প্রসেনজিৎ দাশগুপ্তর লেখা বইটি হাতে নেওয়ামাত্র স্পষ্ট হয়ে যায় তার উপজীব্য কী। নামেই পরিষ্কার—‘ভুলবে সে গান যদি: চেনা অচেনা গানের গল্প’। নানা গানের হারিয়ে যাওয়া নানা গল্প। আর গল্প শুনতে-পড়তে কার না ভালোলাগে?
এই ভাবুন না, বিশ্ববিখ্যাত ‘জিঙ্গেল বেল্স’ (ক্রিসমাস সং) বা ‘টম অ্যান্ড জেরি’র থিম মিউজিক সহ নানা এপিসোডে আবহসংগীত, এ তো আমাদের বহুল পরিচিত। কিন্তু কেমন লাগবে এদের তৈরি হওয়ার ইতিহাস, সেই সময়ের শরিক হতে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স প্রদেশের মেডফোর্ড শহরে যে ট্যাভার্ন-এ ‘জিঙ্গল বেল্স’ গানটি রচিত হয়েছিল তার দেয়ালে লাগানো ফলক।
লেখক খুব সচেতন ভাবেই ‘একাডেমিক গবেষণার তত্ত্বতালাশে’ যাননি। অনেকটা ঘরোয়া আড্ডার মেজাজে বেঁধেছেন তাঁর লেখাগুলোকে। কোনো গল্পের ফেরে যেমন চুপ করে থেকেছি বহুক্ষণ, চেনা গানের কাছে ফিরে গেছি সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে, আবার কোনো গল্প পড়ে রাত একটায় বন্ধুকে ফোন করেছি, গল্প শোনাব বলে। নিপুণ কলমে হালকা চলার ছন্দে বাঁধা গল্পগুলো তথ্যসমৃদ্ধ করেছেন, যদিও তথ্যের ভারে ইতিহাস ক্লান্ত হয়নি, গল্পেরা তার মজলিশি আড্ডায় মনোগ্রাহিতা হারায়নি লেখার মুনশিয়ানায়।
কোন্ সময়কালকে লেখক ধরেছেন বলা মুশকিল! একদিকে যেমন পুরাণের গল্পকথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গানের গল্প, তেমনই সমসময়ের গানের প্রসঙ্গও বইয়ের বিষয়বস্তু। আজাদ হিন্দ ফৌজের অলিখিত ‘জাতীয় সংগীত’ বা সরদারি বেগমের পাশাপাশি নরেনের কাছে রামকৃষ্ণর গান শোনা এবং ‘Kali, The mother’ তৈরির গল্প উঠে আসে। উঠে এসেছে সামাজিক ইতিহাস। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যখন ‘নারা’ ওঠে ‘অনলহক’ সেই ‘অন-অলহক’ বা ‘আমিই সত্য’তে কীভাবে মিশে যায় উপনিষদের ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’ বা বাইবেলের ‘revelation’–এর ‘I am He’… উঠে আসে গান ! প্রতিবাদের মশাল হয়ে।
গান তো প্রতিবাদেরই অঙ্গ। ‘বিদ্রোহী গান প্রেমেরই গান!’
গান তো আদতেই রূপকথা। সত্যি রূপকথা। নয় বলুন? যখন জেনেছিলাম ‘কেশরিয়া বালম’, ‘দরবারি কানাড়া’ বা ‘বিলাসখানি তোড়ি’র ইতিহাস, ভাটিয়ারের কোমল রেখাবের মতো সুরেলা এই ইতিহাস আমায় ছুঁয়ে গেছিল, ছুঁয়ে গিয়েছিল জীবনের ক্লান্তিহীন বিষণ্ণতাকে। এই গল্পগুলোর সাথে পথ চলতে চলতে আদিম মানুষের মতো হেঁটে বেড়িয়েছি পুরানো দিল্লির ইদগাহ রোডের কোনো গলিতে, যেখানে ইতিহাস এখনও জেগে উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা সানাইবাদকের সুর শুনবে বলে! ইতিহাস একা জেগে থাকে। সুখীও নয়, দুঃখীও নয়। অসীম এবং চিররহস্যের এই অতীত ঘেরাটোপে যে নির্বাণ হয় না, তা কেবল স্মৃতি আছে বলেই না!
এই স্মৃতিকেই উসকে দিয়েছেন লেখক। ইতিহাস খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকের মতোই আমাদের কাছে উপস্থিত করেছেন একের পর এক আশ্চর্য ‘দাস্তান’! ইতিহাসের ঋণ চুকিয়েছেন। ১৩ বছরের অকালপ্রয়াত (নাকি হত) মাস্টার মদন, বিস্মৃতি দিয়ে আমরা আবার খতম করেছি যাঁকে, যাকে শুনবেন বলে আমির খান, কে এল সায়গল সহ শাস্ত্রীয় সংগীতের বিখ্যাত মানুষেরা অপেক্ষা করতেন, লেখক আমাদের নিয়ে গেলেন সেই ঠিকানায়। আমাদের এই গরিব দেশে যেমন সংগীতকাররা ‘সালাম’ পান না, বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যান বনরাজ ভাটিয়া বা অজিত বর্মনেরা, এই বই, কোথাও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
অকালপ্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী মাস্টার মদন
এখানে শুনুন তাঁর কণ্ঠে একটি গান
সুরের টানে সুর মিলে যায়। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের ‘যব ছোড় চলে লখনউ নগরি’ তাই এস্রাজে মিলে যায় রবীন্দ্রনাথে। ‘যাবো না গো যাবো না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে/ এই নিরালায়…।’ নিরালায় সঙ্গী হয়ে থেকে যায় কিছু সুরের রেশ, থেকে যায় গল্পগুলো। কিছু চিঠি। সময়ের চিঠি। একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবে। আমরা কেউ কেউ সেই চিঠি পাই, পড়ি। কেউ কেউ সেই চিঠি দেখেও দেখি না। এড়িয়ে যাই।
‘আজ জানে কি জ়িদ না করো’-র মতো গান, শুধু গানের ইতিহাস নয়, গানের চোরাস্রোতে লুকোনো গল্প বলে এই বই। বিস্মৃতির অনাদরে আমরা যা হারিয়েই ফেলতে বসেছিলাম…
এই বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন বিতান চক্রবর্তী। আদিম সুরের মতো ‘ছিমছাম’ প্রচ্ছদ তাঁর। চোখের আরাম দেয়। ঋত প্রকাশনী এই বইটি ছেপেছেন। আমরা ‘পকেটবুক’ বলতে যে আকার বুঝি, ঠিক সেই আকারে বইটিকে বেঁধে তাঁরা সহজেই ভ্রমণসঙ্গী করে তুলেছেন এই বইটিকে।
এই বইয়ের প্রাককথন লিখেছেন প্রখ্যাত সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র। জানিয়েছেন তাঁর ভালোলাগা; যা উপরি পাওনা এই বইয়ের সাথে।
গান শুনতে ভালোলাগে যাঁদের, যাঁদের ভালোলাগে গল্প শুনতে, এই দুই ‘সম্প্রদায়ের’ পাঠক-পাঠিকারই ভালোলাগবে এই বই। আর কে বলতে পারে, নতুন কোনো গানের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে না এই বই পড়ে?
ফোনে অর্ডার দেওয়া যাচ্ছেনা। ফোন বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে।