অফিসের কাজে আমরা সার্ভে করতে গিয়েছি জেলা সদর পেরিয়ে একটু গ্রামের দিকে। কাজ আমাদের পঞ্চায়েতের পরিষেবা নিয়ে । আমরা মানে আমি আর বৃন্দা । বৃন্দা এই সবে চাকরিতে ঢুকেছে, ওর তো খুব উৎসাহ। আমারও বেশ ভালো লাগছে। শহরের ইটকাঠ পেরিয়ে শান্ত সবুজ গ্রাম। আমরা জেলা সদর অফিস ঘুরেই এসেছি, ওখান থেকে গ্রামপ্রধানের সাথে যোগাযোগ করাই ছিল।
আমরা সরাসরি প্রধানের বাড়িতেই এলাম।
প্রধান গলা তুলে বললেন "আরে কুছ সরবৎ উরবৎ তো লাগাও। ম্যাডাম লোগ দূর দিল্লি সে আয়ে হুয়ে হ্যায়।"
কোন সম্বোধন নেই, তাই কাকে যে বললেন বোঝা গেলনা।
আমি একটু কোণাকুণি বসেছি। ঘরের ভিতর থেকে জানলার শিকের মধ্যে দিয়ে একটা লিকলিকে সরু কালো হাত গন্ধলেবুর গাছ থেকে একটা লেবু পেড়ে নিল। হাতটা খুব রোগা হলেও অস্বাভাবিক লম্বা নয়। তবু যেন শহরের আলো থেকে দূরে এই নিঝুম মত গ্রামের বাড়িতে ঐ প্রায় মাংসহীন হাতটা দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
শরবৎ এলো। নিয়ে এলো একটি যুবক।
প্রধান বললেন " আপলোগকি যো ভি পেপার ওপার হ্যায়, ইসকো দে দিজিয়ে....য়ে সব ভর দেগা.... আপ লোগ এন্হি ব্যঠকে আরাম কিজিয়ে।’’
বৃন্দা আবার তরুণ রক্ত। ও তেড়েফুঁড়ে 'সমীক্ষায় সততা' ইত্যাদি নিয়ে লেকচার শুরু করতেই যাচ্ছিল...আমি বললাম ''উসকে সাথে হামলোগ থোড়া গাঁও ভি ঘুম লেঙ্গে'' এতে উনি খুশি হলেন কিনা বোঝা গেলনা তবে সম্মতি দিলেন। বেশ পোড় খাওয়া রাজনীতিক। ওই যুবককে ডেকে নিচু গলায় কিছু নির্দেশও দিলেন।
ছেলেটির নাম পবন। পবনের সাথে আমরা সার্ভে করতে বেরোলাম। এবং ক্রমশ বুঝতে পারলাম আমরা নিজের ইচ্ছেমত চলছি না। কোন একটা অদৃশ্য সুতো আমাদের একটি ছকে চালাচ্ছে। পবন আমাদের পূর্বনির্দিষ্ট কয়েকটি বাড়িতেই নিয়ে যাচ্ছে। এবং তাদের উত্তর মোটামুটি একই রকম ।
সে যাই হোক, আমরা মোট পঞ্চাশজন মত লোকজনের সঙ্গে কথা বলব....অর্ধেক পুরুষ আর অর্ধেক মহিলাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এরকমই ভেবে এসেছি আমরা। পুরুষদের পাতা তবু ভর্তি হল কিন্তু মহিলাদের দেখা নেই।
পবনকে বলতে সে বলল '' প্যাহলে বলনা চাহিয়ে থা না ম্যাডামজি। ঔরৎ কে ভি চাহিয়ে। ওহ উস বিবি কা নাম লিখ দেতা।" আমি বলি সেরকমটা হলে হবেনা। মেয়েদের সাথেই আমরা কথা বলতে চাই।
পবন বলে ''ঔরৎ লোগ ক কুছ পতা নি হ্যায়...ওহ ক্যায়া ব্যাতায়েগা?
আমি বলি তবু ডেকো, আমরা কথা বলে নেবো।
আমরা পরের বাড়িটিতে যাই। পুরুষ সদস্যের সাথে কথা বলি, তিনি পাশের বাড়ির বন্ধুদেরও ডেকে নেন। নিজেদের সমস্যা সবিস্তারে বলেন। আমরা খুশি হই, আমাদের কাজ ভালো এগোচ্ছে।
এবার বলি বাড়ির মেয়েদেরও ডেকে নিন। শুনি “ উনহ সে ক্যায়া করনা? উনহে কুছ পতা নেহি”
বারবার এরকমই।
পর্দার তলা দিয়ে তাদের মলের ঝুমঝুম আওয়াজ শুনেছি, কিন্তু পর্দা তুলে ডাকতে গেলেই ব্যস, আর কেউ নেই, কিচ্ছুটি নেই ....কোথাও শিশুর কান্না শুনে কালো দরজা ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখি সামনে আরো একটি কালোতর দরজা সপাটে বন্ধ. বাচ্চার নামগন্ধও নেই।
এরপর বেরিয়ে রাস্তা ধরে একটু এগোতে দেখি, রাস্তার পাশে চার পাঁচটা, সাদা, কালো, মেটে ছাগল….না না, শুধু ছাগল নয়, একজন মহিলাও বুঝি ওদের মাঝে কোলকুঁজো হয়ে মিলেমিশে গেছে...মানুষ বলে একনজরে যেন বোঝাও যাচ্ছে না....
