এই গল্পটা শুরু করতে গেলে আমাকে দিদার মাথার মধ্যে ঢুকতে হবে -পিঁপড়ের মত একটা রোবট ছেড়ে দিই দিদার ঘরে? প্রোগ্রাম মাফিক, লাল মেঝে বেয়ে বেয়ে খাটের পায়ায় উঠুক, বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকা পেরোক, সিঁথিতে ছোট্টো ড্রিল করুক কপাল ঘেঁষে; তারপর মগজে একটা ক্যামেরা ঢুকিয়ে দিক টুক করে। দিদার স্মৃতি কোথায় আছে , আদৌ আছে কী - ধরে নেওয়া যাক ক্যামেরা জানে; এই মুহূর্তে ক্যামেরা যেন দেখছে অতিকায় এক পাত্র ভর্তি শশাকুচি, সূর্যমুখীর বীজ, গাজরের ফালি, ডুমো ডুমো কুমড়ো, বাদাম, ডালিমের দানা, আর বড় বড় লেটুস পাতা- আলাদা আলাদা করে সাজিয়ে রাখা নয় , সব একসঙ্গে , উপচে পড়ছে যেন; কোথাও সবুজ পাতা পচে নেতিয়ে গেছে, কোথাও কচকচে জ্যান্ত; কোথাও আবার পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে চেরি টমাটো, বেগনে পেয়াঁজ, চীজের ছোটো কিউব, কোথাও যেন ড্রেসিংএর ভারে আলাদা করে কিচ্ছু চেনার জো নেই, কোথাও আবার একরাশ জটপাকানো নুডলসের সুতো - একটা স্তূপের মত- ক্যামেরা খুব কাছে গেলেই সে সব ছিটকে যাচ্ছে এদিক ওদিক, ঢেকে দিচ্ছে লেন্স আবার দুটো বড় বড় পাতার তলায় যেন জল দেখা গেল- তলায় শ্যাওলা, নুড়িপাথর; রঙীন মাছ খলবল খলবল ভেসে বেড়ায়, ঘাই দেয়- একরাশ বুদবুদ ওঠে তখন। ক্যামেরা সেইসব ভিডিও নেয়। অটোম্যাটিক। এবারে আমি পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলাম ; দিদার মুখ দেওয়ালের আয়নার দিকে - আমাকে যেই দেখা গেল আয়নায়, ঘাড় ঘোরালো দিদা ; খুলির ফুটো থেকে নীল আলো শঙ্কুর মত দেয়ালে পড়ল- কিরকির করে একটা সিনেমা শুরু হয়ে গেল আর আমি ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসলাম। দিদা হাসল যেন ।
স্ক্রীনসেভার বদলে যায় রোজ। আজ দুটো পাহাড়ের মধ্যে হ্রদ - আকাশের রিফ্লেকশনে নীলে নীল- সেখান থেকে ভুস করে উঠে এলো পাসওয়ার্ড লেখার খোপ - যেন প্রাণভোমরার কৌটো। উনিশশো পঁচাত্তরের আশ্বিনের সন্ধ্যায় কম্পিউটার, নেট অথবা পাসওয়ার্ড নিয়ে ভাবার সম্ভাবনা এ অঞ্চলে শূন্য ছিল - চশমা চোখে গোঁফ ওলা তরুণ স্যার কলকাতায় ফিজিক্স পড়াতে যেত সকালের ট্রেনে, ইংরিজির সুহাসিনীর একই ট্রেন। তরুণ ছাড়া সায়েন্সের লোক এ পাড়ায় আর কেউ নেই। তদুপরি, সুহাসিনীর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল - তরুণ ফিজিকসের থেকে কবিতা ভালো জানে। আসলে রোজ সকালে দিবাকর বৌএর সঙ্গে স্টেশন অবধি হেঁটে দুধ আনতে যেত, তারপর বাজারে। প্রেম ভাবলে প্রেম, পাহারাদারি ভাবলে তাই, পঁচাত্তরের অই সময় সেসব মাথা ঘামানোর বিষয় নয় - ইংরিজির সুহাসিনীও ভাবে নি। বরং ভোরের বেলার মফস্সলের প্ল্যাটফর্ম, নিম ফুলের গন্ধ, কৃষ্ণচূড়ায় ফুল আসব আসব করছে, পাশে পাশে হাঁটছে সুদর্শন যুবক স্বামী, একটু আগে পুপেকে দুধ টুধ খাইয়ে সদাশয় শাশুড়ীর কাছে রেখে এসেছে- সুহাসিনীর একটু ঘোর লাগা গোছের হত - যেন মোটরবাইকে সে আর দিবাকর- এই পথ যদি না শেষ হয় বাজছে; ব্যাকগ্রাউন্ড প্রোজেকশনে পথচলতি গরু, দুটো কুকুর, রিংকুর ঠাকুমা সাজিতে জবা আর টগর নিয়ে একমুখ হাসল , টুপিপরা আবক্ষ নেতাজীর সামনে পতাকা তোলার বেদী, মিষ্টির দোকানের সামনে সুরেন ঠাকুর বিশাল কড়াই বসাচ্ছে উনুনে , টেলরিং শপের সামনে লাল নীল হলুদ কাপড়ের ফালি, ভাঙা পাঁচিলে এশিয়ার মুক্তিসূর্য। এই সময় তরুণ 'কী দাদা কেমন আছেন? বৌদি ডি এর খবরটা শুনলেন?' বলতে বলতে ঢুকত স্টেশনে - পার্ট ভুলে যাওয়া সৈনিকের মত লাগে ওকে- সরু গোঁফ, নুয়ে পড়া চেহারা, পুবদিক থেকে ভোরের সূর্য সটান স্পট লাইট ফেলেছে মুখে। দিবাকরও খবর নিত তরুণের বাবার, মায়ের। তারপর বাজারের পথ ধরত। তরুণ মৃদুস্বরে কবিতার কথা বলত তখন - কৃত্তিবাসের লেটেস্ট ইস্যু কেমন হয়েছে, , সিগনেট থেকে কী কী নতুন কবিতার বই তরুণের এখনও কেনা হয়ে ওঠে নি - ওমাসের মাইনে পেলে প্রথমেই কিনে নেবে, গত শনিবারে কফিহাউসের দরজায় ও সুনীল গাঙ্গুলিকে সিগ্রেট ধরাতে দেখেছে - এইসব অনর্গল বকে যেত । তারপর ট্রেন ঢুকলে, সুহাসিনী মহিলা কামরায়, তরুণ জেনেরালে। শিয়ালদায় নেমে যে যার কলেজের পথ ধরত। ফেরার পথে দেখা হত কম। তরুণ পার্টি করে- শাশুড়ির মুখে এ'মত শুনেছিল সুহাসিনী। পাড়াতেও। সকালের ঐ দেখাটুকুতেই সুহাসিনীর যেমন ধারণা হয়েছিল, তরুণ আদতে একজন কবি, সুহাসিনীর পছন্দের বইপত্র তরুণেরও জানা হয়ে গিয়েছিল পুরোপুরি।
সেদিন প্ল্যাটফর্মে দেরিতে ঢুকছিল সুহাসিনী - রাতে পুপের জ্বর ছিল, সকালেও ঘ্যানঘ্যান - ওদিকে লেভেল ক্রসিংয়ের গেট পড়ে গেছে, ট্রেন যে বাঁক ঘুরছে -প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে , গৌরাঙ্গ আমার গতি গাওয়া শেষ করে ক্রাচ ঠুকে ঠুকে চা খেতে যাচ্ছে নৃপেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন ঝাঁক বাঁধছে সামনের দিকে ; তরুণ দৌড়ে এসে বলেছিল - 'এত দেরি করলেন আজ বৌদি। দারুণ খবর দেওয়ার ছিল। আপনার প্রিয় লেখক আমাদের উল্টোদিকের বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন - আসলে নতুন বাড়ি করছেন -একবছরের মধ্যে কমপ্লিট হয়ে যাবে; এখান থেকে দেখাশোনার সুবিধে আর কী। পরশু তো রবিবার। দাদাকে নিয়ে বিকেলে চলে আসুন আমাদের বাড়ি। আলাপ হয়ে যাবে।'
আজ দুপুরের বৃষ্টিতে রাস্তা আঠালো আর পিছল; রাস্তা বলতে কাঁচা পাকা অষ্টাবক্র পথ, গত অক্টোবরে খোয়া আর স্টোনচিপস ঢালা হয়েছিল, বাঁদিক ঘেঁষে পার্মানেন্ট ইঁট পাতা - আলগোছে পা ফেলে ফেলে মেয়েকে নিয়ে তরুণের বাড়ি যাচ্ছে সুহাসিনী, সঙ্গে দিবাকর। শাড়ি সামান্য উঠে গোড়ালি দেখা যাচ্ছিল সুহাসিনীর।
-' মহালয়ার আর দশ দিন বাকি, তাই না? ' দিবাকর হাল্কা গলায় বলছিল।
'অচেনা মানুষের পুরোনো ছবি দেখলে মা কে খুব মনে পড়ে জানেন? মনে হয়, মা সম্ভবত চিনত। এই যে আপনার অ্যালবামের হলদে হয়ে যাওয়া ছবিতে চশমা পরা যুবক, পাশে বালিকা হাসছে- আমি তো জানি না এঁরা কারা- এঁরা কে, মানে আপনার কে হ'ন- কিন্তু এই যে কাটা ঘুড়ি, ভাঙা পাঁচিল, দূরে নদীর আভাস- কী রকম মনে হয় জানেন এই যুবক, এই বালিকা যেন অনাদিকাল ঐ খানে দাঁড়িয়ে - আমার মা র সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে গেছে এই এত বছরে কোন না কোন সময়-'
সুহাসিনী সামনের টেবিলে চা রেখে বলেছিল- 'আপনিও লেখেন?'
শান্তিলতা অ্যালবাম ওল্টাচ্ছিল আর সুহাসিনী দেখছিল শান্তিলতাকে- ওরই বয়সী সম্ভবতঃ। টিপ, চশমা, বিনুনী থেকে একটা হরিণের অবয়ব স্পষ্ট হচ্ছিল সেদিনের মত।
রবিবার যখন ওরা তরুণের বাইরের ঘরে, লেখক এই এসে পড়লেন বলে, তরুণের মা চা এর জল চাপাতে ব্যস্ত, দিবাকর তুমুল উত্তেজিত- কথা বলছে তরুণের বাবার সঙ্গে- 'দেশ এর কার্টুনের পাতাটা ছেঁড়া এসেছে, দেখেছেন?' আর, তরুণের ঘরদোর দেখছে সুহাসিনী - বেতের সোফায় কুশন, মোড়া, জানলা দরজার পর্দা, বইয়ের আলমারি, দেওয়ালে বি প্রভার পেন্টিং। আসলে, লেখককে প্রথম দেখার মুহূর্ত কেমন হবে আন্দাজ করতে চাইছিল সুহাসিনী; সাহিত্য সংখ্যায় লেখকের ছবি দেখেছে আগে; এখানে আসবার আগে পাতা উল্টে দেখে নিয়েছে আবার- চশমা, কাঁচাপাকা চুল, মুখে সিগ্রেট- উনি এসে কোন সোফাটায় বসবেন, জানলার পর্দা সরিয়ে সিগ্রেট ধরাবেন, না বই দেখবেন আলমারি খুলে? অস্বস্তি হচ্ছিল সামান্য- কী কথা বলবে সে? অটোগ্রাফ নেবে? নমস্কার করবে না পা ছুঁয়ে প্রণাম? একবার মনে হ'ল না এলেই হত, আবার লেখকের স্ত্রীকে দেখার জন্য আশ্চর্য ব্যাকুলতা বোধ করছিল হঠাৎ - কেমন হয় লেখকের বৌ?
দরজার বেল বেজেছিল একটু পরেই । পর্দার তলার ফাঁকটুকু দিয়ে সদর দেখা যায় না; নারীকণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল- 'নমস্কার, আমি শান্তি। শান্তিলতা।' কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল বসার ঘরের দিকে- 'আপনাদের পাড়া আমাদের আগের পাড়ার তুলনায় কত আলাদা! জানেন, ঐ মোড়ের মাথায় যেখানে অনেক দোকান টোকান - মিষ্টি কিনতে গেলাম একটু আগে- দেখি একটা কুকুরছানাকে খাওয়াচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে- বিস্কুট টিস্কুট দিচ্ছে আর হাত নেড়ে কুকুরছানার গায়ের মাছি তাড়াচ্ছে - আমরা যেমন অতিথির খাওয়ার সময় করি আর কি- খেতে খেতে কুকুরটা তাকালো আর ছেলেটা বলল, আগে তুই খা! উনি কী বলবেন জানি না- কিন্তু এও তো এক গল্প, বলুন?'
লেখকের গলা পাওয়া যাচ্ছিল - শান্তিলতা আর লেখকের কথারা বারান্দা পেরিয়ে এ ঘরে ঢুকছিল; প্রথমে মৌমাছির গুঞ্জনের মত মনে হচ্ছিল সুহাসিনীর তারপর রিনরিনে একটা ধ্বনি- ঘরের দেওয়াল, দরজা জানলার পর্দা, বারান্দার রেলিং সামান্য কাঁপছিল আর বদলে যাচ্ছিল লম্বা লম্বা গাছে; চুন সুর্কি ইঁট বালি সরিয়ে শিকড় নামছিল; বারান্দার মাথায় ঘন সবুজ পাতার চন্দ্রাতপ, আর সদর থেকে এ'ঘর অবধি একটা শুঁড়িপথ তৈরি হচ্ছিল যেন। তারপর কথারা মিলে মিশে একটা অবয়ব তৈরি করল কখন আর এঘরের পর্দা সরিয়ে দুটি হরিণকে ঢুকতে দেখল সুহাসিনী।
বস্তুত সুহাসিনীর বাল্যবন্ধু মীরা বহুবছর আমেরিকায় - দেশে এলে, সুহাসিনী, তৃপ্তি, চন্দ্রা , পূরবী আর ঝর্ণা ওর বাড়িতে একটা গোটা দিন কাটিয়ে আসে- খাওয়া দাওয়া, গান, গল্প, তুমুল হাসাহাসি; মীরা ছবি দেখায়- ওর ঘরদোর, বরফ, পাহাড়, নীল হ্রদ, কাঠের বাড়ি, লং কোট, কবলস্টোন রাস্তার পাশে কাফেটেরিয়া। একটা ছবি দেখিয়েছিল মীরা- বলেছিল, ওর ব্যাকইয়ার্ড- সুহাসিনী দেখেছিল ঘন সবুজ ঘাসে একটি দুটি হরিণ ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে- গৃহস্থের এত কাছে আসে হরিণ?
সস্ত্রীক লেখককে দেখে সুহাসিনীর মনে হয়েছিল - যেন এই সোফা, মোড়ার দিকে ক্যামেরা, আর সবুজ ঘাসে হরিণ এসে দাঁড়িয়েছে, পোজ দিয়েই হারিয়ে যাবে। বাস্তবিকই লেখকের তাড়া ছিল সেদিন- সাহিত্যসভায় যেতে হবে। চা খেয়েই বিকেলের রোদে বেরিয়ে গেল দুই হরিণ।
আজ বিকেলে শান্তিলতাকে গেটের বাইরে দেখে প্রথমে চমকে যায় সুহাসিনী। শান্তিলতা হেসে বলেছিল- 'পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছি, ফ্যাক্টরির মাঠ অবধি গিয়েছিলাম । অনেকখানি ফাঁকা জায়গা আপনাদের এদিকটায়।'
সুহাসিনী এর পর চা খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করায় শান্তিলতা রাজি হয়। রান্নাঘরে ঢোকার আগে শাশুড়ি আর পুপেকে শান্তিলতার কাছে বসিয়ে গিয়েছিল সে। চা আর পাঁপড় আনতে আনতে পুপে আর শাশুড়ি পুরোনো অ্যালবাম আর ড্রইং খাতা নিয়ে অতিথির সঙ্গে জমিয়ে গল্প শুরু করে দেয়।
চা শেষ করে শান্তিলতা অ্যালবাম নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল। যেন হঠাৎ মনে পড়েছে, এইরকমভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিল- 'এদিকটায় আকাশ কত পরিষ্কার - হাঁটতে হাঁটতে আকাশে উড়িছে বকপাঁতি গুনগুন করছিলাম- কী হল জানেন? যা হওয়ার নয় তাই, সত্যি বকপাঁতি দেখলাম ঠিক তক্ষুণি।'
হরিণ বলছিল, 'সব গল্পই কাগজে কলমে লিখতে হবে তার তো কোনো মানে নেই; এই যে গল্প খুঁজে পেলাম, আপনাকে বললাম; ওঁকেও বলব বাড়ি ফিরে। আপনাদের লেখক অবশ্য মানবেন না - উনি নানা লক্ষণ খুঁজবেন- পটভূমিকা, চরিত্র, গৌড়চন্দ্রিকা, উপসংহার- তারপর বলবেন, হয় নি, হয় নি ফেল।'
গেট খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল হরিণ।
দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছিল, শিউলির গন্ধ; সুহাসিনী উঠোনের দড়ি থেকে শুকনো জামাকাপড় তুলে ফেলছিল চটপট। তারপর গা ধুতে বাথরুমে ঢুকেছিল। লাল মেঝেয় অজস্র ফাটল। জলভরা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বালতির তলা দিয়ে ফাটল গুলো অনেক বড় লাগছিল- বালতি সরিয়ে নিলে যে কে সেই- সামান্য চিড়ও তখন চোখ কুঁচকে ঠাহর করতে হয়। সুহাসিনী ছেলেমানুষের মত এই খেলায় মেতে গিয়েছিল- বালতি বসাচ্ছিল, তুলে নিচ্ছিল আবার বসিয়ে দিচ্ছিল।
জানুয়ারির শেষের দিকে মফস্সলে শীতের কামড় বাড়ে । ভোরের কুয়াশায় পথঘাট শুনশান- পুপের গায়ে লেপ টেনে দিয়ে সুহাসিনী আর দিবাকর স্টেশনের দিকে রওনা হয়। হলদে সোয়েটার পরে লম্বা লম্বা পা ফেলে তরুণ এল ট্রেন ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে।
-'বৌদি, আজ নতুন কৃত্তিবাস আনব, আপনার কোনো বই আনতে হ'লে এক্ষুণি বলে ফেলুন। '
সুহাসিনী হেসে হাত নাড়তেই ট্রেন ঢুকেছিল। দিবাকর চেঁচিয়ে বলেছিল, 'চেতলা হয়ে ফিরব। রাত হবে।'
চেতলায় দিবাকরের পিসির বাড়ি। পঙ্গু পিসেমশাই। দু'বছর আগে বাবলু মারা যায়- পিঠ ফুঁড়ে পুলিসের গুলি ঢুকেছিল। প্রতিমাসেই দিবাকর একবার ঘুরে আসে - হরলিকস, ফল টল , টুকটাক বাজার-
বিকেল হওয়ার আগেই জানলা দরজা বন্ধ করে সুহাসিনী- মশা ঢুকে যায় নইলে। শাশুড়ি রেডিওর সামনে মালা জপতে বসলে সে নিজের বইপত্র খোলে - পরদিনের লেকচার, টুকটাক খাতা দেখা। পুপে মায়ের পাশ ঘেঁষে স্কুলের অঙ্ক কষে, ছবি আঁকে। বারান্দার ওপরে অ্যাসবেস্টসের চালে হিম পড়ে, বিড়াল ঘুরে বেড়ায়- আওয়াজ ওঠে খচমচ , টুপটাপ পাতা; ওদিকে ট্র্যান্জিস্টরে কৃষিকথা শেষ হয়ে খবর শুরু হয়ে গিয়েছিল।
-'বৌমা, শিগ্গির এসো। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের কথা কী বলল যেন - দিবা শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে না?'
