এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • ফুরালে খেলা - ভারতের পটভূমিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস ঃ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

    ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ | ২৫৬১ বার পঠিত

  • জয়ন্ত ভট্টাচার্য(সম্পাদক); ভারতের পটভূমিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস : সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা (কলকাতা: অবভাস, ২০০৯); পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৩৫; মূল্য ১৫০ টাকা

    ----------------------------------------------------

    সময়টা ১৮৪৫। স্থান হুগলির একটি ছোট হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার। একজন নেটিভ রোগীর হাইড্রোসিল অপারেশন করছেন এক শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার ও তাঁর নেটিভ সহযোগী। কিন্তু এমন অপারেশন তো কতই হয়। কি এমন খাসিয়ত এতে, যে তার গল্প শোনাতে বসলাম?

    পাঠক, লক্ষ্য করুন সময়টা। আর একবার মন দিয়ে দেখুন। ১৮৪৫ সাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হতে আরো বারো বছর বাকি। রানীর শাসন লাগু হতে তেরো বছর। কিন্তু এহ বাহ্য। আধুনিক অ্যানেস্থেসিয়ার জন্ম হবে এর ঠিক এক বছর পরে, যখন ১৮৪৬ সালে প্রথম ওপেন ড্রপ ইথার অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবহার শুরু হবে। ক্লোরোফর্মের ব্যবহার তারও এক বছর পরে, ১৮৪৭-এ। সার্জারি তখনো হয়,অগত্যা, অ্যানেস্থেসিয়া বিনা। এবং প্রথম অ্যান্টিসেপ্টিক (কার্বলিক অ্যাসিড) চালু করবেন লর্ড লিস্টার, এরও ঠিক বাইশ বছর পরে।

    সেই শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার, জেমস এসডেইলি আসলে একজন ভারতীয় আসামির ডাবল হাইড্রোসিল-এর সার্জারি করছিলেন। একদিকের অপারেশন করবার সময় রোগীটি যে পরিমাণ যন্ত্রণা ভোগ করেন, তা দেখে তাঁর শল্যবিদের মনে হল-যন্ত্রণা উপশমের একটা কিছু ব্যবস্থা না করলেই নয়। নাহলে অন্যদিকের অপারেশন আর করা হবে না। কিন্তু কী সেই ব্যবস্থা? এবার এসডেইলিকেই উদ্ধৃত করা যাক : "রোগীটিকে ব্যথায় অমন কাতরাতে দেখে আমি আমার নেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনকে ( মেডিকাল কলেজের একজন ছাত্র) জিজ্ঞেস করলাম : তুমি মেসমেরিজম দেখেছ কোথাও? সে বলল, সে মেডিকাল কলেজে চেষ্টা করতে দেখেছে, কিন্তু তারা তো কেউ সফল হয় নি। আমি বললাম : আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে এই রোগীটির ওপর চেষ্টা করতে, কিন্তু আমি আসলে কোথাও এটা করতে দেখিনি। কেবল বইয়েই পড়েছি। আমি কি পারব? মনে হয় না।'

    এবং এসডেইলি পারলেন।

    তো, সেই শুরু। শুরু হল এক অদ্ভুত বিতর্কিত অধ্যায়ের - একদিকে সম্মান, রাশি রাশি সম্মান, অন্যদিকে কলঙ্ক ও নিন্দাপঙ্কে ভরা। একজন চিকিৎসকের - কলোনির একজন ব্রিটিশ চিকিৎসকের পেশাদারি জীবনের সবচেয়ে টালমাটাল সময়ের। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাজের চিকিৎসা-"বিজ্ঞান' -এর যাত্রা, তার আঘাত-সংঘাত, গ্রহণ ও বর্জনের ইতিহাস লেখার জন্য এর থেকে চমকপ্রদ, প্রতিনিধিত্বমূলক কাহিনী বোধ হয় আর হয় না।

    এসডেইলি-এর পদ্ধতি ছিল খানিকটা অদ্ভুত। একটি অন্ধকার ঘরে রোগীকে শুইয়ে রেখে (রোগীর গায়ে একটি লয়েন ক্লথ ছাড়া আর কিছু নেই), তিনি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেন। এবার তার মাথার ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঘন ঘন মুখে ও মাথায় শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দুই হাত দিয়ে রোগীর সর্বাঙ্গে থাবার মত করে বোলাতে থাকতেন (শরীরের ইঞ্চিখানেক ওপর দিয়ে); আর এতেই নাকি রোগী ধীরে ধীরে সম্মোহিত হয়ে পড়ত। এতটাই, যে অপারেশনের কাটা-ছেঁড়াজনিত যন্ত্রণা সে আর টেরই পেত না। পরের দিকে এই ক্লান্তিকর কাজের ভার তিনি তাঁর ভারতীয় সহকারীদের হাতে ছেড়ে দেন। মনে রাখা দরকার এসডেইলি-এর নিজের স্বাস্থ্য খুব একটা ভাল ছিল না, তিনি ছিলেন হাঁপানির রোগী, স্কটল্যাণ্ডের পাহাড়ি পরিবেশ ছেড়ে ট্রপিকসে এসে স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এই আশা পোষণ করতেন তিনি ভারতে আসার আগে। যদিও সে আশা পরে দুরাশায় পরিণত হয়। তিনি খোলাখুলি বলতেন , উপনিবেশের জীবন তাঁর স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

    দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল এসডেইলি-এর জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে ভারতীয়দের মধ্যে। যদিও এসডেইলি শুধু যে ভারতীয়দেরই চিকিৎসা করতেন, তা নয়, উপনিবেশের ইংরেজ চাকুরে আর সৈন্যরাও ছিল তাঁর রোগী। তবু এসডেইলির খ্যাতি ছিল অণ্ডকোষের টিউমার (সম্ভবত: হাইড্রোসিল ) অপারেশনে, যা সেসময়ে ফাইলেরিয়া-ক্লিষ্ট ভারতীয়দের মধ্যে দুর্লভ ছিল না।

    ১৮৪৬ সালে এসডেইলি-এর ব্যথাহীন সার্জারি'র খ্যাতি তৎকালীন বাংলার ডেপুটি গভর্নর স্যার হার্বার্ট ম্যাডক্সের নজরে আসে। সাত সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয় এসডেইলির কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে। অক্টোবর মাসে কমিটি রিপোর্ট দেয়, তারা এসডেইলির কাজে সন্তুষ্ট। নভেম্বরে কলকাতার কাছে একটি ছোট হাসপাতাল তৈরির অনুমতি এসডেইলিকে দেওয়া হল। এটি হবে একটি পরীক্ষামূলক সম্মোহন হাসপাতাল। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি -এর সম্মতি ছাড়া একাজ সম্ভব হত না। খ্যাতির চূড়ায় ওঠার সেই শুরু। বাঙালি অভিজাত ও অর্থবান মধ্যবিত্তদের অর্থসাহায্যে খুব শিগগিরই হাসপাতালটি তৈরি হয়ে ওঠে। অজস্র ইংরেজ আইনবিদ, ডাক্তার, ধর্মযাজক ও উচ্চপদস্থ আমলা এসডেইলি-এর সমর্থকে পরিণত হন। স্বয়ং লর্ড ডালহৌসি ছিলেন এসডেইলি-এর অনুরাগী। ১৮৪৮ সালে তিনি এসডেইলিকে প্রেসিডেন্সি সার্জন পদে নিযুক্ত করেন।

    তবে এই খ্যাতি তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারবেন না। খুব শিগগিরই তাঁকে নেমে আসতে হবে অবজ্ঞা আর অপমান, নিন্দা আর ব্যঙ্গের ধুলো-কাদায়। মুখ্যত ব্রিটিশ ও কিছু কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে শুরু হবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির তুমুল প্রতিযোগিতা, তাঁকে বলা হবে "হাতুড়ে', বলা হবে "জোচ্চোর, ভেল্কিবাজ'। মাত্র আঠেরো মাস চলার পরেই তাঁর মেসমেরিক হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ আসবে। ইথার ও ক্লোরোফর্মের আবিষ্কার তাঁর মেসমেরিক সার্জারির কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেবে, কেননা এখন তো অনেক সস্তায় অনেক নির্ভরযোগ্যভাবে যন্ত্রণাহীন সার্জারির ব্যবস্থা বাজারে এসে গেল। ১৮৫৩ সালে তাঁর কলোনির চাকরির কনট্র্যাক্ট শেষ করে এসডেইলি যখন স্কটল্যান্ডে ফেরেন, তখন তিনি একজন নিন্দাবিদ্ধ, "তিক্ত ও ভেঙে পড়া' মানুষ। এর ছয় বছর বাদে ১৮৫৯ সালে তিনি মারা যান নীরবে, মাত্র একান্ন বছর বয়সে। ডাক্তার-মহলে তাঁর স্মৃতিচারণ হয় না, স্থানীয় খবরের কাগজও চুপচাপ থাকে।

    কিন্তু কেন এই বিরুদ্ধতা? সে কি শুধু সম্মোহনের মত একটা অপরীক্ষিত রাস্তায় এসডেইলির হাঁটাহাঁটি বলে? কাÓসিকাল চিকিৎসাবিদ্যায় (গৌরবে "বিজ্ঞান') তার কোন জায়গা নেই বলে? না কি উপরিতলের কেঁচোর নিরীহ মৃত্তিকাবিলাসের নীচে, বেশ খানিকটা নীচে রয়েছে তত-নিরীহ-নয় এমন কোন উত্তরের ভেনমাস ফণা? আসুন, একটু খুঁড়ে দেখা যাক। সময়টা কলোনির বিস্তারের সময়। এই কাজে, এই বিস্তারের কাজে যেমন সাথ দিয়েছে গোলা ও বারুদ, কম্পাস ও জলযান, মানুষের শরীর , ঠিক তেমনি ছিল আধুনিক হয়ে উঠতে থাকা চিকিৎসাবিদ্যা। দীর্ঘ জলযাত্রায় নাবিক ও সৈনিকদের সুস্থ রেখে, স্কার্ভি সারিয়ে, দুর্গম ট্রপিকসের অজানা সব রোগের টীকা আবিষ্কার করে শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীদের, প্রসপেক্টরদের নীরোগ রেখে; নাহলে তারা দুরধিগম্য বন-বাদাড়-জলা-মরুভূমির অচেনা মশা-মাছি-পোকা-মাকড়ের মোকাবিলা করবেই বা কি করে?

    কিন্তু শুধুই কি নীরোগ রাখা? শুধুই কি শরীর? আর মন? মনের কথা ভাবতে হবে না? লেজিটিমাইজ করে তুলতে হবে না, তরুণ শ্বেতাঙ্গ সৈন্যটির কাছে, নবীন প্রশাসকের কাছে এই দমন-পীড়ন-রক্ত ও শেকলের কাহিনীটিকে? হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন নামক শিশুতোষ আখ্যানমালাকে নিটোল করে তুলতে হবে না কি তাদের কাছে, যারা হবে কলোনির এই বিশাল যন্ত্রের বেল্ট ও বল্টু? সে কাজ কি শুধু করবেন সাহিত্যিক-প্রশাসক-নেতা- দার্শনিকেরা? না, সে কাজ করবেন ডাক্তাররাও, চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান তাই কখনো অজুহাতের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে সাদা মানুষের কাছে, আহা, সারিয়ে তুলতে হবে এই জগতের ব্যাধিপীড়িত কালো মানুষদের, সে কারণেই তো এত কষ্ট সয়েও আমাদের অভ্রভযান, শেষহীন সাগর পেরিয়ে, আফ্রিকায়-ভারতে।

    আরো আছে। আছে হেজিমনি প্রতিষ্ঠার সেই পুরনো, প্রায় ক্লিশে হয়ে যাওয়া গল্প। পশ্চিমের আলো, যুক্তি ও সভ্যতার বিপরীতে পূর্বদেশের অন্ধকার, বর্বরতা, কুসংস্কারকে দেগে দেওয়ার গল্প। একটি নিরালোক অপর নির্মাণের গল্প। লর্ড মেকলে ১৮৩০ সালে বলবেন ভারতবর্ষ এখনও "যে চিকিৎসাপদ্ধতিগুলি অনুসরণ করে তা একজন ইংরেজ ঘোড়ার ডাক্তারকেও লজ্জা দেবে'। ডা: জেমস এসডেইলির দুর্ভাগ্য যে তিনি এই সিত-অসিত ভাগাভাগির ভুল সময়ে ভুল দিকে পড়ে গিয়েছিলেন। কীভাবে, সেকথায় একটু পরে আসছি। মজার কথা, এসডেইলি কিন্তু কলোনিয়াল এই ডিসকোর্সের বেশ সরব সমর্থক ছিলেন। লিখেছিলেন : "বঙ্গবাসীদের চেয়ে পৃথিবীর খুব সামান্য মানুষই,- যদি আদৌ কেউ থেকে থাকে- এত ব্যাপক ও অর্থহীনভাবে কুসংস্কারের কবলে পড়ে আছে। ডাকিনীবিদ্যা, যাদুটোনা, অশরীরী ও দানবের প্রভাব এবং তন্ত্রমন্ত্রের ক্ষমতার প্রতি রয়েছে তাদের সবচেয়ে গভীর বিশ্বাস।'

    তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর পদ্ধতিকে যেন কোনভাবেই প্রাচ্য যাদু-ডাকিনীবিদ্যা-মাম্বো জাম্বোর সঙ্গে সমার্থক করে দেখা না হয়। তিনি একজন শিক্ষিত ব্রিটিশ পেশাদার, ব্রিটেনের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যালয়ের (এডিনবরা) স্নাতক; তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি অতি অবশ্যই বিজ্ঞান, অকাট্যভাবে বিজ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে সেটি নিউটনের তত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। মাধ্যাকর্ষণের সূত্র থেকে তা পৃথক নয়।

    মোটের ওপর এই ছিল এসডেইলি-এর দাবি। কিন্তু আরেকটু গোলমাল তিনি পাকিয়ে রেখেছিলেন এই বলে যে এই ক্ষমতার কারণ হতে পারে বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতের বাইরে, বিজ্ঞানের অতীত কোনো কিছু। সম্মোহনকে তিনি বারবার উল্লেখ করেছিলেন "প্রকৃতির ওষুধ' বলে, যা "করুণাময় ঈশ্বর মানবদেহে সংস্থাপিত করেছেন'। প্রসঙ্গত এসডেইলি ছিলেন ধর্মযাজকের পুত্র, তাঁর ভাই ডেভিড এসডেইলিও ছিলেন একজন রেভারেন্ড।

    সব মিলিয়ে গোলমাল যা একটা পাকাবার, তা পাকালো। কিন্তু কেন? যে মানুষটা কিছুদিন আগেও কলোনির শাসকদের কাছে ছিলেন চোখের মণি, সেই তিনি-ই এত অল্প সময়ের মধ্যে কী করে এমন খলনায়কে পরিণত হলেন, যে তাঁকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হল? উত্তরটা ঠিক জানা নয়, সহজও নয়। এক তো এসডেইলি ছিলেন সাম্রাজ্যের হিসেবে মার্জিনের মানুষ, কলোনির ডাক্তার, সে তিনি যতই সাদা-চামড়ার হোন না কেন। নইলে তাঁর সমসময়ের ডা: জেমস ব্রেইডের তুলনায় তাঁর পরিণতি এমন আলাদা হবে কেন। ব্রেইডও ছিলেন স্কটিশ, এডিনবরার স্নাতক, চর্চা করতেন হিপনোটিজম। কিন্তু কখনো ব্রিটেনের বাইরে পা বাড়ান নি পেশার তাগিদে, হাত ছোঁয়ান নি কালা আদমির কালা চামড়ায়। হয়তো সেই পরিবেশগত কারণেই সযত্নে তিনি হিপনোটিজমকে, সাইকো-ফিজিওলজি-র (অর্থাৎ কিনা বিজ্ঞান) চৌহদ্দির বাইরে আনেন নি । ব্রিটিশ চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস অতএব, তাঁকে মাথায় তুলে রেখেছে, "ফাদার অফ হিপনোটিজম'-এর সম্মান দিয়েছে। অন্যদিকে কলোনির ডাক্তার জেমস এসডেইলি তাঁর "অপবিজ্ঞান' এর দায় মাথায় নিয়ে অকালে মারা গেছেন,কেউ খোঁজও নেয়নি। কেননা, তাঁহার বাড়ি আছিল বনগাঁয়! স্বয়ং ডা: ব্রেইড তাঁকে অভিযুক্ত করে বলেন, তাঁর তত্ত্বের কোনো "সাইকোলজিকাল ভিত্তি' নেই, "

    he believes in the transmission of some peculiar occult influence from the operator to the patient
    '-এই বলে।

    কিন্তু শুধু এহেন মার্জিনের তত্ত্ব যে কতদূর অকাট্য, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগতে পারে। না, অকাট্য নয়। অন্তত: হাতের সামনে যখন রোনাল্ড রস রয়েইছেন। এসডেইলি-এর পক্ষে কাল হয়েছিল তাঁর নাছোড়বান্দা কম্বল-নৈকট্য। নানান স্তরের নেটিভ রোগী তাঁর প্রতি পতঙ্গের মত আকর্ষিত হয়েছিল। আর এরাই, মার্জিনের এই আসল বাসিন্দারাই তাদের পতঙ্গ-ডানায় ভর দিয়ে তাঁকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কলোনির সেই পরিধিতে, যেখান থেকে সেন্টারস্টেজের আলোয় সসম্মানে ফিরে আসা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যতই তিনি অস্বীকার করুন না কেন, শাসিতের সঙ্গে এই নৈকট্য (এসডেইলি-এর মেসমেরিক হাসপাতাল গড়ে ওঠে নেটিভদের অর্থ সাহায্যে) সাম্রাজ্যের প্রভুরা ভালো চোখে দেখেন নি। এবং এই কাছে আসা তো শুধু রোগী ও ডাক্তারের কাছে আসা নয়। এ যেন রোল রিভার্সালের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য হাত পাতছে কলোনির কাছে, প্রতীচ্য শিখছে প্রাচ্যের কাছে হাঁটু গেড়ে। অন্তত: সেদিনের ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসনের একটা বড় অংশ একথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে ভারতীয় ব্ল্যাক ম্যাজিকের সঙ্গে তাঁর পদ্ধতির যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে (আগেই বলেছি, সম্মোহনের ভার ভারতীয় সহযোগীদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন এসডেইলি)। এবং তা যে ব্রিটিশ শাসকের হেজিমনির ধারণাকে ক্ষুণ্ন করছিল না, তা কে বলতে পারে। ক্ষুণ্ন হচ্ছিল যেন বিজ্ঞান, এনলাইটেনমেন্ট, যুক্তিবাদও। রোগীরা আসত তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে; লোকমুখে তাঁর হাসপাতালের নাম দাঁড়িয়েছিল "ম্যাজিক বাড়ি' কিংবা "জাদু-হাসপাতাল'। কলকাতার একটি খবরের কাগজে বেশ রসালো করে পরিবেশিত হয়েছিল কিভাবে এসডেইলি "রক্ত ছড়াছড়ি ' করে অপারেশন করতেন আর তাঁর রোগীরা অপারেশন টেবিলে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে থাকত।

    এ যেন এক দড়ির খেলার বাজিকরের ট্রাজিক গল্প। স্পটলাইটের আলো মুখে নিয়ে তার স্বজাতীয় শ্বেত দর্শকদের হাততালির মধ্য দিয়ে যে হেঁটে যাচ্ছে দড়ির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আর সতত সতর্ক থেকেও যে মাঝরাস্তায় ভয়াবহভাবে পড়ে যাচ্ছে জলে, এক তলহীন কুয়োর জলে, যার নাম "অযুক্তি' , যার নাম "প্রাচ্য কুসংস্কার '। আর তার এতক্ষণের শ্বেত পৃষ্ঠপোষকগণ সে কুরঙ্গ দেখে মুখ বাঁকিয়ে উঠে যাচ্ছে ঘৃণায়। তাছাড়া নতুন আইটেম এসে হাজির হয়েছে এই এনলাইটেনমেন্ট সার্কাসে। ইথার ও ক্লোরোফর্মের আবিষ্কার হয়েছে ততদিনে। অতএব, সব মিলিয়ে এসডেইলির প্রয়োজনও ফুরিয়ে এল। প্রায়োগিক প্রয়োজন, হেজিমনিক প্রয়োজন। নটেশাকটি চূড়ান্তভাবে মুড়োলো।

    যে প্রবন্ধটি অনুসরণ করে এই লেখা ফাঁদা, সেটির নাম "ব্রিটিশ ভারতে সম্মোহনতন্ত্র: ঔপনিবেশিক মনোবিদ্যা, ম্যাজিক ও ধর্ম।' লেখক ওয়ালট্রড আর্নস্ট। লেখাটির অনুবাদ বেরিয়েছে অবভাস -এর মার্চ, ২০০৯ সংখ্যায়। অবভাস -এর এই সংখ্যাটির বিষয় "ভারতের পটভূমিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস'। সম্পাদনা করেছেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য। সর্বমোট বারোটি লেখা। লেখাগুলিকে দুভাগে সাজিয়েছেন সম্পাদক। প্রথম ছটি লেখা র বিষয় "প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা থেকে উপনিবেশকালের চিকিৎসা', মূলত আয়ুর্বেদের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব। শেষ ছটির বিষয় উপনিবেশকালের চিকিৎসা-জ্ঞানতাত্ত্বিক সংঘাত, সমন্বয় ও পুনর্জন্ম। আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধটি এই ভাগের মধ্যে পড়ে।

    লেখাগুলির বেশ কয়েকটি অনুবাদ। রয়েছেন সাবল্টার্ন স্টাডিজ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড আর্নল্ড, জেরাল্ডিন ফোর্বস, ডমিনিক য়ুজাস্তিক প্রমুখ। সবকটি অনুবাদ সমান মাপের নয়, কোথাও কোথাও ভাষা একটু জড়োসড়ো, আড়ষ্ট। আমার বেশি আগ্রহের বিষয় ছিল দ্বিতীয় ভাগের লেখাগুলি। ভালো লেগেছে ডেভিড আর্নল্ড-এর লেখা : "একটি প্রাচীন জাতির অবক্ষয় : উপনিবেশিক ভারতে ম্যালেরিয়া ও রেস (

    Race
    ) , (১৮৬০-১৯৩০)'; ভাল লেগেছে অমিতরঞ্জন বসুর লেখা "পাগলামি বিষয়ক নতুন জ্ঞান: উনিশ শতকের বাংলায় পাগলাগারদের মানসিক চিকিৎসা চর্চা'। কিন্তু ছোট পরিসরে আর সীমিত সময়ে সবকটি লেখার ধরতাই দেওয়া সম্ভব নয়, সম্ভবত কাঙ্খিতও নয়। বইখানা কিনেই পড়ুন। সংগ্রহে রাখবার মত বই। সম্পাদককে ধন্যবাদ।

    --------------

    লেখক পরিচিতি : ইন্দ্রনীল ঘোষ দস্তিদার, পেশা ডাক্তারি, আগ্রহ সাহিত্য

    ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১০


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ | ২৫৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন