ঘটনার সময়ে এই মামলার প্রধান অভিযোগকারিণী অর্চনা গুহ (পরিভাষায় PW 1 বা প্রসিকিউশন উইটনেস ১), শ্রীমতী লতিকা গুহ (পরিভাষায় PW 2 বা প্রসিকিউশন উইটনেস ২) এবং গৌরী চ্যাটার্জি ৭ নং জপুর রোড, কলকাতা ৭৪-এর বাসিন্দা ছিলেন। সে সময়ে অর্চনা গুহ কলোরা গার্লস জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬২ থেকে তিনি ওই স্কুলে চাকরি করতেন। ৬৭ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হন। লতিকা গুহ ছিলেন গোখলে মেমোরিয়াল কলেজের অধ্যাপক।
ওই বাড়িতে অর্চনা ছাড়াও থাকতেন তাঁর মা, তাঁর ছোট ভাই সৌমেন গুহ ও সৌমেনের স্ত্রী লতিকা গুহ, পারিবারিক বন্ধু গৌরী চ্যাটার্জি।
১৭ জুলাই ১৯৭৪। রাতে ঘুমোবার সময়ে বাড়ির দরজায় ধাক্কার আওয়াজে সকলের ঘুম ভেঙে যায়। তখন সময় রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে, অর্থাৎ ক্যালেন্ডার মতে ১৮ জুলাই ১৯৭৪। সে রাতে বাড়িতে ছিলেন অর্চনার অন্য ভাইয়ের দুই কন্যা সংহিতা গুহ ও সঞ্চয়িতা গুহও।
দরজা খোলার পর বেশ কয়েকজন লোক বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারা জানায় যে তারা লালবাজার থেকে এসেছে। ওই দলের একজনের নাম পরে অর্চনা জানতে পারেন। তার নাম ছিল মানস। মানস জানায় তারা বাড়ি তল্লাশি করবে। তল্লাশির নামে বাড়ি প্রায় তছনছ করে ফেলা হয়।
অর্চনা-লতিকা ও বাড়ির কোনও সদস্যদের উপস্থিতিতে কোনও সিজার লিস্ট (তল্লাশির পর কী কী বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তা লিপিবদ্ধ রাখতে হয়) প্রস্তুত করা হয়নি বা তার কোনও কপি তাঁদের দেওয়া হয়নি।
এর পর অর্চনা-লতিকা-গৌরীকে লালবাজার যাওয়ার জন্য ভ্যানে উঠতে বলা হয়। রাত ২ টো নাগাদ ভ্যান পৌঁছয় কাশীপুর থানায়। সেখানে প্রায় ঘন্টা দুয়েক তিনজনকে বসিয়ে রাখা হয়। কাশীপুর থানা থেকে তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল সেলে। তখন ভোর প্রায় সাড়ে চারটে।
লালবাজারের স্পেশাল সেল ছিল মূল চত্বরের পশ্চিম দিকে, দোতলায়। স্পেশাল সেলের আকৃতি ইংলিশ L আকৃতির। এই সেলে তিনটি ঘর। প্রথম ও সবচেয়ে বড় ঘরটা ব্যবহার করা হত মূল অফিস ঘর হিসেবে। দ্বিতীয় ঘর ছিল রুণু গুহনিয়োগীর অফিস ঘর। শেষ ঘর - টর্চার চেম্বার। প্রতিটি ঘরই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত।
১৮ জুলাই, ১৯৭৪-এ তিনজনের কাউকেই আদালতে পেশ করা হয়নি।
তিনজনকে করিডোরের একটা বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়। এর পর মানস নামের সেই পুলিশ অফিসার এক এক করে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়।
অর্চনা গুহ যখন ভিতরে যান, তখন মানস তাঁকে সামনে বসিয়ে নাম ঠিকানা শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে এবং সেগুলি লিখে নেয়। এরপর একটি কাগজ অর্চনাকে দেওয়া হয়। সে কাগজে অর্চনার অপরিচিত কয়েকজনের নাম লেখা। প্রশ্ন করা হয়, অর্চনা এঁদের চেনেন কিনা।
সকাল ১০টা সাড়ে ১০টা নাগাদ রুণু গুহনিয়োগী (মামলায় অভিযুক্ত নং ১) অফিসে আসে। তার নির্দেশে অর্চনা, লতিকা ও গৌরীর উপর অত্যাচার শুরু হয়।
