মঙ্গলবার, ৪ অগাস্ট, সন্ধেবেলা যখন প্রথম মৈনাকদার (মৈনাক বিশ্বাস) দেয়ালে মানববাবুর কথা দেখলাম, ভীষণ একটা ধাক্কা যেমন লাগল পাশাপাশি মনে হল একটা যুগের বুঝি অবসান হল। নীলুদার (নীলাঞ্জন হাজরা) সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঝড়ের মতো একটার পর একটা শট যেন আমার চোখের সামনে দিয়ে হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর আমি ডুবে যাচ্ছি সেই ২৫ বছর আগের খাদবপুরের দিনগুলোতে। খাদবপুর কেন বললাম তা বলছি একটু পরে।
তখন আমি সবে মাধ্যমিক, কিন্তু বাংলা আকাডেমিতে দিব্য যাতায়াত, লাইব্রেরির থেকে Esperanto-র ওপর একটা বই নিয়ে বাবার ঘরে বসে বসে পড়ছি। বাবার সঙ্গে তখন একজন ঝকঝকে মানুষ তরতর করে অনেক গল্প করছেন, আমি কিছু শুনছি, কিছু বইতে মন। যাই হোক, একটা ছটফটে বাচ্চা মেয়েকে এস্পেরান্তো পড়তে দেখে তাঁর আমাকে খুব মজাদার লেগেছিল, সেদিনই প্রথম তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্প্যানিশরা J কে খ বলে, আর উনি তার মানে খাদবপুরের অধ্যাপক!
সেইদিন আমি বুঝিনি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি যাঁর অনেক অনুবাদ আমার ইতিমধ্যে পড়া হয়ে গেছে, বাড়িতে তাঁর তরজমা করা অনেক বই। এরপর আবারও তাঁর সঙ্গে একদিন সেই একই ঘরে বাংলা আকাদেমিতে দেখা, বাবা আর উনি গল্প করছেন, আমি একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। গল্পটা হচ্ছিল, উনি আমেরিকা গেছিলেন কদিন আগে, সেখানে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বেড়ালের খাবারের পাশাপাশি বই বিক্রি হচ্ছে। উনি বিশ্লেষণ করছেন, এইভাবেই তো ক্রেতার নাগালে বইকে পৌঁছে দিতে হবে। আমার কাছে সেইসময় ব্যাপারটা একটু ভাসাভাসা লাগলেও বুঝলাম তার মানে খুব ভালো একটা পলিসি এভাবে বই কিনতে পারা।
তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী, মনে পড়ছে তখন ইউজি-থ্রি, পরীক্ষা চলছে, কদিন আগেই বাবার বিশাল অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে, মন দিয়ে লিখছি। পিছন থেকে মানববাবুর গলা, “অবন্তী বাবা এখন কেমন আছেন?” মনটা ভরে গিয়েছিল। ভালো তো ওনাকে লাগতই ভীষণ এবার থেকে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।
রামকৃষ্ণ মিশনে স্প্যানিশ পড়ছি, দিব্যজ্যোতিদার (দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায়) কাছে লাতিন আমেরিকার তাজা খবর শুনছি, স্প্যানিশ অন্তপ্রাণ আমি মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছি কবে আমি কবিতা অনুবাদ করব? আমি জানি মানববাবু হলেন একমাত্র মানুষ যিনি খবর রাখেন এখনকার লাতিন আমেরিকান লেখকদের। অপেক্ষা কবে মানববাবুর দেখা পাব, অনেক অনেক প্রশ্ন করার আছে। কার লেখা, কোন্ বই পড়ব, কোথা থেকে পাব? উনি বললেন নিকানোর পাররা... এরকমই চলছিল।