তার দিকে এগিয়ে যেতেই, সঙ্গের ছেলেটি বলে ' উসকো কেয়া পুছনা? ওহ পাগল ঔরত....
পাগল ঔরত তো আর শুধু ওই গ্রামেই নেই, আমার সাথেও আছে। বৃন্দা ততক্ষনে সড়সড় করে নেমে গেছে ওই মহিলার দিকে....
আমিও প্রায় দৌড়ে বৃন্দার সাথে যেতে থাকি... মহিলা সত্যি পাগল হলে কি জানি কি করে বসেl
আমি পৌঁছানোর আগেই বৃন্দা তাকে সার্ভের বিষয়ে বোঝাতে শুরু করে দিয়েছে।
সেই মহিলা চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাতেই আমি চমকে যাই। ‘না মানুষী’ সেই দৃষ্টি যেন বুক হিম করে দেয় । যেন যুগ যুগান্তরের নিরাশার অন্ধকার সেই দুটি চোখের ফ্যাকাশে মণিতে জমাট বেঁধে আছে। সে যেন আধুনিক যুগের কেউই নয়, তার ঝুলে পড়া ত্বকের বলিরেখার শিলালিপি যেন প্রত্নযুগের দলিল । সেই দলিল, এই ফটফটে দিনের আলোয়, আধুনিক সমীক্ষার নিরিক্ষায় ব্যাখ্যা করা যাবেনা।
বৃন্দা কে হতাশ করে সে আবার মুখটা নামিয়ে নিয়েছে। কথা বা উত্তরের তো প্রশ্নই নেই।
পবন ততক্ষণে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে “ বোলা না ম্যায়, ওহ পাগল অউরত, ওহ কিসিসে বাত নেহি করতি। উস কো কুছ নেহি পতা। ”
এরপর আমরা আরও কয়েকটি বাড়িতে ঘুরি। কোথাও উত্তর মেলে কোথাও বা মেলেনা।
বাড়ির পুরুষটির সাথে কথা বলতে বলতে জল আসে, চা ও আসে, মাথায় ঘোমটা ঢাকা, লাল চুড়ি পড়া যে হাত দুটি চা দিয়ে যায়, কথা বলতে ডাকলেই সে আর নেই। উনুনে বসানো ভাত তেমনি ফুটছে, উনুনের পাশে কাটা সব্জি তেমনি পড়ে আছে ।
শুধু সে নেই। কারণ “উসকো কুছ পতা নেহি”।
পবন কে বলি, "স্কুলে পড়া মেয়ে নেই ভাই ?তাদের বাড়ি নিয়ে চলনা।"
পবন বলে “ হ্যায় না, ম্যাডাম জি, চার পাঁচ ঠ হ্যায় । ওহ ত ছোটে হ্যায়, উনহে কুছহ পতা নেহি ।”
বৃন্দা ক্রমশ বিরক্ত হয়, আমি অবসন্ন হতে থাকি।
মনে মনে অঙ্ক কষি এই যে গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ, যারা আসলে মেয়েমানুষ, তাদের উল্লেখ আছে জনসংখ্যা গোনার তালিকায়, নাম আছে ভোটার তালিকাতেও , তারা এক্কেবারে ভ্যানিশ ।
না ঠিক ভ্যানিশ নয় ।মানুষ আর ভূতের ঠিক মাঝখানটিতে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে তারা ।
এই যে হারিয়ে যাওয়া ঝুমঝুমি গান, বন্ধ হয়ে যাওয়া কালা দরওয়াজা, জানলার ভিতরে কঙ্কালসার হাতের মালকিনেরা প্রেতিনী নয় তো কি?
এদের ছায়া, ছায়া আবছায়া উপস্থিতি বোঝা যায়, কিন্তু স্বর শোনা যায় না। এরা আছে, আবার নেই। দুধ, দই মাছ, মাংসে ভাগ না পেতে পেতে, 'ভূতের বেগার' খাটতে খাটতে শরীরগুলি কঙ্কালসার, মরা মরা চোখ কোটরে আর মুলোর মত দাঁতগুলো বাইরে। এই মরা কাঠগুলোর গায়ে ঝকমকে জড়ির শাড়ি জড়িয়ে দিলেই তো এক্কেবারে জ্যান্ত পেত্নি। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বেশ উঁচু জাতের। কি এক অজানা কারণে বর ছেলে কে কেটেকুটে রেঁধে বেড়ে সিদ্ধ করে খেয়েও নিজেরা বেশ লকলকিয়ে বেঁচে থাকে। তার সাথে আবার জমিজমাও থাকলে তখন তাদের তো শুধু পেত্নী করে রাখলে চলেনা তাদের একটা 'ডাইনি' নামের উঁচু পদে বসাতেই হয়, ...
আর তারপর একটা নিকষ কালো অমাবস্যা টাস্যা দেখে একটু সেঁকেপুড়িয়ে নিলেই হল....
দিনের আলো মরে আসছে। আমরা পবনকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসি। গ্রাম পিছনে পড়ে থাকে। গাড়ি যতই শহরে কাছে আসতে থাকে দেখি মিররে আমার আর বৃন্দার মুখদুটো স্পষ্ট হচ্ছে।
ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসে, আর বৃন্দা সমীক্ষার মেয়েলি কলামে লিখতে থাকে
Not satisfactory, not satisfactory, not..............
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।