১
‘জনদর্শন’ শব্দটা ভাষায় নূতন হওয়া স্বাভাবিক। অন্ততপক্ষে আমার চোখে খুব একটা পড়েনি। তবে শব্দটা আমার বেশ পছন্দ এবং এর মাহাত্ম্য ব্যাপক বিধায় প্রয়োগ করতে বাধ্য হলাম। ‘জন’ বলতে গণমানুষ। দৃশ্ +অন= দর্শন। এর অর্থ দেখা। দেখা বলতে শুধু দর্শনেন্দ্রিয় দ্বারা তথ্য আহরণ বোঝায় না, বোঝায় যুক্তি ও প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত মত বা সিদ্ধান্ত। আগে-পরে দর্শন নিয়ে কিছু কথা লিখেছি, বয়সের দোষে কিংবা যৌবনের উচ্ছ্বাসে খান চারেক কেতাব প্রকাশও করেছি । আপাতত সেসব কথাকে ‘ যুক্তি’ ও ‘ প্রমাণ ’ নামক দুটি শব্দবন্ধে ঢুকিয়ে দিয়ে মূল জায়গায় প্রবেশ করবো। আমাদের মতো অবাধ্যদের বাধ্য করার জন্য ‘ বাধ্যতামূলক শিক্ষা’-র বইপত্তরে শব্দদুটির যেসব তকতকে ঝকঝকে মর্ম অনুধাবনে বাধ্য করে জ্ঞানের প্রকৃত বিকাশকে বাধা প্রদান করা হয় সেসব দিয়ে আমার এই লেখায় বাদানুবাদ না করতে সনির্বদ্ধ অনুরোধ করছি। যাক সেসব কথা। জন ও দর্শন শব্দদুটি একত্র করে যে নূতন শব্দ, জনদর্শন, তৈরি হয় তার অর্থ আমরা করতে পারি জনগণের দর্শন বা গণমানুষের তত্ত্ব। আরো বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়: গণমানুষের উন্নয়ন বা সম্যক প্রগতির যে দর্শন এবং সকল প্রকার শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও জনগণের মাঝে মৈত্রী নির্মাণকারী দর্শনকেই জনদর্শন বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে, গণমানুষের প্রতিবাদী দর্শনই এই জনদর্শন। মানুষ জীবন যাপনের মাধ্যমে অপ্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় যে তত্ত্বায়ন করে বা ডিস্কোর্স নির্মাণ করে তার প্রতিফলন ঘটে এখানে। ফলে ‘ জনদর্শন ’ ব্যাপারটা একক কোনও তকমা হিসেবে ব্যবহার করা বা এর নির্দিষ্ট কিছু মাপদণ্ড নির্মাণ করা শক্ত। বলা যেতে পারে, অসংখ্য চিন্তার সম্মিলিত রূপ জনদর্শন যার প্রকৃত প্রস্তাবে নির্দিষ্ট আদল নেই৷
সাধক শাহ আব্দুল করিমের লেখায় এই জনদর্শনকে প্রগাঢ়ভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর চিন্তাধারা মানবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত এবং প্রতিষ্ঠিত শোষণবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ৷ তাঁর সৃষ্টিসমূহ পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে আমাদের দ্বিধা কেটে যাবে বলে আশাকরি।
২
একেবারে আলাপের সুবিধার্থে তাঁর চিন্তাধারাকে তিনটি ছাঁচে ভরে নিতে পারি৷ ক্যাটাগরি বা অন্যান্য কঠিন কঠিন শব্দ পরিত্যাগ করে ছাঁচ ব্যবহার করলাম। আপনারা কেউ চাইলে ‘ জামা’ শব্দের প্রয়োগ করতে পারেন৷ অর্থাৎ আমরা ওপরের কথাটা জামা দিয়েও বলতে পারি। ‘ আলাপের সুবিধার্থে তাঁর চিন্তাধারাকে তিনটি আলাদা আলাদা জামা পরিয়ে বিচার করতে পারি ’ এভাবেই বলা যায়। ‘ আধ্যাত্মিকতা’ , ‘সাম্যবাদ’ ও ‘ লৌকিক জীবন বিশ্লেষণের আলোকে সমাজচিন্তা ’ —এই হল সেই তিনটি জামা বা ছাঁচ৷
