অপরাজিত মুক্তিপ্রাপ্তির সময় চলে নি। পরবর্তীতে ভেনিসে গোল্ডেন লিও জেতার পর আবার একবার মুক্তি পায় যতদূর শোনা যায়, তাও চলে নি। এখন এই চলা আর না চলার অচলায়তন থেকে চলচ্চিত্রের মুক্তি নেই বলেই বোধহয় এই প্রসঙ্গ দিয়ে প্রবন্ধ শুরু করতে হল, তবে শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমা যে এদেশে মুক্তি লাভ করেছিল তার কান্ডারী শ্রী সত্যজিৎ রায়। এ আমরা জানি কেবল নয়, প্রায় উপপাদ্যের স্বতঃসিদ্ধ। এখন প্রশ্ন ওঠে শুধুই কি আমরা বিশেষত: এই প্রজন্ম এটাই জানব যে তিনি একজন মহামানব কিংবা এক অসীম প্রজ্ঞার অধিকারী যা একাধিক শাখায় পল্লবিত! নাকি নন্দলাল বসুর সুযোগ্য ছাত্রটির শিল্পসুষমার ভেতর প্রবেশ করার অসামান্য সাহস আমরা দেখাব! আপাতত: এই সিদ্ধান্ত আমি পাঠকের উপর ছাড়তে চাই কারণ আমার স্বল্প সামর্থ্য এই বিশাল মহিরুহের একটি নির্দিষ্ট ছায়ায় বসে জিরোতে চায়।
আধুনিকতার সঠিক সংজ্ঞা বা পুঁথিগত বিশ্লেষণ অনেক সময়সাপেক্ষ এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব। উনিশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় মূলতঃ চিত্রকলা এবং কবিতার জগতে যে সৃজন বিস্ফোরণ ঘটে যায় তা প্রায় অভাবনীয়। ইম্প্রেসনিস্ট চিন্তা কিংবা পরাবাস্তবতা যেভাবে আছাড় মারে শিল্পজগৎকে, শুন্যবাদ, অস্তিত্ববাদ এবং অলীকতার ধারণা পাশ্চাত্যের ঘাড় ধরে নাড়াতে থাকে। এই সময়টা, তৎপরবর্তী দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ মানব অস্তিত্বের এমন কিছু বিষয় নিয়ে আসে শিল্পের আঙিনায় যা মূলতঃ আধুনিকতার মেকি রূপকে খোঁচা মেরে মেরে তার ভেতর থেকে রগরগে তরল বার করে ছড়িয়ে দিতে থাকে এদিক সেদিক। সিনেমা তারই এক মাধ্যম হয়ে ওঠে, অবশ্যই সব সিনেমা নয় কিছু সিনেমা। সংগীত জর্জরিত, ধর্মীয় আখ্যানের নাট্যরূপ কিংবা যাত্রাধর্মিতার হাত থেকে সত্যজিতের পথের পাঁচালী যখন আমাদের সিনেমাকে উদ্ধার করে আমাদের উপহার দিল এক মায়াছবি যা অতিমাত্রায় বাস্তব অথচ স্বপ্নভেজা যার শরীরে উঁকি দেয় গ্রাম বাংলার গোপন সব অভিসার, শেষে উথলে ওঠে কান্না, তখন বিশেষত বাঙালির হৃদয়ে আন্দোলন উঠেছিল বৈকি। অপরাজিত স্বাভাবিক নিয়মেই সদ্য জাদুর ছোঁয়া প্রাপ্ত বাঙালি দর্শকের কাছে ছিল আরো এক হৃদয় নিংড়ানো দৃশ্য প্রাপ্তির এক স্বাভাবিক প্রত্যাশা।
সত্যজিৎ এই প্রত্যাশাকে আঘাত করেন ধাপে ধাপে, অনেকটাই ইচ্ছাকৃত কারন ৩৫ বছর বয়সী এই শিল্পী জানতেন যে কোন সবিশেষ দর্শক বা আবেগ প্রত্যাশা নয়, তিনি চলচ্চিত্র জগতে এসেছেন শিল্পটিকে নিজের মতন করে নিংড়ে নিতে। বিশ্ব সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকা একজন দর্শক হিসাবেও তিনি জানতেন যে তাঁকে ক্রমান্বয়ে প্রয়োগ করে যেতে হবে সমস্ত ধারালো অস্ত্র কারণ তবেই তিনি পৌঁছুতে পারবেন এমন এক