সুহাসিনী দৌড়ে পাশের ঘরে এসে রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিলঃ
'আজ সন্ধ্যায় উল্টোডাঙা রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা আপ হাবড়া লোকালের সঙ্গে দার্জিলিং মেলের সংঘর্ষে...'
-'রাধামাধব একী করলে', শাশুড়ি চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই রেডিও বন্ধ করে দিয়েছিল সুহাসিনী। পুপেকে শাশুড়ির কাছে বসিয়ে স্টেশনের দিকে দৌড়েছিল তারপর। এই পথ দিয়ে সে কলেজ যায় রোজ সকালে। আজ রাতে সেই পথ অচেনা লাগছিল তার - নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে শুনতে সে দৌড়োচ্ছিল – অনভ্যাসে, দমে টান পড়ছিল। হোঁচট খাচ্ছিল বারবার।
রাতের স্টেশনে অনুজ্জ্বল আলোর ডুমের তলায় মশার পুঞ্জ, রেললাইনের ওপর দিয়ে কুয়াশা ঢুকছে হু হু করে; স্টেশনমাস্টার লেখা ঘরের সামনে মাফলার, আলোয়ান, চাদরের ঘোমটার তলায় মাথা আর মাথা। তরুণের বাবাকে দেখতে পেয়ে সুহাসিনী ডাকল, ' মেসোমশাই, তরুণ ফেরেনি?'
-'ফিরতে দেরি হবে বলেছিল। ক’টার ট্রেন ধরবে তাও জানি না। এখন তো ওদিক থেকে কোনো ট্রেনই আসবে না। এদের কাছে কোনো খবর নেই বলছে- কী করি ! দিবাকর কোন ট্রেনে ফেরে?'
সুহাসিনীর অস্থিরতা এত লোকের মাঝে এসে সামান্য কমেছিল - সে হাত বাড়িয়ে তরুণের বাবাকে ডেকে নিয়েছিল-' বাড়ি চলুন মেসোমশাই। অপেক্ষা করি। বাস যদি না পায়, যদি হেঁটে ফেরে , দেরি তো হবেই; টর্চ এনেছেন? '
মাথার ওপর ঘন কালো আকাশে মিটমিটে কালপুরুষ, এবড়ো খেবড়ো রাস্তা ঘিরে কুয়াশা; তরুণের বাবার টর্চের আলোয় তারা বাড়ি ফিরছিল নিঃশব্দে-সামনে কুয়াশা পেরিয়ে যেন অন্য এক জীবন অপেক্ষা করছে । দুজনেই সে জীবন অস্বীকার করতে চাইছিল প্রাণপণ, ঠোঁট টিপে কান্না আটকাচ্ছিল, চাদর জড়িয়ে নিচ্ছিল ঘন করে।
শেষ রাতে একলা দিবাকর বাড়ি ফিরেছিল।
একটা নিথর মথকে সযত্নে বাঁচিয়ে জানলা খুলছিল সুহাসিনী। রোদ পড়ছে মথের ডানায়; যদি বেঁচে ওঠে - মুহূর্তের জন্য ভেবেছিল সে। শাশুড়ি ঘরে রেডিও চলছে- আমার রাখতে যদি আপন ঘরে শোনা যাচ্ছিল। দিবাকর খুব সকালেই বাজারে - বেলা বাড়লে মাংসের দোকানে বড় ভিড় হয়ে যায়। ব্রাশ করতে করতে পাঁচিলের ওপর বেড়াল দেখছে পুপে। রোব্বারের রোদ থই থই করছিল বারান্দায়।
দিবাকর বাজারের ব্যাগ নামিয়ে বলল- 'আজ ওঁরা ফিরে যাচ্ছেন - টেম্পো দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। একবার ঘুরে এলে হয়-'
বাস্তবিকই তরুণদের বাড়ির সামনেটায় গাড়ি, টেম্পোতে জিনিসপত্র উঠছে। সামান্য ভিড়। তরুণের চলে যাওয়ার দিনের মত মনে হচ্ছিল সুহাসিনীর; তরুণদের বাড়ির দিকে সে তাকাল বার কয়েক- জানলা দরজা বন্ধ ; চকিতে মনে হ'ল, হলুদ সোয়েটার পরা তরুণ বারান্দা থেকে হাত নেড়ে গেল একবার-
টেম্পোতে মালপত্র উঠে গিয়েছিল- বেতের চেয়ার, হাল্কা টেবিল, বই এর পেটি, আলমারি একটা। লেখককে ভিড়ের দিকে হাত তুলে নমস্কার করতে দেখা গেল।
