প্যাঁ-পোঁ, প্যাঁ-পোঁ – আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স। এই নিয়ে মোট চারটে গেল শেষ দু-ঘন্টায় – সুবিনয় গুনেছেন। সব কোভিড কেস নিশ্চয়ই। চারপাশে কেস বাড়ছে আস্তে আস্তে, সুবিনয় খবর পান। এরকমই একটা অ্যাম্বুলেন্সই সুচরিতাকে নিয়ে গেছিল। আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স সুবিনয়কেও, কিছুদিন পরে। সুবিনয় ফিরেছেন, সুচরিতা ফেরেন নি। সুচরিতা – সুবিনয়ের স্ত্রী। নাকি মৃত্যুর পরে তাকে প্রাক্তন স্ত্রী বলা উচিত? যদিও শব্দ দিয়ে কতটাই বা বোঝানো যায়? এই যে তাঁদের পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন, এটা কি একটা শব্দে ধরা যায়? মানুষ চলে যায় কিন্তু তাদের চিহ্ন থেকে যায়। সেরকম একটা চিহ্ন তাদের সন্তান সুশান্ত। কিন্তু সেও আলাদা সংসার পেতেছে। এখানে থাকে না আর। তারও চিহ্ন রয়ে গেছে এবাড়ির আনাচে কানাচে। সুবিনয় মারা গেলে তারও চিহ্ন থেকে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু চিহ্ন থাকলেই তো হয় না, চিহ্ন পড়ার লোক চাই। কত সভ্যতা, কত প্রাণী এ পৃথিবী থেকে লোপ পেয়ে গেল। তাদেরও তো চিহ্ন রয়ে গেছে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক ছাড়া এই চিহ্ন পড়বে কে? সুবিনয়ের যখন করার মত কাজ ছিল, তিনিও তো কোনদিন ভাবেন নি এই পৃথিবী থেকে একে একে ডাইনোসর, রোমান সভ্যতা, হরপ্পা সভ্যতা সব লোপ পেয়ে গেছে। তিনি তখন ইনক্রিমেন্ট নিয়ে ভেবেছেন, ডিএ নিয়ে, ছেলের মাধ্যমিকের রেজাল্ট নিয়ে। এখন ভাবছেন। হয়ত আর কিছুদিনের মধ্যে আবার একটা অ্যাম্বুলেন্স আসবে তাঁকে নিতে। তিনি চলে যাবেন, কিছু চিহ্ন থেকে যাবে। কিন্তু সে চিহ্ন কেউ কোনদিন দেখতে পাবে না। তাঁর ছেলে পাবে কী? কে জানে।
ঘড়ির দিকে একবার তাকান সুবিনয় – বিকেল তিনটে। উঠে পড়েন। ভাবেন সুচরিতার সব চিহ্ন খুঁজে বের করে তার ছবি তুলে রাখবেন। ছেলেকে দিয়ে যাবেন। প্রথমেই রান্নাঘরে গেলেন। সুচরিতার দিনের অনেকটা সময় কাটতো এখানে। প্রথমেই চোখ গেল একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাপড়ের টুকরোর দিকে। সুচরিতা রান্নার হাত মুছতো এতে। সুবিনয় ছবি তোলেন। তারপর একটা হাতল ভাঙ্গা কড়াই। এটা খুব প্রিয় ছিল সুচরিতার। নতুন কড়াই কিনতে চাইতো না কখনও। তারপর কেটলি, ছাঁকনি, সাঁড়াশি… সুবিনয় ছবি তুলে চলেন।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা কষ্ট উঠে আসে সুবিনয়ের গলার কাছটায়। একটা মানুষের গোটা জীবন শুধু এই কটা ছবি? আরো খুঁজতে থাকেন সুবিনয়। কিছু পুরোন মার্কশিট জমা হয়, কিছু শাড়ি, জামা। কিছু গয়নাও আছে, কিন্তু সেসব লকারে। এইসব ছবি কি প্রিন্ট করে তুলে দেওয়া যায় তাঁর ছেলের হাতে? ছেলে কী ভাববে বাবার ভীমরতি ধরেছে? নিজেকে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করেন সুবিনয়। তাঁর নিজের জীবনের কি কোন চিহ্ন রয়ে গেছে যা তাঁর ছেলেকে তুলে দেওয়া যায়? সুবিনয় ভাল ছাত্র ছিলেন আর খুব উচ্চ সরকারী পদে আসীন ছিলেন এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, তারপর সরকারি চাকরি। নিজেকে নিয়ে কিছুটা গর্বিতই বলা যায় সুবিনয়কে। জয়েন্টের মেধাতালিকায় অনেক ওপর দিকে নাম ছিল তাঁর, উচ্চমাধ্যমিকেও প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলেন তিনি। এরকম একটা জীবন কী চিহ্ন রেখে যেতে পারে ভাবার চেষ্টা করেন সুবিনয়। খুঁজতে থাকেন। প্রথমেই মনে হয় মার্কশিটের কথা। খুলে বসেন তাঁর সারাজীবনের কৃতিত্বের ঝাঁপি। একসময় গর্ব ছিল অনেক এই মার্কশিট নিয়ে। এখন খুলে দেখেন সেই অহঙ্কারটা আর ছুঁতে পারছেন না। শুধু কয়েকটা সংখ্যা। এই সংখ্যার পেছনে অনেক পরিশ্রম ছিল সুবিনয়ের। খেলতে না গিয়ে, বেড়াতে না গিয়ে, আড্ডা না দিয়ে সুবিনয় শুধু পড়ছেন এরকম একটা আবছা স্মৃতি আসে মনের মধ্যে। কিন্তু সবটাই খুব ভাসা ভাসা, কিছু আলাদা করে মনে করতে পারেন না। সেই সব দিন, মাস, ঘন্টা শুধু কয়েকটা কাগজে ছাপা সংখ্যা হয়ে তাঁর সামনে শুয়ে আছে। এই ছবিও যদি তিনি তাঁর ছেলের হাতে তুলে দেন, তারই বা কী মানে? সুবিনয় অস্থির হয়ে ওঠেন। আরো খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যান একটা ফাইল। বেশ মোটা। খুলে দেখেন অনেক কাগজ। প্রথম কাগজটা অনেক পুরোন। ইনকাম ট্যাক্সের হিসেব তখন হাতে করতে হত। সেই সব হিসেব। এখন সব অটোমেটিক। পুরোনো সব ট্যাক্স রেট, আয় সব ভেসে উঠতে লাগল তার চোখের সামনে। তারপর পাওয়া গেল হাউসলোনের কাগজ, পুরোন বীমা পলিসির জেরক্স। সুবিনয়ের প্রোমোশনের চিঠি। কিছু পুরোন প্রেসক্রিপশনও বেরিয়ে এল এসব ঘাঁটতে গিয়ে। সুবিনয়ের জন্ডিস হয়েছিল একবার, সুচরিতার দুবার ম্যালেরিয়া আর তাদের ছেলের টাইফয়েড – সেইসব চিহ্ন নিয়ে কিছু কাগজ পড়ে আছে শুধু। আর কিচ্ছু নেই তাহলে? কোথাও নেই? তাঁর জীবন শুধুই কয়েকটা ছাপানো কাগজ যার আর কোন গুরুত্বই নেই আজ?
ভাবতে গিয়ে মাথাটা ধরে যায়। সুবিনয় চা বানাতে যান। চা নিয়ে সোফায় বসে ভাবতে থাকেন। পুরোন কথা মনে করার চেষ্টা করেন। কৈশোরের কথা, সুচরিতার সাথে তাঁর প্রেমের কথা মনে করার চেষ্টা করেন সুবিনয়। সুবিনয় যেতেন পাড়ার বয়েজ স্কুলে, সুচরিতা রাস্তার ওপারের গার্লস স্কুলে। তাঁরা দুজনেই সাইকেলে যাতায়াত করতেন। দেখা হত প্রায়ই। কিন্তু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল সুচরিতার ক্লাসের বন্ধু, সুবিমলের পাড়ার মেয়ে কণিকা। তখন যেরকম প্রেম হত আর কী! সরস্বতী পূজোতে চোখাচোখি, অষ্টমীতে একসাথে অঞ্জলি, হয়ত ভিড়ের আড়ালে চিরকুট চালাচালি এই করতে করতেই বড় হওয়া। তারপর খুব বেশী হলে কফিহাউসের ইনফিউশন অথবা সাঙ্গুভ্যালীর কাটলেট। প্রেম তখন অন্যরকম ছিল। সেই সময় অনেক চিঠি লেখালিখি চলত। সেসব কী আর পাওয়া যাবে এখন খুঁজলে? সম্ভাবনা কম, তবুও একবার আলমারি হাতড়ে দেখেন সুবিনয়। একটা টিভির রিসিট খুঁজে পান। বহু পুরোন, টেলিরামা কোম্পানির। এসব কোম্পানি কবেই উঠে গেছে। সুচরিতার সাথে প্রেমের কথা ভাবতে চেষ্টা করেন সুবিনয় আর সেটা করতে গিয়েই হঠাৎ মনে পড়ে মৃন্ময়ের কথা। মৃন্ময় সামন্ত। তাদের ক্লাসেই পড়ত মৃন্ময়। পড়াশুনোয় ভালই ছিল কিন্তু সুবিনয়ের মত অত ভাল না। সুবিনয় ফার্স্ট হতেন প্রতি বছর আর মৃন্ময় ওই নয় কি দশ নম্বরে থাকত। মৃন্ময়ও প্রেমে পড়েছিল সুচরিতার, সাইকেল নিয়ে রোজ সন্ধেবেলা চক্কর দিত সুচরিতার পাড়ায়। এই ত্রিকোণ প্রেম নিয়ে একসময় বেশ রেশারেশিও ছিল তাঁদের মধ্যে। তাঁদের বন্ধুরা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে সুবিনয়ের। মৃন্ময়ের বন্ধুরা মনে করত সুচরিতা প্রথমে মৃন্ময়কে প্রেমে আশকারা দিয়েছিল। তাই সুবিনয় যা করছে সেটা অনৈতিক। সুবিনয়ের বন্ধুদের আশ্রয় ছিল সেই প্রাচীন প্রবাদ—এভরিথিং ইজ ফেয়ার, ইন লাভ এন্ড ওয়ার। এই লড়াই চলেছিল বেশ দু-তিন বছর। কিন্তু শেষমেশ পারে নি মৃন্ময়, শেষ হাসি হেসেছিলেন সুবিনয়ই। এইটা মনে করে এত বছর পরেও সুবিনয়ের মুখে একটা জয়ের হাসি ভেসে ওঠে। তারপর কী হয়েছিল মৃন্ময়ের? মনে করতে চেষ্টা করেন সুবিনয়। সুবিনয়ের যদ্দুর মনে আছে ভাল কোথাও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুবিধে করতে না পেরে জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করেছিল মৃন্ময়। কেমিস্ট্রি কী? নাকি ফিজিক্স? ভালো মনে পড়ে না।
এখন সন্ধে পাঁচটা। বাইরে আস্তে আস্তে সন্ধে নামছে। সুবিনয় টিভিটা চালিয়ে দেন। সুবিনয়ের টিভির নেশা নেই। সিনেমা, সিরিয়াল, খবর কিছুই দেখতে ভাল লাগে না। তবু বাড়িতে টিভি চললে অতটা একা লাগে না। মনে হয় কেউ অন্তত কথা বলছে। টিভি চালিয়ে এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরতে থাকেন। হঠাৎ দেখেন কোথাও একটা শোলে দেখাবে সন্ধে সাতটা থেকে। সুবিনয়ের যৌবনের খুব প্রিয় সিনেমা শোলে। সুবিনয় দেখবেন ভাবেন। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে আজ বার বার মৃন্ময়ের কথা মনে হতে থাকে। ভাবতে ভাবতে সুবিনয় ফোন করেন অশোককে – তাঁদের স্কুলের বন্ধু অশোক। অশোক সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব অ্যাক্টিভ আর অনেকের খবরও রাখে। হয়ত অশোক জানবে।
-“হ্যালো, অশোক”?
-“আরেব্বাবা সুবু যে! বল ব্রাদার”।
- “আচ্ছা, তোর মৃন্ময়কে মনে আছে? কোন খবর জানিস?”
- “কোন মৃন্ময়? কালি মৃন্ময় না টেকো মৃন্ময়”?
সুবিনয়ের মনে পড়ে যায় তাদের ক্লাসে দুজন মৃন্ময় ছিল। একজনের ফাউন্টেন পেন থেকে কালি লিক করত আর আরেকজন কখনও কোন কারণে ন্যাড়া হয়ে ক্লাসে এসেছিল। সেই থেকে এই নামকরণ।
-“কালি মৃন্ময়। ওই বটতলার ওদিকটা থাকতো। আচ্ছা, ও স্কুলের পরে কী নিয়ে পড়েছিল তর মনে আছে? ফিজিক্স না কেমিস্ট্রি”?
-“কেমিস্ট্রি। আরে সে তো এখন বিরাট লোক রে! ক্যালিফোর্নিয়াতে বিরাট বাড়ি, কোম্পানির মালিক আরো অনেক কিছু”।
- “সে কী রে? কী করে”?
- “আরে ও তো কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ল কলকাতায়। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে এম এস সি, পি এইচ ডি। এখানে তো স্কুলের চাকরিও পাচ্ছিল না। তারপর পোস্ট ডক করতে গেল আমেরিকায়। তারপর কীসব আবিষ্কার করে, পেটেন্ট নিয়ে সে এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক”।
- বাবা! এ তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার রে!
-“ হ্যাঁ। ও তো ফেসবুকে আছে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে। এত বড় হয়েছে কিন্তু এখনও পুরোন বন্ধুদের ভোলেনি। পরিচয় দিতে ঠিক চিনতে পারল। দু’বছর আগে আমাদের রিইউনিয়ন হল না? তাতে এসেছিল তো। মাঝে মাঝে ফোন করে। যাক গে, তোর খবর বল। এমন একটা সময় পড়ল যে তোর এই সময় যে গিয়ে একটু পাশে দাঁড়াবো তারও উপায় নেই। যাই হোক সাবধানে থাকিস। কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরে অনেকের কিন্তু কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে”।
- “আমি ঠিক আছি রে। তুই সাবধানে থাকিস। বেশি বেরোস না বাইরে”।
- “না রে। সব এখন হোম ডেলিভারি। সাবধানে থাকিস ভাই”।
ফোন রেখে সুবিনয়ের মনে পড়ল তাদের স্কুলের সহপাঠীরা রিইউনিয়ন করছে আজ বেশ কিছু বছর হল। অশোকই মূল উদ্যোক্তা। সুবিনয়কে বলেছিল কিন্তু সুবিনয় উৎসাহ পায় নি। সুবিনয়ের ক্লান্ত লাগে। সোফাতে গা এলিয়ে দেন। তারপর কখন যে তন্দ্রাভাব এসেছিল বুঝতে পারেন নি। হঠাত ধড়মড় করে উঠে বসে দেখেন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁইছুঁই। ঘুম থেকে উঠে সুবিনয় বোঝেন মৃন্ময়ের খবরটা সুবিনয়ের ভেতরে কোথাও খোঁচা মারছে। এটা কী জেলাসি? তারপরেই মনে হয় অশোকের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। সুবিনয় তাড়াতাড়ি ফেসবুক খুলে অশোকের ফ্রেন্ডলিস্ট ঘাঁটতে থাকেন আর মৃন্ময়কে পেয়েও যান খুব দ্রুত। বাইরের চাকচিক্যের আড়ালে মৃন্ময়কে চিনে নিতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। মৃন্ময়ের জীবন ঘাঁটতে থাকেন সুবিনয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রের ধারে একটা প্রাসাদের মত বাড়ি মৃন্ময়ের। একাধিক গাড়ি আছে মৃন্ময়ের। গাড়ি ভাল চেনেন না সুবিনয় কিন্তু ছবির নিচের কমেন্ট পড়ে বুঝতে পারেন তার প্রত্যেকটাই খুব দামী। বেশ কিছু ছবিতে পরিবারের সাথে ছবি দিয়েছে মৃন্ময়। ওর স্ত্রী মেমসাহেব, স্বর্ণকেশী। ছেলে মেয়েদের চেহারাতেও সাহেবি ছাপ স্পষ্ট। স্ক্রীনের দিকে তাকাতে তাকাতে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ঊঠতে থাকে গলা দিয়ে। শেষ হাসি কি তাহলে মৃন্ময়ই হাসল?
সুবিনয় ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে সোফায় বসেন। সামনে টিভি চলছে। সেখানে একটা বিজ্ঞাপন কিন্তু জায়গা বা চরিত্র কোনোটাই এদেশের নয়। সেখানে একটা গাড়ি চলেছে পাহাড়ি রাস্তায়। গাড়িতে এক পুরুষ, এক নারী, দুটি বাচ্চা, একটি কুকুর। গাড়ি এসে থামে এক শান্ত বাংলোর সামনে। এক সুখী পরিবার এগিয়ে যায় বাংলোর দিকে। মৃন্ময়ের পরিবার কী এরকম? সুখী, শান্ত, ঝকঝকে? পর্দার পুরুষটি ক্যামেরার দিকে মুখ করে ক্লোজ আপে হাসে। সাফল্যের হাসি কী এরকম হয়? সুবিনয় ভাবার চেষ্টা করেন। মজা হল কয়েক ঘন্টা আগেও সুবিনয় নিজেকে সফল মনে করতেন। কিন্তু এখন আর মনে হচ্ছে না। অথচ তাঁর জীবনে কিছুই পালটায় নি। ১৪০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, প্রতিষ্ঠিত ছেলে, তার সুখী পরিবার সব এক, একরকম আছে। সুবিনয় নিজেকে বলার চেষ্টা করেন তিনি সফল। কিন্তু নিজের কাছেই সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে না। একটা কষ্ট যেন বুকের ভেতরে ধাক্কা মারতে থাকে। ঠিক কষ্ট নয়, একটা কেমন ঘ্যানঘেনে মন খারাপ। পর্দার বিজ্ঞাপন পালটে এখন কোন একটা হেলথ ড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপন হচ্ছে। একটা বাচ্চা সেটা এক কাপ খেয়ে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার সফল, সতেজ, ঝকঝকে পরিবার আর তাদের হাসি। সফল পরিবারের সুখী হাসি চেশায়ার বেড়ালের হাসির মত পর্দার ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসে যেন বাইরে ঝুলতে থাকে।
সুবিনয় চ্যানেল পাল্টাতে থাকেন দ্রুত। প্রায় সব চ্যানেলেই সুখী পরিবারের সফল হাসি। এত সুখ আর সাফল্য কোথায় থাকে? একসময় শোলে পেয়ে যান। নিশ্চিন্ত। এখানে হিংসে করার মত কোন চরিত্র নেই। বেশ খানিকক্ষণ শুরু হয়েছে সিনেমাটা। আপাততঃ পাথরের ওপর দুটো পা হেঁটে বেড়াচ্ছে আর সেই দু’পায়ের মালিকের হাত থেকে একটা বেল্ট ঝুলছে। সুবিনয় জানেন একটু পরেই পর্দায় দেখা যাবে ডাকাত সর্দার গব্বর সিং এর মুখ। তাঁর তিন সাকরেদ জয় আর বীরুর কাছে মার খেয়ে এসেছে। তারই বিচার হচ্ছে এখন। বহুবার দেখা স্বত্বেও সুবিনয় আটকে যান এই দৃশ্যে।
-কিতনে আদমি থে?
-সর্দার, দো আদমি।
বহুবার দেখা একটা দৃশ্য পর্দায় আবারও অভিনীত হতে থাকে। অন্য এক সাকরেদের কোমর থেকে রিভলবার তুলে নেয় গব্বর। তারপর তিনটে গুলি শূণ্যে ছোঁড়ে সে। সুবিনয় জানে এরপর গব্বর রিভলবারের চেম্বার ঘুরিয়ে দেবে। বোঝা যাবে না কোন ঘরে গুলি আছে আর কোথায় নেই। এই দৃশ্যের পরিণতি জানা সত্ত্বেও রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে সুবিনয়। এমন সময় মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে দেখে অশোকের ফোন। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই টিভির ভল্যুম একটু কমিয়ে ফোনটা তোলেন সুবিনয়। একটু আগেই কথা হয়েছে অশোকের সাথে। নিশ্চয়ই জরুরি কিছু ব্যাপার।
-“হ্যাঁ রে, বল”।
- “কী করছিস”?
- “এই শোলে দেখছিলাম”।
- “শোলে? ওরেব্বাবা! আমরা সেই ভোর থেকে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে গিয়েছিলাম জ্যোতিতে। মনে পড়ে?”
সুবিনয়ের ভাল মনে পড়ে না। তবে সেটা জানতে দেন না অশোককে।
- “হ্যাঁ। মনে নেই আবার? কী সব দিন ছিল। যাকগে, বল কী ব্যাপার”।
সুবিনয় কথা শেষ করে শোলের এই দৃশ্যটাতে ফিরতে চান। তার গলাতেও হয়ত সেই ধৈর্্যের অভাব প্রকাশ পায়।
-“একটা খারাপ খবর আছে রে। তুই সকালে মৃন্ময়ের কথা জিজ্ঞেস করলি না? এক্ষুণি খবর পেলাম মৃন্ময় চলে গেল”।
-“চলে গে্ল? মানে? কোথায় চলে গেল”?
সুবিনয় জানেন চলে যাওয়া বলতে অশোক কী বলতে চাইছে। তবু যেন মানতে পারছিলেন না। প্রশ্ন করে করে এক অনির্বায সত্যিকে দু-এক মুহূর্ত আটকে রাখতে চাইছিলেন তিনি।
- মানে মারা গেছে। তুই খানিকক্ষণ আগে জিজ্ঞেস করলি তো ওর কথা তাই খবরটা জেনে প্রথম তোর কথা মনে পড়ল। ওর কোভিড হয়েছিল কিছুদিন আগে। তোর মতই। সেরে উঠেছিল। আজ হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব শেষ। আমার ভায়রা ভাই ক্যালিফোর্ণিয়াতেই থাকে। মৃন্ময়কে চিনত, আমরা যে স্কুলের বন্ধু সেটাও জানত। ওই খবরটা দিল। আমি বন্ধুদের জানাচ্ছি”।
সুবিনয় কী বলবেন ভেবে পান না। দু-এক মুহুর্ত চুপ করে বসে থেকে ধরা গলায় বলেন, “রাখি রে”। তারপর ফোন রেখে দেন। গলার মধ্যেকার কষ্টটার চরিত্র পাল্টে যায়। চোখের কোনায় এক ফোঁটা জল খানিকক্ষণ টলমল করে গাল বেয়ে নেমে আসে।
পর্দায় তখন গব্বর হাসতে শুরু করেছে। এক আশ্চর্য ভাগ্যের খেলায় বেঁচে গেছে তার তিন সাকরেদ। গব্বরের দেখাদেখি বাকি ডাকাতরাও হাসতে শুরু করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একসময় সেই হাসিতে যোগ দেয় প্রাণ ফিরে পাওয়া সেই তিন ডাকাত। এরই মধ্যে সুবিনয় বুকের বাঁদিকে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করেন। বোঝেন সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। পর্দায় হাসি একটা সংক্রামক রোগের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে, বাজতে থাকে এক মিনিট ধরে। তারপর হঠাৎ তিনটে গুলির আওয়াজ। হাসি থেমে যায়। মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পেরেছে ভেবে হাসছিল যে তিন ডাকাত, শনশন নীরবতার মধ্যে তাদের তিনটে লাশ পরে থাকে পর্দায়। পাহাড়ের ওপর থেকে ক্যামেরা ধরে তাদের। সুবিনয়ের শরীর অবশ হয়ে আসে। চোখের সামনে কালো পর্দা নেমে আসার আগে তিনি বুঝতে পারেন শেষ হাসিটা পর্দা থেকে বেরিয়ে, তাঁর মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে ব্যালকনি দিয়ে বেরিয়ে যায়। সুবিনয়ের মনে হয় শহরের সমস্ত বাড়ির জানলা, ব্যালকনি দিয়ে হাসিরা বেরিয়ে আসছে। শেষ হাসি।
দুর্ধর্ষ লাগল। মানুষের সাইকোলজি নিয়ে সূক্ষ্ম নাড়া চারা। স্বার্থক আপনার এই রচনা।
মাঝখানে অশোক আর অসীম গুলিয়ে গেছে।
ধন্যবার রমিত। ধন্যবাদ দ। আমি আসলে প্রথমে অসীম নামেই লিখছিলাম। পরে মনে হল অশোক নামটা বেশী ভাল হবে। সংশোধন করে দিয়েছি।
একেবারে জীবন্ত ছবি উপহার দেয়ার জন্যে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা থাকছে
ছোটগল্প লেখায় আপনি সিদ্ধিলাভ করেছেন।
গুরুর পাতায় ছোটাই ও আপনি--দুজনের গল্প পেলে গোগ্রাসে পড়ি।
দারুণ হয়েছে। আরও চাই।
দারুন পাঠসুখকর একটি ছোটোগল্প |
Splendid