বোঝাপড়ার স্বার্থে চিন্তাকে জামা-জাঙ্গিয়া পরাতে হয়। সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হল, পরানোর কারণটা ভুলে যাওয়া। কালের নিয়মে একই জামা পরিধান করে থাকা অসম্ভব। রোজই স্নান সেরে নতুন জামা পরতে হয়, নগ্ন থাকা যায় না। অর্থাৎ চিন্তাকে সজীব রাখার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন জামায় তাকে সাজাতে হয়। একই জামা পরে থাকার অর্থ হয় না৷ আমরা যেন এই ব্যাপারটা মনে রাখি৷ আজকের প্রেক্ষিতে যে জামা পরাচ্ছি কাল সে জামা নাও লাগতে পারে৷ মৃত্যুবাসরে যে জামা পরবো তা নিশ্চয়ই বিবাহ বাসরে পরবো না৷ আজ হয়ত আমি তিনটি জামা পরাচ্ছি, কাল হয়তো অন্য জামার দরকার হবে। এই ব্যাপার সম্পর্কে সচেতন হয়েই আসুন আলাপে প্রবেশ করা যাক।
৩
আধ্যাত্মিকতা জনগণের সাথে হাজার হাজার বছর ধরে সংযুক্ত। মানব সমাজকে আধ্যাত্ম থেকে বিচ্যুত করার অর্থ মানব প্রগতির দ্বার রুদ্ধ করা। প্রগতির মানে এই না যে তাতে শুধু ভালো থাকবে। অগ্রগতি ও পশ্চাৎগতি দুইয়ের সম্মিলিত রূপই প্রগতি। সমাজ-জীবন কোনও কিছু একেবারে আগায় না আবার পেছায় না। আগানো ও পেছানোর মধ্যে একটা সমন্বয় থাকে। এটাই মহাকালচক্রের নিয়ম। তাই আধ্যাত্মিকতার দ্বারা মানুষ যেমন শোষিত হয়েছে তেমন শোষণের প্রতিবাদ করেছে। আধ্যাত্মিক বয়ান শোষকের বয়ান নির্মাণেও সহায়তা করেছে আবার শোষিতের বয়ান নির্মাণেও কাজ করেছে। অর্থাৎ তত্ত্বায়ন করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হলো আধ্যাত্মিকতা। তাই একটা ব্যাপার বারংবার চোখে পড়ে, আধ্যাত্মিকতা ছাড়া কোনও সফল বিপ্লব সম্ভব নয়। যে যাই বলুক, আপামর জনগণ আধ্যাত্মিক বয়ানকে সামনে রেখে লড়াই না করলে যেকোনো বিপ্লব ব্যর্থ হবেই। আধ্যাত্মিকতার মূল শিক্ষা হল : নিজেকে ভোগবাদ থেকে বিযুক্ত করে ইষ্টমুখী করা, সমদর্শন ও গুরুভক্তি। একে বিকৃত করে যেমন জনগণকে শোষণ করা যায় তেমন এর ঠিকঠাক প্রয়োগে বিপ্লবী বয়ান নির্মাণ করা যায়৷ শাহ আব্দুল করিমের মধ্যে আমরা সেই বিপ্লবী তত্ত্বায়ন দেখতে পাই৷ তিনি বলছেন :
বিশ্বপতি খোদা তোমার
মহিমা অপার
রাখো মারো ভাঙো -গড়ো
তুমি বিনে কেবা কার।।
সবাই দেখি যার তার ভাবে
এ জগতের সৃষ্ট জীবে
নামের মহিমা সবে
গাইতেছে অনিবার৷।
নামের ধ্বনি সর্বস্থানে ওঠে
বিরাজ করো প্রতি ঘটে
কুদরতে বুদ্ধি না খাটে
ভাবিলে নাই কূলকিনার৷।
স্বর্গ-মর্ত্য আকাশ পাতালে
আলো আঁধারে কি অনল অনিলে
কুল্লেশাইন মোহিত তুমি
অখণ্ড মণ্ডলাকার।।
মজাও হে তোমার প্রেমে
নাম যে স্মরি দমে দমে
কয় বাউল আব্দুল করিমে
ঘোচাও মনের অন্ধকার।।
এই পদ দেখার পরে এ নিয়ে কি আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে?
৪
শাহ আব্দুল করিমের লেখায় ব্যাপক জায়গা জুড়ে আছে সাম্যবাদ৷ শাহ আব্দুল করিমের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন এবং রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এর বড় কারণ। গণমানুষের অধিকারের ব্যাপারে তিনি বরাবরই সচেতন ছিলেন। শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে আলোচনার একটা বিশেষ সুবিধা হলো ‘ করিমের পদই পদের ব্যাখ্যা ’। অর্থাৎ শাহ আব্দুল করিমের পদ মনোযোগ দিয়ে দেখলে বাড়তি কোনো ব্যাখ্যা পড়তে হয় না। অত্যন্ত সরলভাষায় পদ রচনা করতেন তিনি। তাই তাঁর পুঁজিতন্ত্র বিরোধী পদ মানুষকে জাগ্রত করেছে ও উৎসাহিত করেছে লড়াইয়ে। শ্রেণীসংগ্রাম থেকে বিপ্লব কী নেই তাঁর পদে। এত সূক্ষ্মদৃষ্টি হয়তো অনেক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক কিংবা নেতাদেরও ছিল না। করিম গাইছেন:
(১)
কৃষক মজুর ভাই সবারে জানাই
কী পেয়েছ রয়েছ কার অংশে
শোষণের ফাঁদে পড়ে জনগণ কাঁদে
স্বৈরাচার মনানন্দে হাসে রে।।
…………………………….
