১. আমাদের ছাত্রবয়সে ‘কাব্যনাট্য’ আর ‘নাট্যকাব্য’ নিয়ে পাতার পর পাতা আহাম্মকি উত্তর লিখতে হত। প্রমাণ করতে হত রচনায় কোন্ শব্দে বেশি জোর! মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সেই দুর্নিবার নির্বুদ্ধিতায় ঢুকব না। তিনি কবি অনুবাদক নাকি অনুবাদক কবি?
তবে তরজমার সঙ্গে মৌলিক কাব্যচর্চার একটা সূক্ষ্ম বহু কৌণিকতা আছে। মানবেন্দ্রকে মনে রেখেই তরজমা শব্দটি ব্যবহার করলাম। তিনি বিশ্বাস করতেন, অনুবাদ শব্দটিতে আছে ‘বাদ’ আর তরজমায় ‘জমা’। সুতরাং, তিনি ‘তরজমা’-কেই বেশি আদরের মনে করেন।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যরচনার সঙ্গে এই জমাখরচের হিসাব রাখাটা বেশ জরুরি হয়ে পড়ে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাঁর মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি কিন্তু অনূদিত কাব্যগ্রন্থ প্রায় ত্রিশটি। যদিও এর বাইরেও বহু কবিতা অনুবাদ গ্রন্থিত হয়নি। এই অসম বণ্টন কি কোনো ইশারা দেয়? নাকি তাঁর অদম্য এক পরিকল্পনাকেই প্রকাশ করে?
২. মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাগুরু বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি ঠিক উলটো। অনূদিত কাব্যগ্রন্থ সংখ্যা তুলনায় অনেক কম। একই কথা প্রযোজ্য বিষ্ণু দে কিংবা সুধীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। পরবর্তীকালে শঙ্খ ঘোষ অথবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। বুদ্ধদেব বসু অকপটে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, যখন কবিতা লেখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, তখন তিনি অনুবাদে মন দেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও প্রায় একই ধরনের প্রণোদনায় বিশ্বাসী ছিলেন। একে আমরা একটি বিশেষ প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
দ্বিতীয় প্রবণতা লক্ষ করা যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রে। সেখানে অনুবাদ এবং মৌলিক কাব্যরচনা চলে সমান্তরাল পথে। কেউ কারও বিকল্প নয়। একই প্রবণতা হয়তো দেখা যাবে অরূণ মিত্র, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং পুষ্কর দাশগুপ্তের ক্ষেত্রেও। একই কথা বলা চলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং নবারূণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রেও।
কবিতা অনুবাদকের মধ্যে আবার কেউ কেউ মৌলিক কবিতার ধারকাছ মাড়ান না। যেমন চিন্ময় গুহ। পলাশ ভদ্রেরও কবিতা খুব চোখে পড়েনি।
মধুসূদন এবং রবীন্দ্রনাথকে আলোচনার বাইরে রাখছি, যদিও এঁরা দ্বিতীয় দলেই পড়বেন।
বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে দুই বিরোধী নন্দনশিবিরের সদস্য হলেও অনুবাদের সঙ্গে মৌলিক কবিতার সম্পর্কের নিরিখে বেশ খানিকটা সামীপ্য আছে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর অনুবাদের ক্ষেত্রে বিশেষত বোদলেয়র আর রিলকের মাধ্যমে আলোড়িত হন। সেই চিহ্ন স্পষ্টভাবে দেখা যেতে থাকে তাঁর ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ কাব্যপর্বে এবং পরবর্তীকালে। অন্যদিকে, বিষ্ণু দে প্রথম পর্বে বহুলাংশে গভীর ভাবে এলিয়ট এবং পরবর্তী কালে এলুয়ার, আরাগঁ এবং নেরুদার দ্বারা প্রভাবিত হন। কে জানে, প্রত্যক্ষ প্রভাবের চিহ্ন এবং কৃতজ্ঞতাবশতই হয়তো শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম দেন, ‘র্যাঁবো ভের্লেন এবং নিজস্ব’!
৩. মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্য, আমার অন্তত মনে হয়, একটু অন্যরকম। তরজমাকারীকে আমার নদী পারাপারের বড়ো মাঝি মনে হয়। অনবরত দুই ভাষানদী পারাপারের অভিজ্ঞতা প্রকৃতপক্ষে লেখকের ‘আত্ম’-কে লুপ্ত করারই অনুশীলন। মানববাবু সেকথা বুঝতেন। এই ‘মিডিয়াম’ হিসেবে কাজ করতে করতে কণ্ঠস্বর বদলে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেটা মানববাবুর সম্ভবত অভিপ্রেত ছিল না। তিনি সর্বদা চাইতেন ‘নিজস্ব’ কণ্ঠস্বর নিয়ে কবিতায় ফিরে আসতে। হয়তো সেই জন্যই এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতেন, প্রস্তুতি নিতেন। লক্ষ করুন, ‘অর্ধেক শিকারী’ (রচনা ১৩৬৩-১৩৭০। প্রকাশ ১৩৮২), ‘বাঁচাকাহিনী’ (রচনা ১৩৭১-১৩৮১। প্রকাশ ১৩৮৩), ‘সাপলুডো অথবা ঘরবাড়ি’ (রচনা ১৩৮৫-১৩৯৫। প্রকাশ ১৪০৬), ‘এই সময় শনির’ (রচনা ১৩৬৩-১৪০৭। প্রকাশ ২০০৩)—এরকম মানচিত্র প্রমাণ করে তিনি কত দূর নিভৃত অথচ সচেতন কিমিয়াবিদ্যার উপাসক ছিলেন। সারা বিশ্বের অনবদ্য এবং অতি-শক্তিশালী কবিদের কণ্ঠে তিনি যেসব মহাকবিতা উপহার দিয়েছেন পাঠককে তার ব্যাপ্তি এবং আয়তন বিস্ময়কর। তিনি সন্তর্পণে নিজের কবিতায় তাঁদের প্রতিধ্বনি করতে চাননি। একটু লক্ষ করলেই দ্যাখা যাবে, তাঁর পুনরাবৃত্ত কাব্যবিষয় নিজস্ব জীবনযাপন, আর চারপাশের বহুতরঙ্গিত জনদুনিয়া। তারই নানা মিহি-মোটা প্রসঙ্গকে শ্লেষ, রসিকতা আর অন্তর্দৃষ্টিতে ধরতে চেয়েছেন তিনি। ভাষার নানান পরীক্ষানিরীক্ষা, সংরূপের বিভিন্ন প্রয়োগ সেখানে লক্ষণীয়। আরও মন দিয়ে দেখলে মনে হয়, অনুবাদের ক্ষেত্রে যেসব ভাষাবিন্যাসে তিনি প্রদীপ্ত তার সঙ্গে এইসব পরীক্ষানিরীক্ষার বহু পার্থক্যও রয়েছে। তিনি ধারালো, কিন্তু ধারদেনা করে শান দেননি।
৪. সমস্যা হল, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরজমার পাঠক সীমিত হলেও সংখ্যাটি নিতান্ত অল্প নয়। অথচ, তাঁর নিজস্ব কাব্যগ্রন্থগুলির পাঠকের সংখ্যা একেবারেই হাতে-গোনা। ফলে, যে গুরুত্বে তাঁর পর্যালোচনা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। লেখার মধ্যে এখান-ওখান থেকে দু-চারটি উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর পূর্বাপর প্রবণতাগুলিকে ধরা অসম্ভব। তিনি চলে গেছেন। তাঁর পাঠকবর্গ কি অন্তত দে’জ থেকে প্রকাশিত ‘মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাসংগ্রহ’ (২০০৪) বইটি আগাগোড়া পড়ে দেখতে চাইবেন? হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে তর্পণের প্রকৃত পবিত্র পন্থা।
পড়লাম। ভাল লাগল