শান্তিলতা দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এসে একবার পিছনে তাকাল তারপর তরুণদের বাড়ির দিকে। সুহাসিনী এগিয়ে এলে, 'আসি ' বলে হাত ধরল ওর। গাড়িতে উঠতে গিয়ে ঘাড় ঘোরালো একবার; তারপর একটু থেমে বলেছিল, 'স্মৃতিতে ক'দিন বাঁচে মানুষ? গল্পে বাঁচে। জানেন, যেদিন এ'পাড়ায় এলাম, তিন দিন পরে পূর্ণিমা- আমাদের আগের ফ্ল্যাটের জানলায় গ্রিল ছিল, এখানে গরাদ - হঠাৎ ঘুম ভেঙে ...চাঁদের আলো মেঝেয় পড়ে সাদা কালো ডোরাকাটা ডিজাইন হয়েছিল একটা- আমি তো ভুলে গেছি নতুন বাসায় আছি; ভাবছি সাদা অংশ জ্যোত্স্নার , কালো ডোরাটা কোত্থেকে এল- ক্ষণিকের বিভ্রম; গল্পটা কিন্তু রয়ে গেল, সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি আজ।'
সুহাসিনী একটু আগেই একটা কাক দেখছিল; তখন বিকেলের আকাশে কালো মেঘ - যেন বৃষ্টি আসবে; সুহাসিনী একটা গাড়ির মধ্যে আর একটা কাক ধুধু পার্কিং লটে একা একা নেচে চলেছে আপনমনে। কাকটা অদ্ভুত- গায়ে কোনো পালকই নেই যেন কাগজের বাক্স কেটে কালো রং করে বানিয়েছে স্কুলের বাচ্চারা; গাড়ি স্টার্ট নিয়েছিল আচমকা, কাক আওয়াজ পেয়ে তাকালো, এগিয়ে এলো তারপর গাড়ির জানলা বরাবর তীব্র গতিতে উড়ান দিল- গাড়ি যেন ডাক করল চমৎকার- হুশ করে বেরিয়ে গেল। কাকটা আপনমনে ভেসে রইল কিছুক্ষণ তারপর আবার নেমে পড়ল নাচ প্র্যাকটিসে - গাড়ি থেকে মাথা ঘুরিয়ে এইটুকুই দেখা গিয়েছিল। শহর থেকে বেরিয়ে এলে আশ্চর্য সব দৃশ্য দেখা যেতে থাকে। সুহাসিনী ইদানিং রোজই বেরোচ্ছে। দিবাকর গাড়িতে তুলে দিয়ে যায়। স্টিয়ারিঙ্গে তরুণ। কোনোদিন সমুদ্রের দিকে, কোনোদিন পাহাড়।
সুহাসিনী জানে, এই কারপার্ক পেরিয়ে ডান দিকে মোড় নিলে একটা কাফেটেরিয়া তারপর লম্বা লালচে রাস্তা। একটেরে । অনেকখানি নামতে হবে তারপর উঠলেই পাহাড়ের মাথায় বরফ।
অথচ সুহাসিনীর বাথরুমে যেতে হবে এখন । ক্যাফেটেরিয়ার পাশে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে বাথরুমে ঢুকল সুহাসিনী। ফ্যাটফেটে সাদা টাইলস, নীল আলো, গোলাপী সাবান, কলের তলায় হাত পাতলেই জল - সুহাসিনী কমোডে বসে পড়ল । কী আরাম আঃ ! বাথরুমের ঘুলঘুলি দিয়ে দেখল আকাশের রং হালকা হয়ে এসেছে - কাক উড়ে গেল দুটো।
একটা উড়ে যাওয়া কাকের অবয়ব চিনে নিতে ব্যাকড্রপে রঙের যে শেড দরকার, আকাশের রঙ এখনও তার চেয়ে অন্তত দু পোঁচ গাঢ় -এই সময় রোজ দিদার ডায়াপার বদলাতে হয়। আজ বদলাতে গিয়ে দেখি দিদা খুব হাসছে...
এ' ঘরে এসে ল্যাপটপ অন করে লিখতে বসব; স্ক্রীনসেভার বদলাচ্ছিল আবার- ঘন বনে গাছ আর গাছ। একটা হরিণ- গায়ে চন্দনের মত ফোঁটা- ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে-
পর্দার বাইরে রোদ, একটা গাড়ি মোড় ঘুরল- সূর্যের আলো তার উইন্ডস্ক্রীনে এক ঝলক পড়তেই কয়েক সেকন্ডের ফ্ল্যাশ জ্বলল দিদার চোখে। আমার চোখে। এইটুকু ইন্সপিরেশনের দরকার ছিল আমার- শেষ করে দিলাম লেখা।
গল্প না হয়ে এটা একটা উপন্যাস হতে পারত। জানি। থাক। সব কিছুই যে হরফে ধরতে হবে তার তো কোন মানে নেই।
খুব ভালো লাগলো। ইমোশনরাও এই লেখায় ভিজুয়াল হয়ে ওঠে। প্রথম প্যারাগ্রাফ থেকেই মনটাকে পুরোপুরি টেনে নিয়েছে লেখাটা। আর লাস্ট লাইনটা তো অসাধারণ! সত্যি বলতে কি প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শেষ লাইনই খুব ভালো লেগেছে। খুব উঁচুমানের লেখা, ইন্দ্রানীদি।
ইপ্সিতার ছবির জন্যও অনেক প্রশংসা রইলো।
ইন্দ্রাণী দি'র এই লেখাটাও - হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল, কিছুটা পরিচয় করাল আর তারপর ম্যাজিক শুরু করে দিল.....
