
প্রতিবাদের বর্ণবৈষম্য:খৈরলাঞ্জি সন্ত্রাসের প্রতিবাদ হয়েছে বটে, তবে দলিত দেহের ওপর বর্ণহিন্দু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের নজীর ভারতবর্ষের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দায়। কারণটা যে সবসময় পুলিশের লাঠির ভয় বা রাজনীতির টানা পোড়েন তা নয়। বৃহত্তর বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের দলিত নিপীড়নের প্রতি এক নির্মম উদাসীনতা এর প্রধান কারণ বলেই মনে হয়। অনেকেই হয়ত বলবেন, “ধর্ষণ ধর্ষণই, হিন্দু নিপীড়িত, দলিত নিপীড়িত বলে কিছু হয় না”। যাঁরা এমন কথা বলেন তাঁরা কি বলতে পারেন ২০১২ সালে রাজধানী দিল্লি শহরে ঘটা একটি মর্মান্তিক গণধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে গোটা দেশ মুখর হতে পারে, অথচ ২০২০ সালে উত্তর প্রদেশের হাথরাস নামক শহরে ঘটা আর একটি পাশবিক গণধর্ষণ, খুন এবং অঙ্গচ্ছেদের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে তেমন মিছিল হতে দেখা যায় না কেন?
দিল্লির পাশবিকতার বলি হয়েছিলেন একজন হিন্দু মেয়ে। মেয়েটির নাম প্রায় অপ্রকাশ্যেই থেকে গিয়েছে। জানলেও উচ্চারণ করা মানা কারণ হিন্দু সমাজে মেয়েটির নাম প্রকাশ করলে মেয়েটি ও তার পরিবার অপবিত্রতার কালিমায় কলঙ্কিত হবে। মেয়েটিকে আমরা “নির্ভয়া” নামে চিনি। যদিও ধর্ষণ ধর্ষিতাকে কলঙ্কিত করে না, করে ধর্ষককে, বর্ণহিন্দু কাঠামোয় তৈরি ভারতীয় আইনে ধর্ষিতার নাম প্রকাশ বেআইনি। তবু হাথরাসের বলি যে একটি ১৯ বছরের দলিত মেয়ে তা আমরা জানি। মেয়েটির নামও জানি। হাথরাসের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে শুধু যে তেমন কোন প্রতিবাদের মিছিল হয় নি তাই নয়, উলটে হাথরাসের বর্ণহিন্দু ধর্ষক আর খুনীর সমর্থনে হিন্দুদের মিছিল করতে দেখা গেছে। এমন নৃশংসতা সত্যই নজিরবিহীন। ধর্ষণ এবং হত্যার পরেও শেষ হয়নি সন্ত্রাস। দলিত মেয়েটির জিভ কেটে নেয় খুনীরা। বলার অধিকার চাইলে অবর্ণের জিভ কেটে নেওয়া, শোনার অধিকার চাইলে কানে গরম তেল ঢেলে দেওয়া, আর মানবিক বা নাগরিক অধিকার চাইলে গণপ্রহার, ধর্ষণ, খুন আর সবার শেষে দেহ আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ হিন্দুর পবিত্র গ্রন্থ মনিসংহিতায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন হিন্দুঋষি মনু। খৈরলাঞ্জি আর হাথরাসের ধর্ষকরা মনুর আদেশই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
অচ্ছুত, দলিত, অবর্ণ দেহের শাস্ত্র অনুসারে সংহার করা যে পবিত্র কাজ। এই ঘৃণ্য কাজ যে পবিত্র তা জানতে কিন্তু ধর্ষকদের ধর্মগ্রন্থটি পড়তে হয় নি। মাতৃভাষা শিখতে যেমন ব্যাকরণ শিখতে হয় না, হিন্দু বর্ণবাদ শিখতে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পড়তে হয় না, হিন্দুসমাজে জন্মালেই শেখা হয়ে যায়। ইসাবেল উইল্কারসন তাঁর ২০২০ সালে প্রকাশিত “Caste (কাস্ট)” বইটিতে এমন কথাই বলেছেন। বইটির কথায় পরে আসছি। হাথরাসের ধর্ষকরা দলিত মেয়েটির মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত করে দিলেও, মেয়েটির নিষ্প্রাণ দেহটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করার মনুবাদী আদেশ অবশ্য স্থানীয় পুলিশই পালন করেছে ভারতীয় আধুনিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে। মিনিয়াপলিসের পুলিশি বর্বরতা আর হাথরাসের পুলিশি বর্বরতার মধ্যে তফাৎ থাকলেও তা সামান্যই; মিল অবশ্য অনেক। শ্বেতাঙ্গ ভদ্রসমাজের মতই ভারতীয় ভদ্রসমাজও বলেন যে এই পাশবিক ধর্ষক আর খুনিদের সাথে সব বর্ণহিন্দুকে এক করে দেওয়াটা বড্ড বাড়াবাড়ি। ভদ্রসমাজ যদি সত্যিই তা মনে করেন তবে তাকে প্রমাণ দিতে হবে। বর্ণহিন্দু ভদ্রসমাজকে হাথরাস আর খৈরলাঞ্জি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশজুড়ে মিছিল নামাতে হবে, ঠিক যেমন “নির্ভয়া” হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নেমেছিল ভারতবাসী। তা না পারলে হিন্দু ভদ্রলোকেরা যে কেবল ক্ষমতাবানদের গুন্ডাদেরই নিন্দে করে অথচ ক্ষমতার বর্ণবাদী কাঠামোয় আঘাত হানার কথাও ভাবে না, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের এই পর্যবেক্ষণ সত্য বলেই প্রমাণিত হবে।
কাস্ট বা বর্ণবাদ কি এই নিয়ে গভীর চর্চার মধ্যে না গিয়েও এইটুকু বলা যায় যে বর্ণবাদ ভারতবর্ষের প্রাচীন কলঙ্ক যা আজও প্রতিটি বর্ণহিন্দুর জীবনধারণ ও জীবিকার্জনের প্রধান মূলধন। আনন্দ তেলতুম্বদে যখন বলেন যে যতই অগ্রগামী নিজেদের মনে করুক না কেন হিন্দুসমাজ আজও জাত-বর্ণবাদের ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তখন উদারনৈতিক সাবর্ণদের সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগে বটে কিন্তু অস্বীকার করার উপায় তেমন খুঁজে পায় না। আজও প্রায় সব ভারতীরই প্রথম পরিচয় বর্ণপরিচয়ই, বিশেষ করে সাবর্ণ হলে তো বটেই। আজও খবরের কাগজের মেট্রিমনিয়াল কলামগুলো বর্ণ-নির্দিষ্ট পাত্র-পাত্রীর খোঁজে ভরপুর। যে কজন প্রগতিশীল পাত্রপাত্রী-চাই বিজ্ঞাপনে “কাস্ট নো বার” লেখেন, তাঁরাও প্রকাশ করেন তাঁদের কাস্ট। তেলতুম্বদের মতে এই বর্ণহিন্দু মানসিকতা হিন্দু ভারতবাসী গর্বের সাথে বয়ে বেড়ান দেশ দেশান্তরে। তাই আমেরিকার মিনিয়াপলিস শহরের জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যাকাণ্ড আর সুদূর ভারতবর্ষের খৈরলাঞ্জি গ্রামের ভূতমাঙ্গে পরিবারের সংহারের পটভূমি ভিন্ন হলেও মূলগত কাঠামোর বুনিয়াদি ভিত্তি একই। বর্ণভিত্তিক সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস।
এই বুনিয়াদি ভিত্তির কথা ইসাবেল উইল্কারসন তাঁর ২০২০ সালে প্রকাশিত “Caste (কাস্ট)” বইটিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইসাবেল উইল্কারসন বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসকে মাতৃভাষা শেখার সাথে তুলনা করে দেখিয়েছেন যে জাতি-ভিত্তিক বর্ণবাদ বা রেসিজম মাতৃভাষার শব্দ শেখার মত যা জন্মের পর মা-মাসির কাছে শিখতে হয়। জাত-ভিত্তিক বর্ণবাদ বা কাস্টিজম বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের ব্যাকরণ যা আলাদা করে না শিখেও গড়গড় করে মাতৃভাষায় নির্ভুল কথোপকথন সম্ভব। আরও সোজা উপমা দিয়ে বলেছেন, কাস্টিজম বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের হাড়-মজ্জা আর রেসিজম তারই ওপরে গড়া মাংস, পেশি, চামড়া, আর চামড়ার ওপরের রং। সময়ের সাথে সাথে রেসিজমের আকার, প্রকৃতি, রং ইত্যাদি পাল্টালেও মজ্জাগত বর্ণবাদ বা কাস্টিজম অনড়, অক্ষয়, অমর। তাই কাস্টিজমকে আনন্দ তেলতুম্বদে “পারসিস্টেন্ট” বলেছেন, আর ওয়েন্ডি ডনিজার বর্ণবাদের উৎপত্তিস্থল ভারতবর্ষ বলেছিলেন। ভারতীয় কাস্টিজম আর অ্যামেরিকার রেসিজম যে একই সূত্রে বাঁধা তা অ্যামেরিকার সিভিল রাইটস আন্দোলনের স্বনামধন্য নেতা গান্ধীবাদী ডক্টর মারটিন লুথার কিং ১৯৫৯ সালের ভারত পরিভ্রমণের সময় অনুভব করেছিলেন। পণ্ডিত নেহেরুর আতিথ্য আপ্যায়নের অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেও দলিত সম্প্রদায়ের সান্নিধ্যে আসার পর কাস্ট- বা বর্ণ-হিন্দুদের হাতে অচ্ছুত বা আনটাচেবলদের সামাজিক অবমাননার কথা শুনে অ্যামেরিকার দক্ষিণী রাষ্ট্রগুলিতে দৈনন্তিন ঘটেচলা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্তবাদীদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের নিপীড়নের সাদৃশ্য খুঁজে পান। এরপরই ডক্টর কিং নিজেকে এবং সমগ্র কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে অচ্ছুত বা আনটাচেবল গোষ্ঠীর সদস্য বলে ঘোষণা করেন। যদিও ১৯৫৯ সালে অচ্ছুত বা আনটাচেবল, এই অপমানজনক শব্দদুটি পাল্টে মহাত্মা গান্ধী “হরিজন” শব্দের উৎপত্তি করেছিলেন, গান্ধীজীর শব্দচয়নের মধ্যে মিশে থাকা অনুকম্পার আঁচ অচ্ছুত সম্প্রদায় সহজেই ধরে ফেলেছিল। ডক্টর কিংও হয়ত ধরে ফেলেছিলেন। তাই বোধহয় নিজেকে “হরিজন” না বলে অচ্ছুত বা আনটাচেবল বলেন। অ্যামেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের এক অটুট সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা এতই দৃঢ় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে মহারাষ্ট্রের চার দলিত নেতা নামদেও ধাসাল, অর্জুন ধাংলে, রাজা ধালে এবং জে. ভি. পাওয়ার অ্যামেরিকার বিপ্লবী নেতা ম্যালকম এক্সের ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির আদলে ১৯৭২ সালে তৈরি করেন দলিত প্যান্থার পার্টি। মারাঠি সাহিত্য ও কলায় রেনেসাঁস এনেছিল দলিত প্যান্থার পার্টি। এঁদেরই নিরলস প্রতিবাদের জোয়ারে ভেসে যায় “হরিজন” নামকরণ। বর্ণবৈষম্যের শিকার নিপীড়িত নির্যাতিত সম্প্রদায়ের মানুষরা তাঁদের আজ দলিত বা বহুজন বলে চিহ্নিত করেন।
বাঙালিরা নিজেদের প্রগতিশীল জাত বলেই মনে করে। বাংলা খৈরলাঞ্জি বা হাথরাস নয়, একথাও হয়ত বাঙালিরা বলবেন। বাংলা গুজরাত নয়, এমনও তো বাঙালিরা বলতেন। গুজরাত, খৈরলাঞ্জি বা হাথরাস হোক কি না হোক, সাবর্ণ-রঞ্জিত প্রগতিশীল বঙ্গসমাজে যে অবর্ণের জীবনের কেবল মূল্যই নেই তাই নয়, অস্তিত্বও নেই। তাই বাঙালি আইকনদের নামের তালিকা সাবর্ণ পুরুষে ভরপুর। বাঙালিরা নিজেদের যতই প্রগতিশীল ভাবুন না কেন, জাত-পাত বর্ণবিদ্বেষের যে মনুবাদী বিষ বাঙালি হিন্দুর রক্তে মিশে আছে তা অন্য ভারতীয় হিন্দুদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বাঙালি সমাজের কাঠামোও বর্ণবাদের ছাঁচেই তৈরি। ২০২০ সালে অবশ্য পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি। অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যানের পদে নিযুক্ত হয়েছেন ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন” এর স্বনামধন্য দলিত লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। এই ঐতিহাসিক অ্যাকাডেমি দলিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি তো বটেই, বৃহত্তর বঙ্গ সংস্কৃতির উন্নয়নের প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবু বর্ণহিন্দু বাঙালি ভদ্রসমাজের আনাচে কানাচে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে এক তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। সোশাল মিডিয়ায় দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমিকে আক্রমণ করে বাঙালি ভদ্রসমাজের কিয়দংশ দলিত সাহিত্য ব্যাপারটাই অস্বীকার করতে চায়। বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির কুশীলবদের দিকে চোখ মেললেই দেখা যায় যে সাবর্ণ হিন্দু তো বটেই, খানদানি মুসলমান শিল্পীরও স্থান আছে সেথায়, নেই শুধু দলিত শিল্পীর ঠাঁই। খানদানি মুসলমান শিল্পীর স্থান আছে বলে আবার মনে করবেন না যে বাঙালি হিন্দু ভদ্রসমাজ মুসলমান দরদী। তা মোটেই নয়। কথায় কথায় আমির খাঁ’র অমল গীতি, মুজতবা আলির কোমল সাহিত্য বা আকবর-হাবিবের দুর্দান্ত গোল নিয়ে স্মৃতিরোমন্থন করলেও ভদ্র বাঙালি ফুটপাথে ফেজ টুপি পরা মুসলমান ছোকরাকে দেখলেই অন্য ফুটপাথে সরে গিয়ে গা বাঁচান। আগে হিন্দু বাঙালিরা মুসলমানদের দেখলে মুখে যাই বলুন না কেন মনে মনে খুব গালিগালাজ দিতেন। আড়ালে আবডালে মুসলমানদের দেশদ্রোহী বলা, “মীরজাফর” বলে গাল দেওয়া ইত্যাদি অনেকেরই জানা। বাঙালি হিন্দুদের দৈনন্দিন আড্ডার অঙ্গ। আমার মত অনেক সাবর্ণই সে কথা জানেন, প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও। আজকের “হিন্দুতভা” যুগে অবশ্য সরাসরি “রেপিস্ট-টেররিস্ট” ইত্যাদি বলতেও দ্বিধা করেণ না। স্বনামধন্য কৃষ্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র পরিচালক স্পাইক লি (Spike Lee) তাঁর বিখ্যাত “ডু দা রাইট থিং” ছায়াছবির এক জনপ্রিয় দৃশ্যে বাঙালিদের মতই ভেকধারী প্রগতিশীল সাদা আমেরিকানদের সাদা চামড়ার নিচে লুকোনো প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদের আসল রূপ উন্মোচন করেছিলেন এই দেখিয়ে যে কথায় কথায় এনারা কালো আমেরিকান শিল্পীদের আপন করেন বটে, অথচ সাধারণ কালো আমেরিকানদের ছোটলোকই ভাবেন। “তোমাকে ঠিক দলিতদের মত দেখতে নয়” বা “তুমি খুব সুন্দর বাংলা বল” ইত্যাদি প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদী লাইন বুদ্ধিজীবী সম্ভ্রান্ত দলিত বাঙালিদের যে হামেশাই শুনতে হয় এমন কথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের থেকে আসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর মেরুনা মুর্মু অনেক জায়গায় বলেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাঙালি শিল্প-সাহিত্যে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের অবস্থান থাকলেও দলিতের কোন স্থানই নেই। তাই তো দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি কিছু সোচ্চার বর্ণবাদী বাঙালি ভদ্রসন্তানের কাছে আসন্ন অমঙ্গলের সংকেত। এই অ্যাকাডেমি সফল হলে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর ভদ্রসমাজের বংশানুক্রমিক বজ্রআঁটুনি শিথিল হবার সম্ভবনা রয়েছে। ভদ্রসমাজের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতেই দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির ওপর আক্রমণ হানার চেষ্টা চলেছে। এক্সক্লুশানের সংস্কৃতি এক ভগ্নপ্রায় সংস্কৃতি। বাঙালি ভদ্রসমাজের এই অপচেষ্টা ব্যর্থ না করতে পারলে সমগ্র বঙ্গসংস্কৃতিই চরম সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে।
নিচু জাতের প্রতি সাবর্ণ বাঙালির বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণা যে তাদের বংশগত রোগ তা গত সেপ্টেম্বরে খোদ কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাই অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা ডক্টর মেরুনা মুর্মু ওপর আনা একটি ঘৃণ্য বর্ণবাদী আক্রমণের কথা কলকাতার অনেক পত্রিকাই প্রকাশ করেছে। বেথুন কলেজের মত একটি সম্ভ্রান্ত কলেজের বেশ কিছু উচ্চবর্ণের ছাত্রী ডক্টর মুর্মুকে আক্রমণ করেন সোশাল মিডিয়ায়। সোশাল মিডিয়া ইনফর্মেশন এজের বা তথ্য যুগের এক অভিনব উপাদান। কিন্তু একই সাথে সোশাল মিডিয়া সন্ত্রাসবাদের হাতেও এক নতুন হাতিয়ার। সোশাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানোর আর বেক্তিগত বা সমষ্টিগত আক্রমণ উপেক্ষা করলে তার ফল যে কী হতে পারে তা আমরা প্রায় সকলেই জানি। সোশাল মিডিয়ার গুজবের ভিত্তিতে রাজধানী দিল্লিতে হিন্দু দাঙ্গাকারীদের হাতে দুই ভারতীয় মুসলমানের হত্যা থেকে শুরু করে অ্যামেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি তে নেমে আসা শ্বেতাঙ্গ দাঙ্গাকারীদের তাণ্ডবের খবর আমাদের সকলের জানা। ডক্টর মুর্মুর ওপর হানা সোশাল মিডিয়ায় আক্রমণও তুচ্ছ করার নয়। ওঁকে আক্রমণ করা হয় কারণ উনি অতিমারীর সময় ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষার চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য বেশি এমন স্পষ্ট কথা বলবার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। তবে যে ছাত্রী ডক্টর মুর্মুর ওপর প্রথম আক্রমণ হানেন, তিনি ডক্টর মুর্মুর বক্তব্যকে আঘাত করেননি, করেছিলেন তাঁর জাতকে। বলেছিলেন যে ডক্টর মুর্মু ছোট জাত বলেই নাকি এমন কথা বলতে পারেন। ছাত্রীটির স্বরে ছিল সেই একই বর্ণবাদী ছাঁচে ফেলা অপমান, গালিগালাজ আর কটাক্ষ যা খৈরলাঞ্জি গ্রামের হিন্দু ছেলে-মেয়েরা ভূতমাঙ্গেদের প্রতি নিক্ষেপ করেছিল ভয় দেখাতে। মহারাষ্ট্রের অজ্ঞাত গ্রামের বর্ণহিন্দুদের ভাষা আর কলকাতার বেথুন কলেজের বর্ণহিন্দুর ভাষায় তারতম্য থাকলেও, ভাবে তারতম্য নেই। সুরেখা, সুধীর, রোশান, আর প্রিয়াঙ্কার ওপর যে অত্যাচার নেমে এসেছিল, ডক্টর মুর্মুর ওপর হয়ত তা আসবে না, কিন্তু অবর্ণ জীবনের প্রতি সাবর্ণের তাচ্ছিল্য আর অনীহার কদাকার রূপ খৈরলাঞ্জি শহরতলীর মেঠোপথ আর মহানগরী কলকাতার রাজপথকে একই সূত্রে বাঁধে।
