হাসা কোথাকার লোক কেউ জানত না। মনে হয় বাঙালী ছিল না। একটা অদ্ভুত অ্যাক্সেন্টে হড়বড়িয়ে জড়িয়েমড়িয়ে বাংলা বলত সে। কথা অবশ্য খুব অল্পই বলত। "কই মাঠাকরুন ( কিম্বা মাঠান), কিছু কাজ দাও দিনি'' অথবা "বড় ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খেতে দাও দিনি'', "একটা পুরানা কম্বল দাও, জাড় লাগছে হে"- এইজাতীয় সব কথা। সব কথা মনেও নেই। হাসার গায়ের রং ছিল কালো আঙুরের রসে একটু ড্যাশ অফ বাদামী মেশালে যেমন হয়, তেমন। তার চামড়া ছিল বেশ রসালো দেখতে, তুলতুলে দেখতে। যদিও হাসা মোটা ছিল না মোটেই। বরং তার উল্টো। ক্ষীণকায় না হলেও রোগার দিক ঘেঁষেই ছিল সে। তার ওপরে সারা গা দিয়ে ছোট ছোট আঙুরের মত গুটি বেড়িয়ে ব্যাপারটাকে বেশ ঘোরালো করে দিয়েছিল। দাঁত ছিল না। মাড়িতে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলত সে। একটু ঝুঁকে হাঁটত। সব মিলিয়ে তাকে একটা চলমান বাদামী আঙুরের থোকা বলে মনে হত। যদি অবশ্য সেরকম কিছু থেকে থাকে।
এই হাসা আমাদের বাড়ির নানান কাজ করে দিত। পুজোর আগে আগে বাড়িময় ঘাস ছাঁটত, আগাছার জঙ্গল ছাঁটত, নারকেল গাছ সাফ করত, নারকেল পেড়ে দিত। আর কি কি করত , জানি না। আমাদের কেন, পাড়ার অনেকেরই বাড়ি কাজ করত। তার বিনিময়ে খেতে পেত। কিছু টাকা পেত। তাতে ওর চলত কিনা জানি না। আমরা তখন নিতান্তই ছোট মানুষ। অবশ্য চলবে না-ই বা কেন, তিনকুলে কে-ই বা ছিল ওর।
কিম্বা হয়তো কেউ ছিল। কেউ তো জিগ্গেস করে দেখেনি কখনো। থাকুক না থাকুক, তাদের জন্য কোনো ভাবনা ছিল না ওর। নিজের জন্যেও ছিল কি? মাঝেমধ্যেই হাসা উধাও হয়ে যেত কোথাও, মাঝেমধ্যেই সেধে কাজ দিতে চাইলেও করত না। হয়তো পৃথিবীর বিরলতম সুখী মানুষদের একজন ছিল হাসা। যুধিষ্ঠির যে অর্থে বলেছেন, সেই অর্থে নয়। অঋণী, অপ্রবাসী সে ছিল না।কিন্তু সেই পাগলা ফকিরের মত সে-ও হয়তো দেখতে পেত শন শন করে ঘাস গজাচ্ছে, রোদ উঠছে- বিষ্টি পড়ছে, লোক জন্মাচ্ছে, মরেও যাচ্ছে আবার- আর সে আপনমনে খুব একচোট হাসত। হেসে নিত পেট ভর্তি করে।
কিন্তু চিরদিন যে কাহারো সমান নাহি যায়, সে কথা তো কবি কতদিন আগেই বলে গেছেন। এহেন হাসারও হাসি বন্ধ করে দিয়েছিল বনিতা। বা বলা যায়, হাসা'র খরচায় হেসে নিত বনিতা। হাসা'র বেলায় যেমন , বনিতা'র বেলায় কিন্তু তেমন না। যে ঠিকুজিকুষ্ঠি কিছুই জানি না। পাড়াশুদ্ধ সব বাচ্চারা- এবং বড়রাও- জানতাম বনিতা মেদিনীপুরের মেয়ে। অল্প বয়সে সে এসেছিল আমাদেরই পাড়ার একজনের বাড়িতে কাজের মেয়ে হয়ে। অল্প বয়স মানে আমাদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বড়। এখন ভাবলে বুঝতে পারি, তখনই তার বেশ চোখা যৌবন এসে গিয়েছিল শরীরে। সাদা ফ্রক পড়ত, ফ্রকে আঁটত না শরীর। ফর্সা ছিল বেশ, দাঁতগুলোও ঝকঝকে। বনিতা এমনিতে ভালোই ছিল, কিন্তু তার একটাই রোগ-কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়া। হাসাকে নিয়ে একটা ছড়া বানিয়েছিল, দেখতে পেলেই সুর করে সেই ছড়াটা পড়ত সে, আর নিজে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ত। ছড়াটা এইরকম-
হাসা হাস হাসিতে যায়
হাসা'র সোনার নুপুর পা'য়
হাসা পোড়া রুটি খায়
হাসা'র শাশুড়ি পালায়।
( “ওঃ হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ , মাগো’’-হাসতে হাসতে চোখে জল এসে যেত তার।)
প্রথম দুটো লাইনে হাসা আপত্তি করার কিছু পেত না। বরং কিঞ্চিৎ আহ্লাদিতই বোধ করত মনে হয়। হাসার মাথা নিশ্চয় গরম হতে শুরু করত তৃতীয় লাইনের ঐ পোড়া রুটি'র প্রসঙ্গ থেকে। আর চতুর্থ লাইনে পৌঁছে তো হাসা দিশাহারা হয়ে পড়ত, হাতের কাছে ধুলোময়লা- মুথা ঘাস-পাতাপুতা যা পেত ছুঁড়ে মারত। পরের দিকে আর ছড়া বলতেও হত না, বনিতাকে দেখলেই তার মেজাজ খাট্টা হয়ে যেত। বনিতাও হাসাকে দেখতে পেলেই যেখানে যত কাজ থাক, ছুট্টে এসে গেটের সামনে হাজির হত।
এর থেকে মনে হয়, হাসাকে যতটা সুখী ভাবতাম-মানে এখন ভাবছি বসে- ততটা সুখী নিশ্চয় সে ছিল না। শাশুড়ী ও পোড়া রুটি প্রসঙ্গে তার অত খচে যাওয়ারই বা কি ছিল, সেসব কি তার দুর্বল পয়েন্ট, অ্যাকিলিসের হিল? আর বনিতা, সে-ই কি সার্থক সুখী ছিল? নাকি সুখের কল্পনা করে রস পেত এত?সে কি হাসা'র নাম করে নিজের ভবিষ্যৎজীবনের সুখের ছড়াই বানাত বসে বসে? এমন বনিতা , যার পায়ে সোনার নূপুর, যার শাশুড়ী পালিয়ে বেঁচেছে, এবং যে দিনান্তে পেট ভরে রুটিটা - পোড়া হোক যাই হোক-অন্ততঃ খেতে পায় ! এইরকম সব প্রশ্ন পায় এখন ভাবতে বসলে। হাসা ও বনিতাকে পেলে খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তাদের পেলে তবে তো ! আমারও বয়স বাড়লো, আর দুজনেই এক এক করে- না, যা ভাবছেন তা নয়, একসঙ্গে নয়- যে যার মত আলাদা আলাদা কোথায় যে খসে পড়লো, কে জানে। আর তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না।
