মাউন্ট হোলিওক কলেজ। সে আমলে নাম ছিল ইয়ং লেডিস সেমিনারি। আমেরিকার মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসের প্রথমদিককার একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে পড়তে এল ম্যাসাচুসেটসের মেরি লুইজা ব্রাউনিং। কন্যা পড়তে-শিখতে ভালোবেসে, কিন্তু হলে কি হয়! গরীব ঘরের মেয়ে, কাজ না করলে চলে না, তাই একটানা ইস্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে কলেজের পড়া শেষ করা তাঁর ভাগ্যে নেই। কিছুদিন পড়ার পরেই কানে এল, ভারতে মেয়েদের স্কুলে পড়ানোর শিক্ষয়িত্রী চাই। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মেরি চলল সুদূর ভারতে।
ভারতের মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারে কাজ করা বিদেশিনীদের মধ্যে মেরি কোনদিক দিয়েই প্রথম নন। ঔপনিবেশিকতার প্রথম যুগে হানা মার্শম্যানের মত মেয়েরা এসেছেন মিশনারি স্বামীর পিছুপিছু। তবে সে ধারা অনেকদিন হল পালটে দিয়েছেন মেরি অ্যান কু্ক। ১৮২১ সালে একাকী মিস কুক ইংল্যন্ড থেকে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন। তারপর এসেছেন-গেছেন আরও অনেক সাহেব-মেমের দল। মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে ক্ষীণ প্রদীপটি আগেই জ্বলে উঠেছে, সেটি যাতে নিভে না যায় সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দেশজ কর্তারাও কিছুজন অল্পবিস্তর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে এতকিছুর পরেও বেশিরভাগ মেয়েরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। হাতে গোনা কিছু ইউরেশিয়ান-বালিকা আর শহরাঞ্চলের সামান্য কিছু অভিজাত বাড়ির মেয়েরা ছাড়া সেদিন স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায় ক’জন? কাজেই মেরির সামনে প্রায় ফাঁকা ক্যানভাস, আঁচড়ের অপেক্ষায়।
আপাতত মিস ব্রাউনিং চললেন আগ্রায়। সেখানে মিশনারি গৃহিনী মিসেস স্কট আর মিসেস ফুলারটনের মেয়েদের স্কুলের সহকারী শিক্ষিকার পদ অপেক্ষা করছে তার জন্য। ব্যবস্থার দায়িত্বে প্রেসবাইটেরিয়ান বোর্ড অফ ফরেন মিশন। ১৮৫৫ সালের ১৭ই জুলাই জাহাজ ভাসল বোস্টন থেকে। সমুদ্রযাত্রায় তিনি একা নন, তাঁর সহযাত্রী ক্যাল্ডারউড দম্পতি আর জনসন দম্পতি। দলে আছেন আরও এক মিশনারি, ডেভিড হেরন। ক্যান্ডারউড আর হেরন অবশ্য রিফর্মড প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চের দলের। তাতে কোন অসুবিধা নেই, তাঁরাও প্রেসবাইটেরিয়ান বোর্ড অফ ফরেন মিশনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। দীর্ঘ যাত্রাপথ, কিউপিডের জমাটি জল্ভাসি বাসর। জাহাজেই মন দেওয়া-নেওয়া পর্ব সারলেন মেরি আর ডেভিড ।
