১৮ জুলাই ১৯৭৪-এর বিকেল চারটে নাগাদ ফের স্পেশাল সেলের অফিসে নিয়ে আসা হয় অর্চনা-লতিকা-গৌরীকে।
সন্ধেবেলা, রুণুর নির্দেশে সন্তোষ দে অর্চনাকে টর্চার চেম্বারে নিয়ে যায়। টর্চার চেম্বারে একটি লাঠিতে অর্চনাকে বাঁধা হয়, মাথা নিচে- পা ওপরে। হাঁটু দুটি বাঁধা হয় আলাদা করে, তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি লাঠি। এই লাঠির দুটি প্রান্ত চেয়ারের হ্যান্ডেলে রাখা হয় এবং অর্চনার শরীর মাঝে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
রুণু গুহনিয়োগীর নির্দেশে সন্তোষ, আদিত্য ও অন্যান্য পুলিশকর্মীরা সমস্ত শক্তি দিয়ে অর্চনার পায়ের নিচে লাঠির বাড়ি মারতে থাকে। এই অত্যাচারের সময়ে রুণু ও অন্যান্য পুলিশকর্মীরা অর্চনার পায়ের নিচে জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো চেপে ধরতে থাকে, লাঠির আঘাত ছাড়া। পায়ের নিচে লাথিও মারতে থাকে।
এরপর রুণু অন্য পুলিশদের বলে অর্চনার কপালে ঠান্ডা জলের ফোঁটা দিতে। ঠান্ডা জলের ফোঁটা দেওয়া শুরুর পর অর্চনার মাথায় ভয়ানক যন্ত্রণা হতে থাকে, মুখ দিয়ে ফেনা বেরোতে শুরু করে। অর্চনা অজ্ঞান হয়ে যান। পুলিশ কর্মীরা তাঁকে নামিয়ে এনে চেয়ারে বসান ও মুখে জলের ছিটে দেয়। তাঁকে ওই চেম্বারের খাটে শুইয়ে দেওয়া হয়।
রাত ৮টা নাগাদ, অর্চনা, লতিকা ও গৌরীকে স্পেশাল সেলের সেন্ট্রাল লক আপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই রাত কাটান তিনজন।
পর দিন, ১৯ জুলাই, ১৯৭৪। সেন্ট্রাল লক আপ থেকে তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয় স্পেশাল সেলে। কিছুক্ষণ পর শিয়ালদা আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় অর্চনা গুহ, লতিকা গুহ ও গৌরী চ্যাটার্জিকে।
কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলেও, তিনজনের কাউকেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পেশ করা হয়নি। কোর্টবাবুর ঘরে আটকে রাখা হয় তিনজনকেই। ঘন্টা দেড়েক পর, অর্চনা-লতিকা-গৌরীকে স্পেশাল সেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওঁরা জানতে পারেন, আদালতে পুলিশ তাঁদের ভুয়ো নাম দিয়েছে। তাঁদের জন্য আদালতে কেউই জামিনের আবেদন করেনি।
সেদিন, ১৯ জুলাই, ১৯৭৪ রুণু গুহনিয়োগীর নির্দেশে সেলের মধ্যে অর্চনার সামনে সাদা কাগজ নিয়ে আসে অমিত মজুমদার নামের এক পুলিশ অফিসার। একই রকমের সাদা কাগজ লতিকা ও গৌরীকেও দেওয়া হয়। অর্চনাকে বলা হয় সাদা কাগজে সই করে দিতে। হুমকি দেওয়া হয়, সই না করলে অর্চনার সঙ্গে যা করা হয়েছে, সেই একই অত্যাচার করা হবে তাঁর মা ও দুই ছোট ভাইঝির উপরেও।
বিকেলে রুণুর অফিসে ডেকে পাঠানো হয় অর্চনাকে। রুণুর পাশে একজন পুলিশ অফিসার বসেছিল। অর্চনার পাশে বসে আরেক পুলিশ অফিসার, লালবাজারের অরুণ ব্যানার্জি। অর্চনা পরে জানতে পারেন রুণুর পাশে বসা অফিসারটি হাওড়া থানার। হাওড়ার অফিসার অর্চনার সঙ্গে কথা বলা শুরু করতেই অরুণ ব্যানার্জি অর্চনার মাথায় প্রবল জোরে ঘুঁষি মারতে শুরু করে। সে ঘুঁষি চলে ১০-১৫ মিনিট ধরে। অর্চনা মাথায় ও সারা শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা বোধ করতে থাকেন। এরপর তাঁকে অফিসঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সন্ধেবেলা ফের অর্চনাকে রুণুর অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। রুণু একটা চেয়ারে অর্চনাকে বসতে বলে। অর্চনা বসার পর রুণু গৌরীকে টর্চার চেম্বারে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়। গৌরীকে অর্চনার সামনে দিয়েই টর্চার চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে টর্চার চেম্বার থেকে গৌরীকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় অফিসে। গৌরীকে দেখে অর্চনা বুঝতে পারেন পুলিশ অফিসাররা গৌরীর উপর নির্মম অত্যাচার করেছে।
এরপর রুণু গুহ নিয়োগীর নির্দেশে অর্চনার সামনে দিয়ে লতিকা গুহকে টর্চার চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্চনা রুণুর ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছিলেন লাঠির আঘাতের শব্দ এবং অশ্রাব্য গালিগালাজ। কিছুক্ষণ পর লতিকাকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় মূল অফিসে, অর্চনার সামনে দিয়েই। তাঁর অবস্থা দেখে অর্চনা বুঝতে পারেন লতিকার উপরেও নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে। এরপর রুণু ডেকে পাঠায় কমলকে। কমল এলে রুণু অর্চনাকে বলে কমলের দিকে তাকাতে। রুণু বলে, “এর হল ‘সোনে কা হাথ’। এ হাতে যে পড়েছে, তার নিস্তার নেই।” রুণু ভয় দেখাতে থাকে। বলা হয় আজ অর্চনার শেষ দিন। আজ যদি অর্চনা মুখ না খোলেন, তা হলে তাঁকে খুন করে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে। বাড়ির কোনও লোক প্রমাণ করতে পারবেন না যে অর্চনাদের তিনজনকে লালবাজারে বা রুণু গুহ নিয়োগীর কাছে নিয়ে আসা হয়েছে।
রুণু কমলকে নির্দেশ দেয় অর্চনাকে শিক্ষা দেবার জন্য। কমল অর্চনার চুলের মুঠি ধরে তাঁকে চেয়ার থেকে টেনে তোলে এবং তাঁর মাথা দেওয়ালের দিকে ছুড়ে দেয়। দেওয়ালে মাথা ধাক্কা লাগার ঠিক আগে চুল ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের দিকে নিয়ে আসে। এই পদ্ধতিতে অত্যাচার চলে ১৫-২০ মিনিট ধরে। অর্চনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। তাঁর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। সারা শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছিল তখন অর্চনার। তাঁকে চেয়ারে বসতে বলা হল। কিছুক্ষণ পর আদিত্যকে রুণু নির্দেশ দিল অর্চনার চুল ধরে ঝুলিয়ে রাখতে। আদিত্য ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্চনার চুল এত জোরে টানে যে তাঁর মাথার কিছু চুল ছিঁড়ে যায়।
আদিত্য ও আরেকজন কনস্টেবল অর্চনার মাথার চুল দু দিক থেকে ধরে তাঁকে মেঝে থেকে তুলে ঝুলিয়ে রাখে। ১৫-২০ মিনিট ধরে চুল ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর মধ্যে রুণু এগিয়ে আসে, অর্চনার পায়ে লাথি মারে. তাঁকে কদর্য ভাষায় গালাগাল দেয় এবং তাঁর শরীরের কিছু জায়গায় জ্বলন্ত চুরুটের ছ্যাঁকা দেয়। অর্চনা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পুলিশরা তাঁকে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর তাঁর মুখে, চোখে জল দিয়ে, মুখের মধ্যে জল দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করা হয়।
জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অর্চনাকে সেন্ট্রাল লক আপের অফিস ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্চনা দেখেন অফিস ঘরে লতিকা বসে রয়েছেন। লতিকা অর্চনার কাছে জানতে চান কী অত্যাচার করা হয়েছে। অর্চনা সেই মুহূর্তে কথা বলতে পারছিলেন না। লতিকা তখন আদিত্যকে জিজ্ঞাসা করেন। আদিত্য স্বীকার করে যে অর্চনার উপর নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে। আদিত্য এ কথাও বলে যে সে জীবনে প্রথমবার কোনও মহিলাকে এরকম ভাবে অত্যাচার করল।
লতিকাকে লক আপে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর লক আপে নিয়ে যাওয়া হয় অর্চনাকেও। সেদিন, ১৯ জুলাই, ১৯৭৪ অর্চনাকে আলাদা রাখা হয়। এর পরের ১৫ দিন অর্চনাকে সলিটারি সেলে রাখা হয়েছিল।
২০ জুলাই ১৯৭৪। সকাল ১০টা নাগাদ অর্চনা, লতিকা, গৌরীকে স্পেশাল সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ অফিসাররা অর্চনার উপর অত্যাচার চালাতে শুরু করে এবং তিনজনকে জোর করে সাদা কাগজে সই করতে বাধ্য করা হয়।
রুণু গুহ নিয়োগী ক্রমাগত অর্চনা, লতিকা ও গৌরীকে ঘুঁষি মারছিল এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
বিকেল চারটে নাগাদ তিনজনকেই সেন্ট্রাল লক আপে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ৮ টা নাগাদ অর্চনা ও লতিকাকে স্পেশাল সেলের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছিল রুণু ও কিছু কনস্টেবল। রুণুর নির্দেশে অর্চনাকে টর্চার চেম্বারে নিয়ে যায় কনস্টেবল আদিত্য। চেয়ারে অর্চনাকে বসিয়ে আদিত্য বলে, আজ মুখ না খুললে বাইরে চারজন অবাঙালি মাতাল দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারা এক ইশারায় অর্চনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ধর্ষণ করবে।
রুণু এসে আদিত্যকে জিজ্ঞাসা করে অর্চনা কিছু বলেছেন কিনা। আদিত্য জানায় কিছুই বলেননি। টর্চার চেম্বারে এসে রুণু আদিত্যকে বলে অর্চনার হাত দড়ি দিয়ে বাঁধতে। রুণুর কথা মত আদিত্য দড়ি দিয়ে অর্চনার হাত বাঁধে। সে দড়ির একটা মাথা ছিল চামড়ায় মোড়া।
ওই চামড়ার দিকটা দিয়ে রুণু সজোরে অর্চনার মাথায় মারতে থাকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে। সে আঘাতের শব্দ এমন ছিল যে মনে হচ্ছিল অর্চনার মাথা নারকেলের মত ফেটে যাচ্ছে। অর্চনা সারা শরীরে যন্ত্রণা বোধ করতে থাকেন। এক সময়ে তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যান।
পুলিশ অফিসাররা অর্চনাকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। কনস্টেবল আদিত্য অর্চনার মুখে চোখে জল দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে। অর্চনাকে সেন্ট্রাল লক আপে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে লক আপের অন্য মহিলা ওয়ার্ডাররা অর্চনাকে সেলে নিতে অস্বীকার করেন। অর্চনা হাঁটতে পারছিলেন না। লালবাজারের উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তাঁকে ফিমেল লক আপে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আদিত্য ও আরেকজন কনস্টেবল অর্চনাকে সেলে নিয়ে যায়।
অর্চনার খুব তেষ্টা পেয়েছিল। কিন্তু তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে নিজে জল নিয়ে খাবার মত অবস্থায় ছিলেন না। কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে তিনি সেলের মধ্যে ঢুকেই অজ্ঞান হয়ে যান।
পরদিন অর্চনার জ্ঞান ফেরে লতিকা ও গৌরীর কান্নার শব্দে। উঠে বসেন অর্চনা। তাঁর নড়বার ক্ষমতা ছিল না। লতিকা ও গৌরী অর্চনাকে বলেন, তাঁরা অনেকক্ষণ ধরে অর্চনাকে ডেকে সাড়া পাচ্ছিলেন না।
২১ জুলাই ১৯৭৪-এ অর্চনা, লতিকা ও গৌরীকে স্পেশাল সেলে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ১৮ জুলাই ১৯৭৪ থেকে ১৩ অগাস্ট ১৯৭৪ পর্যন্ত এই তিনজনকে লক আপে রাখা হয়েছিল। এই ২৭ দিনে এঁদের কোনও আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাঁরা একই পোশাকে এই দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। তাঁদের স্নান বা মুখ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাঁদের পশুর মত করে রাখা হয়েছিল। ২২ জুলাই থেকে প্রতিদিন অর্চনা, লতিকা ও গৌরীকে স্পেশাল সেলে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হত, কুৎসিত গালিগালাজ করা হত এবং তাঁদের সামনে কদর্য অঙ্গভঙ্গি করা হত। জ্বলন্ত সিগারেট ও চুরুটের ছ্যাঁকা দেওয়া হত তিনজনের শরীরে।
এই অত্যাচারের জেরে অর্চনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। ১৯৭৪ সালের ১৩ অগাস্ট অর্চনা, লতিকা ও গৌরীকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্চনা সারাদিন ধরে মাথায় যন্ত্রণা বোধ করতে থাকেন এবং সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেন। অর্চনার শরীরের নিম্নাঙ্গ পঙ্গু হয়ে যায়।
উফ।
কল্পনাতীত :-(((
বার বার শিউরে উঠতে হয়!
#
তাপস দা, পুরো লেখা, মামলার নথি ও অন্যান্য তথ্যসূত্র সমেত একটি বই প্রকাশের চেষ্টা করো। এই দলিল সংরক্ষিত রাখা খুব দরকার। শুভ
লেখা চলতে থাকুক । এই ইতিহাস টা খুব জরুরি ।
এইগুলো সিনেমাতে দেখা যায়। বাস্তবে এর ১0% o যদি সামনাসামনি ঘটতে দেখি, বোধহয় বমি করে ফেলবো। আমাদের অফিসের একজনকে একবার জলপথ হয়ে ফেরার সময় কি একটা সামান্য কারণে ঐ পথের গ্রামবাসীরা তাড়া করে ধরে ফেলে মারে। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন মিলে মেরে ফেলে রাখে, পরে পুলিশ নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হয়, সেই বিবরণ শুনে এবং পরে তার ট্রমার বিবরণ শুনে কেঁপে গেছি। আর এখানে দিনের পর দিন ধরে এই রকম টরচার!
ঐ সব রাক্ষস, দানব এসব গল্পকথা না, আমাদের মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
উফ কী ভয়াবহ। তবু এ সত্য, তাই সম্পূর্ণ ঘটনা পড়তে চাই। তাড়াতাড়ি likhun