প্রথম সারির দৈনিকের প্রথম পাতায় ‘পেগাসাস’ বলে একটি নতুন শব্দ আমদানি হওয়াতে হয়তো অনেকেই আশ্চর্য হয়েছেন, কিন্তু যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন এই হোয়াটসআপ দিয়ে পেগাসাসের সাহায্যে নজরদারি অন্ততপক্ষে ২০১৬ সাল চলছে। কিছুদিন আগেই সারা দেশ ফাদার স্ট্যান স্বামীর প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা নিয়ে সরব হয়েছিল, কিভাবে তাঁর নামে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছিল তা নিয়ে দেশজুড়ে এখনো আলোচনা চলছে, কিভাবে মিথ্যে প্রমাণ তাঁর ফোনে এবং কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে, যে কিভাবে, কিসের সাহায্যে এই কাজগুলো করা হয়েছে, এবং কার প্রত্যক্ষ মদতে এই গুপ্তচরের কাজটি হয়েছে। এই কিছুদিন আগে আমরা শুনেছি যে চৌকিদার নাকি চোর, এখন তো মনে হচ্ছে চৌকিদার গুপ্তচরও বটে।
প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার এই ‘পেগাসাস’টা কি? এক ইজরায়েলি সাইবার যুদ্ধব্যবসায়ী এনএসও গ্রুপ কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা পেগাসাস বলে একটি ভাইরাস বা স্পাইওয়্যার, কিছু ফোনে তাদের মালিকদের অজান্তে ইনস্টল করে দিয়েছে। এই পেগাসাস ভাইরাস যদি কারুর ফোনে থাকে, তাহলে সেটি ফোনের ক্যামেরা থেকে তাঁর অজান্তেই ছবি বা ভিডিও তুলতে পারবে। এছাড়াও তাঁর কল লিস্ট, কন্ট্যাক্ট, ক্যালেন্ডার, কথাবার্তা, সবই রেকর্ড করতে পারবে। চাইলে কিছু ডকুমেন্ট তাঁর ফোনে বসিয়েও দিতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই ভাইরাস ফোন বন্ধ অবস্থায় থাকলেও যে কোনও মানুষের গতিবিধির ওপরে নজর রাখতে সক্ষম। শোনা যাচ্ছে যে বিভিন্ন সাংবাদিক, সমাজকর্মী - যাঁরাই এই সরকারের বিরোধী, তাঁদের ফোনে তাঁদের অজান্তেই এই ভাইরাস বা স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যথারীতি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এনএসও গ্রুপও তাদের বক্তব্য রেখেছে যে, এই রকম কোনও গুপ্তচরবৃত্তি করা হয়নি। অথচ আমরা জানি এই সংস্থা সরকারের কাছেই এই স্পাইওয়্যার বা ভাইরাস বিক্রি করে।
বেশির ভাগ মানুষ বলতে পারেন যে তিনি তো সরকার বিরোধী নন, তাঁর তো সরকারের কোনও নীতি নিয়ে কোনও উষ্মা নেই, তাহলে তিনি কেন এই সরকারের লক্ষ্যবস্তু হবেন? কোনও মানুষ নিজে হয়তো কিছু লেখেননি, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনও পোস্ট পছন্দ - সেটা জানিয়েছেন। ব্যস তাহলেই হবে। ধরা যাক, একদিন সকালে তিনি মেইল-বক্স খুললেন, দেখলেন একটি মেইল এসেছে জি-মেইল থেকে, তাতে লেখা ‘We believe that your account may have been the target of government backed actors, which means that they could gain access to the information in your account’ এটা পেয়ে কি মনে হবে? তখন কি মনে হবে না যে প্রতিটি কথা সরকার শুনছে? ঠিক এই রকম একটি বার্তা পেয়েছিলেন কলকাতার অন্যতম পরিচিত বিজ্ঞানকর্মী ও সমাজকর্মী পার্থ সারথি রায়। এই পার্থ বাবুকে অনেকেই হয়তো চেনেন বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন দিয়ে, এই পার্থবাবু নানান সময়ে দেশের প্রান্তে নিপীড়িত মানুষদের কাছে পৌঁছে যেতেন। তাঁর সঙ্গে গৌরী লঙ্কেশেরও যোগাযোগ ছিল। তাই কি তাঁর মেইলকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল? যদি খেয়াল করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে যাঁদের ওপর এই নজরদারি চালানো হয়েছিল তাঁরা কোনও না কোনোভাবে এই সরকারের বিরোধী। এই পার্থ সারথি রায়কে কিন্তু সারা বিশ্ব চেনে তাঁর নিজের বিজ্ঞান গবেষণা দিয়ে, কিন্তু তাতে এই সরকারের কিছু আসে যায় না। তিনি যখনই তাঁর সরকার বিরোধী অবস্থান রেখেছেন তখনই তিনি সরকারের চক্ষুশূল হয়েছেন।