সেই সূত্রের সূত্রধর বর্ণবাদী মনু আর মনুবাদ। মিনিয়াপলিসের হত্যাকারী শ্বেতাঙ্গ শোভান, খৈরলাঞ্জি-হাথরাসের হিন্দু বলাৎকারি, আর কলকাতার সাবর্ণ সাইবারবুলিদের হাত এক বর্ণবাদের রক্তেই রাঙ্গা। যেদিন বর্ণহিন্দু বাঙালি এই সত্য স্বীকার করার সাহস অর্জন করতে পারবে সেদিন হয়ত বাঙালি ভদ্রলোকদের দেশ-বিদেশে খৈরলাঞ্জি, হাথরাস আর যাদবপুরের কলঙ্ক আর বয়ে বেড়াতে হবে না। বাঙালি ভদ্রলকেদের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন না ঘটলে মেরুনা মুর্মুদের ওপর সাবর্ণের উৎপীড়নও থামবেনা, খৈরলাঞ্জি-হাথরাসের হত্যালীলায়ও কোন ছেদ পড়বে না।
জেন এলিয়ট (Jane Elliot) একজন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান শিক্ষাবিদ। প্রায় একযুগ ধরে অ্যামেরিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড চালিয়ে আসছেন মিস এলিয়েট। যেখানেই ভাষণ দিতে যান, বক্তৃতার পর মিস এলিয়েট একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, বিশেষ করে সেই সব শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের উদ্দেশে যাঁরা অ্যামেরিকার বর্ণবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। যাঁরা বলেন “আমি বর্ণ দেখিনা”, “আমি চামড়ার রং দেখিনা”, বা “আমি বর্ণবাদী নই”---- প্রশ্নটা তাঁদের উদ্দেশে। মিস এলিয়েট তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, “ If you white folks want to be treated the way black folks are treated in the society, stand up.” অর্থাৎ, “যে যে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপর যেমন ব্যবহার করা হয় তেমন ব্যবহার পেতে ইচ্ছুক, তাঁরা উঠে দাঁড়ান”। প্রশ্নটা সহজ, আর উত্তরও জানা। কোন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান উঠে দাঁড়ান না। এই একই প্রশ্ন সাবর্ণ ভারতবাসীর সামনে রাখলেও একজনও উঠে দাঁড়াবেন বলে মনে হয় না কারণ যতই “আমি বর্ণ দেখিনা, আমি কাস্ট মানিনা” বলুন না কেন, প্রতিটি সাবর্ণ জানেন দলিত, আদিবাসী, অবর্ণ সম্প্রদায়ের প্রতি বর্ণহিন্দু সমাজের অন্যায় আচরণের কথা। পরীক্ষাটা একবার করে দেখা যেতেই পারে।
জাতি-ভিত্তিক বর্ণবাদ অ্যামেরিকার কলঙ্ক। জাত-ভিত্তিক বর্ণবাদ ভারতীয় সমাজের কলঙ্ক। বর্ণবাদের কাঠামো বড় শক্ত। এর ভিত গভীর। বর্ণহিন্দু কি পারবে অবর্ণ ভারতবাসীর সাথে ছন্দ মিলিয়ে বর্ণবাদের ইমারতের অন্তরমহল থেকে নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত হানতে? সাবর্ণ ভারতবাসী কি পারবে দলিত ভারতবাসী, আদিবাসী ভারতবাসী অবর্ণ ভারতবাসীর সাথে গলায় গলা মিলিয়ে এই মন্ত্রে গর্জে উঠতে, দলিত জীবনের মূল্য আছে, আছে আদিবাসী জীবনের মূল্য, আছে শরণার্থী, উদ্বাস্তু জীবনের মূল্য? অনেকেই, বিশেষ করে বর্ণহিন্দু ভদ্রলোকেরা বলেন, “আহা, আলাদা আলাদা করে বলতে হবে কেন? সব মানুষের জীবনের মূল্য আছে বললেই তো হয়।” দলিত জীবনের, আদিবাসী জীবনের, শরণার্থী আর উদ্বাস্তু জীবনের মূল্য যে সমাজ দেয় না, সেই সমাজে “সব মানুষের জীবনের মূল্য আছে” বলা অর্থহীন তো বটেই, মিথ্যেও। তাই আজ যে ডাকের প্রয়োজন তা হতে হবে তীক্ষ্ণ আর সুনির্দিষ্ট। তবেই হয়ত বর্ণবাদের অট্টালিকা চূর্ণ হবে, ভারত এক নতুন চেহারায় দেখা দেবে, যা সমুজ্জল।
santosh banerjee | ২৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৭:১৫102026কয়েকটা ছোট ঘটনার কথা বলি ।...আমার পরিবার বন্দোপাধ্যায় বংশ খ্যাত ।..নাক উঁচু ভাব টা ছোট থেকেই শিখে এবং দেখে আসছি !!একটু বড়ো হয়ে যখন জানলাম এগুলো সব ওই মনু বাদ চিন্তা ধারার ফসল এবং প্রচণ্ড ভাবে মানবতা বিরোধী ।..তখন রক্তে লাগলো দোল !!বিয়ে করলাম কায়স্থ মেয়েকে ।।।সে কি যে গঞ্জনা ।..আলাদা হলাম ।..সবাই বললো "মা কে ছেড়ে বৌ কে ধরলি""??দিন গেলো।.. মাস গেলো ।..অন্য ভাই রা সম গোত্রে।..উঁচু জাতে বিয়ে করেও মা নামক মহিলা টিকে এক বিন্দুও দেখলো না ।..দেখলো আমার কায়স্থ বৌ !!আমার মেয়ের বিয়ে হলো কায়স্থ পরিবারে ।..একেবারে তথা কথিত "শুদ্র " জাতে ।..আত্মীয়রা মুখ ঘুরিয়ে নিলো ।..কিন্তু ওই মেয়ের জামাই যখন অর্থ সাহায্য করে তাদের ঘোর বিপদ থেকে বাঁচালো ।..তখন ।..."কি ভালো জামাই রে তোর "।..বলেই এটা খাওয়ায় তো সেটা খাওয়ায় ।..দিন রাত মুঠো ফোনে তার সঙ্গে সম্পর্ক ।..ইত্যাদি !!এই যে বাঙালি দের (বা মানুষের ) চাল চরিত্র হাকিকাত ।।.একে কি বলবেন ??সুতরাং ।..মনেহয় ।..আইন আদালত দিয়ে কিছু হয় না হবেও না !!সমাজ টাকে ভেঙে ।.দুমড়ে ।..মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলি চলুন !!তারপর মনু বাদ ..বাদ !!!এক্কেবারে বাদ !!!হবে সত্যি কারের সাম্য বাদ !!বাম ফ্রন্ট এর সাম্য বাদ নয় কিন্তু !!
রাজা ভট্টাচার্য | 2601:192:437f:fa6a:5ab:b6f8:b132:***:*** | ২৮ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:৫৯102129@সন্তোষ ব্যানার্জী
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনি যা বলেছেন সত্যি। তবে আইন আদালত দিয়ে কিছু হয় না বললেও তো চলবে না। আইন আদালতের ওপর তো আস্থা রাখতেই হবে। সমাজও পাল্টাতে হবে। ঘরে ঘরে পাল্টাতে হবে। সমাজ পাল্টালে আইন আদালতও সমাজের সাথে সাথেই পাল্টাবে। আইন আদালতে যারা আছেন তারাও তো সমাজেরই সদস্য। রাজনীতির ওপর আস্থা আনতে হবে। রাজনীতিতে স্বক্রিয় অংশ নিতে হবে। সময় লাগবে। কিন্তু কোথাও একটা শুরু হোক।
Hiren Singharay | ২৮ জানুয়ারি ২০২১ ১২:২৮102137অসাধারন লিখেছেন। লোকে পড়ুন । বুঝুন ভরতীয় বর্ন ভেদ অনেক গভীরে। রবিবারে পাত্র পাত্রীর কলম দেখলেই জানা যায়। দলিতদের কথা তো অনেক পরে। জয়পুরে কেল্লার ওপর থেকে গাইড দেখাল নীল মার্কা বাড়ি ব্রাহ্মন দের। আপারথেইড এ দেশের আইনের বই তে লেখা নেই। আমাদের মনের ভেতরে লেখা আছে।