সেভেন্থ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অর্চনা মামলায় নিজে সওয়াল করার সপক্ষে সৌমেনদা যে যু্ক্তি দিয়েছিলেন, তার অন্যতম ছিল - নিজের আইনজীবীদের উপর আস্থা হারানো। প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা চলে, আইনজীবীদের বিশ্বাসঘাতকতা না ঘটলে, এই মামলায় রুণুরা সত্যিই জেলে যেতে পারত।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যেদিন মামলার শুনানি শুরু হল, তখন অর্চনাদির ডিপোজিশন চলছে। ডিপোজিশনে অর্চনাদিকে প্রশ্ন করছেন, বিশিষ্ট সিনিয়র আইনজীবী। ভঙ্গিটা এরকম- কাঠগড়ায় অর্চনাদি, লইয়ারের সামনে টেবিল, এজলাশে যেমন হয়, তিনি দাঁড়িয়ে, একটা পা পিছনের চেয়ারে তোলা। ঠিকই পড়লেন। একটা পা পিছনের চেয়ারে তোলা, আশ্চর্য সে ভঙ্গি। আর তিনি একটা কাঠি দিয়ে কান চুলকোতে চুলকোতে নিজের মক্কেলকে প্রশ্ন করছেন। এটা একদিনের ঘটনা নয়, সে আইনজীবী ডিপোজিশন চলাকালীন এরকম ভঙ্গিতেই সওয়াল চালিয়ে গিয়েছেন। সে সব ডিপোজিশন পর্ব অতি স্বল্পস্থায়ীই হত। মনে রাখতে হবে, এই মামলার জন্য অর্চনাদি বিদেশ থেকে এখানে আসতেন। এসে থাকতেন কোনও আত্মীয়ের বাড়ি। এই পর্যায়ে মূলত জপুরের বাড়িতেই।
কান চুলকোনো সেই আইনজীবী অমিয় চক্রবর্তী। পরবর্তীকালে, অমিয়র সওয়াল শুনে একদিন সন্ধেবেলা সুকিয়া স্ট্রিটে গিয়ে বলেছিলাম, অমিয় টাকা খেয়েছে। কালধ্বনির দফতর তথা আড্ডাখানা, সুকিয়া স্ট্রিট। প্রশান্তদা রাগ করেছিলেন। প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়, বহু বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলা কালধ্বনি পত্রিকার সম্পাদক। বলেছিলেন, এরকম কেন বলছিস। তুই কী করে এরকম বলতে পারিস! সে অর্থে দেওয়ার মত উত্তর ছিল না; আমি আইনজ্ঞও নই যে ল পয়েন্ট ধরে বলতে পারব। তবে সৌমেনদা নিজের আইনজীবীদের উপর অনাস্থা ব্যক্ত করার পর, নিজে সওয়াল শুরু করার পর, এই মামলাতেই, রুণুর পক্ষে চলে গিয়েছিল অমিয়। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। রুণুর হয়ে আদালতে আসত, জেরা করত, বিষ্টু ঘোষকে পয়েন্ট জোগাত। এই মামলা বিশ্বাসঘাতকতার।
অর্চনাদি লক আপ টর্চারে পঙ্গুত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁর শরীরের নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাত হয়েছিল। বেশ কিছু বিদেশি সংস্থা, অর্চনা গুহর কথা জানাজানি হবার পর এগিয়ে আসে। অর্চনাদিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় তাদের তরফে। ডেনমার্কে সে সময়ে অর্চনাদির ফিজিওথেরাপি যিনি করতেন, তাঁর নাম পিয়া জনসন বা জেনসেন। পিয়ার সঙ্গে অর্চনাদির বিয়ে হয়েছিল।
অর্চনা গুহর ঘটনা নিয়ে একটা উপন্যাস আছে। ডোন্ট কল মি আ ভিক্টিম! আমাজনে দেখলাম দু হাজার টাকার বেশি দাম। ওই কারণেই পড়া হয়ে ওঠেনি, উঠবেও না কদাপি।
ম্যাজিস্ট্রেটের বিধান ছিল, সৌমেনদা কেন সওয়াল করার অধিকারী, তা সওয়ালের মাধ্যমেই সৌমেনদাকে বলতে হবে। সেদিন ভয়াবহ বৃষ্টি ছিল। সে মারাত্মক বৃষ্টি। কুষ্টিয়ার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ডাকতে গিয়ে পাচ্ছিই না। পিকনিক গার্ডেন পর্যন্ত চলে গেলাম। অত জলে কেউ ডালহৌসি যেতে রাজিই হয় না। অনেক বেশি টাকা চাইছিল একজন। শেষ পর্যন্ত তাকেই নিয়ে যাওয়া হল। ডিকিতে বই, পায়ের কাছে বই। সাইটেশনের জন্য। বই একটা ব্যাপার হয়ে উঠবে, আরও পরে, এই মামলায়। সে পরেরই কথা।
সেদিন সৌমেনদা প্রায় তিন ঘণ্টা সওয়াল করেছিলেন। ফাঁকা, প্রায় সম্পূর্ণ ফাঁকা একটা এজলাশে, বৃষ্টিবিধৌত শহর কলকাতার এক খুপরি বিচারশালায়, সেদিন ইতিহাস রচিত হল। সৌমেনদা সওয়াল করলেন, কেন তিনিই এ মামলার সওয়ালের যোগ্যতম ব্যক্তি। তিনিই এই মামলার প্রথম দিন থেকে রয়েছেন, সমস্ত নথি আগা থেকে গোড়া তিনিই দেখেছেন, উকিল পাল্টেছে, অর্চনাদি বিদেশে থেকেছেন পরিবার ও অসুস্থতা সঙ্গী করে। সৌমেনদা বলেছিলেন, আইনজীবীদের উপর তিনি আস্থা হারিয়েছেন। এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে নিশ্চয়ই, পৃথিবীর ইতিহাসে, ভারতের ইতিহাসে, কিন্তু এত বড়, এত খ্যাত একটা মামলার ভার সম্পূর্ণ নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার পিছনে যে অপরিসীম স্পর্ধা ছিল, তা বাংলা ভাষার কোনও ইতিহাসে লিখিত নেই।
সৌমেন গুহর কাছে, লতিকা গুহর কাছে, সৌমেনদা-লতিকাদির পালিতা কন্যা মীনার কাছে, এই অস্বীকৃতির কারণে অপরাধী থাকতে হবে। কিন্তু অপরাধী কেউ নয়, কারণ এই দায়টুকুও কেউ ওন আপ করেনি।
এ কথাগুলো না লিখলেও হত। সৌমেনদা এমনিতে লোকসমক্ষে সিভিল রাইটস, হিউম্যান রাইটস- এসব শব্দবন্ধ ব্যবহারে একটা কস্টিক অ্যাটিচিউড দেখাতেন। তবে একদিন, একবার বলেছিলেন, শোন তাপস, হিউম্যান রাইটস কোনওদিন তুমি করতে পারবে না, যতদিন না তুমি এমপ্যাথেটিক হতে পারবে। সিমপ্যাথি নয়, এমপ্যাথি।
সেই কথাটা মনে পড়ে।
আরো কিস্তি আসবে তো?
এই বিখ্যাত মামলার শুনানী শোনার কৌতূহল নিয়ে আশির দশকে একবার বন্ধুদের সঙ্গে একটি আদালত প্রাঙ্গনে গেছিলাম মনে পড়ে। তবে সেদিন কোনো কারণে যতক্ষণ উপস্থিত ছিলাম, শুনানী শুরু হয় নি - এমনটা মনে পড়ে।
চেষ্টা করব কিস্তিতে কিস্ততে লেখার।
এটা ৯ এর দশকের বিবরণী; সুপ্রিম কোর্ট যখন বলেছিল, ডেইলি বেসিসে লোয়ার কোর্টে মামলার শুনানি সম্পূর্ণ করতে হবে।
পড়ছি