প্রথম মনে রাখতে হবে যে এই ইজরায়েলি সাইবার যুদ্ধ ব্যবসায়ী এনএসও কিন্তু একমাত্র কোনও সরকারকেই এই স্পাইওয়্যার বিক্রি করেছে। এই স্পাইওয়্যার এতোটাই দামি, কোনও একজন ব্যক্তির পক্ষে, গুপ্তচরবৃত্তি করার কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকলে, এই স্পাইওয়্যার সাধারণ মানুষের ফোনে ইন্সটল করার কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। খবর যা পাওয়া যাচ্ছে, বিভিন্ন সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বিরোধী দলের নেতা, এমন কী ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গোগোই-এর বিরুদ্ধে যাঁরা যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের সবার ফোনে এই গুপ্তচর স্পাইওয়্যারকে ঢোকানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাঁর নিজের সরকারের সাংসদ এবং মন্ত্রীদের ফোনও বাদ যায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গুপ্তচরবৃত্তি কি আইনত করা যায়? সংসদে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন এবং বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী দুজনেই বলেছেন, যে যা হয়েছে, আইন মেনেই হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা এ-ও বলেছেন যে এই বিষয় নিয়ে এত জলঘোলা করার বা হইচই করার কি আছে? এ তো অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, সারা বিশ্বের ৪৫ টি দেশ এই স্পাইওয়্যার কিনেছে, শুধুমাত্র ভারতেই এর সমালোচনা হচ্ছে কেন? বিরোধীরা উল্টে এই প্রশ্ন যদি সরকারকে করে, যে যদি সরকার এই পেগাসাস ইজরায়েলি সংস্থার থেকে কিনেই থাকে, কি উদ্দেশ্যে তাঁরা তা কিনেছেন, সেটা সোজাসুজি প্রকাশ্যে বলতে হবে। এই স্পাইওয়্যার দিয়ে দেশের উন্নয়ন বা বিকাশ হবে, এই ভেবে কেনা হয়নি নিশ্চিত। কিংবা যদি কোনও ব্যক্তি প্রশ্ন করে বসেন - এই স্পাইওয়্যার দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে কত খরচ হলো, সেটা কোন ভাণ্ডার থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা কি দেশের জনগণের জানার অধিকার নেই? পিএম-কেয়ারস বা এই ধরনের, যা পরীক্ষা করা হবে না, সেই রকম কোনও ফান্ড? নাকি নির্বাচনী বন্ডে যে টাকা উঠেছে সেই টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে এই স্পাইওয়্যার? তাহলে সরকারের তরফ থেকে কি উত্তর আসবে?
কিন্তু যাঁরা এই কথা বলছেন, কিংবা যাঁরা মনে করে থাকেন সমস্ত বার্তাই তো গোপনীয়, কোনও মানুষ বা রোবটের পক্ষেই এটা পড়তে পারা সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য কিছু কথা বলা জরুরি। যে কোনও বার্তা যে বলা হয় ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড’- এটা একটি ফোন থেকে অন্য ফোনে যাওয়ার সময়ের কথা মাথায় রেখে বলা হয়, অন্যথায় এই ধরনের স্পাইওয়ার যদি কোনও ফোনে ইন্সটল করা হয়, তাহলে সেই ফোনের সমস্ত কিছু দেখা সম্ভব, এমনকি সেই ফোন থেকে যদি কোনও ব্যক্তি তাঁর অর্থনৈতিক কাজ চালান, তাহলে সেই ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, তাঁর পাসওয়ার্ড এবং যত যাবতীয় তথ্য চুরি করা সম্ভব। আরও একটু তথ্য দেওয়া যাক, এই এনএসও গ্রুপ এর মালিক ফ্রান্সেস্কো পার্টনার। এদেরই আর একটি সংস্থা ক্রসম্যাচ, আমাদের আধার বানাতে ভারত সরকার যাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে, যারা সমগ্র ভারতবাসীর আঙুলের ছাপ, রেটিনা স্ক্যান ইত্যাদি অত্যন্ত ব্যক্তিগত তথ্যের অধিকারী। এই যে আজকে আধারের সঙ্গে রেশন কার্ড সংযোগের জন্য সবাই ছুটছেন, তাহলে আসলে নিজের তথ্য কি এই ইজারায়েলি সংস্থার মালিকের হাতে তুলে দেওয়র জন্য এত তোড়জোড় চলছে? তাহলে এখন যদি কেউ প্রশ্ন করেন, যে নির্দিষ্ট বরাত না পেলে নাকি এই এনএসও র মতো সংস্থা কাজ করে না, এবং তারা সরকার ছাড়া কাউকে এই স্পাইওয়্যার বিক্রি করে না, তাহলে ভারতের এই বিভিন্ন মানুষের ফোন নম্বরে যে গুপ্তচরবৃত্তি করা হলো, বা বলা ভালো এখনো চলছে, সেগুলো তাহলে কার নির্দেশে হয়েছে?
বিরোধীরা যথাযথ কারণেই এই নজরদারি করার বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এই নজরদারি অত্যন্ত ভয়ের একটি পদক্ষেপ এবং এই স্পাইওয়্যার দিয়ে যে ইভিএম বা ভোটিং মেশিনকেও প্রভাবিত করা যায় না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনেকে আবার বিরুদ্ধ যুক্তিও দিয়েছেন, কোনও ব্যক্তির যদি লুকোনোর মত কিছু না থাকে, তাহলে তাঁর ভয়ের তো কোনও কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু এখানেই একটা মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন এসে যায়। গোপনীয়তা মানে কোনও কিছু লুকোনো নয়, উল্টে প্রতিটি নাগরিকের একটি নিজস্ব জায়গা থাকাটাই গোপনীয়তা, যা কোনওভাবেই অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যাঁরা ভাবছেন যে তাঁর ব্যক্তিগত ফোনে তো এই স্পাইওয়্যার সরকার ঢোকায়নি, তাহলে তাঁর এই বিষয়ে না ভাবলেও চলবে, তাঁরা সম্পুর্ণ মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। যেহেতু কোনও একটি ব্যক্তির সমস্ত কিছুর নাগাল পাওয়া সম্ভব এই স্পাইওয়্যারের দৌলতে, সুতরাং তাঁর কন্ট্যাক্ট তালিকারও নাগাল পাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়। সেই সূত্র ধরে তাঁদের অর্থনৈতিক লেনদেনও যে সরকার দেখছে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
যখন সরকারের উচিৎ ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রকে রক্ষা স্বার্থে কাজ করার, তখন শাসক দলের নেতামন্ত্রীরা প্রায় সমস্বরে অস্বীকার করে চলেছেন এই নজরদারির কথা। বারংবার ইঙ্গিত করছেন যে এটি একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করার জন্য, কিন্তু সত্যিটা কি তাই? যতই এই সরকারের পক্ষ থেকে বিগত ইউপিএ সরকারের নজরদারির দিকে আঙুল তোলা হোক না কেন, এটা কি অস্বীকার করা যাবে, যে এই সরকার তাঁর বিরোধী কোনও কিছু যাতে মাথা-চাড়া না দেয় সেদিকে যথেষ্ট সচেতন? এই সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করেও সেই জরুরি অবস্থার হাড়হিম করা পরিবেশ যে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, সেটা কি যে কোনও গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষ অস্বীকার করতে পারেন? এই সরকার যেভাবে ফাদার স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে প্রমাণ প্রোথিত করেছে বলে শোনা যাচ্ছে, কিম্বা যেভাবে ভীমা কোরেগাও মামলা সরকারের নিজস্ব তদন্তকারী সংস্থা সাজাচ্ছে তা দেখে কি মনে হচ্ছে আমরা খুব সুখের সময়ে বাস করছি? সমস্যাটা হচ্ছে এই পেগাসাস নিয়ে সাময়িক যে অস্বস্তির মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পড়েছে, তা কাটিয়ে উঠবে তারা অচিরেই, কারণ রাজনৈতিক সমাজ এবং নাগরিক সমাজ কখনোই সমস্বরে আওয়াজ তুলবে না, যে এই গুপ্তচরবৃত্তিকে আইনত মান্যতা দিলে আখেরে দেশের গণতন্ত্রের ক্ষতি। তাই গ্রিক পুরাণের ঘোড়া থেকে গণতন্ত্রের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?
বিস্তারিত জানলাম..
যাদের ফোনে পেগ্যাসাস থাকলেও থাকতে পারে বলে কাগজে লিখছে তাদের মধ্যে কতজনের ফোনে আদৌ পেগ্যাসাস পাওয়া গেছে?
সরকারে থাকা সব দলই বিরোধীদের উপর নজরদারি চালায়। এতে নতুনত্ব কি আছে? 70 বছর ধরে সাধারণ মানুষ এসব কম দেখেনি।
পেগাসাস ইত্যাদি নিয়ে আলাদা করে হৈচৈ কেন হয় বুঝিনা। গুগল আর আপেল তো কবে থেকে সমস্ত স্মার্টফোন ব্যবহারকারিদের ২৪ ঘন্টা নজরবন্দী করে রেখেছে!