটা করা যাবে না। বোঝই তো, সব রাজা-উজিরের ব্যপার। তো সেই কারণেই তোমাদের ফোন করা।”
- গে খুনে গে গোয়েন্দা?
আবারও হেসে উঠলেন দিব্যেন্দু। তারপর বললেন, “আসলে খুন কিনা, সেটাই এখনো জানা নেই। বাইরে তো কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, শুধু পায়ের তলায় একটা আটকে থাকা কাচের টুকরো ছাড়া। দেখে মনে হচ্ছে সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। আজকাল তো হার্ট অ্যাটাক একেবারে জলভাত হয়ে গেছে। তবু পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট এলে শিওর হওয়া যাবে।”
- তাহলে? এনি রিজন টু সাস্পেক্ট ফাউল প্লে?
- আসলে একটা খটকা। তুষারবাবুর কথামত অফিসের কাজে ওর এখন মুম্বাই থাকার কথা। পরশু গেছে, আগামীকাল ফেরার বুকিং। তাহলে যার মুম্বাই থাকার কথা, সে টালা ট্যাংকের কাছে মাঝরাতে কী করছিল? তাও আবার কোনো লাগেজ ছাড়া? এদিকে অফিসের কথামত তুহিন নাকি পার্সোনাল কাজে মুম্বাই গেছে, অফিস এর কোনো কাজে নয়। কী পার্সোনাল কাজ – সেটা অফিসের লোকেরা জানে না। আরও দু’-একটা কনফিউশন আছে। সেগুলো না হয়, দেখা হলে বলব। তা তুমি আর রুপু আসবে নাকি একবার তুহিনের বাড়ি? আমি ওদিকেই যাবো বলে বের হচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমাদেরও ডেকে নেই।
একবার রজতের দিকে দেখল সৌম্য। ও এখনও এক মনে শশা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যে কানটা এদিকে খাড়া। বাবা আর পার্টনারের মধ্যে কী কথা হচ্ছে, সেটাই শুনছে।
সৌম্য ফোনটা মুখ থেকে সরিয়ে বলল, “কাকু কল করেছেন। তুহিন, আমাদের সাথে প্রেসিতে পড়ত, ও আজ সকালে মারা গেছে। সেই ব্যপারেই কাকু আমাদের একটু হেল্প চান। যাবি?”
রজত শুধু ছোট করে বলল, “হুঁ।”
সৌম্য আবার ফোনটাকে কানে লাগিয়ে বলল, “ওকে কাকু, আমরা আসছি। কোথায় আসব বল। তোমার ওখানে লালবাজারে, না ডায়রেক্ট তুহিনদের বাড়িতে?
দিব্যেন্দুবাবু বললেন, “ডায়রেক্ট ওখানেই চলে যা। আমি অ্যাড্রেস হোয়াটস্যাপ করে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, আবার ঝগড়া করেছিস?”
সৌম্য কাকুর এই তুমি থেকে তুইতে চলে যাওয়াটা লক্ষ্য করল। কাকু এখনও তুমি আর তুইতে গুলিয়ে ফেলেন। ছোট্ট করে হেসে বলল, “হ্যাঁ কাকু। তুমি তো জানই।”
“জানি তো বটেই। কিন্তু তুইও এবার তোর মাকে তোদের ব্যপারটা বলে দেওয়ার কথা ভাব। আমিও তাহলে ওঁকে বেয়ান বলে ডাকতে পারি। তুই কিন্তু আমাকেও বেয়ানসুখ থেকে বঞ্চিত করছিস।”
সৌম্য একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল, “হ্যাঁ, দেখি এইবার।” তারপর কথা ঘোরানোর জন্য জিজ্ঞাসা করল, “কখন পৌঁছতে হবে বল।”
দিব্যেন্দুবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, “এখন তো সাড়ে এগারোটা। তোরা তাহলে একটা নাগাদ পৌঁছো। তবে খেয়াল রাখিস, প্রচুর মিডিয়া থাকবে। ভুলেও কিছু বলিস না যেন।”
- তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমরা দু’জন একটার আগে পৌঁছে তোমার জন্য ওয়েট করব। তুমি এলে তারপর ঢুকব।”
- “ঠিক হ্যায়। আমি পৌঁছে কল করছি। রাখছি এখন।” দিব্যেন্দুবাবু কলটা কেটে দিলেন।
সৌম্য হাতে ধরে রাখা সিগারেটটা জ্বালাল। তুহিন নেই, ভাবতেই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। যদিও গত কয়েক বছর তেমন যোগাযোগ ছিল না, তবুও তুহিনকে আর কখনো চাইলেও দেখতে পাবে না, এটা ভাবতেই সৌম্যর মনটা ভারী হয়ে গেল। প্যানডেমিক শুরু হওয়ার পর থেকে কত চেনাজানা মানুষ যে এরকম দুম করে নেই হয়ে গেছে, তার হিসেব রাখা মুশকিল। কার যে ক’দিন পরমায়ু কে জানে।
রজতকে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সৌম্য। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সরি। এবার মা এলে তোকে আর বাড়ি যেতে হবে না। তুই এখানেই থাকিস।”
***
ওলায় বসে জানলার কাচটা নামিয়ে দিল সৌম্য। এমনিতেই এসি ওর পছন্দ নয়, তার ওপর এই প্যানডেমিকের সময় মনে হয় একটু খোলামেলা থাকাই ভাল। সৌম্য ভেবেছিল তুহিনদের বাড়ি যেতে যেতে ও রজতের সাথে মায়ের এখানে আসার ব্যপারটা নিয়ে একটু কথা বলে নেবে। সোহিনীদেবী রজতকে চেনেন সৌম্যর বন্ধু এবং ওদের ডিটেক্টিভ এজেন্সি সৌরলোকের পার্টনার হিসেবে। তিনি জানেন, যে কাজের প্রয়োজনে রজতকে প্রায়ই সৌম্যর বাড়ি থেকে যেতে হয়। তাই সৌম্যর বাড়িতে সব সময়ই রজতের জন্য স্পেয়ার টুথব্রাশ, জামাকাপড়, ঘরে পরার পায়জামা, চপ্পল ইত্যাদি থাকে। কিন্তু রজত আর সৌম্য যে কাজের পার্টনারের থেকেও বেশি কিছু, সেটা ওঁর জানা নেই। ফলে, সোহিনীদেবী কলকাতায় এলেই রজতকে কিছু দিনের জন্য পাততাড়ি গোটাতে হয়। এবং প্রতিবারই এই নিয়ে একটা মন কষাকষি হয়।
কিন্তু সৌম্য কিছু কথা শুরু করার আগেই রজতের ফোন বেজে উঠল। মানসের নাম্বার। মানসকে ওরা দু’জনে মজা করে কমিউনিটির শোভা দে বলে। হেন কোনও খবর নেই যা মানসের কাছে অজানা। কে কার সাথে প্রেম করছে, কে কার সাথে শুয়েছে, কে কোথায় কাকে ধোঁকা দিচ্ছে সব খবর ওর নখদর্পণে। মানস শুধু খবর রাখেও না, দেয়ও।
রজত কল রিসিভ করে স্পিকারে দিল।
- হ্যালো।
- ওই, আমি মানস বলছি রে। কোথায় তুই?
- বল। একটু বেরিয়েছি।
- তোর বরের সাথে? উহ, তোর বরটা যা হ্যান্ডু না, দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে।
রজত একবার আড়চোখে সৌম্যকে দেখল। সৌম্যর মুখে কোনও হেলদোল নেই। রজত জানে, সৌম্য এই রকম নির্বিকার মুখ করে বসে থাকলেও মনে মনে নিশ্চয়ই হাসছে।
রজত মানসকে বলল, “এখানেই আছে, ফোন স্পিকারে দেওয়া। তোর কথা সব শুনছে”।
- এ মা। আগে বলবি তো। তুই না, একটা যা তা। হ্যাঁ রে, তুহিনের খবরটা শুনেছিস?
রজত তাড়াতাড়ি করে স্পিকার অফ করে কানে হেডফোন লাগাল। একটা গোঁজা রইল ওর কানে, অন্যটা সৌম্যর। ওলার ড্রাইভার এসব কথা শুনুক, ও চায় না।
- হ্যাঁ, শুনেছি।
- সত্যি চারিদিকে কী সব হচ্ছে বল তো।
- “সিরিয়াসলি। কীভাবে কী হল, তুই কিছু জানিস?” রজত চেষ্টা করল যদি মানসের থেকে কিছু খবর আদায় করা যায়।
মানস বলল, “টিভিতে তো বলল, হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু এই রকম রাস্তার মাঝখানে তাও আবার মাঝ রাত্তিরে হার্ট অ্যাটাক? কী জানি বাবা, আমার তো কেমন গড়বড় কেস মনে হচ্ছে।”
রজত জিজ্ঞেস করল, “গড়বড় কেস মানে? কমিউনিটির কেউ?”
- হতেই পারে। আমার তো মনে হয় ওর ওই চিস্যা বয়ফ্রেন্ডটাই করেছে। কাল পার্টিতে যা ঝামেলা হল দু’জনের মধ্যে।
রজত খবরের গন্ধ পেয়ে নড়েচড়ে বসল। পরের দশ মিনিটে মানসের কাছ থেকে যা জানা গেল, তার সারমর্ম হচ্ছে গতকাল হোটেল রাঁদেভুতে একটা পার্টি ছিল। সেখানেই ওর পার্টনার ঋককে নিয়ে এসেছিল তুহিন। নাচে, গল্পে, হাসাহাসিতে সময় ভালই কাটছিল। ছন্দপতন হয় যখন আমন শর্মা বলে কলকাতায় নতুন আসা একটি ছেলে হঠাৎ তুহিনকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে একটা চুমু খেয়ে বলে বসে, “আই সো মাচ লাভ ইওর সেক্সি লং নেক”। তুহিন যদিও আমনকে সরিয়ে দেয়, কিন্তু ঋক এরপরই খুব রেগে যায়। মানস আর অন্যরা মিটমাট করানোর চেষ্টা করলেও ঋক পার্টি ছেড়ে চলে যায়। পেছন পেছন তুহিন। তারপরেই সকালে এই খবর।
রজত জানতে চায়, কেউ সকাল থেকে ঋকের সাথে কথা বলেছে কিনা। মানস বলল, যে ও কয়েকবার ট্রাই করেছিল কিন্তু ফোন বেজে গেছে, ঋক তোলেনি। সৌম্য ইশারায় ঋকের ফোন নাম্বারটা চাইতে বলল। মানস জানাল যে ও হোয়াটস্যাপ করে দেবে।
ফোন রেখে রজত সৌম্যর দিকে ফিরল।
- কী মনে হচ্ছে তোর?
- আমার মনে হচ্ছে সামনের জিপটাই আমার শ্বশুরমশাইয়ের এবং শ্বশুরমশাই খুব টেনশনে আছেন। দ্যাখ, ড্রাইভারের সিটের পেছনে কেমন হাত দিয়ে চাঁটি মেরে চলেছেন।
রজত সামনে তাকিয়ে দেখল সত্যিই তাই। ও এতটাই ফোনে ডুবেছিল, যে খেয়ালই করেনি ওরা ওদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।
গাড়ি থেকে নামার সময় ক্যাবের বয়স্ক ড্রাইভার ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বললেন, “দোনো খুশ রহো।”
সকাল থেকে গুমোট বিষণ্ণ দিনটা এই তিনটে শব্দে হঠাৎ যেন ঝলমলে হয়ে উঠল।