আমার দাদাকে (অলখ মুখোপাধ্যায়) আমার থেকেও বেশি স্নেহ করতেন, দাদার কাছেই শুনেছিলাম মার্কেজ-এর সঙ্গে ওনার দেখা হয়েছিল, আর মার্কেজই বলেছিলেন খাদবপুর। আমি চলে এলাম এদেশে, স্প্যানিশের মায়া ছাড়তে পারিনি, আবার শুরু করলাম স্টেজ ফোর স্প্যানিশ পড়া, এখানকার ইউনিভার্সিটিতে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পিএইচডি শুরু করার কথা ভাবা, আর এইসবের পিছনে ওই ঝকঝকে মানুষটির প্রবল সমর্থন ছিল।
আমার কাছে মানববাবু ছিলেন যেন একটি সেতু। শুধু স্প্যানিশ সাহিত্য নয়, পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ মানববাবুর হাত ধরেই। বলকান দেশগুলোর যে নিজস্ব চরিত্র তা তিনি খুব ভালো করে বোঝাতেন। তিনি বলতেন, সাহিত্য যেমন একটি মানুষের কথা, তেমনই সাহিত্য সেই মানুষটির সমাজের কথাও। তাই সেই সমাজটিকে না চিনলে কী করে চেনা যাবে তাঁর রচনা? মনে পড়ে যায়, বাংলা আকাদেমিতে একদিন পবিত্র সরকার, যিনি আমাকে ছোটো থেকে চিনতেন বলে পবিত্রকাকু বলে ডাকি, আলোচনা করছিলেন বাংলা ভাষার লোনওয়ার্ড নিয়ে। তখন বাংলা আকাদেমি থেকে বিদ্যাৰ্থী অভিধান প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। বাবা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত। সেই প্রসঙ্গেই পবিত্রকাকু আর বাবার আলোচনার মধ্যে ঘরে ঢুকলেন মানববাবু। তিনি তখন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, কীভাবে বলকান দেশগুলোতে ছোটো ছোটো কত ভাষা গোষ্ঠী রয়েছে। তারা একে অপরের থেকে শব্দ ধার করে। সেই শব্দের অর্থ কেমন করে বদলে যায়। এই দেশগুলোর সীমানা তখন বারবার বদলে যাচ্ছিল। এই সীমানা বদলের, পরিচয় বদলের প্রভাব পড়ছিল সমাজে। পরে দাদা যখন তার একটি নাটক ‘মেডেল’–এ এই ক্যায়োটিক স্পেসটা ধরার চেষ্টা করেছিল, তাকে ভাষায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, মানববাবু খুব খুশি হয়েছিলেন। মানববাবুর বক্তব্য ছিল, আধুনিক মানুষের মনে চিন্তার যে ক্যায়োটিক স্পেস থাকে, তার সঙ্গে তার ভাষার প্রত্যক্ষ মিলটা প্রকাশিত হওয়া জরুরি। মানববাবু অ্যাসথেটিক্সের এই যে রূপটা তুলে ধরতেন, তাঁর পড়ানোয়, তাঁর আলোচনায়, তাতে গর্ব হয় যে, এমন একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম।
মনে পড়ে যায়, ফেলুদার গল্পে সিধুজ্যাঠা যে মনের দরজা-জানলা খুলে রাখার কথা বলেছিলেন, তা যেন মানববাবুর সঙ্গেই মিলে যায়। অথচ, এমনিতে কথা কম বলতেন। অনেক সময় দেখেছি, কত লোক কথা বলছে, মানববাবু চুপ করে বসে। কিন্তু তাঁকে বলতে বললে, কী সুন্দরভাবে সিঁড়ির মতো করে লজিক সাজিয়ে নিজের মননে উপনীত হতেন। ক্যায়োটিক স্পেস থেকে এই লজিক্যাল উত্তরণের ধরনটাও তাঁর কাছ থেকে শিক্ষণীয় ছিল। পিজিতে উনি অনেক ক্লাস নিয়েছিলেন, ওনার প্রত্যয়, ওনার দৃঢ় মতামত, ওনার রসবোধ, ওনার মুখ টিপে হাসি এ সবই বিখ্যাত, কিন্তু এ সবের ওপরে আমাকে যেটা সব থেকে বেশি মুগ্ধ করত, তা হলো পড়াতে পড়াতে ওঁকে কোনও দিন নোট্স দেখতে হত না। পড়াতেন ছাত্র-ছাত্রীদের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে। কথাগুলো মর্মে ঢুকে যেত।