সৌকর্যে যাকে অনুকরন করতে বাধ্য হবে সেই বিশ্ব যারা সদর্পে নিজেদের জ্যাঠামো দাবি করে আসছে। অপরাজিত ছবি শুরু এক আশ্চর্য গতিময়তায়, বেনারসগামী ট্রেনের গতি, কাশীর ঘাটে পায়রার ছটফটানি, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যে ছন্দ এই ছবির ঊষা লগ্ন তা কেবল এস্ট্যাবলিসিং শট হিসাবে নয় বরং আসন্ন বিয়োগ মুহূর্তের পূর্বে জীবনের আবহমানতাকে দেখাবার প্রয়াস। বিভূতিভূষণের বিখ্যাত উপন্যাসের থেকে যে একটি খন্ড সত্যজিৎ নিজের মন মতন তুলে নিয়েছিলেন এবং তাতে বিস্তর কাটাছেঁড়া করেছিলেন তার কারণ আমার মনে হয় একেবারে গোড়া থেকেই তিনি তাঁর অভীষ্ট সম্পর্কে ছিলেন পরিষ্কার, লেখকের উপন্যাসধর্মিতা, তৎসংলগ্ন আবেগ এখানে চলচ্চিত্রকারের জন্য মূল উপজীব্য বিষয় হয়নি, আর এখানেই আধুনিকতার প্রবেশ। মা এবং ছেলের স্বাভাবিক আবেগ ও তাদের বিচ্ছিন্নতার যে দুঃখরস তার চেয়ে আধুনিক পৃথিবীতে অপু নামক এক বালকের অবস্থান কি হতে পারে তাই সম্ভবত হয়ে দাঁড়ায় পরিচালকের মূল দৃষ্টিভঙ্গি। আর আধুনিকতার এই প্রয়াসে সঙ্গিনী হয়ে আসে চিত্রনাট্যে গতির ব্যবহার। গতি বলতে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না আজকের সিনেমার মেকি যান্ত্রিক দ্রুততার কথা ভেবে। এ ছবির যে গতি তা মূলতঃ তার আত্মায়। বালক অপুর প্রথম দৃশ্য এই ছবিতে মনে করুন পাঠক, সেখানেও গতি, দৌড়। পরবর্তীতে দেওয়ানপুরে পুরুত পেশায় সদ্য অভ্যস্ত এক বালকের বিদ্যালয় গমনের অভিলাষ, সেখানেও গতি। অপুর যে দৌড় তা অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় এই ছবিতে চরিত্রটির মূল গন্তব্যকে অনুমান করে গেছে। ফিরে আসি শুরুতে। কাশীর ঘাটই শুধু নয়, ভাড়াবাড়িতে হিন্দিঘেঁষা বাংলা, অপুর মুখে শোনা তাঁর অবাঙালি বন্ধু, কথকঠাকুরের কথকতা, হরিহরের মুখে সংলাপ “কবরেজি করচি কি এমনি এমনি?”, পালোয়ানের ব্যায়াম এ সমস্ত কিছুই অঞ্চলটির শরীরে প্রবাহিত সংস্কৃতির নাগাল পেতে চেয়েছে। আধুনিক শিল্প যে স্বতন্ত্রতার সন্ধান করে তা এখানে বিদ্যমান, যেমন বিরাজমান ব্যক্তিমানুষের সংকীর্ণতার ছবি, সামাজিক স্তরবিন্যাস ও তৎসম্পর্কিত দ্বিধার প্রতিফলন নন্দবাবুর কাছে অপুকে পাঠিয়ে সর্বজয়ার দেশলাই চাইবার দৃশ্য, হরিহরের অসুস্থতার ঠিক পরপর নন্দবাবুর “বেয়ান, পান সাজছেন?” অবশ্য শুধু এই দৃশ্যেই নয়, ছবির প্রায় শুরু থেকে সর্বজয়া চরিত্রে করুণা দেবীর অভিব্যক্তি অসামান্য সাবলীলতায় দরিদ্র পরিবারটির ওপর দিয়ে যাওয়া পুরোনো এবং আসন্ন ঝড়গুলোকে তার মুখে প্রতিফলিত করে, কিংবা আশঙ্কা করে। এরপর প্রথম যখন ছবিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাস্তবতার আঘাত জীবনের অনুষঙ্গ কে পায়রার ঝাঁকে ফিরিয়ে আনেন সত্যজিৎ সেই বহুল আলোচিত দৃশ্যে অবশ্য আমার মনে হয় তার ঠিক পূর্বেই বালক অপুর ঘটিতে করে জল আনার দৃশ্যে কাশীর ঘাটে পালোয়ানটির উপস্থিতি আর সেদিকে অপুর এক ঝলক দৃষ্টি আসন্ন মৃত্যুটির পাশে জীবনের এক নীরব উপস্থিতি। অথচ মৃত্যুদৃশ্য স্থায়ী হয় না, হওয়ার কথাও নয়, অপুকে সাদা বসন পড়াবার এক ঝলক এর সাথে সাথেই ছবি চলে যায় পিতৃহারা ছেলে ও তার মায়ের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে কারণ এগিয়ে যেতে হবে, এগিয়ে যাওয়াই আধুনিকতা। ঠিক যেভাবে অপুর মায়ের কোলে শুয়ে সেই সরল জিজ্ঞাসা “তোমার পয়সা নেই মা?”, সর্বজয়ার মুখের ক্লোজ আপ যার সাথে সাথেই ইস্কুল ঘরে শিক্ষকমশাই, পরিদর্শক আর অপুর আবৃত্তি। অভাব অনটন দ্বিধা দ্বন্দ্বের কোন বিস্তার সম্পুর্ন বর্জিত। কারণ ওই এগিয়ে যাওয়া। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মায়ের দেখে ফেলা অপুর ফাইফর্মাশ খাটা পয়সা পাবার বাসনায়, সঙ্গে সঙ্গে সর্বজয়ার সিদ্ধান্ত, সাথে সাথেই গতির অবতারণা। এসব কিছুই একটি নির্দিষ্ট দৃশ্যধর্মিতার পত্তন করে ছবিতে যা সুচিন্তিত এবং উদ্দেশ্যমূলক।
জ্ঞানের জগতে উৎসুক এক বালকের প্রবেশ, তার বিষ্ময়, কেরোসিনের আলোর ক্লোজ আপ শটে অপুর বড় হয়ে ওঠা, গ্রাম্য জীবনে এক স্বপ্নাতুর বালকের কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়া, শিক্ষকমশাই এর কাছ থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ - ছবির এইটুকু অংশের মধ্যে দুলাল দত্তের অসামান্য সম্পাদনা আমাদের প্রস্তুত করতে থাকে আসন্ন উৎকন্ঠার জন্য। অপুর শহরে যাবার কথায় সর্বজয়ার প্রাথমিক বাধা তো প্রত্যাশিত ই ছিল কিন্তু পশ্চাৎপটে অসামান্য শব্দের প্রয়োগ তার অভিঘাত বাড়ায় বিশেষত যখন অপুর প্রতিরোধ আসে সংলাপে “তুমি যা বলবে তাই হবে না?” তবু মায়ের রাগ যে পড়বেই। কিন্তু আশ্চর্য এখানেই, হয়ত বা এখানেই বিভূতিভূষণের অপুর থেকে আমাদের চরিত্র আলাদা হয়ে যায় এত তীব্রভাবে যে মায়ের এতদিনের জমানো অর্থের কথা শোনার পর অপুর মধ্যে আমরা দেখতে পাই বন্ধনমুক্তির অভিব্যক্তি, মায়ের প্রতি আবেগ নয় বরং সামনের আগত দিনের নেশায় এক দারুন উত্তেজনা। কোলকাতা শহরের যে প্রাথমিক বিহ্বলতা তাও যেন স্থায়ী হয় না, কাজের প্রয়োজনটাই বড় হয়ে ওঠে, রয়্যাল প্রেসের যন্ত্রসভ্যতা আধুনিক পৃথিবীকেই চেনায় বেশি করে, মাকে লেখা প্রথম চিঠিও যেন শেষ হতে না হতেই ছবি ডিসলভ করে চলে যায় ক্লাসরুমে, যেন সত্যজিতের সবটুকু আগ্রহ অপুর পৃথিবীতে। “আর ঘুমানোর ক্লাস পেলি না? টিসিবি র ক্লাসে?” -ছোট্ট এক সংলাপ বন্ধুত্বকে নাগরিক জীবনের এক অংশ হিসাবে বরণ করে নেয়।
ঠিক সেসময়েই আমাদের মনে পড়ে মায়ের কথা। সাথে সাথেই সুব্রত মিত্রের দেবসম ক্যামেরা দূরে ট্রেনের দৃশ্যের সাথে সর্বজয়াকে সাজেশন এ রাখে মাদুর গোটানোর দৃশ্যে, পরিচালক বুঝিয়ে দেন ধ্রুপদী চলচ্চিত্রকারের গুণগুলো আধুনিকতার চিত্রনে তিনি মোটেই হারিয়ে ফেলেননি। এরপর অপুর ফিরে আসা, স্বল্প কাটা কাটা সংলাপে মিতভাষী অথচ তীক্ষ এক এফেক্ট এনেছেন সত্যজিৎ। কিন্তু হায় দর্শক, যখনই মা ও ছেলের পুনর্মিলনের অশ্রুসজল দৃশ্য রচনা হতে যাবে, আমরা শুনতে পাই সর্বজয়ার খেদোক্তি, অপুর প্রতি তাঁর মায়ের দাবি, শরীর খারাপের বর্ননা, ছেলের কাছে চিকিৎসার আর্জি জানানো ইত্যাদি। উপন্যাসের সর্বজয়া যখন ‘চিরাচরিত অপুকে ফিরিয়া পায় কোলে’ সিনেমার অপু মায়ের কথার উত্তর টুকুও দিতে পারেনা, ঘুমিয়ে পড়ে। সন্তানের উচ্চাশা আর মায়ের অভিলাষ যেন সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায়, “সময় হবে না মা”- অপুর সপাট উত্তর এবং রবিশঙ্কর এর সুর গল্পকথা বা নাটক নয়, এক আধুনিক বাস্তবতার চিত্ররচনা করে। যে রেললাইন ছোট্ট অপুকে স্বপ্নে তাড়া করে বেড়াত সেই রেলের লাইন এখন তার নিজের জীবনের অগ্রসরতার সঙ্গী হয়ে ওঠে। সর্বজয়ার প্রতীক্ষা অপুকে আর একবার ফিরিয়ে আনে। উপন্যাসের অপু কিন্তু এমনিতেই থেকে যায় আর একদিন। কিন্তু সিনেমার অপু বেড়িয়ে গিয়েও ফিরে আসে। কিন্তু প্রত্যাশিত ভাবেই সে দৃশ্যও ক্ষনিকের। যেন আলাদা কোন গুরুত্ব নেই কেবলই মনের খেয়াল এই ফিরে আসা। ডিসলভ করে সাথে সাথেই ছবি ফিরে আসে শহরে, প্রেসে, অপুর কলেজজীবনে। দু মাস কেটে যায়। ছোট ছোট দু তিনটে শটে।
চোখের তলায় কালি পড়া মায়ের মুখ দেখে আমরা বুঝে যাই, আরো এক পরীক্ষার সামনে পড়তে চলেছে অপু। গাছের তলায় অসুস্থ সর্বজয়া, তার কুণ্ঠা, কষ্ট বেদনা এসমস্ত কিছু নিয়ে মায়ের চরিত্রকে নিষ্ঠুরভাবে সত্যজিৎ রাখেন আমাদের সামনে, আমরা দর্শককুল নিজেদেরকে অপুর জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসাই। আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয় দ্বিধা। মাকে মানি অর্ডারে দু টাকা পাঠিয়ে কর্তব্য সারে অপু। বন্ধুকে বলে, মাকে ম্যানেজ দেবার কথা- গ্রামে তার খালি ঘুম পায়, পড়া হয়না। আধুনিকতায় আরো গাঢ় ভাবে প্রবেশ করেন পরিচালক। ঠিক এর পরের দৃশ্যেই আমরা পাই আবার সেই ট্রেন, যেন দুটি আলাদা পৃথিবী বোঝাপড়ায় আসতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মায়ের শেষ মুহূর্ত, দ্রূপদী ফ্রেম, জোনাকি সঙ্গী হয় সর্বজয়ার, ঠিক এরকমই এক ট্রেনের দৃশ্যে ফিরে আসত অপু কিন্তু সে আর আসেনা। মা আর সন্তানের বিচ্ছিন্নতা ঘটে যায় তাদের যৌথ উপস্থিতি ছাড়াই, ঠিক যেমন বাস্তবে হয়। শহর থেকে অপু ফেরে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে, ফিরে আসে মলম বিক্রেতা শহর জীবনের প্রতীক হয়ে। অপু যেন গ্রামে না ফিরেই বুঝতে পারে জ পল সাত্রের ভাষায় “man is condemned to be free” – তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চরম সিদ্ধান্ত। পরবর্তী অংশটুকু অর্থ্যাৎ ছবির শেষ কিছু দৃশ্যে অপুকে আমরা দেখি ভেঙে পড়তে, মায়ের মৃত্যুতে শোকাহত বিষণ্ন এক চরিত্রকে দেখে আমাদের হটাৎ মনে হয় আমাদের ভীষণ চেনা, কাছের। সমবেদনা জাগে আমাদের। কিন্তু তাও যে এক মাস্টার স্ট্রোক- মুহূর্তের মধ্যেই আমরা উপলব্ধি করি পর্দার পেছনে অবতারের মতন এক শিল্পীকে। সেই শিল্পী যে জানেন তিনি কি করবেন! আসলে আধুনিক একটি কাহিনীই তো নয়, একটি আপাদমস্তক আধুনিক চরিত্র নির্মাণ ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তাই দর্শক প্রত্যাশাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অবধি না করে অপু পা বাড়ায় শহরের দিকে। মৃত্যু তো সে প্রথম দেখছে না।কিন্তু ভাগ্যের এই নিরন্তর উপহাস কে সপাটে চড় কশানোর জন্যই না সে এগিয়ে গেছে শিক্ষার পৃথিবীতে, নাগরিক পৃথিবীতে, আবিষ্কার করেছে এক আধুনিক মন। তা সে ভবিষ্যৎ যেমনই হোক। এখানেই তার জয়, মানুষের জয়, জীবনের জয়- জয় সত্যজিতের।
নটে গাছ মোড়ানোর আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিমায় বলি পাঠক ভাববেন না এতক্ষন অপরাজিত নামক নক্ষত্রটিকে কাটা ছেঁড়া করতে চাইলাম, প্রথাগত কায়দায় রিভিউ বা সেরকম কিছুও করতে চাইনি। সময় এবং স্পেস এর ব্যবহার, দৃশ্যন্তরের প্রণালী কিংবা সিম্বলিজম এইসব নিয়ে আরো অনেক কথাই এ ছবির বিশ্লেষণের উঠে আসবার কথা। ডিটেলের প্রতি পরিচালকের ঈগল দৃষ্টিও এ ছবির এক বিশেষ সম্পদ। হাতার পেছন দিযে সর্বজয়ার চা ঘাটা, অপুকে দইয়ের ফোঁটা কপালে দেওয়া, রাস্তাতে বুড়ি র লাঠির বাড়ি মারা ঝগরুটে ছেলেদের থামানোর চেষ্টা, ইস্কুল গেটে গরু ঢুকে পড়া, অনিলের ‘বেরিয়ে যাবে স্যার?’ এসবই ক্ষণজন্মা পরিচালকের দ্বিতীয় ছবির সম্পদ। তবে এ সব কিছু ছাড়িয়ে আমার কাছে এই ছবির মূল সম্পদ হইয়ে ওঠে আধুনিকতা, দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের নিরাসক্ততা, এগিয়ে যাবার প্রবণতা, এসব কিছু ই এ ছবির প্রাসঙ্গিকতা। আজও এই রাজ্যের প্ৰত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে যখন কোন কিশোর বা কিশোরী, যুবক বা যুবতী ভবিষ্যতের স্বপ্নে মাতাল হয়ে শহরের দিকে পা বাড়ায়, হয়ত বা অন্য রাজ্যের অন্য শহরের দিকে এগিয়ে যায়, তার চোখের সেই রামধনু আকাশে সত্যজিতের অপুকে আমরা খুঁজে পাই সব সময়। এ সত্য চিরন্তন। সেই সত্যের পথে ধাবিত হতেই কয়েকটি দৃষ্টান্ত রাখতে চাইলাম আপনাদের কাছে। আশা করি আপনাদের সময় নষ্টের কারণ হলাম না!
ভালো লাগলো পড়ে। কিন্তু বংশী চন্দ্রগুপ্ত তো সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন না। শিল্প নির্দেশক ছিলেন।
সন্দীপন বাবুকে ধণ্যবাদ ভুল ধরবার জন্য। তথ্য টা হাতে সঠিক ছিল। লেখার সময় দুলাল দত্ত র জায়গায় নাম টা ভুল করে বংশীবাবু র এসে গেছে। দু:খিত।
সঠিক বিশ্লেষণ, যাত্রা কেবলই আধুনিক।