এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হুল জোহার আর ৭ই জুলাই

    TANJAN BOSE লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ জুলাই ২০২৪ | ১২১ বার পঠিত
  • ৩০শে জুন হুল দিবস হিসাবে পালিত হয় ঠিকই, কিন্তু এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ঠিক হয় আজকের দিনেই৷ ১৮৫৪ সালের এই দিনেই ঘটে মহেশলাল দত্তের নিধন৷ যেখান থেকে আন্দোলনের গতিই পালটে যায়৷ হান্টার সাহেবের মত অনুযায়ী, "... দারোগা হত্যার ঘটনাটিই তাঁহাদের অভিযানের চরিত্র ও রূপ বদলাইয়া দেয়। নিরীহ সাঁওতাল এবার প্রতিহিংসার জ্বালায় উন্মাদ হইয়া ওঠে এবং তাঁহাদের বিস্মৃতপ্রায় বন্য চরিত্র নূতনভাবে দেখা দেয়!" কিন্তু কে এই মহেশ দারোগা? কেন তার হত্যা? আজকের লেখা এই নিয়ে। 

    সাঁওতালদের উপর বাঙালি জমিদার আর মহাজনদের অত্যাচার সুবিদিত৷ এদের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ায় লুচিমপুরের বীরসিং পরগনাইত৷ তাঁর ডাকে প্রতিদিনই সাঁওতালরা জমায়েত হতে থাকে৷ এতে স্থানীয় মহাজনদের মন সন্দিগ্ধ হতে থাকে৷ তারা প্রথম বাদলাগঞ্জ থানার মহেশ দারোগাকে এই ঘটনার কথা জানায়৷ কিন্তু মহেশ দারোগা কর্ণপাত করেনা৷ ব্রিটিশ শাসনে শান্তিভঙ্গ করার সাহস কারুর নেই৷ তখন উপায়ান্তর না দেখে নিজেরাই শাসন করার অছিলায় অম্বর গ্রামের জমিদারের নায়েব জগবন্ধু রায় বীরসিংকে ডেকে সভা করতে নিষেধাজ্ঞা জানায় এবং এক বিশাল অঙ্কের জরিমানা চাপিয়ে দেয়৷ বীরসিং নিজের নির্দোষিতা জানালে সর্বসমক্ষেই তাকে জুতোপেটা করে৷ এইভাবেই প্রথম বিক্ষোভের আগুন জ্বলা শুরু হয়৷ সেইদিন রাতেই চানদো বোঙ্গার নামে মোরগ, পায়রা বলি দিয়ে বীরসিং সঙ্গীসাথী সহ ময়রাদের বাড়ি লুঠ করে৷ 

    সেখানকার মহাজন পরদিন মহেশ দারোগার কাছে নালিশ করে এই বিষয়ে৷ ওই অঞ্চলে ভজা পরগনাইতের ভাই গোচ্চো বাস করতেন৷ তিনি ছিলেন ধনী সাঁওতাল৷ মহাজন আর দারোগার লোভ ছিল তাঁর টাকার উপর৷ ফলত দারোগা গোচ্চোকে ডেকে এনে মারধোর করে৷ যদিও এযাত্রা দারোগা গোচ্চো বা অন্যকাউকে গ্রেফতার করেনি কিন্তু পরের বছর গোচ্চোকে দলবল সমেত ধরে এনে নির্যাতন করে৷ এই ঘটনায় সাঁওতাল সমাজে আগুন জ্বলে ওঠে৷ 

