"১৪ই আগস্ট শোনা গেল রায়ট নাকি থেমে গেছে। সত্যি কিনা যাচাই করার জন্য আমি আর সরোজ দত্ত পাগলের মত পায়ে হেঁটে সারা কলকাতা ঘুরেছি। প্রথমে ভয় হয়েছিল, পরে ভয় উড়ে গিয়ে এল স্বস্তি-এক অদ্ভুত আনন্দ। এক হিন্দু বিধবাকেও রাস্তায় যেতে যেতে বলতে শুনছি - 'পার্ক সার্কাস দেখে এলাম, যাই নাখোদা মসজিদ দেখে আসি।'
......একদিকে গড়পাড়ে বিষ্টু ঘোষের আখড়া... অপরদিকে রাজাবাজার.. গিয়ে দেখি দুপক্ষই তোরণ বানাচ্ছে, হিন্দুস্তান-পাকিস্তান দুটি ডোমিনিয়নের জন্ম হচ্ছে। মাঝখানে খানিকটা জায়গা-নো-ম্যানস ল্যান্ড। দুপক্ষই বোমা নিয়ে সতর্ক, সশস্ত্র।... হঠাত সাহস করে রাজাবাজারের দিক থেকে এক মুসলমান ছেলে নো-ম্যানস ল্যান্ডে এসে চেঁচিয়ে বলল - 'আমাদের একটা হাতুড়ি দিতে পারেন? আমাদের একটা হাতুড়ি দরকার।' গড়পাড়ের দিক থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল - 'এই নিন হাতুড়ি।' সে হাতুড়িটা রাজাবাজারের দিকে ছুঁড়ে দিল। মুহূর্তে উবে গেল সব ভয়-সন্দেহ-অবিশ্বাস। যে বোমা তারা একে অপরকে মারবার জন্য বানিয়েছিল - সেসব ফাটিয়ে তারা দিনটাকে সেলিব্রেট করল।
যতই ঘুরছি দেখি রাস্তায় রাস্তায় কোলাকুলি। স্টিরাপ পাম্প দিয়ে গোলাপজল ছিটোচ্ছে লোকে পথচারীর গায়ে। সম্পূর্ণ অচেনা লোককে পথচারী সিগারেট বিলোচ্ছে। স্বাধীনতার জন্মলগ্নে হিন্দু-মুসলমান মিলে গেল। কলকাতা আনন্দে হেসে উঠল।"
(চিন্মোহন সেহানবিশ - উত্তাল চল্লিশ/অসমাপ্ত বিপ্লব - অমলেন্দু সেনগুপ্ত)
সে আনন্দে যোগ দিতে পারেন নি একজন ন্যুব্জ, স্থবির বৃদ্ধ। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি তখন বিদ্ধস্ত, আশাহীন। কলকাতার ঘরে ঘরে যখন আলো ও মঙ্গলশঙ্খ, পথে পথে তোরণ, হাসি, গান, 'জয়হিন্দ' ধ্বনি, তখন তাঁর ঘরে আলো স্তিমিত। দাঙ্গা-পীড়িত বেলেঘাটার হায়দরী ম্যানসনের বাড়িতে তিনি তখন অনশনে রাত্রিযাপন করছেন। মোহনদাস করমচন্দ গান্ধি।
-------
১৯৪৫ সালের পর থেকেই গান্ধি সক্রিয় রাজনীতি থেকে ক্রমে দূরে সরে আসছিলেন। ব্যক্তিগত দূত সুধীর ঘোষই তখন তাঁর ও কংগ্রেসের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র। প্রথমে ক্যাবিনেট মিশন, পরে মাউন্টব্যাটেনকে তিনি বলেন-জিন্নাকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া উচিত; কখনো বলেন -ব্রিটিশ আগে দেশ ছাড়ুক, হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করে নেবে। বলেন-দেশভাগ যদি হয় তবে তা হবে তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে। হায়, স্থবির বৃদ্ধের কথায় কেউই কান দেয় না। কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা তাঁকে মনে করে দন কিহোতে। তফাৎ একটাই, এই কিহোতের এখন আর কোনো সাঙ্কো পাঞ্জা নেই। হতাশ গান্ধি বলেন - 'ওরা আমাকে মহাত্মা বলে। কিন্তু আমার প্রতি ওরা একজন ঝাড়ুদারের মতও ব্যবহার করে না।' (দেশবিভাগ-পশ্চাৎ ও নেপথ্য কাহিনীঃ ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। দেশভাগের মাউন্টব্যাটেন-প্রস্তাব সকলেই মেনে নিয়েছেন, এ খবর নিজের মুখে গান্ধিকে জানাতে এসে মাউন্টব্যাটেনের মনে হয় ৭৭ বছরের এই বৃদ্ধ যেন এক ডানা-ভাঙা পাখি!
কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, ব্যথিত বৃদ্ধ ঠিক করেন নোয়াখালির গ্রামে গ্রামে, বিহার-কলকাতা-দিল্লি-পাঞ্জাবের দাঙ্গা-বিদ্ধস্ত বস্তিতে তিনি শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। তাঁর সারাজীবনের আদর্শ - অহিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করবেন। সঙ্গী তাঁর অক্ষয় সাহস আর হাতে-গোনা কয়েকজন অনুগামী। বিহারে হিন্দুরা তাঁদের আচরণ পরিবর্তন না করলে তিনি আমরণ অনশনের হুমকি দেন '৪৬-এর নভেম্বর মাসে। আর '৪৭ এর জানুয়ারি মাসে তিনি শুরু করেন তাঁর নোয়াখালি ভ্রমণ। দাঙ্গার শিকার নোয়াখালির সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মনোবল জোগানো আর সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মন পরিবর্তনের জন্য এই তাঁর যাত্রা-সাত সপ্তাহের এই যাত্রায় ১১৬ মাইল তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। জল-কাদার মধ্য দিয়ে, ভাঙা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, বিরুদ্ধ-ক্রুদ্ধ মানুষের ঘৃণা পেরিয়ে, সংশয়-অবিশ্বাস পেরিয়ে, মৃত্যুভয় পেরিয়ে খালিপায়ে তাঁর এই হাঁটা - এ হাঁটার তুলনীয় নজির পৃথিবীর মানুষ খুব বেশি একটা দেখে নি। তাঁর পথে ক্রুদ্ধ মুসলমানদের ছড়ানো ময়লা তিনি একবার নিজের হাতে পরিষ্কার করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে তাঁর যাত্রা শুরু হত রবীন্দ্রনাথের 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে' গান দিয়ে। সুমিত চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন - 'সেটি হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় স্তোত্র।' শুরুতে কিছু প্রতিরোধ ছিল - সাংবাদিক শৈলেন চ্যাটার্জি লিখেছেন - মুসলমানরা তাঁকে বিশ্বাস করত না; পরে তারা বুঝতে শুরু করল - এই মানুষটি সাধারণ একজন মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু নয়, এ অন্য কিছু। লাইন দিয়ে মানুষ তাঁকে দেখতে আসত, তাঁর চলার পথে ভিড় করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকত তারা - তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে পীড়িত মানুষজনকে সান্তনা দিতেন, প্রার্থনা করতেন, সম্প্রীতির কথা বলতেন।
জীবনের সবচেয়ে বড় এই পরীক্ষা গান্ধিকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। সেইসময়কার একটি নোটে তিনি লিখেছেন - 'প্রিয়তম বন্ধুরা ছেড়ে চলে গেছে; যে সত্য আর অহিংসার নামে শপথ নিয়েছিলাম, জীবনের দীর্ঘ ষাট বছর যা আমাকে শক্তি জুগিয়েছে - আজ তার আর কোনো মানে নেই।' (The Great Partition: Yasmin Khan)। ঘনিষ্ঠ অনুগামী নির্মল কুমার বসু শুনছেন, মহাত্মা বিড়বিড় করে বলছেন - মৈঁ ক্যা করুঁ?
---------------
''পথের মানুষ আবার পথে নামলেন। ভেঙে দিলেন আশ্রম, ছেড়ে দিলেন সঙ্গীদের, দেহের ন্যূনতম প্রয়োজনের অভ্যাসকেও ফেলে দিলেন ছুঁড়ে, একলা হলেন, শুদ্ধ হলেন, মুক্ত হলেন। এ মুক্তিতে তাঁর প্রয়োজন ছিল। এ না হলে ব্যর্থ হত তাঁর সমস্ত জীবনের সাধনা। এই তাঁর পূর্ণতা, তাঁর প্রায়শ্চিত্ত, যুধিষ্ঠিরের মত কঠিন শোকাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ স্বর্গারোহণ।
কোন স্বর্গে? ...যেখানে ভয় নেই, বীরত্বও নেই। লোভ নেই, ত্যাগ নেই। ক্রোধ নেই, সংযমও নেই। যেখানে আশ্রয় নেই, তবু নিশ্চয়তা আছে। যেখানে বিফলতা নিশ্চিৎ, তবু আশা অন্তহীন।.... কোথায় পড়ে রইল তাঁর দেশ, যেখানে বছরের পর বছর তিনি কাটিয়েছেন ভক্ত-বন্ধুদের সাহচর্যে, আর কোথায় এই সিক্ত, কর্দমাক্ত, অসংস্কৃত নোয়াখালি! কোথায় তাঁর পথের শেষ জানেন না, কখনো ফিরবেন কিনা তাও জানেন না। ... কিন্তু কেন? অহিংসার অগ্নিপরীক্ষা হবে বলে? চিরস্থায়ী শান্তি আনবেন বলে? ও-সব কথা কিছু বলতে হয় বলেই বলা : ও-সব কিছু না। আসল কথা স্বর্গকে তিনি পেয়েছেন এতদিনে; সেই স্বর্গ নয়, যা দিয়ে রাজনৈতিক রচনা করেন জনগণের সমস্ত বঞ্চিত কামনার, ঈর্ষার, কুসংস্কারের তৃপ্তিস্থল, আর পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করতে না করতে যা প্রতিপন্ন হয় আরো একটি যুদ্ধের মাতৃজঠর; সেই স্বর্গ, যা ছাড়া আর স্বর্গ নেই, যা মানুষ সৃষ্টি করে একলা তার আপন মনে, সব মানুষ নয়, অনেক মানুষও নয়, কেউ কেউ যার একটিমাত্র আভাস মাঝে-মাঝে হয়তো পায়, কিন্তু যাকে সম্পূর্ণ রচনা করে সম্পূর্ণ ধারণ করতে যিনি পারেন তেমন মানুষ কমই আসেন পৃথিবীতে, খুবই কম; - আর তেমনি একজনকে আজ আমরা চোখের উপর দেখছি বিদীর্ণ বিহ্বল নোয়াখালির জলে, জঙ্গলে, ধুলোয়। নম্র হও, নোয়াখালি; পৃথিবী প্রণাম করো।"
