সিধু জ্যঠামি
তামিমৌ ত্রমি
সেই সেদিনের কমলা হেম-পুকুরে নীল সুতোর হেম-হাঁস চরে বেড়ানো টেপজামাবেলাতেই হোক অথবা আজ্কের খোঁপাবেলায় কোলেরটির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঠাকুরমার ঝুলি’র পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঢুলবার কালেই হোক, গুপী গাইন আর বাঘা বাইন -এই দুই সঙ্গীর সঙ্গে আকাশে বাতাসে ঘাসে ঘাসে মহানন্দে হারিয়ে যেতে কোন সময়েই কি কারোর মানা আছে? তারা যেমন হাল্লার রাজা আর রাজকন্যাকে ভূতের রাজার মায়াবরে হাল্লা থেকে শুণ্ডিতে ট্রান্সপোর্ট করেছিল, তেমনি আমিও মাঝেমাঝে তাদের মধ্যমণি হয়ে কখনো সাগরে দেখি চেয়ে , কখনো দৃশ্য দেখি বন্য, আবার কখনো তুষারমণ্ডিত শির সৃজনের বিস্ময় দুর্জয় হিমালয়।
যেমন এই মুহুর্তে আমার ইচ্ছে করছে তাদের সঙ্গে হাল্লার মন্ত্রীর বিপুল গদীসম্পন্ন সুখাসনের ঠিক পিছনে গিয়ে লুকোতে। কেন? কারণ আর কিছুই নয় – আর দু এক মিনিট নখরাগ্র দংশনের শেষেই আবির্ভূত হবেন ধরণীর নবম আশ্চর্য্য মোহমহিম ব্যক্তিত্ব।
‘বরফি’ - নামটাই এমন যে উচ্চারণমাত্রেই জিভ নামক অঙ্গটি আলোড়ন ও আস্ফালনে প্রবলভাবে জানাতে থাকে নিজের অস্তিত্ব এবং প্রখর অবাধ্যতায় কেবলই মুখের দরজা ঠেলে পিছলে পিছলে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু নবম আশ্চর্য্যের কথাটা এই, যখন বরফি আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসেন তখন যেন আমাদের চোখদুটোও দুখানা রসনায় পরিণত হয় এবং তার পোষাক – পরিচ্ছদের প্রতিটি আঁক এবং বাঁক, প্রত্যেক মুখ ও দেহভঙ্গী যেন চক্ষুবতীরা গিলে ফেললে তবে তাদের শান্তি।
সবচেয়ে থমঘন ব্যাপারটি হল, বরফি’র সানগ্লাস। অমন বরফি আকারের সানগ্লাস কস্মিনকালেও যে হতে পারে সে ধারণা ছিল না সেই সাদামাটা সময়ে। আর টুপিতে আরশোলার মতো শুঁয়ো!
এরপর গঙ্গা যমুনা দিয়ে কত কোটি কোটি হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের ছানারা বয়ে গেছে… আজ এই শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে থাকা অক্সিজেনের বার্ধক্যে কত যে ছোটদের ছবি দেখা হল, তাতে যে কতসব বিদ্ঘুটে চেহারার কিম্ভূত চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হল তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু একটা অদ্ভুত টুপি, একটা বরফিছাপ আলখাল্লা, একটা বরফি সানগ্লাস আর একটুখানি ভনভন মক্ষিকা সুলভ চলাফেরা আর যথোপযুক্ত সুরের মেলবন্ধনে একটি চরিত্রকে গ্রহাতীত বিশিষ্টতা দেওয়া, এ বিস্ময়ের ভাগ হবে না!
আর সেই মানুষ ! বরফি’র মতোই ধারালো রূপময়তার অধিকারী মিষ্টিমধুর সরল হাস্যমাখা ব্যক্তিত্ব যিনি একটি কথাও না বলে শুধুমাত্র আকারে ইঙ্গিতে চলনে বলনে নিজের লোভ শঠতায় যাদুবিদ্যার পারঙ্গমতায় রুদ্রতেজে মন্ত্রীর মতো ষড়যন্ত্রীকেও দশমহাবিদ্যায় দাঁত খিঁচিয়ে অম্লান -আজও আমাদের হৃদয়ের সিংহাসনে যিনি যাদুকরদের সম্রাট হয়ে বসে আছেন!
সেই স্বরাট যাদুকরই আবার কোন মোহন ইন্দ্রজালে আমাদের সামনে জ্ঞানের এভারেস্ট ‘সবজান্তা সিধু জ্যাঠা’য় বদলে যান। শার্লক হোমসেরও মাইক্রফট হোমস রয়েছেন। মাইক্রফটের ‘ডিডাকশন’ দেখলে হতচকিত হতে হয় ঠিক কথা কিন্তু পুজোঘরের ধূপ -দীপ – চন্দন আর পুষ্পগন্ধী শ্রদ্ধা জাগে কি বা তপোবনসুলভ বৈরাগ্যের ভাব? জ্ঞান সাগরে নিমজ্জিত জ্ঞানগর্ভ মানুষটি অনেক কিছু করতে পারার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে জ্ঞানভিক্ষু হয়ে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন, তা আমাদের এই মাউজ বা ব্রাউজার দৌড়ের জীবনে যেন হ্যালির ধূমকেতুসম অহংকৃত উপদ্রব ! আমরা যেখানে সোনার পাখি সোনার শিকলে বেঁধে জানলাগুলো বন্ধ করে রেখেছি যাতে খাঁচার পাখি খাঁচা থেকে কোনগতিকে বেরিয়ে পড়লেও সে যেন ঘর থেকে কোনমতেই বেরোতে না পারে; অনন্ত কোয়ারান্টাইনকেই নিয়তি বলে মনে করে সেখানে সিধু জ্যাঠা একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন মনের সবকটা জানলা খুলে রেখে ! কাঁধে ফেলা সেই প্রাজ্ঞ শাল, মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে বাঁধানো মোটা বই এবং স্থিতপ্রজ্ঞ সৌম্য মূর্তিমন্ত মানুষ কোনদিনও তাঁর মোহজ্যাঠামি থেকে আমাদের মুক্তি দেবেন কি?
প্রথিতযশা কবি, নাট্যকার, অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, প্রথম লোকসভার সদস্য (১৯৫২ -১৯৫৭), সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়ের (নাইডু) ভাই, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাঁর কাব্যপ্রতিভার প্রশংসা করেছেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব শ্রী হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বাংলা ও হিন্দী চলচ্চিত্র ও সাহিত্য জগতে ১৯৯০ এর ২৩ শে জুন অবধি যে মণি মুক্তো অবলীলায় ছড়িয়ে রেখে গেলেন -তা কুড়িয়ে সেই আলোচাল কুড়তে কুড়তে আমাদের বেলা হয়ে যাবে সন্দেহ নেই। তবে মনশ্চক্ষে দেখতে পাই, সাহেব বিবি গোলামের (হিন্দী) ‘ঘড়িবাবু’ যেন আজও তাঁর মহাকালিক ঘড়িঘরে হরেক কিসিমের অবদানে দম দিচ্ছেন, পেণ্ডুলামের মতো বিজ্ঞ মাথাটি নাড়াচ্ছেন আর অপেক্ষা করছেন ভ্রমনাশী কালসমুদ্র পেরিয়ে ধুলোজাল ছিঁড়ে কবে ভবিষ্য ভূতনাথ এসে তাঁর দরজায় কড়াঘাত করবে।
আমাদের প্রথম যৌবনে একটি সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ছিল ইংরেজিতে, নাম 'ব্লিটজ'-মালিক এবং সম্পাদক আর কে করঞ্জিয়া। তার 'লাস্ট পেজ' বলে পাতাটা ছিল খাজা আহমেদ আব্বাস নামক চিত্রপরিচালক ও রাজ কাপুরের অধিকাংশ ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রাইটারের।
কিন্তু আরেকটি আকর্ষণ ছিল ভেতরের পাতায় সিধুজ্যাঠা বা হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের একটি দীর্ঘ ইংরেজি কবিতা-প্রায় প্রত্যেক সংখ্যায়। খেয়াল করুন, পরের দিকে 'জুলি' ফিল্মের সেই কাল্ট সং -প্রীতি সাগরের গলায় "মাই হার্ট ইজ বীটিং" লিরিকটি ওই সিধু জ্যাঠার লেখা।
অথচ ইনি অন্ধ্রে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রথম লোকসভায় অন্ধ্র থেকে কমিউনিস্ট সমর্থিত নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। শোনা কথা ,একদিন লোকসভায় স্বরচিত হিন্দি গীত "সূর্য অস্ত হো গয়া, গগন মস্ত হো গয়া" গাইতে গাইতে ঢুকেছিলেন। নেহেরু স্মিত মুখে শুনছিলেন এবং বিরোধীরা তাল দিচ্ছিলেন।
অশেষ ধন্যবাদ ! জুলির গানটা ওঁর লেখা জানতাম না! ব্লিতস খুব মনে পড়ে। ইন্দ্র সেন জোহারের কলাম আর ভক্স পপুলি ! আর সিধু জ্যাঠার কবিতা! কত কিছু মনে করিয়ে দিলেন!
একটা কলাম ছিল - আই ডোনট নো সন !
লেখাটি বরফি ও সিধুজ্যাঠা নামক চরিত্রদুটি নিয়ে নাকি হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে , তা ভাল করে বুঝতে পারা গেল না।