হিন্দু-মুসলমান এক মায়ের সন্তান
গেল কতো প্রাণ বিদ্বেষে
বাঁচতে যদি চাও একে হয়ে দাঁড়াও
কৃষক মজুর মিলেমিশে রে৷।
(২)
মোদের কেউ নাই রে কৃষক মজুর ভাই
হাড়কুটা পরিশ্রম করি খাইতে নাহি পাই।
সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ সামন্তবাদ মিলে
দেশের সম্পদ লুটে নিল তিন ডাকাতের দলে।।
(৩)
শোষকের ইমারত গড়তে নাতারা পাগল
রঙবেরঙের বের হয়েছে ভোটশিকারীর দল।
(৪)
সর্বহারা শোষিত যারা আমরা ভাই ভাই
এবার করিতে হবে মুক্তির লড়াই
মানুষ মুক্তির তরে৷।
(৫)
মূলমন্ত্র সমাজতন্ত্র আসে যদি ভাই
ধনীদের চলে যাবে জীবনের কামাই।
তাইতো মাথায় বারি৷
(৬)
মূলকথা ধর্মের ভাওতা তাহার লাগিয়া
কেহ এলেন লেনিনবাদের মুখোশ পরিয়া
তারা কৃষক দরদি।
(৭)
বিপ্লব ছাড়া সর্বহারার বাঁচার উপায় নাই
তিন ডাকাত হয় দেশের কর্তা জানতো সবাই
বড়টা সাম্রাজ্যবাদ৷
‘ করিমের পদই পদের ব্যাখ্যা ’ — ওপরের খণ্ডাংশ দেখে বোধহয় আর দ্বিমত করার কারণ নেই।
৫
শাহ আব্দুল করিমের সমাজচিন্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বলাটা পরম্পরাগত সৌন্দর্যবর্ধন নয় একেবারেই। করিমের সমাজচিন্তা গড়ে উঠেছে লৌকিক জীবন বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে। করিম ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতি, ভাল-মন্দ এবং মুক্তির আকাঙক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে সমাজকে দেখেছেন৷ অর্থাৎ করিম সমাজকে ব্যক্তিবিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানতে নারাজ। তাই করিম আধ্যাত্মিকতা, মুক্তির চেতনা ও ব্যক্তি জীবনের আবেগ কোনও কিছুই তাঁর চিন্তা থেকে বাদ দেন নি। আমরা কয়েকটা নমুনা দেখতে পারি :
(১)
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম।
(২)
আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া
গান গাই আমার মনরে বুঝাই
মন থাকে পাগলপারা৷
গানে প্রাণবন্ধুরে ডাকি
গানে প্রেমের ছবি আঁকি৷
পাবো বলে আশা রাখি
না পাইলে যাবো মারা৷
(৩)
সুসময়ে ছাড়ো নৌকা বেলা বয়ে যায়
কৃষক মজুর জেলে তাঁতি আয়রে সবাই আয়।
নব রঙের পাইক সাজে জনগণের নায়
হাইল ধরিও সুজন মাঝি ইমানের বৈঠায়৷
কেউ নায়ে জল সিচে কেউ বৈঠা বায়
রঙবেরঙের বাজনা বাজে সারি গান গায়৷
ভয় করিনা ঝড় তুফানে পাইকে যদি কয়
বাউল আব্দুল করিম বলে যাবো সোনার গায়৷
শাহ আব্দুল করিমের আধ্যাত্মিক, বিপ্লবী চেতনা ও লৌকিক জীবনের আলোকে সমাজভাবনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত৷ এটাই তাঁর জনদর্শন। মানুষের সার্বিক উন্নতি এভাবেই হবে তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি বলতেন : এই পৃথিবীটা একদিন বাউলের পৃথিবী হবে৷ কথাটা হয়তো এক লাইনের তবে বেশ অর্থবহ৷ কয়েক বালাম বই লিখেও হয়তো যা বলা যেত না বা কয়েক হাজার গান লিখেও, তা করিম একটা লাইনে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে দিলেন৷ এটাই তাঁর জনদর্শন।