প্রথমে গৌরীকে টর্চার চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর অর্চনাকে যখন টর্চার চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি দেখেন গৌরীর হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, এবং দুই হাঁটুর মধ্যে ও দুই কনুইয়ের মধ্যে লাঠি ঢোকানো রয়েছে, সে লাঠির একটা দিক দুটি চেয়ারে রাখা। গৌরীকে ওই দুটি চেয়ারের মধ্যে এই অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর মাথা নিচের দিকে, পা উপরের দিকে। গৌরী ছিলেন একটু মোটাসোটা মানুষ, তাঁর শরীরের ভার তাঁকে প্রায় বিকল করে দিয়েছিল।
অর্চনা দেখেন ওই অবস্থায় গৌরীর পায়ের তলায় প্রবল জোরে লাঠির বাড়ি মারছে এক পুলিশ। তার নাম কমল। এর পর অর্চনাকে হুমকি দেওয়া হয়, স্বীকারোক্তি হিসেবে তাঁর কাছে যা চাওয়া হবে, তা না দিলে তাঁর অবস্থাও গৌরীর মতই হবে। গৌরীর অবস্থা দেখে অর্চনা বুঝতে পারেন তাঁর সঙ্গে কী হতে চলেছে। তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে বড় অফিস ঘরে নিয়ে আসা হয়।
কিছুক্ষণ পরে কমল টর্চার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে এবং রুণু তাকে লতিকা গুহর উপর অত্যাচার শুরুর নির্দেশ দেয়। লতিকা চেয়ারে বসেছিলেন, তাঁকে জোর করে দাঁড় করানো হয়। কমল লতিকাকে দেওয়ালের গায়ে ঠেসে দাঁড় করায়।
নিজের ডান হাত দিয়ে লতিকা গুহর বাঁ গালে ভয়ংকর জোরে চড় মারতে শুরু করে কমল । এতটাই নির্মমভাবে কমল চড় মারছিল যে অর্চনার মনে হয়েছিল লতিকার চোখ কোটর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবে। বেশ কিছুক্ষণ চড় মারার পর লতিকাকে চেয়ারে বসানো হয়। অর্চনা দেখেন, লতিকার গাল ভয়াবহ রকম ফুলে গিয়েছে এবং তাতে স্পষ্ট আঙুলের দাগ।
এরপর টর্চার চেম্বার থেকে গৌরীকে বাইরে বের করে আনা হয়। রুণুর নির্দেশে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় অর্চনাকে। নিয়ে যায় সন্তোষ দে নামের এক পুলিশ কনস্টেবল। এই মামলায় সন্তোষ ২ নং অভিযুক্ত।
সন্তোষ সহ আরও কয়েকজন কনস্টেবল অর্চনাকে মেঝেতে বসায়। শাড়ি তুলে দেওয়া হয় হাঁটুর ওপর। শাড়ির সামনের অংশ দুপায়ের পেছনে বেঁধে দেওয়া হয়, যেমন করে পুরুষেরা কাছা বাঁধেন, শক্ত করে আঁচল বেঁধে দেওয়া হয় কোমরে। একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় অর্চনার দু হাতের কব্জি ও পা। দু হাঁটু আর দুই কনুইয়ের মধ্যে একটা লাঠি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যেমনটা করা হয়েছিল গৌরীকে। এরপর দুটি চেয়ারে লাঠির দুপ্রান্ত রেখে মাঝখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় অর্চনাকে। মাথা নিচের দিকে, পা উপরে।
রুণু গুহ নিয়োগীর নির্দেশে, সন্তোষ লাঠি দিয়ে অর্চনার পায়ের তলায় মারতে থাকে। এত জোরে মারা হতে থাকে যে অর্চনার মনে হচ্ছিল মাথার ভিতরের শিরাগুলো সব ছিঁড়ে যাবে।
এই মার যখন চলছিল, তখন সব সময়ে রুণু ঘরে থাকছিল না। মাঝে মাঝে আসছিল। যখনই আসছিল, অর্চনার পিছনে লাথি মারছিল। আর জ্বলন্ত চুরুট চেপে ধরছিল অর্চনার কনুইয়ে, পায়ের তলায়, পায়ের বুড়ো আঙুলের নখে। সঙ্গে চলছিল নোংরা গালিগালাজ।
অর্চনা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন এবং প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর অর্চনার লাঠি দড়ির বাঁধন খোলা হয় এবং চ্যাংদোলা করে ওই চেম্বারেরই একটা খাটে শোয়ানো হয়। কিছু পুলিশ কর্মী অর্চনার হাত মা ম্যাসাজ করে। যন্ত্রণায় অর্চনার চোয়ালও কাঁপছিল। সেখানেও ম্যাসাজ করে পুলিশ। তাঁর মুখে জলের ছিটে দেওয়া হয়।
কিছুক্ষণ পরে অর্চনাকে পুলিশ অফিসারেরা টানতে টানতে অফিস ঘরে নিয়ে যায়। তখন বেলা ২টো থেকে ৩টের মধ্যে। সে ঘরে তখন গৌরী চ্যাটার্জি ও লতিকা গুহ চেয়ারে বসে। এরপর তিনজনকেই একতলায় সেন্ট্রাল লক আপের অফিস ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সে ঘরটা উঠোনের উল্টোদিকে। উঠোন পার হবার সময়ে তিনজনেই কার্যত পঙ্গু।
[এই বিবরণ, মামলার নথি থেকে নেওয়া। অর্চনা গুহ, মামলায় যে বয়ান দিয়েছেন, তা থেকে। একবারে গোটা বিবরণটা অনুবাদ করে ফেলা গেল না। ততটা নির্মোহ এখনও হওয়া যায়নি। অত্যাচারের বিবরণ, অপমানের বিবরণ, হত্যার বিবরণ, এসবই অমোঘ ও অবধারিত হিসেবে বারবার অভিজ্ঞতায় এসেছে, তাকে লিপিবদ্ধ করে যেতে হয়েছে। তবু।
এই মামলা সম্পর্কে মিথ্যাচারের অর্থ, এই অত্যাচারের সপক্ষে থাকা যদি না-ও হয়, অন্তত, এই অত্যাচারকে ছোট করে দেখা তো বটেই। ফলে যাঁরা, যেসব শুভানুধ্যায়ীরা, আমাকে প্রথম কিস্তির শিরোনাম পাল্টাতে বলেছেন, ব্যক্তিগত ভাবেও, তাঁদের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। না, আমি ওটা পাল্টাব না। কান গরম করে দেবার আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। হেফাজতে অত্যাচারকে, পুলিশি অত্যাচারকে, যারা ছোট করে দেখায়, তাদের কান। অত্যাচারের সপক্ষে যারা, তাদের কান। প্রাণে মারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে এসেছি, দেখলাম কানে মারার মত রাজনৈতিক হিংসাপরায়ণতা রয়ে গিয়েছে। সে হিংসা পবিত্র কিনা, তা নিয়ে তর্ক করব না। তত বিশ্বাস নেই। শুধু সত্যিটা উচ্চারণ করে রাখলাম।]
পড়ছি। ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুটা আন্দাজ থাকলেও এই সত্যি নেওয়া যায় না। তবু প্রকাশ্যে আসুক, আরও অনেক লোকের কাছে পৌঁছাক রাষ্ট্র শক্তির পৌরুষের কথা।
আমরা পড়ছি। আপনি লিখে যান। এই সব অত্যাচারের বিবরণ আরো বেশী করে প্রকাশ্যে আসা দরকার।
১৯৭৪ এর জুলাই মাস। নকশাল আন্দোলন প্রায় শেষ-ই বলা যায়, নেতা কর্মীরা অনেকেই নিহত বা কারা বন্দী, মুষ্টিমেয় কিছু জন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তখনও এত ভয়াবহ অত্যাচার করতে হচ্ছে রাষ্ট্র-কে
আসলে রাষ্ট্রের অত্যাচারের প্রয়োজন কখনো ই ফুরোয় না, শুধু অত্যাচারিতের মুখ বদলায়। অর্চনা গুহ- র জায়গায় টর্চার চেম্বারে ঢুকতে হয় সোনি সরি-দের
অত্যাচারের বিবরণ পড়তে কষ্ট হয়, কিন্তু এর ডকুমেন্টেশন থাকা উচিত, ভবিষ্যতের জন্য, রাষ্ট্র তো পাল্টায় না, তার কর্মপদ্ধতি-ও বদলায় না।
তাপস, যতটা পার লেখ। খুবই মূল্যবান এই লেখা, এই দলিল
পড়ে যাচ্ছি। এই বিবরণ। ভীষণ কেঁপে উঠেও পড়ে যাচ্ছি। শেষ অবধিই পড়ব
প্রথম লাইনকটা সম্পর্কে তাপসকে বলে দেই, এই স্টাইল, মানে কমেন্টারি ও তথ্য , এগুলোর আপাত পারম্পর্য্যবিহীন উপস্থাপনা আমার ভালো লেগেছে। জানি আপনি স্টাইল নিয়ে বেশি চিন্তিত নন, তবুও।
পড়ছি।ভয় করছে।তবু চাই সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসুক।
পড়ছি!আর ভেসে উঠছে ১৯ নং ঘর।কত ঘটনা!
চলুক। ইতিহাস তৈরী হোক।