কলকাতা হয়ে হেরন গেলেন দেরাদুন। দেরাদুনে উডসাইড ১৮৫৩ সালে ( নাকি ১৮৫৪? ) সালে মিশন খোলেন। সেটাই ডেভিডের নির্ধারিত কর্মস্থল। এদিকে মিস ব্রাউনিংকে পেয়ে ভারি খুশি তাঁর আগ্রার মেয়েদের স্কুল। খুবই আগ্রহ-উৎসাহ নিয়ে পড়ান তিনি। কর্তারা জানাচ্ছেন, একজন মাউন্ট হোলিওকের ছাত্রীর থেকে এমনটাই তো আশা করা যায়। তবে আগ্রা মেরিকে ধরে রাখতে পারল না। সিপাহী বিদ্রোহের মহা বিস্ফোরণ হওয়ার অল্প কদিন আগেই আগ্রা ছেড়ে মেরি গেলেন সাহারাণপুরে। ডেভিডের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। তারপর একদিন চড়ে বসলেন রাতের ডাকগাড়িতে। মাত্র তেত্রিশ বছর আগে, ডেহরা শহরের উদয়কালে, শোর সাহেব কয়েদীদের উদয়াস্ত হা-ক্লান্ত পরিশ্রমে বানিয়ে দিয়েছেন এই ডেহরা থেকে সাহারনপুরের রাস্তা। ঘোড়ার দুলুনির ছন্দে, ঘন শালবনের মধ্যে দিয়ে আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে সেই পথ ধরে মোহন পাস হয়ে দেরা উপত্যকার দিকে যেতে যেতে মেরি আগামী জীবনের স্বপ্ন বুনতে লাগলেন।
ডেভিড হেরন প্রথম থেকেই দেরাদুনের মিশনের ছেলেদের স্কুলে পড়াচ্ছিলেন। ১৮৫৯ সালে কর্তাগিন্নি দুজন মিলে একটা বোর্ডিং স্কুল খুললেন, শুধুমাত্র নেটিভ খ্রিস্টানদের পরিবারের জন্য। বছর শেষে সেখানে ছাত্রী দাঁড়াল ১৩ জন বোর্ডার, আর ৫ জন ডে স্কলার। মেরির স্বপ্ন ছিল মাউন্ট হোলিওক কলেজের ধাঁচের একটা শিক্ষায়তন বানানো। যেখানে গৃহদায়িত্বের বাইরে শুধু পড়াশোনাই মুখ্য হবে , পড়াশোনার মান হবে উঁচু - মানের ব্যাপারে কোন আপোষ করা হবে না। কখনো মেরি গোলোককে সঙ্গে নিয়ে, কখনো মিস মিলারকে, আবার কখনো ক্যাথরিন এল বেটিকে সঙ্গে নিয়ে মেরি সেই স্বপ্নপূরণে মাতলেন । সঙ্গতে ডেভিড। অবশ্য মিসেস হেরন মারা গেলেন ১৮৬৩ তে। স্কুলটা কিন্তু টিকে গেল। ডেভিড হেরন পরবর্তীকালে জানিয়েছেন যে এই স্কুল খোলার পিছনে তাঁদের “নেটিভ খ্রীস্টান” - একমাত্র এই ইন্টারেস্টিং ক্লাসটির মেয়েদের সুশিক্ষিত করার ইচ্ছে ছিল। নাহলে অশিক্ষিত মা’দের হাতে পরে খ্রিস্টান সন্তানদের বড়ই কষ্টের দশা হয়। তবে পাঠক মনে রাখবেন, এই স্কুল অবশ্য শ্বেতাঙ্গদের কন্যাসন্তানদের জন্য নয়। তাদের জন্য ল্যান্ডরে উডস্টক স্কুল ১৮৫৩ থেকেই আছে। সেও উডসাইডের তৈরি। অফিসারদের, বড় ব্যবসায়ীদের বা মিশনারিদের কন্যারা সেখানেই যায়। প্রেসবাইটেরিয়ানদের মহান সোশ্যাল জাস্টিসের আদর্শ এবং হিউম্যানিটির আলো সেই বিভেদের কালিমা ঘোচাতে পারেনি। সে কথা যাকগে।
এদিকে ১৮৬২-৬৩ সালে দেরাদুনের ছেলেদের স্কুলে একজন নেটিভ ক্রিশ্চান টিচার যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েই তার বেশ নাম ছড়িয়ে পড়েছে। রিপোর্ট অনুসারে ইনি কলকাতার স্কচ ফ্রি চার্চ স্কুলের ছাত্র। মিশনারি সার্ভিসেই থাকবেন বলে অনেক বেশি মাইনের সরকারি স্কুলের চাকরিও ছেড়েছেন। মিশনারিদের রিপোর্টেই পাওয়া যাচ্ছে এই গুণকীর্তন, তবে সেখানে এই শিক্ষকের নাম নেই। স্থান কাল পাত্র দেখে অবশ্য ধরে নেওয়া যায় ইনি হয়ত চুঁচুড়া উপজেলার মহানাদের বাসিন্দা ভুবনমোহন বসু। মহানাদ অতি প্রাচীণ জায়গা, মন্দিরময় হিন্দুসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল জায়গা। সেইখানে ১৮৫৬ সালে কিছুটা জমি কিনে ফ্রি চার্চ মিশন তৈরি করা হয়। সঙ্গে উচ্চবিদ্যালয়। ডাফ সাহেবের শিষ্য রেভারেন্ড জগদীশ্বর ভট্টাচার্য সেই কেন্দ্রের দায়িত্ব পান। ভুবনমোহন বসু কি তাহলে জগদীশ্বরকে দেখে অনুপ্রাণিত হলেন? জানা নেই। ভুবনমোহন বসুর সম্বন্ধে জানার জন্য অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন লাভ হয়নি। তাই জানা নেই কিসের টানে তিনি তখন ধর্মত্যাগ করলেন, কেনই বা কলকাতা ছেড়ে সপরিবারে সুদূর দেরাদুনে চলে গেলেন!
ভুবনমোহন বসুকে নিয়ে কেন টানাটানি? বলছি। তার আগে একটু দেরাদুন নিয়ে কথা হোক। কেমন ছিল সে আমলের দুন? জি আর সি উইলিয়াম তার ১৮৭৪ সালের মেমোয়ারে সুন্দর ছবি এঁকেছেন ঘন সবুজে ঢাকা ঢেউ খেলানো শিবালিক পাহাড়ে ঘেরা দুন উপত্যকার। হালকা জন বসতি। তার মধ্যে ১৮৭৪ সালে উপত্যকায় পাঁচশর বেশি নেটিভ ক্রিশ্চানের বাস। আর তার মধ্যে ৩০০ জনই মিশনের চাষবাষের কাজে ব্যস্ত। গোটা উপত্যকাতেই পড়াশোনার তেমন চল নেই। স্কুল বলতেও তখন ঐ মিশনারিদের স্কুলই ভরসা। উপত্যকার প্রধান শহর দেরাদুন। সেনা এলাকা ,অ-সেনা এলাকা মিলে, ইউরোপিয়ান - অ্যাংলোইন্ডিয়ান- দেশিতে জমজমাট। সেখানে বাস করে হাজার সাতেক লোক। সাহেব এও জানিয়েছেন যে কয়েকজন উৎসাহী বাঙালি মিলে একটা ব্রাহ্মসমাজও চালায়। সেই সমসাময়িক বাঙ্গালী ব্রাহ্মরা কারা ছিলেন ?
সেই সুদূর দেরাদুন থেকে ১৮৭৬ সালের নভেম্বর মাসে একটি আবেদন এসে জমা হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবেদন জানিয়েছেন ডেভিড হেরন। তাঁর মেয়েদের স্কুলের একটি ছাত্রীকে সেবারের এন্ট্রান্স পরীক্ষাতে বসানোর অনুমতি চেয়ে। সে আবেদন অবশ্য পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছেন রেজিস্ট্রার। কারণ পরীক্ষার নিয়মের যে প্রচলিত অর্থ তাতে মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জায়গা নেই। তবে আহা বেচারি মেয়েটা পরীক্ষা থেকে বাদ পরে গিয়ে যদি কষ্ট পায় তাই তাকে স্পেশাল অনুমতি দেওয়া হল অনথিভুক্ত ছাত্রী হিসেবে সে পরীক্ষা দিতে পারবে। মুসৌরির স্কুলের হেডমাস্টারের অত্ত্বাবধানে। তবে পাস যদি বা করেও, তার নাম কিন্তু পাস করা ছাত্রদের লিস্টে থাকবে না।