(নোয়াখালি-বুদ্ধদেব বসু)
-------
গান্ধীর নোয়াখালি-মিশন মুসলিম লীগ নেতাদের স্বভাবতই পছন্দ হয় নি। বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি বলেন - নোয়াখালির পরিস্থিতি স্বাভাবিক, গান্ধীর সেখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর তালে তাল মিলিয়ে ফজলুল হক পর্যন্ত বলেন - গান্ধীর উপস্থিতি নোয়াখালির হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে বিষিয়ে দিচ্ছে। নেতাদের উস্কানিতে সাধারণ মুসলিম জনতা খেপে উঠতে থাকে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে ওঠে। মুসলমানেরা গান্ধীর সভা বয়কট করতে শুরু করেন। গান্ধীর পথে ময়লা ছড়িয়ে রাখা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে ওঠে। ভগ্নমনোরথ গান্ধী নোয়াখালি থেকে ফিরে আসেন। কিন্তু নোয়াখালিকে তিনি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন নি। সুযোগ পেলেই আবার নোয়াখালি যাবেন, এই বাসনা তাঁর মনে ছিল।
নোয়াখালির পালা সাঙ্গ হলে বিহার। সেখানে উলটপুরাণ, হিন্দু দাঙ্গাকারীদের হাতে আক্রান্ত মুসলিমরা। বিহারের পর দিল্লী, যেখানে পাঞ্জাব থেকে কাতারে কাতারে হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা এসে জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে, সেই আগুনে জল ঢালতে হবে।
১৫ই অগাস্টের দু সপ্তাহ আগে গান্ধী দিল্লী ছেড়ে চললেন কাশ্মীর। সেখানে দিন চারেক কাটিয়ে ট্রেন ধরে চললেন কলকাতা। উদ্দেশ্য, সেখান থেকে পুনরায় নোয়াখালি-যাত্রা।
৯ই অগাস্ট এসে উঠলেন সোদপুরের আশ্রমে। কলকাতায় তখনো ধিকি ধিকি দাঙ্গার আগুন জ্বলছে। কলকাতায় এর মধ্যে প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে কংগ্রেসের শ্যাডো মন্ত্রীসভা চালু হয়ে গেছে। ফলে ধারণা হয়ে গেছে এখন আর মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালালে প্রশাসন থেকে বাধা আসবে না। সত্যিই মন্ত্রীসভার অনুমোদনে শান্তিরক্ষার নামে মুসলিম মহল্লাগুলি ঘিরে দেওয়া হয়েছে পুলিশ দিয়ে; অপসারিত হয়েছে কুখ্যাত পাঞ্জাবী মুসলমান-পুলিশবাহিনী। ঘোষ মন্ত্রীসভা এ ব্যাপারে পূর্বতন সুরাবর্দি মন্ত্রীসভার পথই অনুসরণ করছিল - পুলিশ ও প্রশাসনের সাম্প্রদায়িকীকরণ; এ যাত্রায় অবশ্য উল্টোমুখে।
৯ই অগাস্ট গান্ধী এসে পৌঁছতেই কলকাতার মুসলিম নেতারা তাঁর কাছে হাজির হলেন। জানালেন - ১৫ই অগাস্ট মুসলিম বস্তিগুলিতে বড় ধরণের হামলার আশঙ্কা রয়েছে। গান্ধী যেন অন্তত ১৫ই অগাস্ট অবধি কলকাতায় থেকে যান। কলকাতা শান্ত থাকলেই নোয়াখালিসহ গোটা বাংলা শান্ত থাকবে। হিন্দুরাও কেউ কেউ স্বীকার করেন - কলকাতার পরিস্থিতি খুব উদ্বেগজনক। একমাত্র গান্ধির উপস্থিতিই পারবে কলকাতার আগুন নেভাতে।
ভীতসন্ত্রস্ত মুসলিম নেতাদের অনুরোধ গান্ধী ফেরাতে পারলেন না। শুধু একটাই শর্ত দিলেন - লীগ নেতা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দিকেও তাঁর সাথে থাকতে হবে। এবং এতে সুরাবর্দির জীবন বিপন্ন হতে পারে, তাও জানিয়ে রাখলেন।
অন্যসময় হলে সুরাবর্দি এ কথায় কর্ণপাতও করতেন না। গান্ধীকে তিনি চরম শত্রু ভাবতেন। তাঁকে 'ঐ বুড়ো চালিয়াতটা' বলে ডাকতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আপদ বড় বালাই। পাশার দান উল্টে গেছে। সুরাবর্দি, অগত্যা রাজি হয়ে গেলেন।
১৩ই অগাস্ট বিকেলে গান্ধী গিয়ে উঠলেন ১৫০ বেলেঘাটা মেন রোডের হায়দরী মঞ্জিলে। নামেই মঞ্জিল, আসলে ভাঙাচোরা একটি একদা-ম্যানসন। চারিদিক খোলা, যে কোনো দিক থেকে মব এসে যে কোনো সময় আক্রমণ করতে পারে।
১১ তারিখ গান্ধী সোদপুর থেকে কলকাতা এসে পৌঁছলে তাঁকে দেখতে ভিড়ে ভিড়াক্কার; তাঁর গাড়ির চারপাশে শুধু মানুষের মাথা। অবশ্য সামগ্রিক ছবিটা পুরো এক রঙা নয়। দুদিন পরেই এক বিক্ষুদ্ধ জনতা এসে গান্ধীকে কালো পতাকা দেখায়। 'গান্ধী গো ব্যাক' ধ্বনি ওঠে; তাঁর জানালা লক্ষ্য করে ইঁট ছোঁড়া হয়। জনতা দাবী করে, গান্ধীকে কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে; অথবা কাঁকুড়গাছি-উল্টোডাঙা অঞ্চলে এসে থাকতে হবে - কেননা ঐসব এলাকা থেকে বহু হিন্দু পরিবার উৎখাত হয়েছে। এও বলে তারা - এক বছর আগে যখন হিন্দুরা মার খাচ্ছিল, তখন কোথায় ছিলেন গান্ধী, কোথায় ছিল তাঁর দায়িত্ববোধ? (ছেচল্লিশের দাঙ্গা - সন্দীপ বন্দোপাধ্যায়)। গান্ধী জনতার এক প্রতিনিধিদলকে ঘরে ডেকে নিয়ে কথা বলেন; সাময়িকভাবে তারা শান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যায়। বিচ্ছেদের কাঁটা কিন্তু রয়েই যায়।
১৪ই অগাস্ট সন্ধ্যায় সম্ভাব্য পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ এসে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে জানতে চান - আগামীকাল কী ধরণের উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। গান্ধী তাঁকে জানান - স্বাধীনতা দিবসে উৎসব পালনের কোনো ইচ্ছে তাঁর নেই। কেননা - 'সব দিক জ্বল রহে হেঁ, ভুখা মর রহে হেঁ, নাঙ্গে মর রহে হেঁ।' হিন্দুস্তান টাইমসের এক সাংবাদিক স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তাঁর বার্তা জানতে চাইলে তিনি বলেন - তাঁর কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। বিবিসি'র সাংবাদিক তাঁর সচিবের সঙ্গে দেখা করে তাঁর বার্তা চাইলে গান্ধী তাঁকে জওহরলালের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। নাছোড়বান্দা সাংবাদিক তাও পিড়াপিড়ি করলে গান্ধী বলেন - 'ওদের ভুলে যেতে বলুন যে আমি ইংরাজি জানি।' (India After Gandhi - Ramchandra Guha)
১৪ই অগাস্ট সন্ধ্যাতেই গান্ধীর প্রার্থনাসভার শেষে কিছু উন্মত্ত হিন্দু জনতা সুরাবর্দি'র নাম ধরে গালাগাল শুরু করে; তারা সুরাবর্দি'র রক্ত চায়। আবার ইঁট-পাটকেল ছোঁড়া হতে থাকে। তারা দাবী করে, সুরাবর্দিকে তাদের সামনে এনে হাজির করতে হবে। গান্ধী সুরাবর্দিকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তাঁর একটি হাত সুরাবর্দি'র কাঁধে। গান্ধীর সচিব ও জীবনীকার পেয়ারেলাল স্মৃতিচারণা করেছেন - 'মুহূর্তের মধ্যে জনতার উন্মত্ততা থেমে গেল। চারিদিকে সম্পূর্ণ নীরবতা।'
এরই মধ্যে একজন যুবক সুরাবর্দিকে লক্ষ্য করে চীৎকার করে ওঠেন - 'আপনি কী গত বছরের কলকাতার দাঙ্গার দায় স্বীকার করেন?'
'হ্যাঁ, আমি সে দায় স্বীকার করছি' - সুরাবর্দি বলেন - 'আমি ঐ দাঙ্গার জন্য লজ্জিত।'
জনতা শান্ত হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই একজন পুলিশ এসে খবর দেন - শহরের আর এক প্রান্তে বিশাল মুসলিম জনতা হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছেন। মানুষ তাই শুনে উল্লাসে ফেটে পড়ে।
১৫ই অগাস্ট দিনটি গান্ধী অনশনে কাটালেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মেজাজ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দীর্ঘ এক বছরের সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরে কোথা হতে মানুষের মনে এত ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে উঠলো, বলা মুশকিল। 'বন্দে মাতরম' আর 'জয়হিন্দ' ধ্বনির পাশাপাশি রব উঠল - 'হিন্দু-মুসলমান এক হো'। হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে; মুসলমানেরা হিন্দুদের মসজিদে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে; শিখ ড্রাইভারেরা বলছেন - আজ ট্যাক্সিতে উঠলে পয়সা লাগবে না। চায়ের দোকান-রেস্তোরাঁ সকলের জন্য উন্মুক্ত। উল্লসিত জনতা ভেঙে ফেলছে রাজভবনের গেট। শহরজুড়ে মহাত্মাজী-র নামে জয়ধ্বনি। কাতারে কাতারে মানুষ বেলেঘাটার বাড়িতে এসে গান্ধীর দর্শন পেতে চায়। তাদের অনুরোধে-উপরোধে গান্ধী বারবার এসে দাঁড়ান জানালা'র সামনে। শুধু ১৫ তারিখেই প্রায় ১০,০০০ মানুষ গান্ধীকে দেখতে আসে। সেদিনটি ছিল আবার ঈদের দিন। দলে দলে মুসলিম বেলেঘাটায় এসে দাবী করেন - গান্ধীজী'র দর্শন পেয়ে তবেই তাঁরা রোজা ভাঙবেন।
এই সাময়িক শান্তিতে গান্ধী খুশি হলেও আনন্দে আত্মহারা নন। রাজকুমারী অমৃত কাউরকে লেখা এক চিঠিতে জানান - 'জানিনা এই দশা কতদিন স্থায়ী হবে! হিন্দু-মুসলমান বাস্তবিক একটি দিনের মধ্যেই একে-অন্যের বন্ধু হয়ে উঠেছে। সুরাবর্দি যেন বদলে গেছেন - অন্ততঃ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।' চিঠির আপাত শান্তি-কল্যাণ ছত্রের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অশান্তির আশঙ্কা।
৩১শে অগাস্ট মুসলমান ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে গ্রান্ড হোটেলের এক সমাবেশে গান্ধীকে সংবর্ধনা জানানো হয়। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু মন্দিরগুলির সংস্কারের জন্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ১০০১ টাকা। ২রা সেপ্টেম্বর গান্ধীর নোয়াখালি চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আবারও তাঁকে সে পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হয়।
কেননা ৩১শে অগাস্ট রাত থেকেই কলকাতায় আবার দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।
----
৩১ শে অগাস্ট রাত দশটা নাগাদ একদল হিন্দু গুণ্ডা বেলেঘাটায় গান্ধী-আশ্রম আক্রমণ করে। এরা হকি স্টীক, ইঁট-পাথর নিয়ে তৈরী হয়েই এসেছিল। কাচের জানালা ভাঙচুর করা হয়, কেউ কেউ বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসবাবপত্র, ছবির ফ্রেম ভাঙচুর করতে থাকে। তাদের দাবী, সুরাবর্দির সঙ্গে হিসেব-নিকেশ এখনো বাকি আছে, সুরাবর্দিকে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা একটি লোককে দেখিয়ে বলা হয়, এ মুসলমানদের হাতে মারাত্মক আহত হয়েছে; কেন, তার জবাব গান্ধীকে দিতে হবে। উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে গান্ধী জোড়হাত করে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ফল হয় উল্টো; তাঁকে উদ্দেশ্য করে একটি লাঠি ও একটি ইঁট ছুঁড়ে মারা হয়। একটুর জন্য গান্ধী আহত হতে হতে বেঁচে যান। এই মব দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য তৈরী হয়েই এসেছিল; আহত লোকটিকে নিয়ে আসা তাদের পরিকল্পনার অংশ ছিল - আদতে তার আঘাত ছিল সামান্যই।
ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ ও পুলিশ কমিশনার ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনেন। কিন্তু এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পরের দিন ১লা সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতা শহরে বড় রকম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণকারীরা ছিল পেশাদার হিন্দু গুণ্ডা, এদের ভাড়া করে আনা হয়েছিল বাইরে থেকে। আক্রমণের লক্ষ্য ছিল পূর্ব ও মধ্য কলকাতার মুসলিম মহল্লা। বেলেঘাটা-তালতলা-এন্টালি-হাতিবাগান এলাকায় একের পর এক মুসলিম বস্তি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র ১লা সেপ্টেম্বরের দাঙ্গাতেই ৫০ জন মারা যান, আহত হন আরো ৩৭১ জন।
১লা সেপ্টেম্বর রাতের একটি ঘটনা গান্ধীকে খুব আহত করেছিল। তাঁর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে কিছু মুসলিম পরিবার মিয়াবাগান বস্তিতে ফিরে এসেছিল। নতুন করে দাঙ্গা ছড়ানোর খবর পেয়ে তারা আবার রাজাবাজারে ফিরে যেতে মনস্থ করে। ৩০ জন মুসলিমকে নিয়ে একটি ট্রাক যখন রাজাবাজারের দিকে এগোচ্ছে, তখন গুণ্ডারা ট্রাকটির ওপর বোমা ছোঁড়ে; দুজন মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। নির্মলকুমার বসু লিখেছেন - ঐ ঘটনার কথা শোনামাত্র গান্ধীজী'র মুখ 'কঠিন' হয়ে ওঠে এবং তিনি প্রেস-বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমরণ অনশনের কথা ঘোষণা করেন। গান্ধী বলেন - ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে তাঁর অনশন শুরু হবে এবং যতক্ষণ না মানুষ হিংসা ত্যাগ করে এবং জনজীবনে সুস্থতা ফিরে আসে ততক্ষণ তিনি অনশন চালিয়ে যাবেন।
সন্ধ্যায় যখন তাঁর অনশন শুরু হচ্ছে, ততক্ষণে ঘটে গেছে আর একটি মর্মান্তিক ঘটনা। ছুরিবিদ্ধ হয়েছেন গান্ধীবাদী স্বাধীনতা-সংগ্রামী শচীন্দ্রনাথ মিত্র। দাঙ্গা শুরু হয়েছে খবর পেয়ে তিনি বড়বাজার থেকে শান্তিমিছিল বের করে চিৎপুরের দিকে এগোতে থাকেন। নাখোদা মসজিদের কাছে তাঁকে ছুরি মারা হয়। দু-দিন পর মেডিক্যাল কলেজে তিনি মারা যান। তাঁর শেষ কথা ছিল - আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি (সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)।
এবারের দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল গান্ধীকে জনসমক্ষে বেইজ্জত করা। গান্ধীর প্রয়াসে 'অলৌকিক্ভাবে' কলকাতায় শান্তি ফিরে আসা, গান্ধীর প্রতি মুসলিম জনতার অগাধ আস্থা তৈরী হওয়া - এর কোনোটাই হিন্দুত্ববাদীরা ভালো চোখে দেখছিল না। পাশাপাশি আর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবতঃ সুরাবর্দিকে হত্যা করা। বড়বাজারের অবাঙালী ব্যবসায়ীরা চেয়েছিল মুসলমানদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে তাদের দোকানপাট-ব্যবসাকেন্দ্র দখল করা। হিন্দু বস্তিমালিকরাও চাইছিল বস্তি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করে হিন্দু ভাড়াটে বসাতে।
সেপ্টেম্বরের দাঙ্গার পিছনে সরাসরি হয়তো কোনো দলীয় মদত ছিল না। কিন্তু হিন্দু মহাসভা বা কংগ্রেস - কেউই এই দাঙ্গার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রতিরোধ বাহিনী গড়ার নামে, স্বাধীন বঙ্গ আন্দোলনের বিরোধিতা করবার নামে যে গুণ্ডাবাহিনীকে তারা একদা কাজে লাগিয়েছিল, তারাই রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়ে নির্বিচার খুনোখুনিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কেননা তখন আর প্রশাসনও তাদের প্রতি বৈরী নয়। গুণ্ডাদের রাশ দলীয় নেতাদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। অস্বস্তি এড়াতে নেতারা বলতে থাকেন - বাইরে থেকে আমদানী করা গুণ্ডা আর কিছু বাজে লোকই দাঙ্গা করে যাচ্ছে - এর পিছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই।
২রা সেপ্টেম্বর শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার আরেক নেতা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে অনশন প্রত্যাহার করে নিতে অনুরোধ জানান। ৪ঠা সেপ্টেম্বর উত্তর কলকাতার পুলিশ গান্ধীর অনশনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে ২৪ ঘন্টা অনশন পালন করে। দাঙ্গাবাজী চলবে না, মহাত্মাজীর প্রাণ বাঁচাতে হবে - এই বলে কলকাতায় জোরদার শান্তি-আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর একটি বিশাল শান্তি মিছিল কলকাতার পথে ঘুরে বেড়ায়। এলাকায় এলাকায় পাহারা বসানো হয় শান্তিবাহিনীর লোকদের দিয়ে। মুসলিম ন্যাশন্যাল গার্ড আর হিন্দুস্তান ন্যাশনাল গার্ডের মত দাঙ্গাবাজ দলও যোগ দেয় শান্তিবাহিনীতে। গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ দীন শ মেহতা ৪ তারিখ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বুলেটিনে জানান - শিগগিরই গান্ধীজী'র রক্তে অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে শুরু করবে এবং তাঁর যা বয়স আর যে রকম উচ্চরক্তচাপের সমস্যা, তাতে পরিস্থিতি শিগগিরই হাতের বাইরে চলে যাবে। বাংলার গভর্নর চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি ঐ একই পত্রিকায় বিবৃতি দেন - 'The hours are steadily, and not too slowly, wearing Mahatma Gandhi away' গভর্নর এও বলেন - কলকাতায় গান্ধী মারা গেলে এবারে কিন্তু আর জনগণ কোনো বিদেশী সরকার অথবা কোনো বহিরাগতকে দোষ দিতে পারবে না। (Calcutta and it's struggle for peace - Anwesha Roy / The Stormy Decades: Calcutta, ed. Tanika sarkar and Sekhar Bandyopadhyaya)
৪ঠা সেপ্টেম্বর দুপুরে জনা পঁয়ত্রিশ গুণ্ডা এসে গান্ধীর কাছে অস্ত্র-সমর্পণ করে যায়। পরের দিনও সেই একই ঘটনা ঘটে। এইসব জমা-পড়া স্টেনগান-হ্যান্ড গ্রেনেড-দেশী বন্দুক-কার্তুজ আর তরোয়াল দেখে গান্ধী বেশ মজাই পেয়েছিলেন মনে হয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অস্ত্রগুলো দেখে তিনি মৃদু হেসে বলেন - 'এইসব জিনিষ এই প্রথমবার দেখলাম।' অবশ্য এই অস্ত্রসমর্পণ ছিল নিছকই প্রতীকী। হিন্দু গুণ্ডাদের এক বড় সর্দার গোপাল পাঁঠার কোনো হেলদোলই ছিল না গান্ধীর অনশন নিয়ে।
কিন্তু সাধারণ মানুষ এবং নেতারাও এক সমবেত পাপবোধে ভুগতে শুরু করেন। গান্ধীর রক্ত নিজের হাতে মাখতে তাঁরা কেউই রাজী ছিলেন না, অন্ততঃ সেসময়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে একটি লিখিত বিবৃতিতে প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁরা শহরের শান্তি বিঘ্নিত হতে দেবেন না। এঁদের মধ্যে হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিও ছিলেন। ঐ দিন সকাল থেকেই কলকাতার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নতি হতে শুরু করে। সেদিন রাত ৯টা ১৫তে গান্ধী অনশন ভঙ্গ করেন। ৬ই সেপ্টেম্বর ময়দানে এক বিশাল জনসভায় তিনি বলেন - শান্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েই তিনি অনশন-ভঙ্গ করেছেন; কলকাতার শান্তি বিঘ্নিত হলে আবার তাঁকে অনশনে বসতে হবে।
কেউ কেউ কলকাতার এই ঘটনাকে অলৌকিক বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও গান্ধী নিজে বলেছিলেন - এই ঘটনা অলৌকিকও নয়, আকস্মিকও নয়। হিন্দু-মুসলমান পারস্পরিক মিলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল বলেই দাঙ্গা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। গান্ধীর এই দাবী কতদূর সত্যি, তা বলা কঠিন। দীর্ঘ এক বছর ধরে দাঙ্গার আবহে থাকতে থাকতে মানুষ ক্লান্তও হয়ে পড়েছিল। আর একটি কারণ, যেমন 'হিন্দু' নামের একটি কট্টর দক্ষিনপন্থী কাগজে লেখা হয়েছিল - 'কলিকাতার হিন্দুপক্ষ কিছুদিন হইল প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল এবং কোনো কোনো অঞ্চলের মুসলমানদিগের মধ্যে ত্রাস ও আতঙ্কের সৃষ্টি করিতে সমর্থ হইয়াছিল।' কিন্তু এখন 'সাম্প্রদায়িক রক্তারক্তির আর কোনো সার্থকতা নাই। কেননা পাকিস্তান কায়েম হইয়া গিয়াছে।'
অনেকের কাছেই দাঙ্গার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আরো বড় কারণ ছিলেন ব্যক্তি গান্ধী। তাঁর মৃত্যুর জন্য কলকাতাবাসী নিজেদের দায়ী করতে রাজী ছিল না।
অহিংসা-ভ্রাতৃত্ববোধের মত গান্ধীবাদী আদর্শের টানে অবশ্য মানুষ দাঙ্গা থামায় নি। সারা ভারত জুড়ে তারপরেও দাঙ্গা চলতে থাকে, বিশেষতঃ পাঞ্জাবে। আপাতশান্ত এলাকাতেও চলতে থাকে সাম্প্রদায়িকতার চোরাটান। যার সাময়িক অবসান ঘটবে ৫ মাস পরে ৩০শে জানুয়ারি গান্ধীহত্যার মধ্য দিয়ে।
বিন্যস্ত ও তথ্যবহুল লেখা। সলতে পাকানোর পরের অংশটিও লিখতে অনুরোধ জানাই।
ইন্দ্রদা, এই জায়গাটা নিয়ে লেখালেখি খুব দরকার। ৪৫ পরবর্তী গান্ধীর ভূমিকা এবং স্বাধীন সরকারের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক কী ছিল? ৪৫-এর পরে গান্ধীর নিঃসঙ্গতা দেখে মনে হয়, ভারত ছাড়ো আসলে তাঁর সাংগঠনিক জীবন শেষ করে দিয়েছিল। ১৯৩৯-এ এরকম পদক্ষেপ নিতে তিনি কেন চান নি কিছুটা বোঝা যায় হয়।
কাছাকাছি টপিক নিয়ে এইটা লিখেছিলাম, পোড়ো- https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=20303
ভালো লাগুক না লাগুক, দেশ ভাগের জন্য কংগ্রেস সম্পূর্ণ দায়ী। ইতিহাস নেহেরুকে ক্ষমা করবে না।
বড় তৃপ্তি পেলাম।
আসলে ছোটো বেলা থেকে অনেক লেখাপড়া করা লোকেদের মুখে গান্ধী বিদ্বেষ শুনে কান ক্লান্ত । সুভাষ প্রীতি প্রকাশ এ গান্ধী বিদ্বেষ অনেকের প্রিয় । এ লেখা অনেকের কাছে জবাব।
শ্রদ্ধা নেবেন
বিষয়টা এতোটা একরৈখিক নয়। গান্ধীর শেষ পর্বটি করুণ ও সহানুভুতির দাবী করে। কিন্তু দেশভাগে গান্ধী দায় এড়াতে পারেন না। কেবিনেট কমিশনের গ্রুপিং প্রস্তাব মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছিলো। কংগ্রেস অসম আর উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশের কতৃত্ব হারানোর স্বার্থে এবং গোপীনাথ বরদোলুইয়ের আবদারে গান্ধী এতে রাজি হননি। হলে ভারতের অখন্ড থাকতো। আর হরিপুরা কংগ্রেসের শঠতার দায় একান্তই গান্ধীর। সুভাষ খামোখা ইমোশনাল হয়ে গান্ধীকে মাঠ ছেড়ে দিলেন, সেটা সুভাষের অপরিনামদর্শিতা। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু কুটিল জওহরলালকে মাথায় তোলার অন্ধ "স্নেহ"র হিসাব গান্ধীকে চোকাতেই হতো।
