কিছুদিন পরই বাংলা নববর্ষ। আবার এবছর মারাঠি নববর্ষ- গুড়ি পড়ৱাও কাছাকাছিই পড়েছে।
দেখা যাক পয়লা বৈশাখে কোথায় কোথায় নববর্ষ? বাংলা, এবং বাংলার প্রতিবেশী- মায়ানমার, তার প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, তস্য প্রতিবেশী লাওস ও কাম্বোডিয়া, এছাড়াও- শ্রীলঙ্কা, তামিলনাড়ু, কেরালা, পাঞ্জাব, এবং বাঙালির প্রতিবেশীরা- আসাম, উড়িষ্যা, নেপাল, মিথিলাঞ্চল – এদের সবার নববর্ষ পয়লা বৈশাখ বা তার একদিন আগে- চৈত্র সংক্রান্তির দিন।
নিচের ইনফোগ্ৰাফিকটি একঝলক দেখে নিন, তারপর আমরা আরো বিশদ আলোচনায় যাব।
লক্ষণীয় হল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলোতে পয়লা বৈশাখে নববর্ষ- মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা- এরা সবাই থেরবাদী বৌদ্ধ প্রধান দেশ। থেরবাদী বৌদ্ধ প্রধান দেশের সবকটিতেই পয়লা বৈশাখে নববর্ষ। এর সাথে বৈশাখী পূর্ণিমা- অর্থাৎ বুদ্ধের জন্ম ও নির্বাণের দিনের সাথে কোনো যোগ আছে কিনা জানা নেই। তিব্বত, মোঙ্গোলিয়া বা ভূটান- যেখানে বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম প্রধান- সেখানে পয়লা বৈশাখে নববর্ষ নয়। মহাযানীরা যেসব দেশে বড় সংখ্যায় আছে- চীন, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম সেসব দেশেও নয়।
বুদ্ধের জন্ম ও নির্বাণের দিনের সাথে যোগ থাকতে পারে, না ও পারে, বরং একটি ব্রাহ্মণ্য যোগ আছে। বরাহমিহির রচিত সূর্য সিদ্ধান্ত। এটি মায়ানমার, থাইল্যান্ড এইসব দেশের ক্যালেন্ডারের ভিত্তি। বাংলার ক্যালেন্ডারেরও। অশোকের সময় বৌদ্ধ ধর্মের মাধ্যমে এবং পরবর্তীকালে বাণিজ্যযাত্রীদের আর পল্লব রাজাদের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় হয়। স্থানীয় হিন্দুরাজ্যও ওদিকে গড়ে ওঠে- যেমন ফুনান এবং শ্রীবিজয় রাজ্য।
মায়ানমারের প্যু নগর-রাজ্যগুলিতে প্রথম শতকে শক ক্যালেন্ডারের ব্যবহার শুরু হয়। তবে তার আগে প্যু নগর-রাজ্যগুলিতে একটা বৌদ্ধ বর্ষপঞ্জী ব্যবহার হত বলে শোনা যায়, যার প্রবর্তক বলা হত বুদ্ধের মাতামহ অঞ্জনকে। অঞ্জন কোনো ঐতিহাসিক মানুষ কিনা জানা নেই। সপ্তম শতকে শ্রীক্ষেত্র সাম্রাজ্য প্রথম বার্মিজ ক্যালেন্ডারের প্রচলন করে- সেটিও ভারতীয় ক্যালেন্ডারের প্রভাবে। “থুরিয় থিদ্দান্ত” (সংস্কৃত জ্যোতিষগ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্তর বর্মী অনুবাদ) ছিল এই ক্যালেন্ডারের ভিত্তি। একাদশ শতকে পাগান বা বাগান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো মায়ানমারে এই ক্যালেন্ডার প্রসারিত হয়। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে তৈরী হলেও মূলতঃ বৌদ্ধদের মাধ্যমে এই ক্যালেন্ডারের প্রসার মায়ানমারে হয়। তবে বাগান সাম্রাজ্য ব্রাহ্মণদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করত যার উদাহরণ হল বাগানের একাদশ শতকের বিষ্ণু মন্দির।
আমরা বলি সংক্রান্তি; লাওস ও থাইল্যান্ডে বলে সংক্রান। থাইল্যান্ডের রাজারা হিন্দু ব্রাহ্মণ জ্যোতিষীদের রাখতেন পঞ্জিকা সংক্রান্ত গণনার জন্য। তার ফলে থাইল্যান্ডের থেরবাদী বৌদ্ধ রাজাদের নাম হত রাম আর রাজধানী ছিল অযোধ্যা (অপভ্রংশে “অয়ুত্থয়া”)। এই জ্যোতিষীদের ভূমিকা থাকতে পারে সূর্যসিদ্ধান্তকে থাইল্যান্ডে জনপ্রিয় করার পিছনে। এই ব্রাহ্মণরা চতুর্দশ শতক থেকে থাইল্যান্ডে আছে। সংখ্যায় কম, এখন ধর্মে বৌদ্ধ, তবে এখনও রাজকীয় অনুষ্ঠানে এরা পৌরোহিত্য করে। থাই সিনেমা বা সিরিয়ালের মহরতেও এরা পৌরোহিত্য করে। থাই ব্রাহ্মণ দুরকম হয়- ব্রাহ্ম লুয়াং (রাজকীয় ব্রাহ্মণ), ব্রাহ্ম চাও বান (লৌকিক ব্রাহ্মণ)। প্রথম দলটি রাজকীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত এবং এদের মূল সম্ভবত তামিলনাড়ুতে।
দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু, কেরালাতেও পয়লা বৈশাখ নববর্ষ। কিন্তু দক্ষিণ ভারতেই অন্ধ্র-তেলঙ্গনা-কর্ণাটকে এবং মহারাষ্ট্রে, সিন্ধীদের মধ্যে, ও কাশ্মীরে গুড়ি পড়ৱার দিন নববর্ষ হয়- মার্চের শেষদিকে বা এপ্রিলের শুরুতে। অন্ধ্র-তেলঙ্গনা-কর্ণাটকে এই একই উৎসবের নাম উগাদি বা যুগাদি, কাশ্মীরে নওরুজ আর সিন্ধীদের মধ্যে চেতিচাঁদ। এটা কিন্তু চান্দ্রসৌর বা লুনিসোলার নববর্ষ। অন্য হিন্দু উৎসবের মত এদের নববর্ষের তারিখ গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তনশীল। ৩৫৪-৩৫৪-৩৮৪ দিনের সাইকেল হয়। মণিপুর এবং ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপেও একই দিনে নববর্ষ। এছাড়া বেশীরভাগ হিন্দীভাষী রাজ্যেও এদিন নববর্ষ, তবে এটি গৌণ উৎসব, বরং এই দিনকে চৈত্র নবরাত্রের প্রথমদিন হিসাবে তারা উদযাপন করে।
অর্থাৎ হিন্দুদের নববর্ষ কোথাও চান্দ্রসৌর সম্বৎ অনুযায়ী, কোথাও সৌর সম্বৎ অনুসারে। এবার আমি চার রকমের বছরের কথা বলব-
১) প্রকৃত সৌরবর্ষ (tropical year)- যেটির দৈর্ঘ ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৯ মিনিট (এটি সঠিক সৌরবর্ষ- সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর একপাক ঘোরার সময়, বা একই সূর্যোদয়ের স্থানে সূর্যের ফিরে আসার সময়। উদাহরণ- গ্রেগরিয়ান বর্ষ)
২) নাক্ষত্র-সৌরবর্ষ (sidereal year)- যেটির দৈর্ঘ ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট (এটি সূর্যের মেষরাশি থেকে মেষরাশিতে ফিরে আসার সময়- উদাহরণ- পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ক্যালেন্ডার। এই কুড়ি মিনিটের পার্থক্য হয় পৃথিবীর তৃতীয় গতি বা অয়নচলনের (precission) জন্য। হিন্দু জ্যোতিষে সৌরবর্ষ বলতে নাক্ষত্র-সৌরবর্ষই বোঝায়। যদিও ঐ কুড়ি মিনিটের পার্থক্যটা হিন্দু জ্যোতিষে অজানা ছিল না।)
৩) চান্দ্রবর্ষ (lunar year)- ১২টি চান্দ্রমাস মিলে যে বছর। এর দৈর্ঘ মোটামুটি ৩৫৪ দিন। সৌরমাস ৩০-৩১ দিনের হয়- এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে সূর্যের যাত্রাকাল। চান্দ্রমাস হল এক অমাবস্যা থেকে অন্য অমাবস্যায় পৌছোনোর সময়- ২৯ দিন মত দৈর্ঘ্য। চান্দ্রবর্ষর উদাহরণ হিজরি সম্বৎ।
৪) চান্দ্রসৌরবর্ষ (lunisolar year)- কখনও ১২টি চান্দ্রমাস মিলে, কখনও বা ১৩টি চান্দ্রমাস মিলে এই বছর। ১৩ নম্বর মাসটিকে মলমাস বলে। চান্দ্রসৌরবর্ষর দৈর্ঘ্য ৩৫৪ বা ৩৮৪ দিন হয়। হিন্দু উৎসবগুলি এই সম্বত অনুযায়ী হয়। এইজন্য দুর্গাপুজো পরপর দুবছর ১১ দিন করে এগিয়ে আবার মাসখানেক পিছিয়ে আসে। মারাঠি নববর্ষ গুড়িপড়ৱা এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হয়, তাই দুর্গাপুজোর মত তারিখ বদলায়। ইহুদী ক্যালেন্ডারও চান্দ্রসৌরবর্ষ।
নাক্ষত্র-সৌরবর্ষ আর প্রকৃত সৌরবর্ষর যে ২০ মিনিটের ফারাক, সেটা ৭২ বছরে ১ দিনের পার্থক্যে পরিণত হয়। অর্থাৎ বাঙালির পয়লা বৈশাখ বা থাইল্যান্ডের সংক্রান ১৬০০ সালে হত ৯ই এপ্রিল নাগাদ। তৃতীয় শতকে এটি হত বসন্তবিষুবের সময়- ২১ মার্চ নাগাদ- যেদিন দিন-রাতের দৈর্ঘ সমান হয়। মোটামুটি ওরকম সময়েই গ্রীস ও রোমের জ্যোতিষশাস্ত্রের অনুসরণে ভারতে জ্যোতিষশাস্ত্র লেখার শুরু হয়- পৌলিষসিদ্ধান্ত ও রোমকসিদ্ধান্ত। প্রথম বইটি গ্রীক ও দ্বিতীয়টি রোমান (আসলে বাইজান্টাইন) জ্যোতিষ নিয়ে লেখা। এবং ভারতে নিজস্ব জ্যোতিষশাস্ত্রের রচনাও তৃতীয় শতকের আশেপাশে শুরু হয়েছিল। মোটামুটি ২০০০ বছর পর আমরা ১৫ই মে নাগাদ পয়লা বৈশাখ করব।
পয়লা বৈশাখ একসময়ে বসন্তবিষুবের দিনে বা আশেপাশে হত। তাই কেরলে পয়লা বৈশাখকে বলা হয় বিষু। কৃষির সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই একটা গভীর যোগাযোগ পয়লা বৈশাখের ছিল। গুড়ি পড়ৱাও কৃষির সাথে গভীরভাবে যুক্ত এবং সময়টা বসন্তবিষুবের আশেপাশেই। তবে কেন কিছু ভারতীয় জাতি সৌর নববর্ষ বেছে নিল আর কিছু জাতি চান্দ্রসৌর নববর্ষ সেটা জানা নেই।
মজার ব্যাপার তামিল ও বাঙালিরা একই দিনে নববর্ষ করলেও পয়লা বৈশাখের দিন ওদের পয়লা চৈত্র। তবে থাই এবং কম্বোডীয় ক্যালেন্ডারে এই দিন বিসাখ বা পিসাক মাসেরই শুরু হয়।
সবশেষে একনজরে দেখে নিই কাদের কবে নববর্ষ-
১) পয়লা বৈশাখ (সৌরবর্ষ)- বাংলা, আসাম, ওড়িশা, মিথিলাঞ্চল, নেপাল, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটকের তুলু জাতি, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা।
২) গুড়ি পড়ৱা (চান্দ্রসৌরবর্ষ): মহারাষ্ট্র, কোংকণ, সিন্ধ, অন্ধ্র-তেলঙ্গনা, কর্ণাটক, কাশ্মীর, মণিপুর, বালি। এছাড়া অধিকাংশ হিন্দীভাষী রাজ্যে এটি গৌণ উৎসব।
অন্য কয়েকটি ছোট আকারের নববর্ষ হল-
৩) দীপাবলী (চান্দ্রসৌরবর্ষ): গুজরাত।
৪) গুরু নানক জয়ন্তী অর্থাৎ রাসপূর্ণিমা (চান্দ্রসৌরবর্ষ): শিখদের একাংশ।
৫) মকরসংক্রান্তির পরদিন- ১লা মাঘ (সৌরবর্ষ): বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের কুড়ুমি জাতি এবং তামিলদের একাংশ।
[মিথিলাঞ্চল বলতে মৈথিলীভাষী মানুষকে বোঝাচ্ছি আর বিহার, ঝাড়খণ্ড, নেপালের মৈথিলীভাষী অঞ্চলকে বোঝাচ্ছি।
যারা সৌরবর্ষ অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ করে তাদের মধ্যে অনেক সময় একদিনের এদিক ওদিক হয়- যেমন ওড়িশায়, তামিলনাড়ুতে সংক্রান্তির দিন নববর্ষ হয় কিন্তু পশ্চিমবাংলায় একদিন পরে। তবে এগুলো একই উৎসব- মেষ সংক্রান্তিকে ঘিরে- সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। তাছাড়া বাংলাদেশ চান্দ্রসৌরবর্ষ থেকে সরে এসে নয়ের দশক থেকে প্রকৃত সৌরবর্ষ ব্যবহার করা শুরু করেছে তাই বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গের একদিন আগে, এবং ভবিষ্যতে এই পার্থক্য প্রতি ৭২ বছরে একদিন করে বাড়বে।]
পয়লা বৈশাখ এমন একটা দিন যেদিন একজন থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ, পাঞ্জাবের শিখ, বাংলাদেশের মুসলিম, তামিলনাড়ুর হিন্দু- অনেকেই নূতন বছরের আহ্বান জানাচ্ছেন। সবাইকে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখাটা শেষ করছি।
(ইনফোগ্রাফিক লেখকের নিজের তৈরী ও স্বত্ব সংরক্ষিত)
সুদীপ্ত-দা, এটা ফেবুতে তোমার টাইমলাইনে পড়লাম, খুব খুব ভালো / ইনফরমেটিভ লেখা। কখনো ইঙ্গানুবাদ করলে জানিও - আমার তামিল বন্ধুদের ম্যাপটা দেখিয়েছি সেদিন, তারা বেজায় মজা পেয়েছে।
বা:। লেখক ভারতের সরকারী ক্যালেন্ডার শকাব্দ সম্পর্কেও একটু বলুন .
খুব ভালো লাগলো।তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।অনেক জানলাম,আগে অল্পকিছু জানতাম।