অনুলেখকের ভূমিকা:
গত ২৬ ডিসেম্বর, রাইট টু এডুকেশন সংস্থা এবং জয়েন্ট প্লাটফর্ম ফর আকাডেমিশিয়ানস, এই সংস্থা দুটির উদ্যোগে একটি অনলাইন আলোচনাচক্র আয়োজন করা হয়েছিল। গুরুচণ্ডা৯-তে তার আমন্ত্রণপত্র আমি আর পাঁচটা সামাজিক মাধ্যমের মতই শেয়ারও করেছিলাম।
প্রারম্ভিক বক্তব্য দিয়ে সূচনা করেছিলেন অধ্যাপিকা ঈশিতা মুখোপাধ্যায়। সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক রতন খাসনবিশ। এছাড়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সারা ভারত কৃষক সভার সহ সভাপতি বিজু কৃষ্ণান, এই বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজের জন্য বিখ্যাত দীনেশ আব্রল, গ্রামীণ ও কৃষি বিষয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক পি সাইনাথ।
কৃষি, খাদ্য উৎপাদক অন্নদাতা কৃষক পরিবারগুলির অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থানের উপরে নীতির আক্রমণ আমাদের দেশে নতুন না। আক্রমণ যখনই হয়েছে, প্রতিবাদও হয়েছে। কখনো সরকার পিছু হটেছে, কখনো টানা পোড়েন রয়ে গেছে। সাইনাথ স্বয়ং একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আত্মহত্যার বদলে ব্যাপক অংশের কৃষক প্রতিবাদকে বেছে নিচ্ছেন, এটা কিছুটা স্বস্তির। নব্বই এর দশকের শুরু থেকেই, নীতি প্রণেতাদের দৃষ্টিতে কৃষকদের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল করার চেষ্টা হয়েছে, ধরে নেওয়া হয়েছে, আপাতত দেশের শস্য রফতানির ক্ষমতা, শক্তিশালী খাদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রমাণ, অন্যদিকে একই সময় জুড়ে রেশন ব্যবস্থার গণভিত্তি কমানোর দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টাও রয়েছে। অতএব আজকের কৃষক আন্দোলন নতুন না। এই বিষয় গুলি বিভিন্ন বক্তাদের কথাতেই ফিরে ফিরে এসেছে। সাধারণ কৃষি সংকটের ভয়াবহতার মধ্যে এই নতুন নীতি, সাধারণ কৃষক পরিবারের জীবনের দিক থেকে দেখলে, একটি নতুন ধারার সার্বিক আক্রমণ, তবে এতে বিস্ময়ের অবকাশ কম। তাই সার্বিক প্রতিরোধ, সব রকম মূল্য দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি ও স্বাভাবিক। অযাচিত আইন প্রণয়নের পূর্বে অনালোচিত, কর্পোরেট স্বার্থগন্ধবাহী আইনি সংস্কার নিয়ে এই প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক।
এই আলোচনা কৃষির সঙ্গে জড়িত নন এমন মানুষকেও ভাবাতে বাধ্য করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
অনুবাদক-অনুলেখক এর উদ্যোগে প্রাপ্ত,অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তাদের অনুমতিক্রমে,কিছুটা সংক্ষেপিত অনুলিখন প্রকাশ করা হল। পাদটীকাতে, কিছু ওয়েব লিংক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি লিংকই এই লেখা তৈরির সময় অর্থাৎ অন্তত ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ পর্যন্ত পড়া যাচ্ছিল, এবং আলোচনার চিহ্নিত অংশটির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ছিল।
শুভোদয় দাশগুপ্ত এবং নন্দিনী মুখোপাধ্যায়দের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছাড়া এই অনুলিখন, তার অনুমোদন সংগ্রহ অসম্ভব হত। ঈশিতা মুখোপাধ্যায়কে অনেকবার বিরক্ত করেছি, ছোটো ছোটো প্রশ্ন নিয়ে। এঁদের তিনজনকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
অধ্যাপিকা ঈশিতা মুখোপাধ্যায়- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগ, রাইট টু এডুকেশন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
অধ্যাপক রতন খাসনবিশ- অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ।
পি সাইনাথ- কৃষি ও গ্রামীণ জীবন বিষয়ে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক, অধুনা রুরাল আর্কাইভস-এর উদ্যোক্তা।
দীনেশ অ্যাব্রোল- ভারতীয় কৃষি, কৃষি ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক সম্পদ সংক্রান্ত আইন ইত্যাদি বিষয়ের সরকারি নীতি বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন, বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে নানা সময়ে কাজ করেছেন। আক্রান্ত কৃষকের প্রতি সহমর্মী মানুষদের সংগঠন, নেশন ফর ফার্মার্স এর সঙ্গে যুক্ত।
বিজু কৃষ্ণান, ভারতীয় কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণা শেষে সারা ভারত কৃষক সভার সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন, কর্নাটকে, মহারাষ্ট্রে বড় কৃষক সংহতি সংগঠিত করার জন্য, বিশেষত ২০১৮-তে মহারাষ্ট্রে কৃষকদের বিখ্যাত 'লং মার্চ' অনুষ্ঠিত হবার পরে, বিজু কৃষ্ণানের সাংগঠনিক অবদানের কথা সর্ব ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে।
প্রথম পর্বে ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, রতন খাসনবিশদের প্রারম্ভিক বক্তব্য এবং বিজু কৃষ্ণান এবং দীনেশ অ্যাব্রোল এর বক্তব্যের অনুলিখন প্রকাশ করা হল।
অধ্যাপিকা ঈশিতা মুখোপাধ্যায় এর প্রারম্ভিক বক্তব্য:
শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, শ্রম আইনের বিরুদ্ধে লড়াই, এবং এই নতুন কৃষি আইন গুলির বিরুদ্ধে লড়াইকে আমরা আলাদা ভাবে দেখি না, এগুলির মধ্যে সংযুক্তি রয়েছে। বড় বড় কর্পোরেট গুলি যে ভাবে সব কিছুকেই, সাধারণ মানুষের হাতে যা আছে সব কিছুকেই কুক্ষীগত করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধেই এই ব্যপাক লড়াই চলছে। এই বিষয়টি কেই মাথায় রেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আজ আমরা দীনেশ আব্রোল, রতন খাসনবিশ, বিজু কৃষ্ণান এবং পি সাইনাথ কে আমাদের মাঝে পেয়েছি। দীনেশ নেশন ফর ফার্মার্স এর মাধ্যমে আপনি এই লড়াইয়ে দীর্ঘদিন রয়েছেন। সাইনাথ, আপনি দীর্ঘ সময় ধরে কৃষি ও কৃষকের সংকটের বিষয়ে আমাদের সচেতন করছেন, তথ্য দিয়ে যুক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করছেন, আপনার কাছে আমরা ক্রমাগত শিখছি। আমি আপনাদের প্রত্যেককে জানাতে চাই আমরা আপনাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে আছি। আমাদের ক্যাম্পাসগুলি বন্ধ আছে, কিন্তু আমরা আমাদের চিন্তা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করিনি। আন্দোলনও বন্ধ হয় নি। এই অনলাইন সভায় সভাপতিত্ত্ব করার জন্য অধ্যাপক রতন খাসনবিশকে, আমাদের বহুদিনের সাথী রতনদাকে আহ্বান করছি।
অধ্যাপক রতন খাসনবিশ এর প্রারম্ভিক বক্তব্য:
ধন্যবাদ, আমাকে এই আপনাদের আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য। হ্যাঁ আমি আপনাদের সংগ্রামে আপনাদের সঙ্গে আছি । প্রথমে জানা কথাটা আরেকবার বলি, উন্নত দেশ গুলিতে, জাপানে, আমেরিকায়, ইউরোপে, ব্রিটেনে, প্রচুর ভর্তুকি দেওয়া হয় এবং হবে, এবং আমাদের দেশের সরকারের নীতি হল সমস্ত রকমের ভরতুকির থেকে পিছিয়ে আসা। এবং এটাই চলছে। আমাদের আলোচকরা আলোচনা করবেন এই বিষয়গুলিতে। প্রথমে বিজু কৃষ্ণান, তার পরে দীনেশ অ্যাব্রোল, তার পরে সাইনাথ তাঁদের বক্তব্য রাখবেন।
বিজু কৃষ্ণানের বক্তব্য:
সভাপতি রতনবাবুকে নমস্কার এবং আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই। কৃষক বিরোধী আইন গুলোর বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন নিয়ে আলোচনা জরুরি। কেন আন্দোলন গুলি শুরু হল একটু প্রথমে আলোচন করে নিই। তারপরে তার বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার গতিপ্রকৃতি আলোচনা করব।
আজ যে আন্দোলন দেখছেন, এর আগেও ছ মাস ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন হয়েছে। কারণ ভ্রান্ত অনিষ্টসাধনের নীতির আক্রমণ চলছে নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই চলছে, একেক সময়ে একেক রূপ নিয়ে। সাম্প্রতিকতম বিষয়গুলির কথা আজ বলব।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়ে, বিজেপি চমকপ্রদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল [1], তারা বুঝতে পেরেছিল কৃষকের অবস্থা ভালো না, বাজারমূল্য আকাশছোঁয়া, তারা প্রচারের ঝড় তুলেছিল, কর্পোরেটের টাকায়, সেই প্রতিশ্রুতি অধিকাংশই মিথ্যা এমনকি বেপরোয়া দায়িত্ত্বজ্ঞানহীন ভাঁওতা বলে প্রমাণিত হয়েছে। কী বলা হয়েছিল? বলা হয়েছিল, কৃষকের রোজগার বাড়বে, বলা হয়েছিল, খরচের অন্তত দেড় গুণ ফসলের দাম পাবে কৃষক। এমনকি ভর্তুকি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল, বলা হয়েছিল বীজ, সার উৎপাদক দের জন্য শস্তা করা হবে, ঋণ দেওয়া হবে সহজ শর্তে, অপেক্ষাকৃত অল্প সুদের হারে। ছিল প্রতিটি খেতে সেচের ব্যবস্থার, আর বিপদ হলে ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে বিমার প্রতিশ্রুতি। সত্যি কথা বলতে কি, জমির অধিকারের দিকটি ছাড়া সমস্ত কৃষক সংগঠনের দাবিদাওয়া একত্রে এনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল [2]।
নির্বাচনের ফল ঘোষণা এবং নতুন মন্ত্রীদের শপথগ্রহণের অনতিকাল পরে কৃষক সংগঠনগুলির অনেকে কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। মন্ত্রী বলেন নির্বাচনের ব্যাপারে কোন আশাই না রাখতে, তাঁদের সোজা কথা ছিল, এই প্রতিশ্রুতি রাখার জন্য দেওয়া হয় নি, ভোট পাওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে বিজেপির তদানীন্তন সভাপতি আবার পরিষ্কার করেই বলেন, নির্বাচনের প্রচারে বলা কথা, তো ভোট নেবার জন্য বলা। শুধু তাই না, সরকার সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে ঘোষণাপত্রে স্বীকার করে যে এই সব প্রতিশ্রুতি মানা সম্ভব না [3]। সুতরাং নির্লজ্জ কথার খেলাপ প্রথম মোদী সরকারের আমলের প্রারম্ভেই শুরু হয়ে গেছিল। ২০১৪-র ডিসেম্বরে সরকার জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত অর্ডিনান্সটি নিয়ে আসে [4]। সেই অর্ডিনান্সের উদ্দেশ্যই ছিল, কর্পোরেটের হাতে বড় বড় জমি তুলে দেওয়া। এর বিরুদ্ধে কৃষির সঙ্গে জড়িত নানা ধরণের সংগঠন, বিভিন্ন বাম সংগঠন, আদিবাসী সংগঠনগুলি, এক জায়্গায় এসে জমি ও জঙ্গল রক্ষার বিষয়ে ভূমি অধিকার আন্দোলনের মঞ্চটি গড়ে তোলেন। এই আন্দোলন এতটাই জোরদার হয়ে ওঠে, এই অর্ডিনান্স প্রত্যাহার করতে হয়, এবং তিন তিনবার আইনে পরিণত করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এছাড়া স্বাধীন ভাবে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন নিজেদের মত আন্দোলন চালাচ্ছিল। যেমন ধরুন ন্যায্যমূল্য এবং ঋণের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেছিল, সারা ভারত কৃষক সভা। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার, হিমাচল প্রদেশে এই আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আপনাদের হয়তো মহারাষ্ট্রের কিসান লং মার্চের কথা মনে আছে। নাসিক থেকে ১৮৬ কিলোমিটার হেঁটে শ্রমিকরা পৌছন মুম্বাই শহরে [5]। তৎকালীন বিজেপি সরকারকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল, যে তার বিষয়গুলি পর্যালোচনা করবে।
এর পরে সেই ভয়ংকর দিন আসে, ২০১৬ নভেম্বর নোটবন্দি ঘোষণা করা হয়। সারা দেশের লোক তো বিপদে পড়লেনই, যাঁরা নগদে কাজ করেন, সেই সব গ্রামীণ শ্রমিক, কৃষকরা ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা সাংঘাতিক বিপদে পড়েন। দ্রুত পচনশীল ফসল (ফুল, ফল, তরকারি ) যাঁরা বুনেছিলেন, তাঁরা বিরাট বিপদে পড়ে যান। মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানের আন্দোলনে সম্ভবত খানিকটা উদ্বুদ্ধ হয়ে মধ্য প্রদেশে আন্দোলন শুরু করেন কৃষকরা। মূলতঃ ফসলের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে। ২০১৭-র জুনে শিবরাজ চৌহান সরকারের পুলিশ কৃষকের উপরে গুলি চালায় [6]। ৬ জন কৃষক নিহত হন, মনে রাখবেন, আন্দোলনকারী কৃষকের কেউই বাম আন্দোলন কেন, অন্য কোন বিজেপি বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না, তাঁরা বিজেপি বা সংঘ পরিবারের অন্য সংগঠন গুলিতেই মূলত আস্থা রাখতেন। তাঁদের মূল দাবি ছিল রসুনের ন্যায্য মূল সংক্রান্ত। চাষিদের বক্তব্য ছিল, কিলো প্রতি ৩৪-৩৫ টাকা খরচ হয় রসুনে, রাজ্য সরকারের দাবি ছিল, না ওটার খরচ ২৭ টাকা। ওদিকে উৎপাদকরা খোলা বাজারের ব্যাবসায়ীদের কাছে ১ টাকা / ২ টাকার বেশি মূল্য পাচ্ছিলেন না। একই সময়ে বাজারে খুচরো ক্রেতারা কিন্তু রসুন ১৪০ টাকা কেজির নিচে রসুন পাচ্ছিলেন না। কর্নাটকের অড়হর ডাল চাষি দের ও একই অবস্থা ছিল। তাঁরা পাচ্ছিলেন কেজিতে ৩৫-৪০ টাকা, বাজারে ডাল বিক্রি হচ্ছিল ২০০ টাকার কাছাকাছি দরে। বড় বড় সংস্থা এই কাণ্ডটা করছিল, আদানি, আইটিসি, রিলায়েন্স সকলে। মন্দসৌরের গুলি চালনার ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই, কৃষকরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, এবং সারা দেশের প্রায় আড়াইশো বা তার বেশি কৃষক সংগঠন, সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি তৈরি করেন।
এরকম সময়ে পার্লামেন্টে দুটি প্রাইভেট মেম্বার বিল আনা হয় [7], একটা হল ন্যায্য মূল্যের দাবি তে, আরেকটি ঋণের জাল থেকে কৃষক কে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে। কিন্তু সরকারের কর্ণপাত করার সময় ছিলনা, আর মজাটা হল, ২০১৯-এ সংঘ পরি বারের অভীষ্ট জাতীয়তাবাদ এর জিগিরকে কাজে লাগিয় নির্বাচনে লড়াই করে বিজেপি। মানুষকে তাঁরা ২০১৪-র প্রতিশ্রুতি ভুলিয়ে দিতে সফল হন। সারা ভারত কৃষক সভা সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, কৃষি বিমা ব্যাপারটি যে সম্পূর্ণ চোখে ধূলো দেওয়ার কল সেটা ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে, বহু বিমা কোম্পানিকে প্রচুর টাকা দেওয়া হয়েছে, কত টাকা কোথায় কোন বিপর্যয়ে কোন চাষিরা পেয়েছেন, তার কোন হিসেবের ঠিক নেই। মজার গল্পটা শুনে নিন, প্রথানমন্ত্রীর প্রিয় গুজরাট রাজ্য পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা থেকে নাম তুলে নিয়েছে [8]। এম এস পি নিয়ে আর কী বলব, বেশির ভাগ জায়গাতেই বেশির ভাগ চাষি এই সুবিধে নিতে পারেন না, আর তালিকায় যে সব ফসলের নাম থাকে, মাঝে মাঝেই সব কটির সরকারি ক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয় না। অপুষ্টির বিপজ্জনক বৃদ্ধি ঘটেছে কোথাও কোথাও, সরকারের সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। একশো দিনের কাজের প্রকল্পটির ক্রমাগত ক্ষতি করার চেষ্টা হয়, কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার গুলির পক্ষ থেকে। এই পরিস্থিতিতে দু তিনটি কাজেই সরকার কে মনোযোগ দিতে দেখা গেছে, বিলগ্নিকরণ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি এবং অবশ্যই নির্বাচনগুলির পরে, বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থন ক্রয়।
২০২০ মার্চ এপ্রিলে গম, আলু, ভুট্টা, কপি, বিভিন্ন ডাল খেত থেকে তোলার সময়, তখন মহামারীজনিত লক ডাউন শুরু হল, সরকার চক্ষুলজ্জাহীন হলেও, দেশবাসীর মাথা হেঁট হয়ে গেছিল, হাজার হাজার কর্মহীন, বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল শ্রমিককে দেশের রাস্তায় বেরিয়ে আসতে দেখে। সমস্ত ফসলে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হন কৃষকেরা, কৃষি শ্রমিকদের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন কৃষক সংগঠন দাবি তোলে প্রতি দরিদ্র কৃষক ও কৃষি শ্রমিক পরিবারকে অন্তত মাসিক ১০০০০ টাকা আপৎকালীন সাহায্য করা হোক, ২০০ দিনের কর্ম দিবস নিশ্চিত করা হোক, খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক, অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষায় নজর দেওয়া হোক। খাদ্য সুরক্ষার ব্যাপারে, রাজ্য সরকার গুলি সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করেন, কেরালায় যেমন ২০টি অত্যাবশকীয় দ্রব্য সহ ফুড কিট বিলি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার চাষিদের ঋণ মকুব করেন নি, তবে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা কর্পোরেট ঋণ মকুব করা হয়েছে কাছাকাছি সময়ে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা এই আইনকটি উপহার হিসেবে পেলেন, কোথাও কোনোদিন কোনো কৃষক সংগঠন এই দাবি তোলেননি। বিল আনার আগেকার আলোচনার যে সব দাবি সরকার পক্ষে করা হচ্ছে, তার কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সত্যিই কী আলোচনা হয়েছে, তা বলা কঠিন। আইনগুলির নাম আকর্ষণীয় ভাবে দেওয়া হয়েছে। সরকারের রসবোধ আছে বলতে হবে, তবে সময়্জ্ঞানের কোন প্রমাণ নেই।
প্রথম আইনটি আসলে মাণ্ডির মৃত্যুঘন্টা বাজানোর এবং পুরো বাজারটাই কর্পোরেট পুঁজির লাভ করার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়ার কাজ করবে। অত্যাবশ্যক পণ্য আইনে যা পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে মজুত এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, কর্পোরেটের হাতে। তৃতীয় আইনটি চুক্তি চাষে কর্পোরেটের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য, সরকারি প্রভাব মুক্ত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কাছে কৃষকের ন্যায়বিচার চাইবার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, এই যে ব্যাপক প্রতিবাদ হচ্ছে, সেটা ঠিক বিনা কারণে হয়নি। কৃষকরা ক্ষুব্ধ। আইনগুলি যখন প্রথম অর্ডিনান্স হিসেবে আনা হয়েছিল, সারা দেশে প্রায় ৩৬০০ টি জায়্গায় তার কপি পোড়ানো হয়েছিল। বিল পাশ করতে সুবিধে হবে বলে, ৮ জন লোক সভা সদস্য কে বরখাস্ত করা হয়। তার মধ্যে সারা ভারত কৃষক সভার সহ সম্পাদক রাগেশ এবং সি আই টি ইউ-এর সম্পাদক করিম রয়েছেন [9]। ২০১৪ থেকে আজ অব্দি সমস্ত ঘটনা গুলির পর্যালোচনা করলে মনে হবে, সরকারি নীতি প্রণয়নের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি কর্পোরেট দের কব্জায়। অর্থাৎ এই আইনগুলি ধারাবাহিক একটা জনবিরোধী চিন্তার ফলাফল, আকস্মিক কিছু না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। শান্তাকুমার এসব প্রস্তাব ই দিয়েছিলেন [10]। এছাড়া বিদ্যুত সংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হচ্ছে। কারণ আর কিছু নয়, কৃষকের জন্য বিদ্যুতের ভর্তুকি তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে, বিদ্যুত বণ্টন ও উৎপাদন পুরোটাই কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার প্রকল্প।
সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করার করার প্রচেষ্টায় কোন খামতি রাখে নি, যথারীতি। বলা হচ্ছে এটা নাকি শুধু পাঞ্জাবের সমস্যা। বলা হচ্ছে, কেরালায় মাণ্ডি নেই, সেখানে বিক্ষোভ হচ্ছে না কেন। আপনারা খবর নিয়ে দেখুন, যে সব জায়গায় বামপন্থীরা দুর্বল, নামে মাত্র রয়েছেন, সেখানেও প্রতিবাদ হচ্ছে। মানুষ নিজের তাগিদেই, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এগিয়ে আসছেন। ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কেরালা, একটা বিরাট অংশে, বাগিচা ফসলের রাজ্য, কফি চা ইত্যাদি উৎপাদন হয়, এছাড়া মসলা, গোলমরিচ, এলাচ, হলুদ এর চাষ যে হয়, কেন্দ্রীয় সংশ্লিষ্ট বোর্ড এই প্রতিটি ফসলের বিপণন নিয়ন্ত্রণ করার কথা। এদের এত দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে যে বোর্ডগুলি বিপন্ন কৃষকের কোন কাজে লাগে না। এই ধরনের যে ফসলগুলি উৎপাদন করা হয়, সেগুলির আমদানির ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ নেই, এটি ই নিও লিবেরাল অর্থনীতি, কংগ্রেস বিজেপি সব কেন্দ্রীয় সরকারই এর পক্ষে সওয়াল করে গেছে নব্বইয়ের দশক থেকে। কেরালার কৃষক রা বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে, ধানে কেরালা অনেক বেশি ন্যুনতম মূল্য দিয়ে থাকে, কেন্দ্রীয় দরের থেকে প্রায় কুইন্টালে ৯০০ টাকা বেশি। কেন্দ্রীয় দর ১৮৬৮ টাকা, কেরালা সরকার দেয় ২৭৪০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য রাজ্য সরকারের তরফে হেকটর প্রতি ২০০০ টাকা সাহায্যের ব্যবস্থা রয়েছে, আর পঞ্চায়েতের তরফে সাহায্যের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি, ১৬ টি অন্যান্য ফসলে (তরকারি, ফল) ন্যুনতম মূল্য সমর্থন করার ঘোষণা করেছে। এই ব্যবস্থা গোটা দেশে প্রথম। কো-অপারেটিভ ব্যবস্থাকে শক্ত করা হয়েছে, সুবক্ষা প্রকল্পের কর্মসূচির মাধ্যমে এবং ৩৬০০ কোটি টাকা এই সংক্রান্ত কাজে বরাদ্দ করা হয়েছে। কেরালা সরকার এই ভাবেই কৃষিতে ব্যাপক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে।
প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে বিজেপি সরকার গুলির পক্ষ থেকে, তবু নানা ভাবে সংগঠিত হচ্ছেন মানুষ। ঐতিহাসিক আন্দোলন চলছে। কৃষকদের আত্মত্যাগের উদাহরণ দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। এই আন্দোলনে করতে গিয়ে প্রায় চল্লিশ জন কৃষক, শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন [11]। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোন সমবেদনা জানানো হয় নি। কর্পোরেট দখলদারি কায়েম করার চেষ্টা অব্যাহত। প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের উচিত এই সংগ্রামকে সাহায্য করা সমর্থন করা।
দীনেশ আব্রোল-এর বক্তব্য:
বিজু এতক্ষণ বললেন কৃষক আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটির কথা। আমি আর্থিক নীতির প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টিকে উপস্থাপন করতে চাই। অধ্যাপক রতন খাসনবিশ বলছিলেন আর্থিক নীতি সংক্রান্ত এবং বাণিজ্যের দিকটির কথা।
হ্যাঁ কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি নীতিতে পরিবর্তন অবশ্যই এসেছে। মনে হচ্ছে সরকার এম এস পি রাখতেই চাইছে না।
প্রথমে আপনাদের বলি, হিসেবটা যদি দেখেন, রফতানি মোটের উপরে কমা সত্ত্বেও, কৃষিজাত পণ্যের রফতানি কিন্তু বেড়েছে। একটা উদাহরণ দিই। মোদীর আমলে, মোটামুটি ২০১৬-২০১৭ -২০১৮ র মধ্যে, বাসমতী ব্যতীত চালের রফতানি বেড়েছে, প্রায় ৪৮%। অন্য খাদ্য শস্যের রফতানিতেও একই রকম ঝোঁক। তৈলবীজের রফতানি বেড়েছে ৩৩%। এই রফতানিগুলি এফ সি আই এর মজুত শস্য থেকেই হয়েছে। এবং এর ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন) র কৃষি সংক্রান্ত কমিটি তে আমাদের দেশকে সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। আমাদের দেশে ভর্তুকির যুক্তি ছিল আমাদের দেশে কৃষি দিয়ে মানুষ জীবন নির্বাহ করে, অনেক অনেক বেশি মানুষ রয়েছে কৃষিতে। খাদ্য সুরক্ষার বিষয় রয়েছে। এই সরকার হয় দূরদর্শিতার অভাবে, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে, অথবা হয়ত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পন করেই, এই রফতানি করিয়েছে।
গত জুন থেকে তিনটে বৈঠকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রবল আপত্তি করেছে, এই নিয়ে। আমি অনুরোধ করছি, এটাকে সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখবেন না। ২০১৩-য় বালিতে অনুষ্ঠিত আলোচনায়, খাদ্য সুরক্ষার বিষয়ে আমরা যে অধিকার আদায় করেছিলাম, এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে এই ব্যাপারে আমরা সমর্থন পেয়েছিলাম, এই দায়িত্ত্বজ্ঞানহীনতা, কিন্তু তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২০১৪ র সময় থেকেই আমরা জানি, নতুন কেন্দ্রীয় সরকার, রেশন ব্যবস্থার আওতাটিকে বাড়ানোর পক্ষে তো ছিল ই না। উল্টে যে দেশের মানুষের যে অংশ রেশন ব্যবস্থার সুবিধা পান, তাদের নানা বাধা প্রদান করে সেই সংখ্যাটাকে তারা কমানোর পক্ষেই প্রয়োজননীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত ছিল। এবং এই পদক্ষেপ গুলি কে সামগ্রিক ভাবে না দেখার কোন কারণ নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় নিজেদের দেশের অবস্থানকে দুর্বল করা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখা মুশকিল।
অন্য দিকে এই একই সময়ে কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে কৃষি বিষয়ে সরকারি আর্থিক বিনিয়োগ/ সাহায্য অন্যান্য মানুষের আয় সংক্রান্ত সাহায্য বেড়েছে। আমরা 'মুক্ত' অর্থনীতি হওয়ার পদ্ধতিতে মশগুল, ট্রাম্প যখন এদেশে এসেছিলেন, তখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর বিষয়ে পীযুশ গোয়েল এর ঘোষণা / বক্তব্যের কথা আপনাদে নিশ্চয় মনে আছে [12]। অন্যদিকে উন্নত দেশে কিন্তু নীতির গতি ঠিক উল্টো দিকে।
গম, চাল ইত্যাদিতে ভর্তুকির নীতি যেমন সংকটের মুখে, তেমনকি কিন্তু এটাও জানা দরকার, আমাদের পশুপালন, দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদনেও কিন্তু ভর্তুকি আজ সংকটের মুখে। এবং এটা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড-এর আন্তর্জাতিক তৎপরতায় ঘটছে। আসলে এই সমস্যাটা কয়েক বছর ধরেই ঘটছে, রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ (আর সেপ) আলোচনার সময়তেই কিন্তু ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের ফলেই তদানীন্তন সরকার বাধ্য হয় পিছিয়ে আসতে এবং পশুপালন ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদনে ভরতুকি কমানোর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে। দেখুন আক্রমণ অনেক দিক থেকেই এসেছে। ওয়ালমার্ট তো ফ্লিপকার্টকে কিনে নিয়েছে। আমাজন, ওয়ালমার্ট ইত্যাদি কোম্পানিগুলি আমাদের দেশে ব্যবসা বাড়াচ্ছে।
অপেক্ষাকৃত ছোটো ট্রেডাররা ও কিন্তু আপত্তি করছেন। গোটা সাপ্লাই চেনটাই দখলের চেষ্টা চলছে। আদানি এবং রিলায়েন্স রিটেল ও নিজেদের মজুত করার ক্ষমতা ক্রমশ বাড়াচ্ছে। এই আইন গুলি এদের সামগ্রিক স্বার্থটি দেখার জন্য তৈরি। কৃষকদের স্বার্থ কিছুই দেখা হচ্ছে না। ১৭-১৮-১৯-এর মধ্যেও আপনারা জানেন, মনসান্টো এবং বায়ার একত্রিত হয়েছে, ডুপন্ট এবং ডো কেমিকাল একত্রিত হয়েছে, সিনজেন্টা এবং কেমচেয়ানা একত্রিত হয়েছে। ব্যবসায়িক একত্রীকরণের বিষয়গুলো যখন আমাদের দেশের কম্পিটিশন কমিশন এর সামনে এলো, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে ও সংস্থাটিতে উপদেষ্টার কাজ করছিলাম, আমরা বার বার সাবধান করেছিলাম সরকারকে, বলেছিলাম, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপারটির নামে যেন একচেটিয়া ব্যবসার ক্ষমতা বাড়ানোর কাজ না হয়, বলেছিলাম হস্তক্ষেপ করার জন্য, সরকার আমাদের আমল দেন নি। আরেকটা কথাও বুঝতে হবে, অল্পো আগে থেকেই কিন্তু এই কোম্পানিগুলি তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকেও হায়দ্রাবাদ ও গোয়া থেকে সিংগাপুর সহ অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেছে, অর্থাৎ এমন নয় আমরা বাজার উন্মুক্ত করে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কিছু লাভবান হচ্ছি। আমি এই প্রসঙ্গে বিভাগের সচিবের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। তাঁর সরাসরি বক্তব্য ছিল, নতুন কৃষি বড় কোম্পানিরাই নিয়ন্ত্রণ করবেন, আমাদের সেটার বিরোধিতা করার ক্ষমতা নেই।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নীতি প্রণয়ন হচ্ছে। একদিকে বিদেশি, অন্যদিকে এখন নতুন করে দেশি একচেটিয়া পুঁজির সুবিধার জন্য এই সব কৃষি আইন আনা হচ্ছে এতে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে যাতে খাদ্যশস্য রফতানিতে সুবিধে হয়, খাদ্য সুরক্ষার কোন বিষয় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এটা যেমন সত্যি সমস্ত কৃষকের কাছে এপিএমসি মাণ্ডির ব্যবস্থার সুযোগ পৌছয়নি, সবুজ বিপ্লবের আওতায় আসা রাজ্যগুলিতে এই ব্যবস্থার সুবিধা বেশি করে পৌছেছিল। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্রের একাংশ, কর্নাটকের একাংশ এই সুবিধা পেয়েছিল, এই অঞ্চলগুলিতে এপিএমসি কৃষকের রোজগারে একটা নিশ্চয়তা এনেছিল, কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার, গত দশ বছরে কিন্তু এই অঞ্চলগুলিতে সামগ্রিক ফসল উদ্বৃত্ত প্রায়শই নিম্নমুখী, এবং কৃষকের খরচও বেড়েছে। এটা যেমন সত্যি জলস্তর নেমে গেছে পাঞ্জাবে, তেমনই জল তোলার খরচও কিন্তু বেড়েছে। (মনে রাখতে হবে, সারা দেশেই মাটির তলার জলের ব্যবহার কিন্তু বেড়েছে, শুধু সবুজ বিপ্লবের অঞ্চলে বাড়ে নি।) এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, ইলেকট্রিসিটি বিল যেটা আনা হয়েছে, তাতে চাষে ব্যবহৃত বিদ্যুতের খরচ পাঁচগুণের বেশি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু বিদ্যুতের খাতে একটা হিসেব মতে, প্রায় ১০০০০ কোটি টাকার খরচ বাড়বে এই রাজ্যগুলিতে। সরকার বা বড় কোম্পানিগুলি কিন্তু কৃষির খরচ সামলাবে না, এমনকি যাতে জল সার কম লাগে এরকম জাতের বীজের চাষের কথাও বলবে না। সেরকম প্রযুক্তিগত উন্নতিও কিছু হবে না। সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও আনার কথা বলা হবে না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উৎপাদনের দায় শুধু কৃষকের।
তাহলে যুক্তির দিক দিয়ে আমরা এসে পড়ছি, কর্পোরেট ফার্মিংয়ের প্রসঙ্গে। বড় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি চাষ করে কি কৃষক তার ঘর সামলাতে পারবে? আপনার শ্রী সুখপাল সিংয়ের লেখা পড়ে দেখতে পারেন [13]।
প্রথম কথা পরিষ্কার বলা দরকার, ভাগ চাষ, জমি ভাড়া নিয়ে চাষ এগুলোর সঙ্গে বড় কর্পোরেট চুক্তির চাষকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদিত শস্যের ব্যাপারে দরদামের ব্যাপারে কোন গ্যারান্টি কেউ দিচ্ছে না। এবং সবচেয়ে বড় কথা ছোটো বড় নানা ধরনের ব্যবসায়ী যাঁরা কৃষকের সঙ্গে নানা ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রেখে চলেন, তাঁদের কথা কিছুই ভাবা হচ্ছে না, যেন সকলেরই আর্থিক শক্তি সমান। এপিএমসি পাশ কাটানোর জন্য যে আইন আনা হয়েছে, তাতে কিন্তু বড় মজুতদার, ছোটো ব্যাবসায়ীর স্বার্থ দেখার কোন প্রচেষ্টাই করা হয়নি।
কৃষিপণ্যের বাজারটা যাকে বলে প্রাথমিক দ্রব্যের বাজার, মৌলিক খাদ্য শস্যের বাজার। এতে বিভিন্ন গোত্রের উৎপাদক, ব্যাবসায়ী, তার ক্রয় ক্ষমতার তারতম্যের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত ছিল। আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আছে সি এস আই আর থেকে আসা তৈলশস্য এবং ডাল শস্য নিয়ে। কিন্তু আমাদের নিরীক্ষা ব্যাবসায়িক দিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ খাদ্যশস্যের এই বাজারে, মজুতদারের, ফাটকা কারবারের, ফিউচার্স-এর রমরমা, শুধু প্রক্রিয়াকরণে সত্যি, এমনকি নতুন প্রযুক্তি এনেও সত্যি বলতে কোন লাভ নেই। সুতরাং এই যে বলা হচ্ছে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং চুক্তি চাষ এই মুক্ত অর্থনীতিতে কৃষক স্বার্থ রক্ষা করবে, সেটা যথেষ্ট কিনা সন্দেহ রয়েছে। যখন সাইনাথ বলবেন, তখন আমি নিশ্চিত, এই বিষয় গুলিতে বিচারব্যবস্থার, নিজস্ব ক্ষমতা কী ভাবে খর্ব করা হয়েছে সে ব্যাপারে বিশদে যাবেন।
একজন জেলাশাসকের হাতে চুক্তি চাষে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের অভিযোগ মেটানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে, বিচার ব্যবস্থার ক্ষমতার থেকে বড় কোম্পানিগুলিকে রক্ষা করার জন্য। সরকার এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে যে প্রাতিষ্ঠানিক সীমানা রয়েছে, তাকে মুছে দিয়ে কৃষকের চুক্তি লংঘনের অভিযোগ নিয়ে লড়াই করার ক্ষমতা দুর্বল করা হচ্ছে। ভারতীয় কৃষকের সমস্ত ধরণের ক্ষমতায়ন এতদিন যা গড়ে উঠেছিল, তাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টাই চলছে। এই আলোচ্য সবকটি আইনের মূল উদ্দেশ্যই তাই। শেষ করার আগে আমি একটা রাজনৈতিক দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
এপিএমসি ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকার কথা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। বলা হয় এদের ক্ষমতা অতিরিক্ত বেশি, এরাই মূল সুবিধাভোগী। মজাটা হল, এখন পশ্চিম উত্তর প্রদেশে তৈরি হতে শুরু করেছে এফ পি ও (ফারমার প্রডিউসার অরগানাইজেশন), এগুলি কোম্পানি হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে, যাদের নতুন করে ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। যারা নাকি উৎপাদক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি হবে এবং কৃষিজাত পণ্য ক্রয়ের কাজ করবে। বিহারেও ২০০৬ থেকেই এটা চলছে। কিছুই না, নতুন মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি করা হচ্ছে মাত্র। সাবসিডি দেওয়া হচ্ছে। পুরোনো কমিশন এজেন্টদের ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে মাত্র। এফ পি ও ২০০৬ থেকেই বিহারে শুরু হয়েছিল। নতুন শ্রেণি তৈরি করা হচ্ছে। এটা পুঁজি নির্মাণের একটা নতুন, সরকার অনুমোদিত পদ্ধতি মাত্র। মেখলা কৃষ্ণমুর্তির কাজ যদি আপনারা দেখেন, ইনি উড়িষ্যা এবং বিহারে এবং মধ্য প্রদেশে এই এফ পি ও দের কাজ কর্মের সারভে করেছেন, বিজেপি এবং আর এস এস নতুন সমর্থন ভিত্তি তৈরি হচ্ছে মাত্র [14]। মজাটা হল, বিজেপি খুচরো ব্যবসায়ী দের রাজনৈতিক দল হিসেবেই শক্তি লাভ করেছিল, বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপক পরিমাণে আসার ফলে এই সমর্থন তাদের ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে, সুতরাং এই এফপিও তৈরি করে নতুন সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করার একটা রাজনৈতিক প্রয়োজন ও ছিল। এবং একই সঙ্গে বড় কর্পোরেটের শস্যক্রয়ের কাজটি করে দেওয়াই এদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য।
এই রাজনীতিকে কি পরাস্ত করা সম্ভব? বিজেপি যেমন ভাবে নতুন সমর্থক তৈরি করছে, কৃষকরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করেছেন, নিজেদের বিপদ বুঝতে পেরেছেন, এবং এগিয়ে এসেছেন। সবুজ বিপ্লবের রাজ্যগুলির ভেতরে ও বাইরে এই সব কৃষি আইনের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য অনেক ধরণের বামপন্থীরা কাজ করছেন। কেরালা রাজ্য কে আক্রমণ এমনি এমনি করা হয় নি। আমাদের ভাবতে হবে, কী ভাবে আরো বেশি করে মানুষকে বোঝানো যায়, এটা শুধু কৃষকের সমস্যা না, খাদ্য সুরক্ষা ও আক্রান্ত, বিভিন্ন ধরণের হকার সহ প্রচুর মানুষের জীবিকা কি ভাবে আক্রান্ত। এবং এটাও বোঝা দরকার এটা শুধু গ্রামীণ সমস্যা না। শহরগুলির নিম্ন আয়ের মানুষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, হবেন, নাগরিক শ্রমিক রা তো একটা বড় অংশে গ্রামীণ পরিবার গুলিরই সন্তান। এটা তো কোভিডের সময়ে আরো স্পষ্ট হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটা এতটাই জড়িত, আমি নিশ্চিত, বড় সংহতি, মানুষের বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
এই লেখাটির মাধ্যমে গুরুর পাঠকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলি পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। মূল ধারার মিডিয়া চুপ করে বসে তামাশা দেখছে।