    ভগ্নাডিহির চূণার গ্রামের পরগনাইতের ছিল চার ছেলে৷ সিধু,কানহু, চাঁদ আর ভৈরব৷ এদের মধ্যে সিধু, কানহু ঘোষনা করে দেয় যে মারাঙবুরু তাদের দেখা দিয়েছে এবং সাঁওতালদের এক হতে বলেছে৷ শালপাতার মাধ্যমে সাঁওতালদের এককাট্টা করে ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন৷ এই সময়ই আরেক ঘটনা ঘটে।  কতিপয় সাহেব রাজমহলের কাছে বসবাস করা সাঁওতাদের তিনজন স্ত্রীলোককে অপহরণ করে৷ সাঁওতালরা একত্রিত হয়ে সাহেবদের হত্যা করে স্ত্রীলোকদের উদ্ধার করলেও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ এবং সিধু কানহুর সভায় দলে দলে যোগ দেয়৷  শুধুই সাঁওতাল নয় কিন্তু৷ আশেপাশের অঞ্চলের নিম্নশ্রেনীর খেটে খাওয়া হিন্দু, মুসলিমরাও একজোট হয়৷ এইদিনেই ওঁরা ঘোষনা করেন যে সমবেত ভাবে কলকাতায় গিয়ে সরকারের কাছে নিজেদের অভিযোগ জানাবে৷ তাঁদের অভিযোগ খুবই সোজাসাপটা ছিল৷ মহাজনেরা সাঁওতালদের শোষন করে নিজেদের সম্পত্তি বানায়৷ কিন্তু মহাজনদের লুঠ করলে সাঁওতালদের শাস্তি হলে মহাজনদের কোন শাস্তি হয়না কেন?  তারা নিজেদের জমির উপর নিজেদের অধিকারের দাবী নিয়েই শুরু করে পথচলা৷ চলতে চলতে পাঁচক্ষেতিয়া বাজারে এসে উপস্থিত হয়৷ এইলহানে তাঁদের পথ রোধ করে মহেশ দারোগা৷ মহেশ দারোগা তাঁর মনোভাব গোপন রাখার চেষ্টা করলেও সাঁওতালরা জানতে পারে যে উক্ত বাজারে অবস্থিত পাঁচ কুখ্যাত মহাজনের থেকে ঘুষ খেয়ে দারোগা এসেচহে মূলত তাদের নামে চুরির মামলা দায়ের করে গ্রেফতার করতে৷ তারা এর প্রতিবাদ করায় মহেশ দারোগা তার দলকে নির্দেশ দেয় এদের উপর অত্যাচার চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করার৷ কয়েকজনকে মেরে বেঁধেও রাখে৷ এরফলে সৃষ্টি হয় চরম উত্তেজনার৷ কয়েকজন ছুটে আসে বন্দীদের মুক্ত করতে৷ মহেশ দারোগা হাতে থাকা বল্লম নিয়ে প্রথম যাকে সামনে পায় তাকেই গেঁথে ফেলে৷ কিন্তু ততক্ষনে তাকে ঘিরে ফেলে অন্যরা এবং টাঙ্গির কোপে তার মাথা আলাদা করে দেয়৷ একই সময়ে ওই বাজারে অবস্থিত পাঁচ কুখ্যাত মহাজন মানিক চৌধুরী, গোরাচাঁদ সেন, সার্থক রক্ষিত, নিমাই দত্ত আর হিরু দত্তকেও হত্যা করে বিদ্রোহীরা৷ 

    মহেশ দারোগা মূলত ছিল মহাজনদের খাসলোক৷ তাঁদের ঘুষের টাকা খেয়ে তাদের অঙ্গুলিহেলনেই সাঁওতালদের উপর অত্যাচার করত৷  আরেকদিকে বিপ্লবীদের দলেছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিপীড়িত শ্রেনীর মানুষ৷ তাই ইংরেজরা এই বিপ্লবকে "Santhal rebellion " এর নাম দিলেও তা ছিল মূলত শাসক শ্রেনীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেনীর সংগ্রামই৷ কারন এই মহাজন, জমিদার, দারোগা ছিল ইংরেজ শাসনের মূল স্তম্ভ৷ এদের অন্তরালে বাস করেই ইংরেজ সরকার নিজেদের শোষন নিপীড়ন চালাত৷ এই বিদ্রোহের অসফলতার হাজার একটা কারণ আছে৷ কিন্তু ধনিক শ্রেনীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীর এই প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম ইংরেজ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়৷ সাধারণ মানুষের ভিতরে বিপ্লবের বীজ বোনে৷ যার ফলস্বরূপ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সংগঠিত হয়৷

    তথ্যসূত্র 
    সাঁওতাল বিদ্রোহ - সুপ্রকাশ রায়
    ১৮৫৫ র সাঁওতাল হুলের ইতিহাস - দিগম্বর চক্রবর্ত্তী৷ সাঁওতাল বিদ্রোহ - গৌরিহর মিত্র
    সাঁওতাল অভ্যুত্থান - এল নটরাজন
    সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর কাহিণী - মহম্মদ আবদুল্লাহ রসূল
    ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম -  সুপ্রকাশ রায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন