চারিদিকে যখন হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা নিয়ে চন্ডীমণ্ডপ চলছে সেরকম একটা সময়ে হাতে এল এস ওয়াই কুরেশির দ্য পপুলেশন মিথ: ইসলাম, ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড পলিটিক্স ইন ইণ্ডিয়া শিরোনামের বইটি। হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা নিয়ে যে-সব সবজান্তা মত জাহির করা হচ্ছে তার ভিত্তিটা কী? সেগুলো কতকগুলো মনগড়া সংখ্যা এবং সুবিধে মতো বেছে নেওয়া কিছু “বাস্তব ঘটনা”-র সরলীকৃত উপস্থাপনা। এইরকম একটা “ঘটনা” হচ্ছে, প্রতি দশ-বছরে আমাদের যে লোকগণনা হয় তাতে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধির হার হিন্দুদের তুলনায় বেশি হচ্ছে, এবং তার ফল হিসেবে ভারতের জনসংখ্যায় মুসলমানদের ভাগ বেড়ে চলেছে। ব্যস, লোকেরা হাতে চাঁদ পেয়ে গেল! এবার এই তথ্যটাকে ব্যবহার করে প্রচার চালানো হচ্ছে, হিন্দুদের সামনে মহা বিপদ, অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানরা সংখ্যায় বেড়ে যাবে, আর হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। কিন্তু, মজার ব্যাপার হল, গত তিন দশক ধরে যে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারটা হিন্দুদের তুলনায় যে বেশি করে কমছে, সেটাকে বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে। তাছাড়াও যেটা নিয়ে একেবারে উচ্চবাচ্য নেই তা হল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মানুষের ধর্মীয় সংযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এটা নির্ভর করে সামাজিক-আর্থিক অবস্থানের ওপর। ভারতের মুসলমানরা যেহেতু দেশের সব থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পড়েন, তাঁদের মধ্যে জন্মহার তুলনামূলকভাবে বেশি। অর্ধসত্যের পিঠে চেপে বুজরুকরা তাদের অন্ধবিশ্বাস ও বিদ্বেষ প্রচারের মধ্য দিয়ে সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে আড়াআড়ি ভাগ করে চলে। আজকে আমাদের চারপাশ যখন ঘৃণা ও ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন, তেমন একটা সময়ে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে এই সব গালগল্পগুলোর আড়াল থেকে আসল সত্যটা বের করে এনে কুরেশির মতো সুস্থচিন্তার লোকের কথাগুলো মানুষজনের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা বেশ কঠিন।
কুরেশির বইতে কিছু বিশ্লেষণ বিভিন্ন বছরের লোকগণনা ও ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র চারটি রাউন্ডের মতো ব্যাপক তথ্যের ভিত্তিতে করা। এগুলো জনসংখ্যাবিদ ও উন্নয়নের ছাত্রদের কাছে বেশ পরিচিত। তা সত্বেও এগুলোকে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে আবার হাজির করাটা খুব জরুরি। কারণ, জনসংখ্যা বিষয়ক গালগল্পগুলো “বাজারে খুব খায়”, সেগুলোকে ভেদ করে প্রকৃত সত্য তুলে আনতে হলে তথ্যগুলোকে বোধগম্য ভাবে তুলে আনা দরকার। কুরেশির বইটার বিশেষত্ব এই যে, এখানে দুটো জিনিসকে মিলিয়ে দেখা হয়েছে: জনসংখ্যাগত তথ্য এবং ইসলামের ধর্মীয় বয়ান। একদিকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যাগত তথ্যগুলো বিশদে তুলে ধরা হয়েছে, আর অন্যদিকে মুসলমানদের পরিবার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আদতে ইসলামি অনুজ্ঞা কী সেটা ঘেঁটে দেখা হচ্ছে। ইসলাম ধর্মে পরিবার নিয়ন্ত্রণের অনুমোদন নেই বলে যে মনগড়া গল্পটা বলা হয় সেই কল্পিত বিশ্বাসটাকে ভাঙ্গবার উদ্দেশ্যে এ বইতে কুরান ও হাদিস থেকে নানা সাক্ষ্য তুলে আনা হয়েছে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, বহু ইসলামি দেশে পরিবার নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে, অথচ, ধর্মগুরুদের কাছ থেকে তেমন কোনো বাধা আসেনি।
ভারতে পরিবার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে অন্যদের সঙ্গে মুসলমানদের বড় কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। বস্তুত, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভেতে মুসলমানদের মধ্যে বেশ ভালমাত্রায় গর্ভনিরোধকের ব্যবহার পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, কোনোরকম গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার করছেন না, কিন্তু আদৌ গর্ভধারণ করতে চান না, বা পরে করতে চান, এমন মহিলার সংখ্যাটাও তাৎপর্যপূর্ণ। কুরেশি প্রাক্তন আমলা, এবং সরকারি নীতি ও কর্মসূচি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রচুর। ফলে, তিনি ভালমতোই জানেন যে, রিপ্রডাক্টিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ সার্ভিসেস-এর মতো জননী ও শিশুদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহীত কর্মসুচিগুলোর উদ্দেশ্য খুবই ভাল, কিন্তু যাদের জন্য এগুলো করা প্রায়শই এগুলো তাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়। মুসলমান মহিলাদের মধ্যে পরিবার নিয়ন্ত্রণের আগ্রহ নেই বলে যে গল্পটা চালানো হয়, আসলে তার প্রধান কারণ হচ্ছে মুসলমান বসতগুলোতে কাজের ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্বিকার মনোভাব। কখনো কখনো একদিকে কুসংস্কার ও অন্যদিকে লোকেদের মধ্যে পরিবার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ঠিকঠাক জ্ঞান না থাকার ফলে কোনো কোনো জায়গা থেকে এ সম্পর্কে কিছু বিরোধিতার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই রকম ছোট আকারে, ঈষৎ কিছু বিরোধিতার খবর শোনামাত্রই গোটা সম্প্রদায়টাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই সঙ্গে খুব গলাবাজি করে প্রচার করা হয়, “দেখেছ, ইসলাম কত খারাপ!” অথচ, মোট জন্মহার (টি এফ আর), অর্থাৎ কোনো মহিলা প্রজননক্ষম আয়ুষ্কালে গড়ে যত সন্তানের জন্ম দিতে পারেন সেই হিসেব অন্য কথা বলছে। ১৯৯২-৯৩ সালে প্রথম এন এফ এইচ এস –এর সময় থেকে মুসলমান মহিলাদের মধ্যে মোট জন্মহার (টি এফ আর) ভালমতোই হ্রাস পাচ্ছে, এবং হিন্দুদের সঙ্গে পার্থক্যটা খুবই কমে এসেছে। ১৯৯২-৯৩ ও ২০১৫-১৬ সময়কালে হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার ৩,৩ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২.১-এ। একই সময়ে মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যাটা কমেছে ৪.৪ থেকে ২.৬-এ। মজার ব্যাপার হল, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জন্মহারের হিসেবে ব্যাপক পার্থক্য আছে – বিহার ও রাজস্থানের হিন্দুদের জন্মহার কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের জন্মহারের চেয়ে অনেক বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটাই সর্বরোগহর সরকারি নীতি গৃহীত হয়ে থাকে – সবার জন্য একটাই কর্মসূচি। এই নীতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সম্প্রদায় যে বিবিধরকমের জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান সেগুলোকে আদৌ ধর্তব্য মনে করে না। ফলে এমনও হয় যে, সরকারি কর্মসূচিতে একটা বিশেষ পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হল, এবং বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর চাওয়া অন্য পদ্ধতিগুলোকে অবহেলা করা হল। এমন অবস্থায় অনেক সময়ই লোকে সরকারি পদ্ধতিটাকে নাকচ করে দেন। সুতরাং, যদি কোনো গোষ্ঠী নির্বীর্যকরণের পদ্ধতিটা পছন্দ না করেন, সেটাকে তাঁদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অনাগ্রহ বা বিরোধিতা ভেবে নেওয়াটা ভুল হবে। কেবল মুসলমানদের বেলাতেই নয়, এটা সব সম্প্রদায় সম্পর্কেই বলা যায়।
কুরেশির বিশ্লেষণে যেমন আছে তথ্যের সমাহার তেমনই আছে যুক্তির জোর। বস্তুত, বইটাতে তিনি যা লিখেছেন তার অনেক কিছুই জানা। অবশ্য, সবার নয়, যাঁরা জানতে চান তাঁদের – অনেকেতো জানতে চানই না। এ বই, বিশেষত শেষের দিকে, “জনসংখ্যার রাজনীতি” বিষয়ক অষ্টম অধ্যায়টা পাঠকের মনকে বিশেষভাবে বিচলিত করবে। এই অধ্যায়ে কুরেশি হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারিত জনসংখ্যা বিষয়ক গালগল্পগুলোকে ভেদ করে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছেন। আশা করা যায় যে, এখানে উপস্থাপিত তথ্য ও সেগুলোর ব্যাখ্যা ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন রোধ করার কাজে লাগবে। যাঁরাই উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাপ্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান তাঁদের সকলেরই এ বইটি পড়া দরকার বলে মনে করি।
হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার আপেক্ষিক হ্রাসবৃদ্ধির আলোচনায় দুই সম্প্রদায়ের জন্মহারের তফাতের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশ’-এর প্রসঙ্গটিও এনে ফেলা হয় পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের তপ্ত আবহাওয়ায় বারবার শোনা গেছে, সীমানা পেরিয়ে দলে দলে মুসলমান নাকি পশ্চিমবঙ্গে এসে বসবাস করছেন। এখানে সাম্প্রতিক প্রকাশিত আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটির লেখক আমার সহকর্মী শাশ্বত ঘোষ এবং শুভনীল চৌধুরী। ওঁরা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন বিজেপি নেতারা যা দাবি করে থাকেন – বিরাট সংখ্যক মুসলমান বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করে চলেছেন – তা সত্যি হতেই পারে না। যদি হত, পশ্চিমবঙ্গে জনবৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় জনবৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে যেত। ১৯৫১ থেকে দশক-ওয়ারী জনবৃদ্ধির হার যদি দেখি, দেখব প্রথম দুই দশকে পশ্চিমবঙ্গের জনবৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় হারের থেকে বেশি থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার কমার গতি যেহেতু দ্রুততর, ১৯৮১ থেকে পশ্চিমবঙ্গের হার সর্বভারতীয় হারের নিচে নেমে আসে। প্রচুর পরিমাণে অনুপ্রবেশ হলে এরকম হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের যে জেলাগুলি বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি যদি শুধু সেই জেলাগুলির দিকেও দেখি তাহলেও দেখব মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে। যেমন ২০০১ থেকে ২০১১-র মধ্যে সেসব জেলায় এই বৃদ্ধির হার কমেছে ৪.৩ শতাংশ বিন্দু।
একদিকে যেমন ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক লাভ ওঠানোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যা ও অতিকথার বিস্তার চলতে থাকবে, অন্যদিকে একে প্রতিহত করতে প্রকৃত তথ্য ও বিশ্লেষণের চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। তথ্য ও জ্ঞানের শলাকা দিয়ে প্রকৃত অজ্ঞতা দূর হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা ও অজ্ঞতার মিশেলে যে অতিকথার নির্মিতি তাকে ঠেকানো সহজ কর্ম নয়।
বহুকাল আগে,১লা সেপ্টেম্বর ২০০৬ এই একই বিষয় নিয়ে এ অধমের লেখাটির কথা মনে পড়ে গেল। উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।
একটা সতর্কীকরণ ঃ তখন গুরুর লেখাপত্তর পুরোনো ব্যবস্থাপনায় ছাপা হতো, তাই কিছু কিছু শব্দ ঘেঁটে গেছে। একতূ কষ্ট করে পড়ে নেবেন। গুরু ব্যবস্থাপকদের অনুরোধ, এগুলোকে কি ঠিক করা যায় ?
শুভনীল ও শাশ্বত প্রাসঙ্গিক লেখাটির লিংক রইল।
এটি আনন্দবাজারে শুভনীলের একার লেখা । ফ্রন্টলাইনের লেখাটি নয়। ত্রুটি মার্জনীয়।
Thank you Sir
As usual khub e valo lekha
দারুণ। অনেক কিছু জানা গেল যা ভক্তদের কাউন্টার করতে লাগবে।