এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • কোথায় তোমার দেশ গো বন্ধু? পর্ব ৮

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৯৪৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)


  • ২৬ নভেম্বর, ২০৩০ মঙ্গলবার

    “ঘুমের ঘন গহন থেকে যেমন আসে স্বপ্ন”

    ঘোড়া ছুটছে, দুলকি চালে নয়, একেবারে জোড় পায়ে। ঘোড়ার উপরে সওয়ার ওটা কে?

    আমি? না তো; আমি তো তারিণী কুমার দত্ত, পিতা চারুচন্দ্র দত্ত, সাকিন - রবীন্দ্র-পল্লী, পোস্ট অফিস - নাকতলা। না না, বর্তমান নিবাস - ডিটেনশন সেন্টার নম্বর 1276/WB, পোস্ট অফিসের নিকট নাকতলা হাই স্কুলের বিপরীতে উদয়ন সংঘের দুর্গাপুজা প্রাঙ্গণের পিছনে অবস্থিত।

    ধেত্তেরি, এটাও ভুল। এটা একটা অল্পদিনের মত পান্থনিবাস বা সরাইখানায় মাথাগোঁজা। তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে কয়েকটা রাত কাটানোর জন্য আশ্রয়। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। তাই কালো রাত বড় লম্বা, ফুরোতে চায় না। রাত কেটে গেলেই এখান থেকে বেরিয়ে পড়া যাবে।

    তাহলে সাকিন কী দাঁড়ালো? বললাম তো জারুইতলা, পূর্ব পুরুষের ভিটে। এসব তো যত্ন করে রেখে দেওয়া চিঠির গোছাতেই প্রমাণিত। তাহলে আটকাচ্ছে কিসে? ও, ওই গ্রামটা ময়মনসিংহ জেলায়। অবিভক্ত বাংলার বোধহয় সবচেয়ে বড় বা দ্বিতীয় বৃহৎ জেলা। কিন্তু দেশভাগের পর ওটা পড়ল পূর্ব পাকিস্থানে, বর্তমানে বাংলাদেশে।

    কাজেই ব্যাটা তারিণীকুমার, ওই পরিচয়ে জোর দিলে তুমি বিদেশি এবং বিনা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া এদেশে বসবাস করার জন্য ডিটেনশন সেন্টারে থাকার যোগ্য। কতদিন থাকতে হবে? কেন, শ্রীলংকা থেকে ভারতের তামিলনাড়ুতে আসা রিফিউজিরা কত বছর ধরে আছে? আর তিব্বত থেকে দলাই লামার সংগে ভারতে রাতারাতি চলে আসা লোকজন? কাংড়ার ধর্মশালায় ওদের কত বছর হয়ে গেল, প্রায় দুই প্রজন্ম।

    ইয়েস, মনে পড়ছে। ওই ঘোড়সওয়ার ভদ্রলোক ওই এলাকার থানার দারোগা। গেছলেন একটা চুরির তদন্ত করতে। ভাল করে দেখুন ওনার সাজপোশাক। খাকি হাফপ্যান্ট, মাথায় শোলার টুপি, গায়ে ছোট কোট ও ক্রস বেল্ট। কোমরে রিভলভার। আরে, দারোগাবাবুটিকে আমি চিনি। উনি আমার পিতামহের পিতামহ — রামজীবন দত্ত।

    ‘ধর ধর ওই চোর, ওই চোর!
    - নই আমি নই চোর, নই চোর!
    মিথ্যা, মিথ্যা এ অপবাদ’।

    ঠিক তাই হল। দারোগার ঘোড়া থামল গ্রামের বাইরে ফকির আজলান শাহের দরগায়। দারোগা ঘোড়ার পিঠে বসেই হাঁক পাড়লেন — আবে এ ফকির! বাহর আও।

    কোন উত্তর নেই। কেউ বাইরে এল না। দারোগার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। কোম্পানীর আমল শেষ হয়ে মাত্র কুইনের রাজত্ব শুরু হয়েছে। আর উনি এই গন্ডগ্রাম এলাকায় কুইনের প্রতিনিধি। এদিকের লোকজনের কি থানাপুলিশের ভয়ডর শেষ হয়ে গেছে? উনি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলেন। ফকিরের দরগার দরমার বেড়ার গায়ে হাতের রুল ঠুকে বললেন — বাহর নিকল!

    কোন সাড়া শব্দ নেই। ভেতরে ঢুকে দেখলেন এক মাজার, তার সামনে ধ্যানস্থ এক ফকির। গুগগুলের ধোঁয়ার গন্ধে বোধহয় দারোগার মাথা ধরে গেছল। ফকিরের কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন — এক ব্যাটা চোর পালিয়ে এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে। তোর আস্তানায় আসে নি তো?

    চোখ খুলে গেল ফকিরের। তাতে ক্রোধ কম, বিরক্তি বেশি। ফকিরের মুখ থেকে বেরিয়ে এল - এ বাঞ্চৎ বাওরা হ্যায় ক্যা?

    বাঞ্চোতটার মাথাটাথা খারাপ নাকি!

    হঠাৎ দারোগার ঘোড়া সামনের দু’পা শূন্যে তুলে চিঁহি করে উঠল। রামজীবন দারোগা চমকে উঠে ঘোড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কেউ কোথাও নেই। চারদিকে ন্যাড়া খেত, ধানকাটা হয়ে গেছে। ঘোড়া আবার চিঁহি-হি করে দু’পা তুলল। রামজীবন যেন কোন অশুভ সংকেত পেলেন। আর দেরি না করে চেপে বসলেন ঘোড়ার পিঠে। ব্যস, ঘোড়া অমনি ছুটতে শুরু করল। না, ট্রট বা ক্যান্টর নয়, সোজা গ্যালপ। রামজীবন প্রাণপণে লাগাম টেনেও বাগ মানাতে পারছিলেন না। ঘোড়া ছুটে চলল - তিনদিন তিন রাত। তারপর থানার ও গাঁয়ের লোকজন খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হদিস পেল মধুখালির গড়ের কাছে। সেখানে গড়ের মাঠে ঘোড়াটি নিশ্চিন্ত ভঙ্গীতে চরে বেড়াচ্ছে, ঘাস চিবুচ্ছে।

    রামজীবনকে পাওয়া গেল আধ মাইল দূরে, একটা বটগাছের উঁচু ডালে বসে আপন মনে হাসছেন আর পা দোলাচ্ছেন। শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়, এলোমেলো চুল । তবে খুঁজে পাওয়া গেল না দারোগার পিস্তল ও রেগুলেশন রুলটা।

    ফকিরের শাপ ফলে গেছল। বদ্ধ পাগল রামজীবন চাকরি হারিয়ে দেশের বাড়িতে থাকতেন। ঘরে বিশেষ থাকতেন না, ঘুরে বেড়াতেন মাঠেঘাটে আদাড়ে পাঁদাড়ে। কখনও কখনও তাঁকে দেখা যেত রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাচছেন আর গাইছেনঃ

    পিঞ্জামেঘের আঞ্জাআঞ্জি চেরাপুঞ্জির পাড়োৎ
    সাদা মেড়া ফালদি’ পড়ে কালা মেড়ার ঘাড়োৎ।[1]
    - আহা বাঞ্চোৎ! বাহা বাঞ্চোৎ! হায় বাঞ্চোৎ!


    এই ঘোড়াটাও অমনিই ছুটে চলেছে, থামার নাম নেই। আমি প্রাণপণে লাগাম টেনেও সামলাতে পারছি না। এভাবে বোধহয় চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাহলে একবারও সূর্য ওঠে নি কেন? আর এ’ঘোড়ার সওয়ার এখন আমি, রামজীবন নই। আমি জানি এরপর কী হবে, ঠিক যেন একটা পুরনো হিট ফিল্মের রিমেক চলছে। তবে রামজীবন দারোগার ভূমিকায় আমি তারিণী কুমার।

    আমি পাগল হতে চাই না, তাই কিছু একটা করতে হবে। অন্ততঃ এই পাগলা ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়তে হবে। লাফ দিলাম, কিন্তু বাঁ পা ঘোড়ার রেকাবে আটকে গেছে। মাথা ঘষটাচ্ছে, মৃত্যু অবধারিত। রামজীবনেরও কি এ’রকম কিছু হয়েছিল?

    চোখ খুললাম। সামনে রহমান ও গুরুপদ’র উদ্বিগ্ন চেহারা। কী হয়েছে মাস্টারমশায়? অমন আওয়াজ করছিলেন কেন? বোবায় ধরেছিল নাকি?

    আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। ইশারা করি জল খাবো।

    একটু ধাতস্থ হয়ে বলি — খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম। রাত কত হোল?

    গুরুপদ বলে – তিনটে বাজে; এবার বাকি রাত পাশ ফিরে শুয়ে থাকুন। চিত হয়ে বুকের উপর হাত রেখে শুলে অমন হয়।

    বাকি রাত ঘুম এলো না। মনে পড়ল – দারোগা রামজীবনের গল্পটা আমার পিতামহ জয়নারায়ণ আমাদের মানে নাতিদের শোনাতেন। আমার কাকার ছেলে নরেশ ছিল মহা বিচ্ছু, ছোট থেকেই। একেকদিন দাদুর ঘরে সবার সামনে খুব নিরীহ মুখ করে বলত — দাদু, আমাদের কোন পূর্বপুরুষ দারোগা ছিলেন না? ইংরেজ আমলে? উনি বোধহয় পাগল হয়ে গেছলেন; তাই না?

    ব্যস্‌ দাদু জয়নারায়ণ ডুবে যেতেন অতীতের স্মৃতিচারণে - এক ডাকসাইটে দারোগার গল্পে। কাহিনী যত এগোতে থাকত, তত ঘর খালি হত। সবচেয়ে আগে আমাদের মা-কাকিমারা। কারণ সবাই জানত এর পর যথাসময়ে ফকিরের বকলমে ‘বাঞ্চোৎ’ গালিটি জয়নারায়ণের মুখে উচ্চারিত হবে। আর হতচ্ছাড়া ফচকে নরেশ -- আমার কাকা বিনয়কৃষ্ণের ছেলে -- দাদুর মুখে একটি প্রাকৃত গালি শোনার আগ্রহে বহুবার শোনা ওই বস্তাপচা গল্পটি ফের শুনতে চাইছে। একেবারে অনুরোধের আসর। কিন্তু আমি এখন ওইরকম স্বপ্ন কেন দেখলাম?

