চালশে না-পড়া একজন আগের পর্বদ্বয় পড়ে বলছিলেন, এ কোনও দায়িত্ববান ইতিহাস রচনা হচ্ছে না। ভদ্রতা বজায় রেখে বলছিলেন না, যে এ কেবল র্যান্ট মাত্র। কিন্তু সম্ভবত তাঁর প্রতিপাদ্য ছিল এরকমই। আমি তাঁর সঙ্গে সহমত হইনি। তাঁকে বলা হয়নি, ইতিহাস ঠিক কী ভাবে লিখতে হয়, তা কিরণচন্দ্র চৌধুরী বা পরবর্তীতে অন্য কোনও চিন্তন বিদ্যালয় নির্ধারণ করে দিতে পারে না। ইতিহাস, ওরকম কিছু নয়। ইতিহাস যখন রচিত হয়, সবসময়ে সকলে বুঝতে পারেন না যে ইতিহাস রচিত হচ্ছে। নদীর স্রোতের মত বহমান ঘটনাধারা ঘটে যাবার অনেক পরে বোঝা যায় ইতিহাস রচিত হচ্ছিল, হয়েছে। তখন একজন বা অনেকে, একসঙ্গে বা পৃথকভাবে, ঘটনাক্রম থেকে বিযুক্ত হয়ে তাকে লিপিবদ্ধ করতে পারেন, সটীক অথবা টীকাবিহীন। কিন্তু যারা ওই সময়কালে, নদী ভাঙন ও নদীর নতুন তীর গড়ার সময়ে নদীতে ছিলেন, তাঁদের বিযুক্তি ঘটে না। যার বিযুক্তি নেই, তার তৈরি করা একটা অবজেক্টিভিটি থাকতে পারে, কিন্তু না-ও থাকতে পারে। এই খণ্ড ধারাবিবরণীকারের কোনও বিযুক্তি আকাঙ্ক্ষা নেই, এই খণ্ড ধারাবিবরণীর কোনও বিযুক্তি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা নেই। ফলে একে কোনও ইতিহাস বলে দাবি করার দায়ও নেই। এই ধারাবিবরণীর এক ও একমাত্র দায়, একটি অন্যায়কে, একাধিক অন্যায়কে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা। এ প্রতিরোধে সে অন্যায় ম্লান হয় না, শুধু পাল্টা একটা স্বর, তা ক্ষীণ হলেও রাখা যায় মাত্র। তাকে ইতিহাসের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে কি না, সে দিকে নজর রাখা এই ধারাবিবরণীর উদ্দেশ্য নয়। হয়ত বিধেয়।
ফলে, এখানে ধারাবিবরণীর সাধারণ নিয়ম মেনে ঘটনাক্রম, সময়ানুসারী নয়। সে সব পাওয়া যেতে পারে বিভিন্ন নথি ও দস্তাবেজে। এ কোনও উপন্যাসও নয়, যেখানে নথি বা দস্তাবেজ আশ্রিত কোনও কল্পনা লিখিত হবে। এই রচনার পদ্ধতি কেবলমাত্র স্মৃতি, হয়ত বা কিছু সংলাপও।
._--------------------+++++++++++---------+++++++-----
এমপ্যাথি কথাটা সৌমেন গুহ বলার পর থেকে, তাড়া করে। তিরিশ বছর হতে চলল। এমপ্যাথি শব্দটা ওই ইনভিটেশন কার্ডটাতেও ছিল। যে কার্ড বিলি করা হয়েছিল উভয়পাক্ষিক সওয়াল-জবাব শেষ হবার দিনে। সৌমেন গুহ বনাম বিষ্ণুচরণ ঘোষ। ব্যাগে রাখা ছিল কার্ডটা। সৌমেনদা বলেছিলেন, প্যাকেট খুলবে না, আমি না-বলা পর্যন্ত। সওয়াল-জবাব পর্ব শেষ হল, ম্যাজিস্ট্রেট রায়দান কবে, তা রিসেসের পর জানাবেন বলে ঘোষণা করলেন। সৌমেনদা আমার কানে বললেন, প্যাকেট খোলো। কার্ড বিলি করো।
কার্ডের বয়ান ছিল এরকম, অর্চনা মামলার রায়ে রুণু গুহনিয়োগী দোষী সাব্যস্ত হওয়ায়, অমুক তারিখে বিশেষ অনুষ্ঠান, মহাবোধি সোসাইটি হলে। কী ভয়াবহ আত্মবিশ্বাস লোকটার, সওয়াল শেষ হবার আগে কার্ড ছাপিয়ে ফেলা, এবং সে কার্ড বিলি করে দেওয়া আদালত চত্বরে, রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণের আগেই।
হুড়মুড়িয়ে বিলি করতে থাকি কার্ড। হরেনের চায়ের দোকানের সামনে। অনেকে চাইতে আসে, স্পষ্ট বলি, রুণুর লোক পাবে না। অপরিচিত সব কালো কোটেরা হাজির হয়ে যায়, মুখ চেনা কেউ বলে, উনি রুণুর লোক না, দিয়ে দিন। সাতিশয় বিশ্বাসে, দিয়ে দিই। রিসেসের পর, বিষ্টু ঘোষ ওই কার্ড, যা আমিই দিয়েছিলাম ওর কোনও লোকের হাতে, তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেয় এবং এর মাধ্যমে রায় প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে আপত্তি তোলে। তাতে অবশ্য, নতুন কোনও ঘটমানতা তৈরি হয়নি।
উল্লিখিত দিনে, মহাবোধি সোসাইটিতে যিনি প্রথম হাজির হয়েছিলেন, তিনি অনামন্ত্রিত। সৌমেনদার কথায়, হাজার চুরাশির মা-রা যখন মিছিল করছিল, তখন উনি মডেস্টি ব্লেজ অনুবাদ করছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তৎকালীন প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। যে সময় দেওয়া ছিল, তার অন্তত আধ ঘণ্টা আগে অত বড় গণ্যমান্য দেখে কী করব বুঝে উঠতে না পেরে সৌমেনদার বাড়িতে ফোন করেছিলাম উনি কখন বেরিয়েছেন জানতে। সৌমেনদা ফোন ধরে বললেন, উনি তখনও বেরোননি। এদিকের ঘটনাক্রম জানাতে তিনি সেই সর্বক্ষণের সুপার কুল কণ্ঠে বললেন, বসাও, চা খাওয়াও। আমি তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করছি না।
কিঞ্চিৎ বাদলা হাওয়া ওঠে। আর এদিকে হল ভরে ওঠে ধীরে ধীরে, সৌমেনদাদের দেখা নেই। আমাকে কে যেন মাইক ধরিয়ে দিলেন, কিছুমিছু বলার জন্য। আমি কাঁপা ঠ্যাং নিয়ে বলতে থাকি, বাইরে দুর্যোগের জন্য কর্মসূচি শুরু হতে দেরি হচ্ছে। রবীন (চক্রবর্তী)দা মাইক রাখার পর বলেন, এমন চমৎকার হাওয়া দিল, তাকে দুর্যোগ বললে! বাইরে সুযোগ হচ্ছে বললে পারতে!
সুযোগ আর দুর্যোগ এমন হাত ধরাধরি করে চলতে, আর কোনও উদাহরণে দেখিনি। যেমনটা ঘটেছিল অর্চনা মামলায়। এ তো এখন প্রায় সকলে জানে, মানে এখন নয়, তখন জানত, এখনকার সকলে নয়, তৎকালীন সময়ের সকলে, যে এই মামলার অন্যতম আইনজীবী, বিশিষ্ট বলে খ্যাত, মানবাধিকার রক্ষক আইনজীবী হিসেবে প্রায় সর্বমহল স্বীকৃত, এই মামলা বেচে দেবার চেষ্টা করেছিলেন পদ আদায়ের জন্য। সরকারি পদ। অর্চনা মামলা ছিল আঁটোসাঁটো। সে মামলা কোয়াশ করা যেত না। তাই দিনের পর দিন, এমন সব প্যাঁচ কষছিল রুণুর স্বাভাবিক পক্ষ আর রুণুর হয়ে কাজ করা মীরজাফররা, যাতে মামলা অনন্ত কাল ধরে চলতে থাকে, চলতেই থাকে, তারপর কালের নিয়মে হারিয়ে যায়, দস্তাবেজ চাপা পড়ে যায়, আর বুলডগের মত কানওয়ালা রঞ্জিত গুহনিয়োগী আর তার শাকরেদরা সপদোন্নতি সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
সৌমেন গুহ শেষ পর্যন্ত তা ঘটতে দেননি।
রোমহষর্ক পরিস্থিতির বিবরণ! সত্যিই এ এক ইতিহাসের যাত্রাই বটে। অথবা ইতিহাস যাত্রার স্কেচবুক।
ঘটনা পরম্পরা বুঝতে নতুন করে আবার আগের দুই কিস্তি পড়ে নিতে হলো। অসম্ভব শক্তিশালী লেখা, রিপোর্টাজ ধরনে লেখা হলেও কালের যাত্রা দৃশ্যকল্প, চরিত্র ও অনুসংগ খুব নিখুঁত।
এই লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জেন, তাপস দা ❤️
মানুষের ইতিহাস এভাবেই লেখা হয়।
লেখা চলুক
এমন প্রতিরোধের স্বর সোচ্চার থাকুক। পড়ছি।
এটাই কি শেষ কিস্তি ? জানি না। তবে আরো দুজন মহামান্যের কথা না আসলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নাম এই মুহুর্তে করছি না, তাপস নিজের মত করে লিখুক।
এটাই কি শেষ কিস্তি ? জানি না। তবে আরো দুজন মহামান্যের কথা না আসলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নাম এই মুহুর্তে করছি না, তাপস নিজের মত করে লিখুক।
তাপস এটা আরেকটু বিস্তারিত করে লিখবেন না?
আমারও অনুরোধ রইল, আর বড় করে লেখার জন্য ।
বি, অরণ্যদা
ভাবনাগুলো একটু ছিঁড়ে যাচ্ছে, আর সব তথ্যাদি হাতের কাছে পাচ্ছি না। ফলে লেখাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। সে জন্য দ্বিধা ও সংশয় হচ্ছিল, হচ্ছে কিছুটা। আরেক পর্ব লিখেছি। নিয়মিত হওয়া হবে না মনে হয়।