যাত্রা শুরু (শেষ পর্ব)
কাকভোরে ঘুম ভেঙে গেল।
সাধারণত আমার ঘুম একটু বেলা করে ভাঙে। ফোনে টাইম দেখলাম - চারটে চুয়ান্ন।
অ্যালার্ম বাজতে এখনো ছ'মিনিট বাকি। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
ভাল করে আলো হয়নি এখনো। নোংরা খড়খড়ে পর্দা সরিয়ে ফাইবার গ্লাসের জানলাটা খুললাম। জানলার বাইরে একটা গ্রিল দেওয়া।
রাস্তা ওপারে মাসির হোটেল। হোটেলের শেডের পেছনে বিষ্ণু ঘাটের লাল মন্দির ক'টা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের চূড়োর ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি গঙ্গা। দেখি, আকাশে ভোরের রং লাগছে।
গতকাল সন্ধ্যেবেলায় হরিদ্বারে এসেছি। আজ সকালেই আবার বেরিয়ে যাব। হরিদ্বার এলে প্রত্যেকবার এই গেস্ট হাউসেই উঠি। মাড়োয়ারিদের গেস্ট হাউস। মোটের ওপর পরিষ্কার-পরিছন্ন। একতলায় রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে।
গেস্ট হাউসের চা-টা ভাল নয়। এত সকালে আমার একার জন্য লিকার চা এরা করবে না - সরপড়া দুধ চা দিয়ে যাবে।
মাল বিশেষ কিছু বের করিনি, তাই প্যাকিং কিছুই নেই। গরম জলের বালতি আনিয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। ব্রাশ করে, গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে নিলাম। দু'সপ্তাহ এখন এতেই চলবে। চান করতে করতে বাথরুমের আয়নায় ভাপ জমে গেল। হাত দিয়ে মুছে নিতে গিয়ে একটা কবেকার পুরোনো কালো টিপ পেলাম।
নিচে বুড়োর দোকানে চা খেতে নামলাম। বাইরে মোলায়েম ঠান্ডা। উলের টুপি-পড়া গুঁফো বুড়োর ঠেলা থেকে ভোঁ-ভোঁ করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাতাসে কেরোসিনের গন্ধ। এক কাপ লিকার চা, দু'টো লেড়ো বিস্কুট।
মাসির হোটেলের সামনে এক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। ব্রেকফাস্টের মেনু চিৎকার করে বলার সময় এখনো হয়নি। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - টিফিনে কি আছে?
ভদ্রলোক বোধহয় একটু বিরক্ত হলেন। বললেন - ক'টা বাজে? লুচি হবে, আলুর তরকারি হবে। তবে এখন নয়, আটটার পর।
- আটটার আগেই আমি বেরিয়ে যাব।
- কোথায় বেরোবেন? কালই তো এলেন! আজই ফেরা?
- ফেরা-ই বলতে পারেন। একটু পাহাড়ের দিকে যাব ভাবছি।
গেস্ট হাউসের বিল মিটিয়ে স্যাক নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, একজন বৃদ্ধ বাঙালি ভদ্রলোক দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - আপনার পিঠে কি ওটা হোল্ড-অল্?
আমি হাসলাম। বললাম - না, ওটা রুকস্যাক।
ওঃ! আমি ভাবলাম হোল্ড-অল্ বুঝি, আজকাল পিঠে করেও নেওয়া যায়। হোল্ড-অল্ দেখেছ তো? ব্যাগও, বিছানাও!
এই বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন।
হোটেলের সামনে ইজাহার খান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। স্যাকগুলো ওপরে তুলে প্লাস্টিকের শিট দিয়ে ঢেকে ভাল করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে একটা ধূপ জ্বলছে, সেটা ফেলা করালাম। ধূপের গন্ধে আমার বমি-বমি লাগে।
রেয়ার-ভিউ মিররে্ কোরানের বয়েত লেখা একটা লকেট মতন ঝোলানো। লম্বা রাস্তা, ওটার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
বিষ্ণু ঘাটের ব্রিজ পেরিয়ে হাইওয়েতে এসে উঠলাম। গতকাল রাতে ব্রিজের মুখে বসে একজন বৈরাগী দোতারা টাইপের একটা ইন্সট্রুমেন্ট বাজাচ্ছিলেন। খুব ভাল লাগছিল শুনতে।
সকালের আলোয় ঝকঝক করছে গঙ্গার জল।
শিবের বিরাট কিম্ভূত মূর্তিটা পেরিয়ে অনেকদূর এসে পড়েছি। এখানে একটা রেলওয়ে ক্রসিং আছে। গাড়ি থামলে বাচ্ছারা এসে ছোট-ছোট লাল ফল বিক্রি করে। কি ফল, নাম জানিনা।
একটা মালগাড়ি পেরোচ্ছিল। এবার আর বাচ্ছাগুলোকে দেখতে পেলাম না।
দূরে সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
এবার একেবারে ব্যাসী পৌঁছে থামব। রাস্তার পাশে বেদব্যাসের মূর্তি। মূর্তির হাতের ফাঁকের পাইপ দিয়ে জল পড়বে - তাতে মুখ ধোব। ব্রেকফাস্ট করব - পরোটা, সবজি, আচার, টক দই। রাস্তার ধুলো বসা কাঁচের গ্লাসে করে এক গ্লাস নিম্বুপানিও খেতে পারি।
হোটেলের সামনে একটা পাহাড়ি কুকুর থাবার ওপর মুখ রেখে চুপ করে রোদে শুয়ে থাকবে।
আবার গাড়ি চলবে। লাল কাপড়-পড়া সাধুর গায়ে ধুলো ছিটিয়ে এগিয়ে যাব। মিররে্ দেখব - সাধু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়ির ওপর পাহাড়ের ছায়া পড়বে। ছায়া ছেড়ে কখনো কখনো পাহাড়ের নরম রোদে গিয়ে পড়ব।
খুব ভালো জায়গাতে শেষ হল।
অনেক ধন্যবাদ, b!
বড় সুন্দর।
এর বেশি বলতে নেই। রোদ আর ছায়াটুকু চোখে নিয়ে চুপ করে যেতে হয়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ইন্দ্রাণী।
আমার এই লেখাটা পড়তে পড়তে মাথার মধ্যে কে যেন বলেই চলেছে আনফোল্ডিং আনফোল্ডিং , খুব অস্ফুটে, কারা যেন পাকদ্ন্ডি বেয়ে উঠে চলেছে অনেক ওপরে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তবু যেন মনে হয় তারা চেনা কেউ। তাদের গায়ের ওপরে রোদে ছায়ায় নক্সা কাটছে হিলিবিলি, আর ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে নামা ঠান্ডায় ঘাড়ে একটা শিরশিরে আরামের অনুভূতি।
এই সিরিজটা পড়লেই আমার পিঠঝুলিটা পেড়ে টেড়ে ঝেড়েঝুড়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।
খুব ভালো লাগলো এই সিরিজটা। লেখার স্টাইল এত সুন্দর -- মিনিমালিস্ট আর্টের মত।
শুরুটা ভাল লাগছিল। একটু পরে লেখাটা স্টাইল হয়ে গেল।
যারা মন্তব্য করেছেন - সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
সম্বিৎবাবুর মন্তব্যটা বেশ ইন্টারেস্টিং ;)
লেখাটা সম্বন্ধে দু'-একটা কথা:
পরিচালক রিচার্ড লিঙ্কলেটার একজায়গায় বলেছেন - ছেলেবেলা নিয়ে কোনো সিনেমা করতে গিয়ে একজন পরিচালক ঠিক যে যে জিনিসগুলো বাদ দিয়ে দেবেন, উনি ঠিক সেই জিনিসগুলো নিয়েই একটা সিনেমা (বয়হুড) বানিয়েছেন।
এই লেখাটায় আমি সেই চেষ্টাটাই করেছি। পাহাড় বাদ দিয়ে পাহাড় নিয়ে লেখার চেষ্টা।
কেমন হয়েছে - জানিনা।
sundar
ভারি সুন্দর লেখা।
লকডাউন পেরিয়ে এপারে আবারও বাস চালু হয়েছে। আমিও পাহাড়ের রোদ গায়ে মাখতে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরুচ্ছি।
শুভ
অনেক ধন্যবাদ, বিপ্লববাবু।
কোথায় যাচ্ছেন? শুভ যাত্রা!
@ দেবায়ন,
এপারে আমাদের রাঙামাটি আর কাপ্তাইয়ের পাহাড়ে যাচ্ছি ঘুরতে। ফিরে এসে লিখবো ভাই।
আপনি আরও লিখুন