খুঁজে পাওয়া গেল না টাকে'র মা-কেও। টাকে'র মা ছিল আমাদের পাড়ার একমাত্র- আশেপাশের তিন-চারটে পাড়ারও- রেজিস্টার্ড পাগলী। মানে যাকে বলে ক্লাসিক পাগলী, তাই। গায়ে একটা ছেঁড়া ত্যানা মত ঝুলত, চুলগুলো জট-পাকানো, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসত। খুব শাপমন্যি করত, থুতু ছেটাতো। মাঝেমধ্যে উঠোনে এসে দাঁড়াত- বলতো- ও বৌদি, দুইটা ভাত দাও । গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা, ভয়ধরানো অশরীরী। নাক টিপে তার ত্যানার আঁচলে খাবার ঢেলে দিতে হত। কিছু খেত ,কিছু গায়ে মাখত। তা-ও তো সে ক্কচিৎ। বাকি সময় কী খেয়ে বাঁচত কে জানে। কোনো রোগ-ব্যধিও হত না , আশ্চর্য। কেউ তার খোঁজ নিত না, পরিবারের কেউ না (না, কে যেন একবার ধরে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছিল, নতুন কাপড় পরিয়ে দিয়েছিল। সে কাপড়ও, কদিন বাদে যে কে সেই) লোকে বলত, ওর ছেলের নাম মোটেও "টাক" নয়। তবে কী নাম, সেকথা আজ আর মনে নেই। কেউ জানত কি? একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে গেল সে। তবে আবছা আবছা মনে আসছে, কে নাকি শেষবার দেখেছিল টাকে'র মাকে। নাটাগড়ের দিকে, নাকি অন্য কোনো মাঠে। পথের পাঁচালী'র ইন্দির ঠাকরুণের ভঙ্গিতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে সে, ধূ ধূ মাঠের মধ্যে। শরীরময় মাছি ভন ভন করছে। মাথার ওপর শকুন পাক খাচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে বলে নি কিছু। নাটাগড়ের মাঠ হলে তো গো-ভাগাড়, সারাক্ষণ সেখানকার আকাশে শকুন পাক খেত। শকুনরাও অবশ্য হারিয়ে যাচ্ছে এখন। তবে সে অন্য গল্প।
টাকের মা চলে যাবার পর অনেকদিন আমাদের পাড়ায় কোনো পাগল আসে নি। এর অনেক পরে আসে গৌর পাগলা ও রূপালী। তবে এরা কেউই ঠিক ফুল টাইম পাগলা নয়; আর ঠিক আমাদের পাড়াতেও থাকত না।গৌর ছিল শ্মশান-পাগলা। কেউ মারা গেলেই গৌর ঠিক খবর পেয়ে যেত। কিভাবে পেত কে জানে, অশরীরী কেউ কি ওর কানে কানে এসে এসে বলে যেত? চেনা হোক-অচেনা হোক, সেই মৃতের খাটিয়ায় গৌরের কাঁধ দেওয়া চাইই। না দিতে দিলেই তুলকালাম অশান্তি। গৌর ফুল-পাগলাও ছিল। সকালে উঠে সকলের বাড়ি বাড়ি ফুল তুলে বেড়ানো কাজ ছিল ওর। একদিন আমার সঙ্গে ভোরবেলা চোখাচোখি হয়ে যাওয়াতে খুব নম্রভাবে স্মিত হেসে বলল- ভাই, ভালো আছিস? আমাদের কুচি টগর গাছ নেড়িয়েই তখন ফুল তুলছিল সে। আর আমি এর আগে কোনোদিন গৌরের সঙ্গে বাক্যালাপ করেছি বলেও মনে পড়ে না। কিন্তু পাগলদের কাছে বসুন্ধরা বন্ধু-ভরা। এহেন গৌর একবারই একজনকে শারীরিকভাবে হেনস্থা করেছিল। তার নাম ছিল ভবী পাগলা। কোনো এক দশমীর দিন শক্তিপুরের প্যান্ডেলে ঠাকুরবরণ করে নেমে আসছিলেন পাড়ার মাসিমা, ভবী তাঁকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। গৌর ছুটে এসে ভবীর ব্জ্রমুষ্ঠি ছাড়িয়ে মাসিমাকে মুক্ত করে ও ভবীকে যথেচ্ছ চড়-চাপাটি দেয়। মুখে শুধু একটাই কথা সে ভবীকে বলেছিল-"পাগল হয়েছিস?''
রূপালী ছিল অত্যন্ত সচ্চরিত্রা ও লাজনম্রা। বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে তার, সামনের দাঁত ভাঙা, চোয়াল বসা। ভাঙা দাঁতেই খুব মিষ্টি করে হাসতে পারত সে। ফুল ফুল ছপওলা ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াত এবং কোনো পুরুষকে সামনে দিয়ে যেতে দেখলেই তাকে কুশলপ্রশ্ন না করে ছাড়ত না- "কী রে ভাই, কেমন আছিস?'' বাচ্চা-যুবক-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল পুরুষমানুষই ছিল তার ভাই, এবং কেউ যখন তাকে জিগ্গেস করত-এই রূপালী, আমায় বিয়ে করবি? তখন ছদ্মরাগ দেখিয়ে সে বলত- "ভাই, তুই খুব দুষ্টু হয়েছিস। তুই ভাই না আমার? দাঁড়া, মাকে গিয়ে বলব।''
তবে কিনা এরা সকলেই ছিল পার্ট-টাইম পাগল। এদের প্রত্যেকেরই বাড়ি ছিল, বাড়িতে অন্ন ও স্নেহ ছিল। এরা এখনো হারিয়ে যায় নি তাই, ঈশ্বর! শচীনদা তো পুরো সুস্থই হয়ে উঠলেন দেখতে দেখতে। প্রচণ্ড প্রতিভাবান ছিলেন, খুব পড়তেন। পড়তে পড়তে একদিন পাগল হয়ে গেলেন শেষে। বাবা-মা গেরুয়া নিলেন, ছোট ভাই দিন বদল করবে বলে কাঁধে বন্দুক নিয়ে ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে চলে গেল। আর শচীনদা পাগল হয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন, বিড়বিড় করে বলতে বলতে যেতেন রাস্তা দিয়ে,ঘরে বসে শুনতে পেতাম- "খুব সুযোগসন্ধানী খেলোয়াড়, সুযোগ পেলেই গোল করবে। সুযোগ পেলেই গোল করবে।" কে সুযোগসন্ধানী, শচীনদা? আমাদের এই বজ্জাত বেঁচে-থাকা?
সেই শচীনদা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে সেই জেল্লা আর ফিরে এল না। বাবা মারা গেলেন, অন্য ভাইয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত, তাঁরা দূরে থাকলেও ভাঙা সংসারে গ্যাটিস লাগাতে টাকা পাঠান নিয়মিত। পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা হয় নিয়মিত। ছোট ভাইও ফিরে এসেছে ছত্তিশগড়ের জঙ্গল থেকে, কাঁধ থেকে বন্দুক আর মন থেকে মোহের ভার নামিয়ে রেখে। অভাবের মধ্যে তার একটা চোখ গেছে শুধু সরকারী বুলেটে। স্যানিটি বজায় আছে, আশ্চর্য ! পৃথিবীকে সে আজো ভালোবাসে !
তাই বলে সবাই তো ফেরে না। শ্যামলদা দিব্যি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল, পাগলামির ছিটে-ফোঁটা লক্ষণও তার মধ্যে ছিল না কোনোদিন। হঠাৎ কোনো এক বিয়ে বাড়িতে-পাড়ারই মধ্যে-খুব হই-হট্টগোল শুনে মাথা গলিয়ে দেখি শ্যামলদা চিল-চীৎকার করে বলছে-"অরবিন্দদা, আপনি সাবোতাজ করছেন কেন? সাবোতাজ করছেন কেন?'' অরবিন্দকাকা নাকি শ্যামলদা'র পেছনে লেগেছিল, ইদানিং ও উল্টো-পাল্টা কথা বলতে শুরু করেছে, সে ব্যাপারটা পাড়ার কিছু লোকের নজরে এসেছে, কেউ কেউ ওকে খেপায় তাই নিয়ে। এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যে শ্যামলদাকে ওর বাড়ির লোক আবিষ্কার করে ফ্যানের ডাণ্ডা থেকে ঝুলন্ত অব্স্থায়।
শাটুদা ছিল "চোত-পাগলা''। প্রত্যেক বছর গরম পড়তে না পড়তেই ওর মাথায় পোকা নড়ে উঠত, বছরের বাকি সময় দিব্য স্বাভাবিক । তবে স্বাভাবিক হলেও দেখলে ভয় লাগত, বিশাল বড় চুল সামনের দিকে নেমে এসে চোখদুটোকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে, মুখে অনেক দিনের না-কামানো দাড়ি। কান থেকে লম্বা লম্বা চুল বেরিয়ে আছে। ঠোঁট দুটো একটু উল্টোনোমত, রক্তাভ। খুব ভালো ক্যারাম খেলত সে, হাত পেলে প্রায়শঃ একবারেই বোর্ড সাফ করে দিত। অনেক দূর দূর যেত ক্যারাম খেলার কম্পিটিশনে। সেই শাটুদা একবার খেপে উঠে আমাদের পাড়ার "বিখ্যাত'' মাস্তানকে ( যে নাকি আট-দশটা বডি তখনি নামিয়ে দিয়েছে) মারতে ছুটল। তাকে মারবে বলে শাটুদা নাকি ওয়ান-শটার লুকিয়ে রেখেছে পাড়ার জলের ট্যাঙ্কের মাথায়, যেখানে চিল-দম্পতিরা বাসা করে থাকে। পাড়ার লোকজন সেদিন শাটুদাকে চেপে ধরে না থামালে কী হত কে জানে।
সেই শাটুদা একদিন হারিয়ে গেল। একদম ভ্যানিস। ম্যাজিকের মত, হাল্কা হাওয়ায় ভ্যানিস। সেই জলের ট্যাঙ্কটাও আজ আর নেই। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের জল আসে, আর তাছাড়া ওখানটায় বাজার বসবে। অতবড় ট্যাঙ্কটাকে ভাঙল কীভাবে কে জানে। ভাঙল যদি তো ওয়ান-শটারটা'র কী গতি হল! সে কি এখন মাটির অনেক নীচে শুয়ে নীলচে ঘুম দিচ্ছে, তার গা থেকে কি অনেক অনেক ওয়ান শটারের গাছ বেরোবে? চিলেরাই বা কোথায় বাসা বাঁধবে কে জানে!
আরো অনেক বড় হয়ে আমি একদিন অন্য একটা দেশে যাবো। অনেকগুলো নদী পার হয়ে যেতে হয় সে দেশে। সেখান থেকেও এমনি করে মানুষ হারিয়ে যায়, ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক। সেদেশের এক বাড়িতে হাসি আর তাতা দুই ভাই-বোন থাকতো। থাকতো, এখন আর তারা সেদেশে নেই। হাসির বাবাকে লোকে আড়ালে-আবডালে কিম্বা মুখের ওপর -যে যার রুচিমত-বলতঃ মালাউন।হাসি রাস্তায় বেরোলে ছেলের দল আওয়াজ দিত, "মাইয়ামাইনষের মাথায় কাপড় দিয়া বাইরান লাগে'' । বরাবরের মুখফোঁড় হাসি অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে হুলিয়ে ঝগড়া করত। আর বাড়িতে এসে বাবার কাছে ধমক খেত ; মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন, আর বলতেন-"আমার মাইয়াডার কি অইবে !'' আর তাতা, তাকে কেউ কিছু বলেছিল কিংবা করেছিল কিনা কে জানে, সে দিন দিন আরো চুপচাপ হয়ে যেতে থাকল। তার বড় বড় সুন্দর চোখদুটো দিন দিন আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠতে লাগলো। জ্যোৎস্নায় পরীরা তার চোখ দেখে পাগল হয়ে যেত।
সেই হাসি আর তাতা একদিন অন্য দেশে চলে গেল। তাদের বাড়িতে এখন একলা বাবা-মা বসে থাকেন। রাত আটটা বাজতে না বাজতেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েন তাঁরা। অন্ধকারে জোনাকিরা বাতাবী লেবুর গাছে ভিড় করে। সুপুরী ফুলের সুগন্ধ আসে। খালের মধ্য দিয়ে নৌকা যাতায়তের ভট ভট আওয়াজ ভেসে আসে। গাব গাছের কষটা অন্ধকারের মধ্যে প্যাঁচা ডেকে উঠে। পরীরা উড়ে উড়ে আসে তাতাকে দেখবে বলে,তাদের ডানা তিরতির করে কাঁপে। বন্ধ জানলায় ধাক্কা লেগে তাদের চিকণ গা ছড়ে যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে তাতা'র হ্যারিকেনের আলো আসে না। ভোরের কুয়াশার মধ্যে ঘুমজড়ানো গলায় আজান বেজে ওঠে। সকালের আধফোটা আলোয় ছেলেরা ব্রীজের ওপর শুকোতে দেওয়া ধানের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যায়। একসময় তাতা এদের সঙ্গে এইভাবে পড়তে যেত। ভোরের আলো খোলা জানালা দিয়ে তাতার ঘরেও এসে পড়ে। যে ঘরে তাতা একসময় থাকত। জানলার পাল্লায়, দেয়ালের গায়ে, আয়নার ওপর মায়ের লিপস্টিক দিয়ে একটা হারিয়ে -যাওয়া ছেলে যেখানে তার নাম লিখে রেখেছে-তাতা, তাতা, তাতা !
আমি জানি, তাতা ভালো নেই। হাসি ভালো নেই। তাদের ভালো না থাকা মনের মধ্যে ভরে আমি নদীর ধারে এসে বসি। হারিয়ে যাওয়া মানুষদের মনের মধ্যে ভরে আমি নদীর ধারে এসে বসি। নদীর কোনো দেশ হয় না। সন্ধ্যানদীর তীরে বসে আমার দোদোবুড়ীর কথা মনে আসে। এক শীতের রাতে দোদোবুড়ীর বাড়ি গেছিলাম। ঠাকুমার পা মচকে গেছে। দোদোবুড়ী এসে তেল মালিশ করলে, ফুঁ দিয়ে দিলে, মন্ত্র পড়ে দিলে পা ঠিক হয়ে যাবে। ফোলা কমে যাবে। ব্যথা কমে যাবে। কিন্তু দোদোবুড়ী গেছে অন্য পাড়ায় ঝাড়ফুঁক করতে। দোদোবুড়ীর অপেক্ষায় আমরা বসে আছি দুটি শিশু। গোয়ালে সাঁজাল দেওয়া হয়েছে, তার ধোঁয়া উঠছে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। মশা কামড়াচ্ছে খুব। আমরা বসে আছি। দোদোবুড়ী কখন আসবে জানি না।
সন্ধ্যানদী এইমাত্র লাল হয়ে উঠল খুব। গাঢ়, ঘন, বিষণ্ণ লাল। আদিম নিষাদ তার রক্তমাখা ভল্ল জলে ধুয়ে উঠে এল এইমাত্র। অনেক রক্ত। হাসি জানে, তাতা জানে। নদী জানে। এই নদী, তার পাড় নেই কোনো। শেষ নেই কোনো। সমস্ত আকাশ, তারকামণ্ডলী-কালপুরুষ, ছায়াপথ, সপ্তর্ষিমণ্ডল , লিওনিড নক্ষত্রপুঞ্জ, আর্সা মেজর ও মাইনর-এই সংকোচনশীল-প্রসারণশীল মহাবিশ্বকে সে বুকে ধরে রেখেছে। সে সব হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা জানে। সবাইকে বুকে রাখে। সে বনিতার কথা জানে। বিশাখা'র কথা জানে। বিশাখা বাবুর বাড়ি কাজ করে সল্ট লেকে। আর অবরে -সবরে এসে সন্ধ্যা নদীর বুকে নৌকা চালায়। রোজগার করে। নদীর পাড়ে তখন সন্ধ্যার শাঁখ বাজে। নীলকুঠির সাহেবরা ইঁটের পাঁজার মধ্য দিয়ে,আকন্দ ঝোপের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে সারাদিনের রোদ্দুরের পরে। নদীর পাড় ধরে আনমনা হেঁটে যান বিভুতিভূষণ।
দোদোবুড়ী, তুমি এসো। কত, কতদিন ধরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। তুমি এই নদীর পাড়ে এসো। মন্ত্র বলো। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলি এক এক করে নদী থেকে উঠে আসুক। গা থেকে রক্তজল ঝেড়ে ফেলে দিক। মাটি কত তপ্ত হয়ে আছে। তুমি শান্তির জল ছেটাও। সবাই মাথা নুয়ে পা ঢেকে বসুক।
ওং শান্তি শান্তি শান্তি।