    সকাল হলে চা দেবার সময় অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হোল যে আজ রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ আমাদের নতুন তৈরি প্রেয়ার হলে জড়ো হতে হবে।

    রাত ৯.৪৫

    আমরা ১৭ জন গায়ে চাদর জড়িয়ে হলে হাজির হয়ে দেখলাম হালদারবাবু ও জোশীজি আমাদের আগেই উপস্থিত হয়েছেন। একটা টেবিলে সাদা চাদর বিছিয়ে তার উপর সিংহবাহিনী ভারতমাতার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ঠেকনো দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা। তার সামনে খুদে খুদে কুড়িটি মোমবাতি, একটা ধূপদানি এবং একটা বাটিতে কিছু ফুল।

    হালদারবাবুর ইশারায় আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। উনি দেশলাই জ্বালিয়ে ধূপকাঠি ধরালেন। তারপর যোশীজি দেশলাই নিয়ে দ্রুত হাতে মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। হলের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হোল, শুধু বারান্দায় আলো জ্বলছে। বেশ একটা গা-ছমছমে ভাব। রহমান আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

    যোশীজির আবেগমণ্ডিত গলার স্বর গমগম করে উঠলঃ

    ‘‘আজ আমরা সমবেত হয়েছি একটি বিশেষ কারণে। রাষ্ট্রের জন্য প্রাণ দেওয়া কুড়িজন অমর শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে।

    আজ থেকে ২২ বছর আগে আজকের দিনে লস্কর-এ-তৈবার দশজন আতংকবাদী পাকিস্থানের করাচি বন্দর থেকে নৌকো করে ভারতের বাণিজ্যনগরী মুম্বাইয়ের উপকুলে নেমেছিল। ওরা ঠিক রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ মুম্বাইয়ের তাজ মহল প্যালেস ও ওবেরয় ট্রাইডেন্ট হোটেল, লিওপোল্ড ক্যাফে এবং নরিম্যান হাউস নামের একটি ইহুদী নিবাসে আক্রমণ চালায়। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গ্রেনেডে সজ্জিত আতংকবাদীর দল কাপুরুষের মত নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের উপর হামলা চালায়। অনেক ট্যুরিস্টদের পণবন্দী রাখে এবং আমাদের সিকিউরিটি ফোর্সের সংগে ওদের লড়াই চলে তিনদিন ধরে। মারা যায় কম করে ১৭৪ জন, যার মধ্যে ২৬ জন বিদেশী পর্যটক। চারদিনের মাথায় আক্রমণকারীদের ন’জন মারা যায়। দশনম্বর কাসভ আত্মসমর্পণ করে। একবছর ধরে ভারতের আদালতে তার বিচার হয়। তারপর দোষী সাব্যস্ত হলে তার প্রাণদণ্ড হয়।

    আমাদের ২০ জন সুরক্ষা কর্মী গুলি ও হাতবোমার আক্রমণের মোকাবিলা করতে করতে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। তারমধ্যে একজন হেমন্ত কারকরে। তিনি ছিলেন মুম্বাই পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার এবং অ্যান্টি টেরর স্কোয়াডের চিফ। যখন আতংকবাদী আবু ইসমাইল ও মহম্মদ কাসব ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ রেল টার্মিনাসে হামলা করে পালাচ্ছিল তখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাশের গলিতে তাদের পথ আটকে দাঁড়ায় ওঁর স্পেশাল স্কোয়াডের জীপ। কিন্তু এ কে ৪৭ এর গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় ওই গাড়ি। নিহত হন বীর যোদ্ধা হেমন্ত কারকরে এবং তাঁর সহযোগী অতিরিক্ত কমিশনার মুম্বাই (পূর্ব) অশোক কামতে, ও এক্সটর্শন সেলের চিফ বিজয় সালাসকর।

    দেশের জন্য ওই আত্মত্যাগ আমরা ভুলব না, ভুলতে দেব না। আরেকটা কথা। মানুষ কখন হারে? যখন নিজের ভাইবন্ধু, পরিবারের কেউ পেছন থেকে ছুরি মারে। পৃথ্বীরাজ চৌহান কখন পরাজিত হন? যখন তাঁর নিজের দেশের নিজের ধর্মের লোক জয়চাঁদ বেইমানি করে। তেমনই রাণা প্রতাপের ভাই শক্ত সিংহ, রাবণের ভাই বিভীষণ। প্রত্যেক যুগে একজন জয়চাঁদ থাকেই। আমাদের কাজ হোল তাদের চিনে রাখা, সমাজে একঘরে করা। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যাই। তাই ১৯৬২ সালের অক্টোবরে কম্যুনিস্ট চিন আমাদের নেফা অঞ্চলে অতর্কিতে আক্রমণ করে। কারণ হোল নেহেরু সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণমেননের কম্যুনিস্ট প্রীতি। ওর নীতি আমাদের ডিফেন্স, আমাদের সৈন্যবাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছিল। নইলে চিনের সাধ্য কি আমাদের হারিয়ে দেয়। ওই লজ্জাজনক পরাজয়ের পর কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কংগ্রেস সরকার তাঁকে পদ্মবিভুষণ সম্মান দিয়েছিল, ভাবা যায়!

    ওই ২০০৮ সালেও তাই হয়েছিল। হেমন্ত কারকারের বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের উল্লেখ পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে ছিল না। পরে জানা যায় যে ওই জ্যাকেট একটা ডাস্টবিনে পড়েছিল। কেন? ওগুলো ছিল সাব-স্ট্যান্ডার্ড, আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি প্রতিরোধ করতে অক্ষম। তাই এত সহজে মারা যান ওঁরা তিনজন। এ’নিয়ে শহীদের স্ত্রী ও মেয়ে প্রশ্ন না তুললে সেই কেলেংকারি জনসাধারণের অগোচরে থেকে যেত। তখন কেন্দ্রে রাষ্ট্রভক্ত সরকার থাকলে এই ঘপলার ঠিকমত তদন্ত হত, কারা পয়সা খেয়ে যোদ্ধাদের পেছন থেকে ছুরি মেরেছে সেটা জানা যেত।[2]

    কিন্তু ওই ঘটনা থেকেই জনতার চেতনা নাড়া খায়। রাষ্ট্রভক্তির জোয়ারে ভেসে যায় দুর্বল তোষামুদে সরকার আর ক্রমশঃ গড়ে ওঠে এক আত্মনির্ভর শক্তিশালী ভারত।

    আসুন, আমরা সবাই শহীদদের উদ্দেশে এক মিনিট মৌনধারণ করি”।

    সবাই নড়েচড়ে আবার সোজা হয়, দুটো হাত ভাঁজ করে সামনে রেখে দু’পায়ের পাতায় সমান ওজন দিয়ে দাঁড়ায়। এক মিনিট দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তারপর বিছানায় গিয়ে লম্বা হব। কেমন শীত শীত করছে।

    কিন্তু ব্যাপারটা সহজে মিটে যাক সেটা বোধহয় ভগবানের ইচ্ছে ছিল না।

    অন্ধকারের মধ্যে ভেসে আসে এক আকুল কন্ঠস্বরঃ স্যার, স্যার, একটু শোনেন। অ্যান্টি স্কোয়াড চিফ হেমন্ত কারকারে টেররিস্টদের গুলিতে মারা যান নাই। উনি মারা গেছলেন এক সাধ্বীর অভিশাপে।

    -- লাইট জ্বালাও, লাইট জ্বালাও! এসব কী হচ্ছে? হালদার, তোমাকে বলছি।

    সমস্ত লাইট একসঙ্গে জ্বলে ওঠায় একটু চোখে ধাঁধা লাগে। আমি হাত তুলে চোখ আড়াল করার চেষ্টা করি। আর খেয়াল করতে পারি নি যে পেছনের সারি থেকে টেনে হিঁচড়ে একজনকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। লোকটাকে হালদারবাবুর সামনে দাঁড় করাতেই উনি সপাটে একটা চড় কষালেন। ও ছিটকে মাটিতে গিয়ে পড়ল।

    রাগে দাঁত কিড়মিড় করছেন হালদার। ওঁর এই চেহারা আগে কখনও দেখি নি।

    -- শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার সময় এই অসভ্যতা! এটা কে? কোন জঙ্গল থেকে এসেছে?

    দু’জন ভলান্টিয়ার দুদিক থেকে ডানা ধরে তুলেছে লোকটাকে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি লোক কোথায়? এত তিরিশ পেরনো এক যুবক। মাথায় আলুথালু চুল, সাতদিনের না কামানো দাড়ি। নিঘঘাৎ নতুন এসেছে, তাই চিনি না।

    এখানে নতুন পুরনো চেনা খুব সহজ। পুরনোরা সময়মত বিছানা ছেড়ে নিজেদের বিছানা গুছিয়ে রাখে। তারপর কুঁজো থেকে ঢক ঢক করে জল খায়, পায়খানায় যায়, ভাল করে প্যানে জল ঢালে। তারপর দাঁত মাজে, লাইন দিয়ে চা খায় আয়েস করে। কেউ কেউ বিড়ি ধরায়, আঙিনায় পায়চারি করে। আবার অনেকেই ব্যায়াম করে, অন্ততঃ একটু হাত-পা নাড়ে। আমি ওসব কিছু করি না। চা খেয়ে বই মুখে বসি যতক্ষণ না নাস্তার ডাক পড়ে।

    তবে ডাক পড়ে কথাটা ভুল, ঘন্টা বাজে। সেই বালিকা বিদ্যালয়ের স্কুলের ঘন্টা। ঘুম থেকে ওঠা এবং স্নানের সময়-ঢং ঢং-ঢং, যেন স্টেশনে গাড়ি আসার আগে প্রথম সংকেত। এর মানে লোক্যাল ট্রেন আগের স্টেশন ছেড়েছে। সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ঢোকার ঘন্টাও তাই। কিন্তু খাবার ঘন্টা-সে জলখাবারই হোক বা ভাত খাবার - মাত্র একটা ঢং! লাইট অফ করার ঘন্টাও তাই। কিন্তু এতসব ঘন্টা বাজায় কে? আরে বিদ্যাভারতী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন চাপরাশি ভবানীদা — আবার কে। ও আবার এই কাজে বহাল হয়েছে, আদ্দেক মাইনেয়। ওর বাড়ি পাশেই। রিটায়ার করেও এই বিল্ডিঙয়ের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

    আমরা দু’জন এখনও একে অপরকে এড়িয়ে চলি। কখনও মুখোমুখি হলে অন্যদিকে তাকাই, না চেনার ভান করি।

    আবার ভাট বকছিলাম। এ তো গেল পুরনোদের কথা। ওরা মেনে নিয়েছে যে বাকিজীবন এই ক্যাম্প নম্বর 1276/WB টাই ওদের ঘরবাড়ি হয়ে থাকবে। তাই ওরা খুব বেশি কিছু চায় না। ডাল বা তরকারিতে একটু নুন, স্নানের সময় কলের জলটা যেন সাবান মাখা অবস্থায় ফুরিয়ে না যায় আর বিড়ি-সিগ্রেট ঘরে আসার সময় অন্য দিকে তাকিয়ে থাকা সিকিউরিটি যেন তার রেটটা আর না বাড়ায়।

    না, এখানে কোন পাগলা ঘন্টি বাজে না। কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত যে এখানে যে ক’টা বটগাছের ঝুরির মতন শুকনো চেহারার বুড়ো হাবড়া রয়েছে তারা সহজে পালাবার কথা ভাববে না। কেন ভাববে? এই কাঁটাতারের বেড়ার সুরক্ষায় ওরা বেশ নিরাপদে রয়েছে। দু’বেলা পেটভরে খাওয়া আর মাথার উপরে শীতগ্রীষ্ম বারোমাস ছাদ — আজকের দুনিয়ায় এ কি কম কথা?

    কিন্তু নতুনেরা? ওরা অবাক বিস্ময়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে, খুঁত ধরে। তুলনা করে কাঁটাতারের বাইরের জীবনের সংগে। সদ্য বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি ঘর করতে আসা মেয়েটি যেমন পদে পদে দুই বাড়ির চালচলন আচার আচরণের মধ্যে ফারাকটা দেখতে পায়। তাই ওদের ঘুম আসে দেরি করে, ভাঙেও অনেক বেলায়। পায়খানায় ও কলতলায় জলের রেশন ওদের বাড়াবাড়ি মনে হয়। খাবার সময় রুটিগুলো হয় কাঁচা কাঁচা, নয় পোড়া পোড়া। তরকারি ও ডালে নুন ও তেল কম, ভাল করে সাঁতলানো হয়নি। অনেকের চুলে চিরুনি ওঠে না, বিশেষ করে অল্পবয়েসীদের। দাড়ি কামানোর কথা বাদ দিন।

    কার ওপর রাগ করছিস রে? দুনিয়ার ওপর না নিজের ওপর? অথবা যে ‘দুনিয়াকে রাখোয়ালেঁ’ তোর এই হাল করেছে? আর যারা কথা দিয়েও কথা রাখেনি, দেখা করতে আসবে বলে আসেনি? যাদের চিঠি লেখা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে?

    এই নতুন ছেলেটা তেমনই কেউ হবে। উস্কো খুস্কো চুল, না কামানো দাড়ি, ময়লা জামাকাপড়। আগের জীবনে নিঘঘাৎ কবিতা লিখত। আর বাড়িতে জামাকাপড় কেচে দিত কাজের মাসি বা বৌ অথবা মা-বোনেরা । কিন্তু ও এসব কী বলছে?

    -- দোহাই সায়েবরা, আমার কথাডা মন দিয়া শুনেন। এটিএস কম্যান্ডার কারকারে সাহেব ওই জানোয়ার কাসভের একে ফর্টি সেভেনের গুলিতে মরে নাই, মরছে সাধ্বীর শাপে।[3] সে প্রায় দশ বছর আগের কথা। ভোপালের সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর বইলাছিল — কোন সাচ্চা দেশভক্ত হেমন্ত কারকারে সাহেবরে ‘দেশপ্রেমিক’ কইতে পারে না। কারণ তিনি হিন্দু সন্ন্যাসিনী প্রজ্ঞা ঠাকুররে মালেগাও বিস্ফোরণের কেসে আতংকবাদী বইল্যা গ্রেফতার কইর‍্যা আদালতে চার্জশীট দিছলাইন। সরকার কারকারে সাহেবরে মরার পরেবা অশোক চক্র দিছে। কিন্তু সন্ন্যাসিনী রাইগ্যা আগুন। কয় ওনার শাপে কারকারে সাহেব মরছে। [4]

    যোশীজির হিমশীতল কন্ঠস্বরঃ মালেগাঁও বিস্ফোরণের ব্যাপারে তুমি কী জান?

    -- মালেগাঁওয়ে সন ২০০৬ সালে চাইরডা বিস্ফোরণ হয়, তাতে ৩১ জন মুসলমান মারা যায়। আবার ২০০৮ সালে ঈদের কয়দিন আগে যে বিস্ফোরণ হয়, তাতে ৬ জন মুসলমান মারা যায় আর ১০০ জন আহত হয়। পুলিশ প্রথমে ৯ জন মুসলমানরে সন্দেহের বশে ধরছিল। তারা দশ বছর জেলে পচার পর এক্কেবারে নির্দোষ বইল্যা ছাড়া পায়। [5] কারণ কারকারে সাহেবের তদন্তে বাইরইল যে এইসব বিস্ফোরণ ‘অভিনব ভারত’ নামের একটা নুতন দলের কাজ। অরা হিন্দু রাষ্ট্র চায়। কর্নেল পুরোহিত আর সাধ্বী প্রজ্ঞা তাগো নেতা। সাধ্বীর কথা হইল কারকারে সাহেব মিথ্যা মামলা সাজাইছেন, জেলে সন্ন্যাসিনীরে টরচার করছেন — সেই পাপে!

    -- ব্যস, এতসব জান আর এটা জানো না যে আদালতে কিছুই প্রমাণ হয়নি? সাজানো সাক্ষীর দল আদালতে সত্যি কথা বলেছে। অধর্মের উপর ধর্মের জয় হয়েছে? আচ্ছা, মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও এ কতজন মুসলিম মারা গেছল তার একেবারে গোণাগুনতি হিসেব রাখ, কিন্তু ২০০২ সালে সাবরমতী এক্সপ্রেসের একটা কামরায় কতজন নিরীহ তীর্থযাত্রী ও করসেবককে জ্যান্তে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল তার সংখ্যাটা বলতে পারবে?

    পাগলাটে ছেলেটা হতভম্ব, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

    -- জানতাম, এটা বলতে পারবে না। ষাট জন; বুঝলে ষাট জন গোধরা স্টেশনে মারা যায়। কট্টর জেহাদিরা আগুন লাগিয়ে ছিল , কামরায় পেট্রল ঢেলে। এবার নামটা বলে ফেল। আর দেশ কোথায় – মানে বাংলাদেশের কোন জেলায় -- সেটাও বল।

    -- নারায়ণ বিশ্বাস, বসিরহাট।

    চমকে ওঠেন যোশীজি, যেন বিজলীর শক খেয়েছেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন — সে তো বুঝতেই পারছি। ওটা আধার কার্ডের নাম, রেশন কার্ডের নাম, ভোটার লিস্টের নাম। এবার আসল নামটা বল দিকি।

    আবার সেই পোষা গরুর মত চাউনি। ও পায়ের ওজন বদলায়।

    -- আমার তো একটাই নাম।

    যোশীজি হালদারবাবুর দিকে তাকান। হালদার মাথা হেলিয়ে সায় দেন । যোশীজি নীচু গলায় জানতে চান যে ওই ছেলেটা এই ডিটেনশন ক্যাম্পে কী করছে?

    হালদার শোনাতে থাকেন এক আশ্চর্য গল্প।

    - ‘স্যার, বলতে পারেন এটা হোল ‘রিভার্স লাভ জেহাদ’।

    বসিরহাটের পানিতর গাঁয়ের নারায়ণ বিশ্বাসেরা সাতপুরুষের জেলে। ইছামতী নদীতে এবং খালেবিলে জাল ফেলে মাছ ধরে পেট চালায়। ওখানে রাস্তার এপারে ভারত ওপারে বাংলাদেশ। ২৫০ ছাউনি, অধিকাংশই মুসলমান। ১৯ বছরের রফিয়া বিবি ওপার থেকে বেড়াতে এসেছিল ওর মামুজানের বাড়িতে, মামুর মেয়ের শাদি। এসেছিল দস্তুরমত ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে। কিন্তু একমাসের ভিসার মেয়াদ ফুরোলেও ফিরে যায় নি। কারণ বিয়ে বাড়িতে প্রতিবেশি হিন্দু ছেলে নারায়ণ বিশ্বাসের সংগে চারিচক্ষের মিলন ঘটে গেল। দু’জনে পালিয়ে গেল কোলকাতায় । বিশ্বাসবাড়ি ও মেয়ের মামা শেখ সরাতুলের বাড়ি রাগে ফুঁসছে। একে অপরকে দোষারোপ করছে মেয়ে ভাগানোয় তলে তলে সাহায্য করার সন্দেহে। যাহোক ওরা ফিরে এল। বলল — মেয়ে বিয়ে করেছে। এখন ওর নাম রাখী। ওরা গাঁয়ের বাইরে আলাদা করে ঘর বাঁধল দরমার বেড়া ও টালি দিয়ে। কিন্তু কেউ পুলিশে খবর দিল। ওরা বলল যে নারায়ণ জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। তাকে বিয়ে করে রফিয়া ওরফে রাখী বিশ্বাসও এখন ধারা ৬ অনুযায়ী নাগরিক। কিন্তু কোর্টে সরকারের উকিল প্রশ্ন তুলল – রফিয়ার ভিসার মেয়াদ বিয়ে করার ১৭ দিন আগেই ফুরিয়ে গেছল। এটা ও থানায় জানায়নি। ফলে বিয়ের সময় ওর স্ট্যাটাস ছিল ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র। তাই রফিয়া গেল জেলে আর অনুপ্রবেশকারীকে সাহায্য করার অপরাধে নারায়ণ বিশ্বাস এল ডিটেনশন সেন্টারে। এখন খুঁটিয়ে দেখা হবে — ওর কাগজপত্তর ঠিক আছে না জাল? ও যে বসিরহাটের পানিতর গ্রামে জন্মেছিল তার কোন প্রমাণ রয়েছে কিনা অথবা ওকি আসল নারায়ণ বিশ্বাস, নাকি ওপার থেকে এসে কোন জেহাদি এখানে ছদ্ম পরিচয়ে ঘাঁটি গেড়েছে।