সে আমলে মুসৌরী যাওয়া বেশ ভজকট ব্যাপার। ডাকগাড়ি না হয় মুসৌরী পাহাড়ের পায়ের কাছের রাজপুর অবধি নিয়ে গেল। তার পর চড়তে হবে মানুষে টানা ঝাঁপান। মালপত্রর জিম্মাদার কুলিরা। তারা মাথায় করে আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে সেই বোঝা নিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। এত কিছু সামলেও মেয়েটা কিন্তু পরীক্ষা দিল আর কি আশ্চর্য! পাসও করে গেল। এবং এইবারেই আসল গল্প শুরু হল। ডেভিড হেরন একেবারে সরাসরি হোম ডিপার্টমেন্টে আবেদন করলেন যে তার স্কুলের একটি মেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেছে। খবরটা যদি হোম ডিপার্টমেন্ট যথেষ্ট গুরুত্বপুর্ণ মনে করে তাহলে যেন তারা মহারানীকে টেলিগ্রাম করে খবরটা জানায়। চার্চের তরফ থেকে সেই বছরের আমেরিকায় পাঠানো বার্ষিক রিপোর্টে একটি ছাত্রীর পাসের খবর দিয়ে জানানো হচ্চে এই পাস কলকাতায় বেশ উত্তেজনা তৈরি করেছে। ছাত্রীর নামটা অবশ্য অনুল্লেখিত থাকে। কলোনিয়াল সাহেবরা নেটিভ লোককে নামে ডাকার তুল্য মর্যাদা দিলে সাহেবের জাত যাবে না? অবশ্য সাহেবকেও তার পৃষ্ঠপোষকদের ভরসা দিতে হয় যে তারা যেন না ভাবেন যে মেয়েদের পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার আসল কাজে ফাঁকি পড়ে গেছে। ধর্মপ্রচারের কাজ ভালই চলছে।
কলকাতায় কিভাবে খবরটা নিল সবাই? সে আমলের খবর কাগজ তো সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি, তবে ‘বঙ্গমহিলা’ মহিলাদের পরীক্ষা পাসের খবরের প্রেক্ষিতে মেয়েস্কুলের উন্নতি করার দাবী তুলেছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসের সিন্ডিকেট মিটিঙে ঘোষণা হল চন্দ্রমুখী বসু এন্ট্রাস পরীক্ষায় পাস করেছেন। সেই প্রথম তাঁর নাম প্রকাশিত হল। সেই মিটিংএই তাঁরা সেনেটে আবেদন জানালেন এই বার তাহলে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টস পড়ার ব্যবস্থা করতে হয়। মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার রীতিকানুন ঠিক করার জন্যও ফ্যাকাল্টি অফ আর্টসকে বলা হল। তবে নিয়মকানুন কি আর এক কথায় তৈরি করা যায়! মাস চারেক পরে আর্টস ফ্যাকাল্টি বলল, আচ্ছা এন্ট্রান্স পরীক্ষা তো ছেলেদের সঙ্গে এক নিয়মেই দেওয়া যাবে খালি মেয়েদের পরীক্ষাটা আলাদা করে মেয়েদের সুপারভিশনে দিতে হবে, কিন্তু এফ এ বা বি এ পরীক্ষার নিয়মকানুনের জন্য একটা বাপু সাবকমিটি লাগবে। আরও ছ’মাস পরে নভেম্বর মাসে সাবকমিটি তাদের রেকমেন্ডেশন জানাল। সবার সব রকমের সম্মতি নিয়ে ২৭ শে এপ্রিল ১৮৭৮ সালে সেই নিয়মের বদল অনুমোদিত হল। আর সেই বছরই মানে ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেয়েদের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার জন্য যেসব আবেদন দিতে হবে তার ফর্মাট প্রকাশ করল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। চন্দ্রমুখীর পরীক্ষা দেওয়ার দুবছর বাদে। ১৮৭৯-৮০ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুনের তালিকায় একটা নতুন বিভাগ জুড়ল। Regulations for the examinations of the female candidates. এন্ট্রান্স পরীক্ষা অবধি নিয়ম ছেলে আর মেয়েদের এক হলেও, এফ এ বা বি এ পরীক্ষা মেয়েরা কলেজে ভর্তি না হয়েও দিতে পারবে। বিষয় নির্বাচনেও মেয়েদের কিছু সুবিধা দেওয়া হল। এই নতুন নিয়মে ১৮৭৮ এ কাদম্বিনী এন্ট্রান্স পাস করলেন, বেথুন থেকে। ( এই বিষয়টা এত বিশদে ও সাল তারিখ সহ বলার কারণ যোগেশ চন্দ্র বাগল মশাই এর বেথুন স্কুলের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে লেখা বইটি পড়লে একটু যেন অন্যরকম ধারণা হয়। )
১৮৭৯ সালের এপ্রিল মাসে আরও সিদ্ধান্ত হল যে ভুবনমোহন বসুর কন্যা চন্দ্রমুখী চাইলে ১৮৭৯ বা তার পরে যে কোন বছর ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষাতে বসতে পারেন। আনন্দমোহন বসু চন্দ্রমুখীর হয়ে সিন্ডিকেটে কথা বলে সেই অনুমতি আবারও ক্ল্যারিফাই করলেন। সেই অনুমতির জেরে ১৮৮০ সালে ফ্রি চার্চ নরমাল স্কুলের থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফ এ পাস করলেন। খ্রিস্টান বলে বেথুন স্কুলের দরজা তাঁর জন্য বন্ধ ছিল। সেই বছর কাদম্বিনীও তৃতীয় বিভাগে এফ এ পাশ করলেন।
কেমন লেগেছিল চন্দ্রমুখীর এই দীর্ঘসূত্রিতা? বিনা কারণে তার এতটা সময় নষ্ট করা? তবে একটা কথা খুব মনে হয়, ধর্মের কারণে তো এমনিতেই হিন্দুরা তাঁকে দূরে ঠেলে রেখেছিল। তাও হয়ত বিলেতফেরত বাবার মেয়ে হলে কথা ছিল, তা না কোথাকার কোন মাস্টারের মেয়ে! তার উপর দেরাদুনে থাকার কারণে কলকাতায় তাঁর তেমন কোন পরিচিতি ছিল না বলেই মনে হয়। একে বোধহয় ট্রিপল বার্ডেনই বলা যায়! পরে কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়ার সময় কাদম্বিনীর সমর্থনে প্রগতিশীল ব্রাহ্ম সমাজ এক জোট হয়েছিল আর দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় তো একাই একশ, এই জনসমর্থন চন্দ্রমুখীর ভাগ্যে জোটেনি।
তবে তাতে চন্দ্রমুখীর বিশেষ কিছু এসে যায়নি। অতঃপর দুই কন্যা একসঙ্গে ১৮৮৩ সালে বি এ পাশ করে ইতিহাস গড়লেন। ব্যাপারটা এতই নতুন রকম যে ভাইসরয় কনভোকেশনে এসে সামগ্রিকভাবে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক কথা বললেন। যদিও সে ভাষণের মুল কথা শিক্ষিত মায়ের সন্তান সুশিক্ষা পাবে আর তাই নারীশিক্ষা দরকার। যে কালের যা ধারা আর কি! কাদম্বিনী তারপর চলে গেলেন মেডিক্যাল পড়তে আর চন্দ্রমুখী ১৮৮৪ সালে ফ্রি চার্চ ইন্সটিটিউশন থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ইংরাজিতে অনার্স পাস করলেন।
একটা কথা এখানে বলা দরকার, অনেকেই বলেন যে চন্দ্রমুখী এই উপমহাদেশের প্রথম মেয়ে যিনি এম এ পাশ করেন। আমি অবশ্য তার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাই নি। তবে মনে হয়েছে এমনটা হওয়া সম্ভব যে যারাই পাস কোর্সে গ্রাজ্যুয়েট হওয়ার পরে আরও পড়তেন, তাঁদের সকলকেই এম এ পাশ বলা হত। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বার করা “গ্রাজ্যুয়েটস - এম এ” বলে একটি লিস্টে চন্দ্রমুখীর নাম আছে, যদিও নামের পাশে তারা দিয়ে বলা আছে অনার্স ইন আর্টস। তবে এম এ হোক বা বি এ অনার্সহোক , ডিগ্রি যাই হোক না কেন তাতে ভারতীয় মেয়েদের কিছু এসে যায় না। মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথে যে বাঁধটি বেঁধে দেওয়া ছিল, সেটি ভেঙ্গে গেল। ক্ষীণধারায় জলস্রোত বইতে লাগল । এরপর সে স্রোতের কুলপ্লাবী হয়ে ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
পাশ করে বেরিয়ে চন্দ্রমুখী বেথুন কলেজেই যোগ দেন। যদিও সরকারী সম্মানের চাকরিতে দেশীয় মেয়ে বোধহয় তিনি প্রথম না। ১৮৭৭ সালেই রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা মনোমোহিনী হুইলার সরকারী ইন্সপেকট্রেস হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছেন। তার আগেও কি কেউ আছেন? জানা নেই, তবে সে কথা এখন থাক। চন্দ্রমুখীর কথায় ফিরে আসি। তিনি বেথুনে ঢুকেছিলেন সুপারিন্টেনডেন্ট হয়ে। (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে) ১৮৯৪ থেকে ১৯০২ সাল অবধি তাঁর নাম পাওয়া যাচ্ছে লেডি প্রিন্সিপাল হিসেবে। ১৯০৪ সালের বেথুন কলেজ সংক্রান্ত তথ্যে আর তাঁর নাম নেই। খুব সম্ভবত ১৯০৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। উইকি জানাচ্ছে যে তিনি কেশবানন্দ মামগায়েনকে বিয়ে করেন। তবে কি বিয়ে ও সংসার তাঁর পায়ে বেড়ি পড়ালো? হতেই পারে, সবাই তো আর অবলাবান্ধব হন না। জানতে খুব কৌতূহল হয় যে যে বাড়িতে বিয়ে হল তাঁরা কি তাঁর কদর বুঝলেন? কেমন ছিল তাঁর দাম্পত্য জীবন? অবশ্য বালিকা বা কিশোরী চন্দ্রমুখীকেই বা চিনেছি কই! কারা ছিল তাঁর সঙ্গী? সমাজের কোন স্তরে তাঁদের বাস ছিল? একে বাঙ্গালী তার উপর ক্রিস্টান হিসেবে দেরাদুনের গোঁড়া হিন্দু পরিবেশে মানিয়ে নিতে তাঁদের কতটা সুবিধা-অসুবিধা হয়েছিল? মিশনারি সাহেবরা কতটা কাছে টেনে নিয়েছিলেন? নাকি ধর্মের কারণে, বর্ণের কারণে, শ্রেণীর কারণে বিচ্ছিন্নতাই তাঁদের একমাত্র সম্বল ছিল। Believing but not belonging এটাই কি তাঁদের পরিবারের ট্রাজেডি? জানার কোন উপায় নেই। কোন স্মৃতিচারণ, চিঠিপত্র কিছুই নেই। সব থেকে আশ্চর্য হল অন্যের স্মৃতিতেও তিনি ধরা পড়েছেন বলে শুনিনি। খুঁজেই যাচ্ছি। কেউ জানেন কোন সন্ধান?
মিসেস হেরনের সঙ্গে চন্দ্রমুখীর দেখা হয়নি। তবে আমার খালিই মনে হয়েছে, চন্দ্রমুখীর চন্দ্রমুখী হয়ে ওঠার পিছনে রেভারেন্ড হেরনের নিশ্চয় অনেকটা অবদান। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে মিসিং লিঙ্ক হলেন মেরি ব্রাউনিং হেরন। সলতে না পাকালে আলো জ্বলে না। চন্দ্রমুখী সম্পূর্না হয়ে উঠলেন আর মেরিকেও যেন সম্পুর্ণ করলেন।
আরেকটাও ডাইমেনশন থেকে যায়। চন্দ্রমুখীর গড়ে ওঠার পিছনে পারিবারিক পরিবেশের কতটা প্রভাব ছিল? চন্দ্রমুখী একাই নন কিন্তু , ১৮৯০ সালে তার বোন বিধুমুখী বসু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এল এম এস পাস করেন। ইনি বিয়ে করেছিলেন কিনা জানি না, তবে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে শুনেছি, সুগায়িকা ইন্দুবালার জন্মের সময় নাকি তার সার্কাস-সুন্দরী মায়ের ডেলিভারি করানোর জন্য বিধুমুখী বসুকে কলকাতা থেকে লাহোর নিয়ে যাওয়া হয়। এঁদের আরেক বোন বিন্দুবাসিনীও নাকি ডাক্তার হয়েছিলেন, কবে সে খোঁজ পাইনি। ১৯০১ সালে বেথুন থেকে রাজকুমারী বসু নামের এক কন্যা বি এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পদ্মাবতী মেডেল পান। ইনিও বোধহয় এই একই পরিবারের। পারিবারিক পরিবেশের কথা এই জন্যেই মনে এল – একই পরিবারের এতগুলি মেয়ের সেই সময়ে বসে এতদূর এগোন কি আর চাট্টিখানি কথা! শুধু স্কুলিং দিয়েই কী আর এতটা এগোন যায়? অথচ কী যে আপশোষের ব্যাপার যে এতগুলি গুণী কন্যা, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে কোন সোনার কাঠির ছোঁয়ায় যে তাঁরা সবাই জেগে উঠেলেন কেউ সেকথা একটু কিছু লিখে রেখে গেলেন না!
আর সে কারণেই এই পরিবারটি থাকেন ছায়াবৎ। কলকাতার হু'জ হুদের দরবারে তাঁদের তেমন ছায়া পড়ে না। হুগলি জেলার ইতিহাসেও ঠাঁই মেলে না এই প্রবাসী পরিবারের। উত্তরাখন্ডের কলোনিয়ান মেমরিতে এক সামান্য স্কুল মাস্টারের বা তাদের মেয়ের কথা ধরা পড়ার কোন কারণ নেই। আবার উত্তরাখন্ডের ক্রিশ্চিয়ান ইতিহাস যখন লেখা হয় তখনও সেখানে স্থানীয়দের ঠেলায় মিশনের কর্মী বাঙ্গালী পরিবারটি জায়গা পান না। সময়ের ঘুর্ণিতে হারিয়ে যাওয়াই তাঁদের ভবিতব্য।
চন্দ্রমুখী জন্মেছেন ১৮৬০ সালে। কাদম্বিনী ১৮৬১ তে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। যে সময়ে চন্দ্রমুখী - কাদম্বিনী বড় হচ্ছেন, তাঁদের সামনে প্রায় কোন রোল মডেল নেই। মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নিয়ে তখনও সমাজের মাথারা খুবই দ্বিধান্বিত, নিজেদের কন্যাদেরও স্কুলে পাঠানো তখন সর্বজনমান্যবিধি নয়, মেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা শুধু “ভাল মা, ভাল বৌ” হওয়ার গন্ডীতেই আটকানো। হাতে গোনা দুচার জন বাদে মেয়েরা নিজেরাও, এমনকি প্রবল আলোকপ্রাপ্ত পরিবারের মেয়ে হলেও, শুধুমাত্র বিয়ে আর সংসার বাদে আর কিছু ভাবতে পারছেন না। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে চন্দ্রমুখী, কাদম্বিনীর দল আমাদের জন্য একটা একটা করে দরজা খুলেছেন। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে চন্দ্রমুখী বললেন "Education is not necessarily enhancement of marriageable quality of a girl but it is a device to prepare herself to face the world with full confidence." এ যে নতুন যুগের ভাষা, নতুন আলোর দিশা! একে মনে ধারণ করতে অবশ্য আমাদের, বাংলার মেয়েদের আরও অনেক দিন লাগবে। এখনও পুরো পেরেছি কিনা সেটাও সন্দেহ!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।