আমি ইন্দ্রনীলবাবুর লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত পাঠক। বহুদিন পরে তিনি ফের কলম ধরেছেন - এটা আমাদের সবার কাছেই একটা বড় পাওনা। এলসিএম লেখাটার যে পর্ব বিভাজন করে দিয়েছেন তার প্রত্যেকটা পর্বই পড়েছি যদিও কোনও মন্তব্য করিনি। বিষয়টা আমার অত্যন্ত আগ্রহের হলেও এখানে যে নিরবচ্ছিন্ন গান্ধী-ভজনা হচ্ছিল তার বিপরীতে গিয়ে মন্তব্য করে ইন্দ্রনীলবাবুর লেখার ফ্লোকে নষ্ট করতে চাইনি। আজ কল্লোলবাবুর মন্তব্যে খানিক সাহস পেলাম। আমারও একই কথা, গান্ধী একরৈখিক চরিত্র নন, ধোওয়া তুলসিপাতাটিও নন। ক্যাবিনেট মিশনের প্রথম থেকেই তাঁর নানা টালবাহানা ও সেই নিয়ে কংগ্রেসিদের বিভিন্ন মহলের অসন্তোষকে যথেষ্ট তোল্লাই দেওয়া - কোনও কিছুতেই তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। দেশভাগের মূল হোতা যে প্যাটেল ও নেহরু এবং তার পুরোটা বুঝতে পেরেও গান্ধীর সেদিকেই ঝুঁকে পড়ার তিক্ত ইতিহাসকে পাঠকের এত ভজনা সত্ত্বেও মানুষ এই জীবনে ভুলতে পারবে না। সেদিকটাও নিশ্চয়ই এই লেখাতে আসবে। আপাতত অধীর অপেক্ষা।
শুধু নেহেরু প্যাটেল নয়, গান্ধীকে ক্রমাগত দেশভাগ, বিশেষতঃ বাংলাভাগের জন্য ঝোলাঝুলি করেছেন কলকাতার মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের হয়ে ঘণশ্যাম বিড়লা নিজেই
"Hindus and Muslims were sons of the same soil of India; they were brothers who therefore must strive to keep India free and united." - M K Gandhi
--
ভারতের পার্টিশনের জন্য গান্ধী দায়ী এরকম একটা মিথ্যে বাজারে চালু আছে, তার কিছু রাজনৈতিক কারণ আছে। খারাপ লাগে দেখে যে লোকজন মিথ্যেটাকে জোর গলায় প্রোমোট করছেন।
খারাপ আমারও লাগে যখন কেউ নাথুরাম অ্যান্ড কোং-কে প্রতিহত করার জন্য অক্লেশে গান্ধীকে ধবধবে সফেদ দেখানোর জন্য অতিশয় ব্যগ্র হয়ে হয় একটা আখাম্বা উদ্ধৃতি নতুবা একটি কাগজের প্রতিবেদনকে সারসত্য হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই করে না ঠ্যাকানো যায় নাথুরামদের, না চর্চা হয় যথাযথ ইতিহাসের। বিশেষত আজাদের বইটা কেন ভারত সরকার কেটেছেঁটে প্রকাশ করেছিল এবং বিস্তর মামলা-মোকদ্দমার কত বছর পরে তা পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয় কিংবা লোহিয়ার গিল্টি মেন অফ ইন্ডিয়াস পার্টিশন শীর্ষক বইটা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল না হয়ে কেউ আলটপকা মন্তব্য করলে আরও খারাপ লাগে। শুধু ইন্দ্রনীলবাবুর টই বলে আর বিস্তারিত আলাপে গেলাম না, নাহলে আরও দু-চার কথা বলার ইচ্ছে ছিল।
কল্লোলবাবু একদম। বিড়লার সঙ্গে গান্ধীর দহরম-মহরম তো লুই ফিশারকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকেই স্পষ্ট। ধন্যবাদ আপনার এই সংযোজনটার জন্য।
এলেবেলে, প্রাসঙ্গিক হলে এখানে বিস্তারিত লিখুন না, মন্তব্য,আলোচনা হলে তো ভালই।
এলেবেলে,
অরণ্যের সাথে একমত। ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণে একমাত্রিক দেবতা নির্মাণ আদৌ কাম্য নয়। নানা মতের প্রকাশ হোক। আপনি লিখুন এখানে। 'শত পুষ্প প্রস্ফুটিত হোক, শত শত চিন্তাধারা প্রতিযোগিতায় নামুক"।
অনীশবাবুকে অনুরোধঃ আপনার বক্তব্যের সমর্থনে তথ্য দিন, বিরুদ্ধমতের ভুল যদি চোখে পড়ে তাকে কাটাছেঁড়া করুন। নইলে গান্ধীর সপক্ষে বলা আপনার কথাগুলো কেবল বিবৃতিমাত্র হয়ে যাবে।
যেমন, হরিপুরা কংগ্রেসে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সভাপতি সুভাষকে কোণঠাসা করার জন্যে গান্ধীর কংগ্রেসের সংবিধান বিরুদ্ধ আচরণ এবং বাকিদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করাটা কোনভাবে জাস্টিফাই করতে পারবেন? তাহলে লিখুন এখানে।
অরণ্য ও রঞ্জনবাবু, ইন্দ্রনীলবাবু সম্ভবত তাঁর লেখা এখনও শেষ করেননি। মানে আমি তাঁর কাছ থেকে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার আশায় আছি। কাজেই মাঝপথেই কোনও মন্তব্য করতে চাই না। শুধু আপাতত যতটুকু তিনি লিখেছেন তার প্রেক্ষিতে বলতে পারি গান্ধীর নোয়াখালি পর্ব ঠিক অতটা মসৃণ বা গৌরবমণ্ডিত নয়। আমি যে গান্ধী লেখার সময়ে ৪৬-৪৭এর দাঙ্গাপর্বটা এড়িয়ে গিয়েছিলাম তার একটা নির্দিষ্ট কারণ ছিল। যথাসময়ে তা প্রকাশিত হবে।
আমি গান্ধীর একনিষ্ঠ ভক্ত নই। আমার আগের লেখায় তাঁর অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু এখানে আমি গান্ধীর জীবনের শেষ এক বছরের ঘটনাসমূহ লিখব বলে ঠিক করেছি। আমার মতামত বা বিশ্লেষণ কিছু তেমন থাকবে না। আপনারা চাইলে আলোচনা করবেন। কিন্তু এই লেখায় আমি তাঁকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়ায় যাবো না। সেসব অন্য লেখার জন্য তুলে রাখলাম।
আর নোয়াখালি পর্ব মসৃণ তো বলি নি! একেবারেই নয়। তবে গৌরবমণ্ডিত কিনা , সে বিষয় তর্কের অপেক্ষা রাখে।