পড়ার শেষে দেখি ফিরতে অসুবিধা, এদিকে ওদিকে ঠোক্কর...
একদিন গল্পের ভেতরেই থেকে যাব ভাবি....
ইন্দ্রাণী ছবি লেখে। জলরঙ তেলরঙ প্যাস্টেল --কোলাজ।
এই গল্পটার জন্য অপেক্ষা ছিল। লেখকের প্রত্যেকটা গল্পই পাঠককে যেন আর একটু একা করে দিয়ে যায়।
প্রতিবারের মতোই এবারও আশাহত হলাম না. টুকরো ছবির কোলাজ ছোট গল্পের রেশ টেনে যায় -হরিনের কাছে
অলৌকিক . এই গল্পের মধ্যে করিব বাস দীর্ঘ দিবস , দীর্ঘ রজনী .
পড়ে মনে হচ্ছে , কনশাশলি , তথাকথিত পোয়েটিক ট্রিটমেন্ট থেকে সরে এসে লেখা হয়েছে। গল্প বলার গল্প , শুদ্ধ গল্পের রাস্তাতেই। চ্যালেঞ্জিং :)
হুঁ কনশাসলি ত বটেই।
একটু দেরীতে পড়লাম। ইন্দ্রাণীর গল্প নিয়ে ত নতুন করে কিছু বলার নেই, কিন্তু সাথের ছবিটাও দুর্দান্ত। লেখা আর ছবি মিলিয়ে বেশ থমকে দেওয়া।
এই লেখাগুলোর সাথে ছবির যুগলবন্দী দারুণ হচ্ছে এবারের লেখাগুলোয়।
মর্মোদ্ধার করার জন্য প্রতিবারের মতো এবারেও একাধিক বার পড়তে হল এবং ভেসে গেলাম কল্পনার জগতে । পরের রচনার অপেক্ষায় রইলাম।
ছোটাইদির গল্প, একেবারেই অন্য রকমের গল্প - এবারেও তাই।
সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে
মোড় ঘুরছে।
গল্প, দৃশ্য ও শব্দের গোনাগাঁথা স্মৃতি। জাতকের হরিণের মতো। শব্দের ক্যানভাস ছিঁড়ে উঠে আসছে গল্পের সিঁড়ি। পরিচিত ইন্দ্রাণী...
পাঠককে নমস্কার। এত পাঠপ্রতিক্রিয়া আশাই করি নি-
একক, দ ঠিকই ধরেছেন।
সচেতনভাবেই।
ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা সবাইকে। আশ্চর্য ছবির জন্য ঈপ্সিতাকে আলাদা করে ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগল লেখা। গল্প লেখার মুন্সীয়ানা মনে দাগ কেটে যায় বার বার ই
এটা একটা অসামান্য লেখা। ছোটাইদির অন্য লেখার থেকে ভিন্ন। কেন জানিনা জায়গায় জায়গায় বিমল কর মনে করাল ("হাল্কা গলায় জিগেস করল"), কোথাও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সচেতনভাবে নয় যদিও। ছোটাইদির ভাষা কি বদলাচ্ছে? সচেতনভাবে?
সুকি,
ধন্যবাদ।
সম্বিৎ,
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ইদানিং খুব পড়ছিলাম - হয়ত লেখার মধ্যে এসে গেছেন তাই; আমি বুঝতে পারি নি । তবে বিমল করকে অত্যন্ত সচেতনভাবে এনেছি , আপনি ঠিক ধরেছেন। বস্তুত বিমল কর এই গল্পে আগাগোড়া জড়িয়ে; সব টুকু খুলে বলব না।
আপাতত এটুকু বলিঃ
বিমল করের জন্ম সেপ্টেমবর ১৯, ২০২১। অর্থাৎ আগামী শরতে ১০০ বছর হবে। ঈপ্সিতা আমাকে অনেকদিন ধরেই লিখতে বলেছিলেন বিমল করকে নিয়ে । প্রবন্ধ লিখতে আমার ভাল লাগে না। এই গল্পটা আমার তরফে বিমল করকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আর ভাষা বদলাচ্ছে কীনা তা এখনই বলার সময় সম্ভবত আসে নি।
প্রতিবছরই গুরুর জন্য শরতকালে পুরোনো কলম ধুয়ে নিয়ে লিখতে বসি। এবারেও তাই। আমার তরফে এইটুকুই বলা যায়।
অনেক ধন্যবাদ।
ভুল টাইপ করেছি।
বিমল করের জন্ম সেপ্টেম্বর ১৯, ১৯২১।