    -- স্লীপার সেল?

    -- সেটারই তদন্ত চলছে।

    কুড়িটা খুদে মোমবাতি কখন নিভে গেছে।


    ৫ ডিসেম্বর, ২০৩০ বৃহস্পতিবার

    “ভাঙনের জয়গান গাই”

    আগামী কাল ৬ই ডিসেম্বর। আজ থেকে ৩৮ বছর আগে এই তারিখে কয়েকশ’ করসেবক হাতুড়ি শাবল গাঁইতি নিয়ে অয্যোধ্যার বাবরি মসজিদের গম্বুজে চড়ে ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে। দেখতে দেখতে কয়েকশ’ বছর আগের একটি স্থাপত্য ধূলোয় মিশে যায়। ওই ভুখন্ডটির মালিকানা নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম পক্ষের দেওয়ানি মামলা আদালতে চলছিল ঢিমে তেতালে। কিন্তু এক পক্ষ অধৈর্য হয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিল। সুপ্রীম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা, প্রধানমন্ত্রীর এবং উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী, কিছুই কাজে এল না। আর সেদিন থেকে ভারতের রাজনীতিতে শুরু হোল নতুন অধ্যায়।

    এখন থেকে জনতার আদালতে হাতে গরম বিচার ও শাস্তি হয়ে উঠল নিও-নর্মাল। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার পালন ধীরে ধীরে গৌণ হয়ে এক লোকাচারের পর্যায়ে চলে গেল। গত দুই দশক ধরে এই দিনটি পালন করা হয় শৌর্য দিবস হিসেবে। আমরা শুনি কীভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের একের পর ইঁট খসে পড়ল শাবলের আঘাতে।

    কাল এই ডিটেনশন সেন্টারেও বড় করে পালন করা হবে শৌর্য দিবস। যোশীজি আসবেন, বাইরের থেকে ছেলেমেয়ের দল এসে গান গাইবে, নকল বাবরি মসজিদ ভাঙার অভিনয় হবে। বাচ্চারা জানবে মোঘলরা কত বর্বর ছিল। ওরা খালি মন্দির ভাঙত, আর কিছু করত না। ওরা শিখবে -- তাজমহল আসলে তেজোমহল এবং রাণা প্রতাপ হলদিঘাটির যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন, হেরে পালিয়ে যাননি। কেন যে এইসব সত্যি কথাগুলো স্কুলের ইতিহাসে থাকত না!

    কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না। সেই ২৬শে নভেম্বর তারিখে হেমন্ত কারকরের কথা ওঠায় যা হোল তারপর আর কোন কিছুর উপর ভরসা করা যায় না। কোত্থেকে এক পাগলা জগাই এসে আমার সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ছকে রাখা প্ল্যান কেঁচে গণ্ডুষ করে দেবে কে বলতে পারে!

    আমি চাইছি এই ১২৭৬ নম্বর ডিটেনশন সেন্টার থেকে বেরিয়ে যেতে। ছাড়া না পেলেও অন্য কোন সেন্টারে পাঠানো হোক-যেখানে আমায় কেউ চেনে না। যেখানে কোন বুড়ো পাকাচুল একটু কুঁজো হয়ে পরা ভবানীদা ঘন্টা বাজায় না। কোন মিলি ভাবি এসে সিগ্রেটের জোগান দিয়ে যায় না। যেখানে কোন এক গুরুপদ পুরনো খবরের কাগজের হলদে হয়ে যাওয়া পাতা সযত্নে বুকে করে রাখে না।

    হালদার মশায় কথা দিয়েছিলেন। বলেছেন আমার উন্নতি দেখে আরও দশজন এগিয়ে আসছে। যোশীজি আমার সম্বন্ধে খুব ভাল রিপোর্ট ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে পজিটিভ রেসপন্স এসেছে। ৬ তারিখের পরে আমাকে একটি বোর্ডের সামনে উপস্থিত হতে হবে। আমার শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা হবে। শুনছি ইউরোপের কোন মানবাধিকার সংগঠন সরেজমিনে কিছু ডিটেনশন সেন্টার দেখতে আসবে। তাদের সূচীতে নাকি এই 1276/WB ও আছে। আমাদের খাওয়াদাওয়া আগের তুলনায় এখন বেশ ভালো দিলেন। আমার অন্য সেন্টারে যাওয়ার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। এখন কাউকে জানাতে বারণ করলেন।

    সবে আদ্দেকটা ভরে ফেলেছি এমন সময় বারান্দা দিয়ে একটা হো হো আওয়াজ – ক্রমশঃ এদিকেই এগিয়ে আসছে। রান্নাঘরের রাঁধুনি দৌড়ে এসে বলল-স্যার, সর্বনাশ হয়েছে। ওই নারায়ণ বিশ্বাস ব্যাটা, ওই যে সেদিন কীসব অভিশাপের কথা বলে উদুম ক্যাল খেল, পাগল হয়ে গেছে। আজ সকাল থেকে কিচ্ছু মুখে তুলছে না । খালি নাচছে আর গাইছে। এখন আবদার ধরেছে — আপনার সামনে নাচ দেখাবে! পাগলের গায়ে কী জোর! দু’দুটো সিকিউরিটি আটকাতে পারছেনা। আরও লোক ডাকতে হবে।

    বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পড়েছে নারায়ণ বলে ছেলেটা। কী তার চেহারা হয়েছে! বাকিরা ভয়ে এবং কৌতূহলে একটু দূরত্ব রেখে তামাশা দেখছে।

    ও এসেই মুচকি হেসে কাওয়ালির স্টাইলে কানে হাত দিয়ে গাইতে শুরু করল আর মুখড়ায় ফিরে দুহাতের চেটো দিয়ে বৃহন্নলাদের মত সুডোল আওয়াজ তুলতে লাগল।

    “দিন দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহানো হোল ভার,
    হোল পুন্নিমেতে অমাবস্যা চারিচক্ষু অন্ধকার।
    এসে বৃন্দাবনে বলে গেল বামি বোষ্টুমি,
    একাদশীর দিনেতে হবে জন্ম-অষ্টমী।
    কাল কামরূপেতে কাক মরেছে, কাশীধামে হাহাকার” [6]।

    ইতিমধ্যে চারজন ভলান্টিয়ার এসে ওকে টেনে হিঁচড়ে প্রায় পিছমোড়া করে নিয়ে যাচ্ছে। ওর মুখের কষে ফেনা উঠছে, চোখের সাদা জায়গাটা অনেকটা লাল। হঠাৎ এক ঝটকায় ও ওদের হাত ছাড়িয়ে আমার সামনে এসে হাত নেড়ে বলে উঠলঃ

    ক্ষুর ঘষন্তি, ক্ষুর ঘষন্তি, চিড়িক চিড়িক পানি,
    তোমার যা মনের কথা সে তো আমি জানি।

    [ প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত]

    [1] সৈয়দ মুর্তজা আলী, “আমাদের কালের কথা”।
    [2] ডেকান হেরাল্ড, জুন ২৫, ২০১৭।
    [3] দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৬ জুন, ২০২১।
    [4] হিন্দুস্থান টাইমস, ৪ মে, ২০২০।
    [5] দি হিন্দু, ১৭ অক্টোবর, ২০১৬।
    [6] ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৯৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জয় | 82.***.*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:১৪502104
  • আহা বাহা।
    রঞ্জনদা  অসাধারণ অসাধারণ।
    আপনার লেখনী অক্ষয় হউক।
  • :|: | 174.25.***.*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:২৬502105
  • কালী পুজো হয়ে যাবার পর আর কৃষ্ণপক্ষ থাকে না। জগদ্ধাত্রী পুজোর শুক্লপক্ষ শুরু হয়ে যায়। সেই জন্য এই ছত্রটি ভেবে দেখা উচিৎ: "কৃষ্ণপক্ষ চলছে। তাই কালো রাত বড় লম্বা, ফুরোতে চায় না।"
  • Amit Sengupta | ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৩:০৩502114
  • অসাধারণ। পরের অধ্যায় তাড়াতাড়ি শুরু হোক। 
  • sandi | 45.25.***.*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:০৫502118
  • রঞ্জনদার লেখা একেবারে চেটে খাওয়ার মত জিনিস। 
  • Ranjan Roy | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:০২502123
  • সবাইকে ধন‍্যবাদ।
    ভাইঝির বিয়েতে কোলকাতা এসেছি। 20 তারিখ দিল্লি ফিরবো। দ্বিতীয় অধ‍্যায় 24 তারিখ নাগাদ।
     
    চতুর্ভুজ,
    শুধরে নেব, ওটা স্বপ্নের বর্ণনার টাইম।
  • aranya | 2601:84:4600:5410:15fa:d7f:31be:***:*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:০৫502124
  • দিব্য হচ্ছে 
  • Emanul Haque | ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ২৩:১০502235
  • এ ভারত যেন কোনোদিন দেখতে না হয়
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন