

“বঙ্গাল দেশ কি গজল” শুনুন, নিহাল সিং, জৈন ধর্ম, এসেছিলেন নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে, পলাশির যুদ্ধের সাতাশ বছর আগে।
বসতী কাসমবাজার, সইদাবাদ খাগড়া সার
রহতে লোক গুজরাতীক, টোপীবাল জেতী জাতীক
আরব, আরমনী আংরেজ, হবসী হুরমজী উলাংদেজ
সীদী ফরাসীস আলেমান সৌদাগর মুরগল পাঠান।।
শেঠী কুংপনী কী জোর দমকে লাগে লাখ কিরোর।
কী বুঝলেন? হরেক জাতির হরেক দেশের লোকজন ও সওদাগর কাশিমবাজার সইদাবাদ খাগড়া অঞ্চলে সেই সময় থাকত। যেমন টোপিওয়ালা গুজরাটি, আরব আরমানি, ইংরেজ হাবসি, হুরমুজি মানে পার্শি, উলাংদেজ মানে ডাচ, সিদ্দি ফরাসি পাঠান মোঘল। অর্থাৎ একটি বিশুদ্ধ কসমোপলিটান শহর।

এছাড়া রাজস্বের কাজে হিন্দুদের প্রায় একচেটিয়া কারবার। রাজস্থানিদের কথাও বাদ দিলে চলবে না। তারাই তো জিয়াগঞ্জ আজিমগঞ্জের শেহেরওয়ালি অসোয়াল জৈন।
মুলতান লাহোর অনেক দূর দেশ থেকে প্রচুর বণিকেরা ভিড় জমাত। পলাশির যুদ্ধের পরে মুর্শিদাবাদের যে কী সর্বনাশ ঘটে গেল তা আজো মালুম হয়। এতো বৈচিত্র্য, এতো জীবনের রঙিন কারুকাজ, সে সব কোথায় উবে গেল? হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন।
সইদাবাদে আরমানি চার্চ। রাস্তায় ক্যারম খেলছে এক পাল চ্যাংড়া ছেলে। তাদের জিগ্যেস করায় একজন বলল খবর পাঠাচ্ছি। গিরজের দরজা খুলে দেবেখন মাসিমা।
মাসিমা বিশাল দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে গিয়ে দেখি পরিচ্ছন্ন আরমানি গির্জা। সুবিন্যস্ত গাছপালা। দুবেলা ঝাড়ু পোঁছা হয়। মাসিমাই জানালেন। কেউই আসে না। কলকাতার আরমানিরা নজরদারি করে। গির্জা চত্বরে অনেক সমাধি। ক্রস তোলা নেই। মাটিতে বা মেঝেতেই ফলক বিছানো। ১৭৯৫ এর সমাধি দেখলাম। আরো পুরনো হয়তো ছিল। ফলকের নকশাগুলো খুব সুন্দর। আরমানি বা পুব ইয়োরোপের নকশা।

মুর্শিদাবাদ দেখতে দেখতে মাথায় যে কথা গুলো বিজবিজ করছিল তাহলো পলাশির যুদ্ধের একশো পর কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে লখনৌ থেকে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ এসে সেই অঞ্চলকে ছোটা লখনৌ বানিয়ে নাচ গান পান পতঙ্গ কবুতর বাখরখানি শীরমল শেরওয়ানি দিয়ে যে শাহি টুকরাটি বানালেন আজো কলকাতা তাই নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। এই নিয়ে আমোদ আহ্লাদ আলোচনার কিছু কম দেখি না। গঙ্গাজমুনি তেহজিব, উত্তর ভারত থেকে সেই সংস্কৃতির নদীটিকে বয়ে নিয়ে তিনি বিচালিঘাটের ডাঙায় নোঙর বাঁধলেন। ভালো কথা। কিন্তু এই মিশ্র সংস্কৃতির তেহজিব বা মেলবন্ধনের পরম্পরায় মুর্শিদাবাদ কোনো অংশেই কম ছিল না। কিন্তু সেইভাবে মুর্শিদাবাদকে তুলে ধরা হয়নি। কোথায় গেল সেইসব নাচিয়ে গাইয়ে রকাবদারদের দল? সম্প্রীতির কাহিনি? পলাশির পর উচ্ছিষ্টের মত ফেলে দেওয়া মুর্শিদাবাদ এতোটাই নজরের আড়ালে চলে গেছে যে স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী তার গৌরবের শিরোপা হারাল। অথচ হেরিটেজ সম্পদ, পর্যটন ও রাজস্ব আদায়ের একটি সফল মাধ্যম অনায়াসেই হতে পারত। ওই অঞ্চলে এখনো থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। সরু সরু রাস্তা। বেহাল অবস্থা।
নবাবি খানা কী রকম ছিল, জানা নেই। শেহেরয়ালিদের একটি কোঠি, বড়ি কোঠি, যাকে হোটেল বানানো হয়েছে সেখানকার শাকাহারী খাওয়া সাধারণের নাগালের বাইরে। আতরওয়ালার বাড়িখানি টিকে আছে। ফারুখের সৌজন্যে একখানি ছবিও প্রাপ্তি হল।

এলাম কিরীটেশ্বরী মন্দির। মূল মন্দিরটি জীর্ণ ও পরিত্যক্ত। এখানে একটি ফলক অত্যন্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে। মন্দিরের জন্য জমিদান করছে একটি মুসলমান পরিবার।
মন্দিরটির পরিবেশ অতি মনোরম। নতুন মন্দিরের মাথায় ইসলামি প্রভাব স্পষ্ট। রানি ভবানীর মন্দিরের ছাদে উল্টানো পদ্মের আকৃতি বেশ অন্যরকম ওই অঞ্চলে। ভবানীশ্বরী মন্দিরের পঙ্খের কাজগুলি অতুলনীয়। চার বাংলা ও এই মন্দিরটি আরকিওলজিকাল দপ্তরের অধীনে। গজল্লা করার জন্য কেয়ারটেকারের ওপর ছেলে ছোকরাদের চাপ আসে। সে তেলেবেগুনে জ্বলে বিরক্ত হয়ে তালা ঝুলিয়ে হাঁটা দেয়।

দেখলাম নবাব সরফরাজ খানের অসমাপ্ত ফুটি মসজিদ। প্রায় জঙ্গলের মধ্যে। বিস্ময়কর ও ছমছমে। আর কদিন পরেই ভেঙে পড়বে, এমন অবস্থা। এমনকি মসজিদে উঠতে হলে গেরিলা জঙ্গিদের কায়দায় উঠতে হয়। ওখানে দু চারটে সিঁড়ি বানাতে কী হয়?
জাফরগঞ্জে মীরজাফর পরিবারের সমাধির মধ্যে দুটি ছোট্ট ছোট্ট কবর নজরে পড়তে পারে। কোনও বাচ্চার নয়। কবর দুটি মীরজাফরের ছেলে মিরনের দুটি পোষা বাজ পাখির। হীরালাল পান্নালাল। মিরনের ছবিতে এই দুই খেচরদ্বয়কে আপনারা দেখে থাকবেন।
রোশনি বাগ খোশবাগ। শান্ত। নিরালা।
.jpeg)
ঘসেটি বেগমের খজানা। একটি আয়ত ক্ষেত্রাকার ইটের ঢিবি। তাকে বল্লাল সেনের ঢিপি বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু না, সে খবর দেবার জন্য ওখানকার খাদিমই যথেষ্ট। গোরু বাঁধতে বাঁধতে তিনি এবং তাঁর ঘরনি দুইজনায় বললেন এই ঢিবি ভাঙবার জন্য প্রচুর গোলা বারুদ চলেছে। ইংরেজদের সন্দেহ, ঘসেটি বেগমের গুপ্ত ধন আছে ওখানে। আশ্চর্যের কথা হল যেই গুলি ছোড়ে সেই মারা যায়। সামনেই একটি ইংরেজের একক সমাধি দেখিয়ে তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ দেন। আশ্চর্যের বিষয় হলেও মানতেই হবে পলাশির ষড়যন্ত্রকারীদের কারুর স্বাভাবিক মরণ আসেনি। সামনে বয়ে চলে শান্ত ভাগীরথী। মতিঝিল হিরাঝিল কবে ডুবে গেছে সেই জলে। মুর্শিদাবাদের কোষাগার দেখে ইংরেজদের চোখ ট্যারা হয়ে গিয়েছিল। স্তূপীকৃত হিরে জহরত দেখে রবার্ট ক্লাইভ ভিরমি খেতে বাকি রেখেছিলেন।
মুরশিদকুলি এবং আলিবর্দি দুজনেরই একটি করে বেগম ছিল। সেকালের পক্ষে বেশ একটা উল্লেখযোগ্য খবর বটে। আলিবর্দি খান ধূমপান করতেন না। কফি খেতেন। কবিতা পড়তেন আর গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। সূক্ষ্ম ভোজন রসিক ছিলেন। রাতে ঘুমোতে যাবার সময় সঙ্গে যেত দ্বাররক্ষক আর কিসসাগো বা স্টোরি টেলার।
আলিবর্দি খানের আরেকটা ভালোবাসার জায়গা ছিল, সেটা হল দুধ সাদা ইরানি বিড়ালের ওপর তার দুর্বলতা। ফরাসি আর ইংরেজরা তার একটু দাক্ষিণ্য পাবার জন্য সারা পৃথিবী ঢুঁড়ে এক সে এক বড়িয়া বিল্লি নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা করত। আলিবর্দির শৃঙ্খলা বা জ্ঞান কোনটাই তাঁর নাতি সিরাজকে মানুষ করতে পারেনি।


এই কিসসার শেষ নেই। এক মুসাফিরের তিনদিনের রাহগুজার, তার পথের মৌতাত শুধু দিয়ে গেলাম এখানে! আমাদের দাস্তানের আসর জমিয়ে যেদিন মুর্শিদাবাদ মধ্যমণি হয়ে বসবে সেই দিনই কিস্তিমাৎ।
b | 14.139.***.*** | ২২ মে ২০২১ ২২:০১106306ছবি গুলোর ক্যাপশন থাকলে ভালো হত। কয়েকটার প্রসঙ্গ বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু অনেকগুলোর নয়।
r2h | 2405:201:8005:9947:bcfc:3eaf:6aad:***:*** | ২২ মে ২০২১ ২২:৪৩106308আলিবর্দী খান বেড়াল ভালোবাসতেন শুনে খুব খুশি হলাম। ভালো লোক।
সিরাজ যে এসব করে বেড়াতেন, এর ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু আছে নাকি শুধুই লোকমুখে? ঘসেটি বেগমের ঢিপির মতন?
গৌতম রায় | 103.242.***.*** | ২৩ মে ২০২১ ০১:০০106326লুৎফুন্নেসার সমাধির পাশে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয় মুর্শিদাবাদের জন্য বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে না আসে এমন বাঙালি নেই। তবে আবদুল হলিম শরর পুরানা লক্ষৌ খেকে বলা যায়, মুর্শিদাবাদ কখনই লক্ষৌ ছিল না। পার্সি মোগল সংস্কৃতিও মুর্শিদাবাদের নবাবদের ছিল না। নবকৃষ্ণ মুন্সি শিরাজকে পার্শি শেখাতেন। সরর বলেছেন ওয়াজিদ আলি সাহের প্রধান শখ ছিল ইমারত—মেটেবুরুজে নজরানা অর্ধেক হয়ে গেল তবু। মুর্শিদাবাদে এঁরা স্কন্ধাবার বানাতেন। বড় ইমারত থাকলে তার অয়েল পেন্টিং থাকতো। ইমারত যাও বা ছিল নিখিল নাথ রায় (মুর্শিদাবাদ কাহিনী)তে আর বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন গঙ্গা সব খেয়ে নিয়েছে। আর, কসমোপলমিটন ব্যবসায়ী ছাড়া শহর থাকবে কি করে। কাশিমবাজার কুঠি থেকে কোম্পানি সবাইকে তাড়িয়ে দিল। টাকার থলে আর্মানি, ডাচ আর সবাই চুঁচড়ো, ফরাসিরা ফরাসডাঙ্গা আর হুগলীতে চলে এল । পরে কলকাতায়। গৌতম রায়
সুকি | 49.207.***.*** | ২৩ মে ২০২১ ০৪:৩১106331এই সিরিজটা ভালো লাগল। বহুকাল আগে তখন মনে হয় ক্লাস এইট-নাইন হবে মুর্শিদাবাদ নিয়ে প্রথম পড়েছিলাম বারিদবরণ ঘোষের উপন্যাস শারদীয় বর্তমানে। ইতিহাস উপকথা মিশিয়ে সে দারুন জিনিস হত
Ipsita Mukherjee | 2409:4060:e92:a17d::db48:***:*** | ২৩ মে ২০২১ ০৮:২৩106332
অনুপম চক্রবর্তী | 117.237.***.*** | ২৩ মে ২০২১ ১১:০২106340অসাধারণ। যথার্থ বলেছেন "-----স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী তার গৌরবের শিরোপা হারাল। অথচ হেরিটেজ সম্পদ, পর্যটন ও রাজস্ব আদায়ের একটি সফল মাধ্যম অনায়াসেই হতে পারত। ওই অঞ্চলে এখনো থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। সরু সরু রাস্তা। বেহাল অবস্থা।" হৃদ্ধ হলাম।
শিক্ষিত হলাম !! অনেক কিছু জানতাম না।... এই লেখা তে তা জানা গেলো !!আমরা যারা বয়স্ক , তাদের হয়তো কিছু টা আগ্রহ থাকবে এইসব হারিয়ে যাওয়া ঘটনা গুলো কে নতুন করে জানতে , কিন্তু এই প্রজন্ম ???দুঃখ হয় , এরা ঋত্বিক ঘটক কে জানে না , কিন্তু ঋত্বিক রোশান কে জানে !!শচীন দেব বর্মন ভুলেগেছে , সচিন টেন্ডুলকার কে মনেরেখেছে !!এটাই আক্ষেপের বিষয় !!!!
শিবপ্রসাদ দাস | 2409:4060:386:56e1:c5d:c9ae:874b:***:*** | ২৪ মে ২০২১ ১০:২০106388সিরাজকে নিয়ে তো বহু মিথ্যে ইংরেজের রটানো।ভারতীয়দের সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গাগুলোকে নস্যাৎ করেই ইংরেজ শাসনের ভিত্তি।শাসনের অবশ্য তা চিরকালের আদত।আজও কেন্দ্রে রাজ্যে একইরকমভাবে শাসন চলে।আগের আগের সব প্রভাবশালী বৈশিষ্ট্যকে একইভাবে নির্বিচারে বরবাদ করেই নিজেদেরটা প্রতিষ্ঠা করতে হয়।তার মানেই য়ে আগের সবই ষোলোআনা ধোয়া তুলসিপাতা তা কেউ বলছে না।কিন্তু যা ছিল তাই,তার বেশীও না কমও না। তা ছাড়া নবাব বাদশাদের সে সময়কার যা জীবন যাপন সিরাজ য়ে তার ব্যতিক্রম তাতো নয়। তারওপর দাদুর অল্প বয়সী আদুরে নাতি।কিছুটা উশৃঙ্খল হবেই।রেওয়াজও তাই।কিন্তু নবাব হিসাবে ইংরেজের সঙ্গে সিরাজের ব্যবহারে , ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেনে অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় রয়েছে।সুশীল চৌধুরী মশায়ের সিরাজের ওপর বইগুলিতে তা পাই।বাাাাাাাাাা