আমি না ৫ নং-এর সুহাসিনী অংশটা বুঝতে পারিনি ; সে কোথায় - মফস্বল না বিদেশী শহরে , স্টিয়ারিং-এ তরুণ মানে কী , বাথরুম দৃশ্যটা কেন ইত্যাদি।
সি এস,
সম্ভবত আমারই অপারগতা।
বুঝিয়ে লিখলাম না।
এটাকে গল্প না হয়ে একটা বড় কবিতা বলে মনে হলো আমার। ঝরঝরে সরল ভাষা। গড়গড় করে পড়লাম কিন্তু তাও বুুঝতে পারলাম না বুঝতে পারলামনা সেটাই বুঝতে পারছিনা। ধোঁয়াশাছন্ন থেকে গেল।
ব্যক্তিগত বিচারে এই সংখ্যার সেরা গল্প এটা। কী ভাষা ! রহস্যময় দার্ঢ্য ইশারা বটে ! একঘর লেখা
লিখি লিখি করে আর কিছুতেই লেখা হচ্ছিলো না। ঐ করে করে বেশ দেরি হয়ে গেলো।
আসলে এইবারের গল্পটা বেশ আলাদা। গল্পের মধ্যে গল্প লুকিয়ে। আর এইবারেই মনে হচ্ছিলো একটু একটু করে লেখককে অনুসরণ করতে পারছি।
শুরুতেই বলে দেওয়া আছে লেখক দিদার মগজের মধ্যে ঢুকে একটা গল্প পড়তে চাইছেন। হয়ত সেই গল্পের বীজ বোনা আছে অনেক ছোটবেলায় স্মৃতির অতলে দিদার মুখ থেকে শোনা টুকরো টাকরা গল্পে, অপ্রাসংগিক কোন বয়ানে, এদিক ওদিক থেকে খাবলা খাবলা মন্তাজ। লেখক সেইগুলোকেই একটা সুতোয় বুনতে চাইছেন, সেখানে ফিল-ইন-দা-ব্ল্যাংক জায়গা গুলোতে কল্পনার প্যাস্টেল রঙ লাগবেই।
তাই এই লেখার ন্যারেটিভ চোখ ভাসিয়ে দিয়ে দ্যাখার মত, প্রচুর প্রচুর ডিটেল, সিনেমার মত। বস্তুতঃ প্রতিটি সীনই আমি যেন নিজের চোখেই দেখে নিচ্ছিলাম, কানে শুনছিলাম ঢাকের শব্দ, খরখরে ইথার তরঙ্গে ভেসে আসছিল কলকাতা ক, কৃষিকথা, সমীক্ষা, নাকে আসছিল শিউলির আর নিমফুলের মৃদু গন্ধ। ঐ জায়গাটা যেখানে চুন সুর্কি ইঁট বালি সরিয়ে শিকড় নামছিল সেটাও যেন এসএফএক্সে দেখে ফেললাম।
কিন্তু গল্পে ঘুরে ঘুরে আসছিল বালতির তলার চিড়ের দাগগুলো। লেখকের স্ত্রীর একেকটা গল্প খুঁজে পাবার গল্প। কে বলতে পারে সেগুলোও একেকটা গল্প তৈরি করছে কিনা অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।
লেখক শুধু এই মনে হওয়াটাই ভাগ করে নিচ্ছেন, একটা সুতো নিয়ে এগিয়ে গেলে জানা নেই সে কোনদিকে গড়িয়ে যাবে, সেইটুকু শুধু পাঠকের ওপরে ছেড়ে লেখক এগিয়ে যাচ্ছেন, কেউ নতুন গল্প খুঁজে নেবে, কেউ নেবে না।
সুহাসিনীর কল্পনায় বিদেশের টয়লেট হয়তঃ এসেছে তার বন্ধু মীরার থেকে শোনা বা দেখা কোন ছবি থেকে। আবার ঐ কাক উড়ে যাওয়া আর তার পরের প্যারাতেই অন্ধকারের গাঢ়ত্বের বিবরণে কল্পনা থেকে বাস্তব (আরেক কল্পনা?) সরে আসা, ফোকাস চেঞ্জ এগুলো লেখার ফ্লেভার হিসেবে খুবই সেভর করেছি।
বরং বিমল কর প্রসঙ্গ ধরতে পারিনি। হয়ত সেরকম ভাবে পড়িনি বলেই। আনন্দমেলায় কিছু কিকিরা পড়ে ছোটবেলাতেই খুব খারাপ লেগেছিল বলে আর পরে পড়িনি। এই ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে ভালো লাগবে।
পাঠককে নমস্কার আবারও।
অশেষ ধন্যবাদ।
শঙ্খ,
এ লেখায় বিমল করের পাঠকের কাছে না আসারই কথা। ভাষার ব্যবহার কিছু আছে যা পাঠকের নজরে পড়তে পারে- যেমন সম্বিত খেয়াল করেছেন।
বিমল করের ছোটো গল্প সংগ্রহ, অসময়, ভুবনেশ্বরী, খড়কুটো, দেওয়াল, পূর্ণ অপূর্ণ তোমার পাওনা হ'ল।
বুঝলাম না দিদি